» » পাঁচ

বর্ণাকার

নৌকাটা ঘাটে বেঁধে রেখে একগাদা কাদা ডিঙিয়ে পাড়ে উঠে আসে ওরা। মন্তু আর করিম শেখ। হাটের এক কোণে মনোয়ার হাজীর চায়ের দোকানে বসে গরম দু’কাপ চা খায়।

হাটের নাম শান্তির হাট। কিন্তু সারাদিন অশান্তিই লেগে থাকে এখানে। দূর দূর বহুদূর গ্রাম থেকে লোক আসে সওদা করতে। খুচরো জিনিসপত্রের চেয়ে পাইকারী জিনিসপত্রের বিক্রি অনেক বেশি। এখান থেকে মালপত্র কিনে নিয়ে গ্রামে গ্রামে আর ছোট ছোট হাট বাজারের দোকানীরা দোকান চালায়।

মাঝে মাঝে দু’একটা সার্কাস পার্টিও আসে এখানে। তখন সমস্ত পরগণায় সাড়া পড়ে যায়। দলে দলে ছেলে বুড়ো মেয়ে এসে জড়ো হয় এখানে। দোকানীদেরও তখন খুশির অন্ত থাকে না। জোর বিক্রি চলে। নদীর পাড়ের ভরাট জায়গাটায় কয়েকটা দোচালা ঘর তুলে নিয়ে সেখানে হোটেল খোলে কেউ। ভিড় লেগেই থাকে।

মানোয়ার হাজীর সঙ্গে করিম শেখের অনেক দিনের খাতির। এ হাটে এলে একমাত্র হাজীর দোকানেই চা খায় করিম। হাজীও বাইরের কোথাও যেতে হলে করিম শেখের নাও ছাড়া অন্য কারো নৌকায় যায় না। চায়ের পয়সা দিতে এলে হাজী একমুখ হেসে শুধালো, কি মিয়া খবর সব ভাল তো?

করিম শেখ বিরক্তির সঙ্গে বললো, আর খবর, হাঁপানি হয়া মারতাছি।

আহা, ওইডা আবার কখন থাইকা হইলো? হাজীর কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর। তা মিয়া হাঁপানি নিয়া না বাইরলেই পারতা।

কি আর করমু ভাই। পেট তো চলে না। করিম শেখ আস্তে করে বললো, পেট তো ঠাণ্ডা গরম কিছু মানে না।

মন্তুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে করিম।

কিছুক্ষণ হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে ওরা।

আকাশটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে দু’পাশের গ্রামগুলো। মাঝে মাঝে দু’একটা মিটমিটে বাতি দেখে বোঝা যায় গেরস্থদের বাড়ি গেলো একটা। কিম্বা হঠাৎ কোথাও একসার বাতি দুলতে দুলতে এগিয়ে যেতে দেখলে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় হাট থেকে ফিরছে। ওরা হাটুরের দল।

মাঝে মাঝে দু একটা শিয়াল আর অনেকগুলো কুকুরের দলবাঁধা ডাক শোনা যায়। আর উজান নদীর একটানা কলকল শব্দ।

হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরে মন্তু।

আশা ছিলো মনে মনে প্ৰেম করিমু তোমার সনে।

তোমায় নিয়া ঘর বাঁধিমু গহিন বালুর চরে।

গানের সুর বহুদূর পর্যন্ত প্ৰতিধ্বনিত হয়। করিম শেখ হুঁকোটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে, নাও মিয়া তামুক খাও।

হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নেয় মন্তু। গুডুম গুডুম টান মারে হুঁকোতে।

তারপর আবার গান ধরে, আশা ছিল মনে মনে।

গান শুনে করিম শেখের মনটা উদাস হয়ে যায়। ও বলে, এইবার একডা বিয়া শাদি করমু ঠিক করছি। একা একা আর ভালো লাগে না। মন্তু গান থামিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অন্ধকারে ওর মুখখানা ভালো করে দেখতে পায় না সে!

করিম শেখ আবার বলে, কি মিয়া কিছু কও না যে?

মন্তু বলে, বিয়া করবা সেতো ভালো কথা।

করিম শেখ বলে, করবার তো ইচ্ছা হয়, করি করে? ভাল দেইখ্যা একটা মাইয়া দেহয় দাও না।

মন্তু হাসে, বলে, ভাল মাইয়া পাইলে কি আর নিজে এতদিন অবিয়াত থাকি মিয়া। বলে আবার গান ধরে সেঃ

আশা ছিল মনে মনে…

বাড়ি ফিরে এসে মন্তু দেখলে বুড়ো মকবুলের ঘরের সামনে একটু ছোট-খাট জটলা বসেছে। বাড়ির সবার সঙ্গে কি যেন পরামর্শ করছে মকবুল। বাড়ির সবার চেয়ে বড় সে। গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সকলকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না বুড়ো। অন্য সবার বেলাও তাই। মকবুলকে জিজ্ঞেস না করে বাড়ির কেউ কোনদিন কোন কাজ কারবার করে না; সুরত আলীর সঙ্গে হয়তো রশীদের মনোমালিন্য আছে! আবুলকে হয়তো মকবুল দু’চোখে দেখতে পারে না। গনু মোল্লাকে হয়তো দিনের মধ্যে পঞ্চাশ বার অভিশাপ দেয় ফকিরের মা। কিন্তু বাড়ির মান-সন্মান জড়িয়ে আছে এমন কোন কাজের বেলা কারো সঙ্গে কারো বিরোধ নেই। তখন সবাই এক। একসঙ্গে বসে পরামর্শ করবে ওরা। মন্তুকে আসতে দেখে ওর দিকে একথানা পিঁড়ি বাড়িয়ে দিলো সালেহা, বহ, মন্তু মিয়া বহ।

