এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠলো টুনি।
এত শিঘ্রী উঠত না সে, বুড়ো মকবুলের ধমক খেয়ে শুয়ে থাকাটা নিরাপদ মনে করলো না। মনে মনে বুড়োকে এক হাজার একশো অভিশাপ দিলো। চোখজোড়া জ্বালা করছে তাঁর। মাথাটা ঘুরছে। ঘরের পাশে ছাইয়ের গাদা থেকে একটা পোড়া কাঠের কয়লা তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে দাঁত মাজতে পুকুরের দিকে চলে গেলো। এক গলা পানিতে নেমে মন্তু গোসল করছে পুকুরে।
ঘোলাটে পানি আরো ঘোলা হয়ে গেছে।
কতগুলো হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে সাতার কাটছে এপার থেকে ওপারে। আর মাঝে মাঝে মুখটা পানিতে ডুবিয়ে চ্যাপটা ঠোঁট দিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা।
কাঁঠাল গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো ঘাটের এক কোণে এসে নীরবে বসলো টুনি। পা জোড়া পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে এক মনে দাঁতন করতে করতে হঠাৎ তাঁর নজরে এলো মন্তুর পিঠের ওপর একটা লম্বা কাটা দাগ।মনে হল কিছুক্ষণ আগেই বুঝি কিছুর সঙ্গে লেগে চিরে গেছে পিঠটা। ওমা, বলে মুখ থেকে হাত নামিয়ে নিলো টুনি, এই এই শোন। মন্তু ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, এইখানটা চিরলো কেমন কইরা, অ্যাঁ?
মন্তু হেসে দিয়ে বলল, গতকাল রাতে সগন শেখের পুকুর পাড়ে একটা বুনো লতার কাঁটা লাগছিলো পিঠে।
টুনির চোখজোড়া মুহূর্তে করুন হয়ে এলো। দরদ ভরা কন্ঠে সে আস্তে করে বলল, চলো কচু পাতার ক্ষির লাগাইয়া বাইন্দা দি, নইলে পাইকা যাইব, শেষে কষ্ট পাইবা।
মন্তু আবার একগলা পানিতে নেমে যেতে যেতে বলল, দূর কিছু অইবো না আমার।
টুনি কিছু বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ মকবুলের উঁচু গলার ডাক ওর কথায় ছেদ পড়লো।
কই টুনি বিবি, বলি বিবিজানের মুখ ধোয়ন কি এহনো অইলো না নাকি? রান্নাঘর থেকে চিৎকার করছে বুড়ো মকবুল। কাল রাতে ধানগুলো ভানা হয়নি সেগুলো ভানতে হবে এহন। হাত ভেঙ্গে ফুলে গেলেও সহজে বসে থাকার পাত্র নয় মকবুল।
তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে বুড়োর মৃত্যু কামনা করতে করতে ঘাট থেকে উঠে গেলো টুনি।
মন্তুর কোনো জমিজমা নেই।
পরের জমিতে খেটে রোজগার করে। লাঙ্গল চষে। ধান বোনে। আবার সে ধান পাকলে কেটে এনে মালিকের গোলা ভর্তি করে। তারপর ধানের মরশুম শেষ হয়ে গেলে কলাই, মুগ, তিল, সরিষার খেতে কাজ করে মন্তু। মাঝে মাঝে এ বাড়ি ও বাড়ি লাকড়ি কাটার চুক্তি নেয়। পাঁচ মণ এক টাকা। কোনো কোনো দিন আট নয় মণ লাকড়িও কেটে ফেলে সে। মাঝে কিছুকাল মাঝি-বাড়ির মন্তু শেখের ছেলে করিম শেখের সঙ্গে নৌকা বেয়েছিলো মন্তু। নৌকায় পাল তুলে অনেক