আলোচনার ধারাটা মুহুর্তে বুঝে নিলো মন্তু।

বুড়ে মকবুলের মেয়ে হীরনের বিয়ের প্ৰস্তাব এসেছে টুনিদের বাবার বাড়ির গ্রাম থেকে। আজ সন্ধ্যায় টুনিকে নিয়ে যাবার জন্যে ওর বাবার বাড়ি থেকে লোক এসেছিলো। সেই দিয়ে গেছে প্রস্তাবটা। জুলু শেখের বেটা কদম শেখ হাল গরু জমি সব আছে ওদের। খাস গেরস্তু ঘরের ছেলে; বিয়ে একটা অবশ্য করেছিল একবার। মাস তিনেক হলো বউ মারা গেছে।

আমেনা বলছে, অত চিন্তা কইরা কী আইবো। পাকা কথা দিয়া দ্যান।

গনু মোল্লা বললো, সব খোদার ইচ্ছা। মাইয়ার কপালে যদি সুখ থাকে তাইলে যেইহানে বিয়া দিবা সেই হানেই সুখে থাকবো। বড় বেশি বাছবিচার কইরোনা।

মকবুল সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলো, হ্যাঁ, তাতো ঠিক কথা।

হীরনের বিয়ের কথা নিয়ে আলাপ হচ্ছিল, মাঝখানে রশীদের বউ সালেহা বলে উঠলো, আমাগো মন্তু মিয়ারেও এইবারে একডা বিয়া করাইয়া দ্যান।

এককোণে নীরবে বসেছিলো মন্তু। ওর দিকে তাকিয়ে সকলে সালেহার কথায় একসঙ্গে সাড়া দিয়ে উঠলো।

বুড়ো মকবুল গভীর গলায় বললো, হুঁ, ঠিক কথা কইছ সালেহা। ওর লাইগা একটা মাইয়া দেহন লাগে।

আমেনা বললো, ওর তো বাপ মা কেউ নাই, আপনারা আছেন দেইখা শুইনা করায়া দেন বিয়াডা।

সঙ্গে সঙ্গে দু-চারজন মেয়ে নিয়েও আলাপ করলো ওরা।

ফাতেমার এক খালাতো বোন আছে। রসুন তার নাম। রসুনের মতো সাদা-হলুদে মেশানো গায়ের রঙ। সুঠাম দেহ। টানা টানা চোখ। বয়স তেরো-চৌদ্দ হবে।

আবুল বললো, ওর মামার এক মেয়ে আছে। দেখতে যেন হুরপরী! তাই মামা আদর করে পরী বলে ডাকে। শুধু স্বভাবটা যেন একটু কেমন কেমন। তাও তেমন কিছু নয়। খায় একটু বেশি। আর ঘুমােয়। মকবুল পরক্ষণে বললো, ও মাইয়া ঘরে আইনা কাজ নাই মিয়া।

আমেনা বললো, অতি দূরে-দূরে যাইতাছ ক্যান, নিজ গেরামে দেহ না। আমাগো আম্বিয়া কি খারাপ মাইয়া নাহি! ও হইলেই খুব ভালো হয়। দিনরাত গতর খাটাবার পারে। মন্তু মিয়ারে সুখে রাখবো।

আম্বিয়ার প্রশ্নে কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। ও মেয়ে গতর খাটাতে পারে একথা সত্যি। কিন্তু ঘরের বউ করে আনার মতো মেয়ে নয়।

মকবুল বললো, ওগো বংশে হাঁপানি রোগ আছে। শেষে হাঁপানি হইয়া মন্তুও মরবো।

মন্তু কিন্তু একটা কথাও বললো না। সে চুপ করে বসে রইল এককোণে। আলোচনা অসমাপ্ত রেখে সেদিনের মতো উঠে গেলো সবাই। একটু পরে যে-যার ঘরে চলে গেলো ওরা।

পিদিম জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকে অবাক হলো মন্তু। মাচাঙের ওপর একরাশ শাপলার ফুল ঝুলছে। বকের মতো সাদা ধবধবে পাতার মাঝখানে হলুদ রঙের কুঁড়ি। ডাঁটাসহ ফুলগুলো মাচাঙ থেকে নামিয়ে নিলো মন্তু।

আজ সন্ধ্যায় বাপের বাড়ি চলে গেছে টুনি। যাবার আগে এগুলো রেখে গেছে ওর ঘরে। একটুকরো ম্লান হাসি জেগে উঠলো মস্তুর ঠোঁটের কোণে। ফুলগুলো আবার মাচাঙের উপর তুলে রেখে বিছানাটা নামিয়ে নিলো মন্তু।

Leave a Reply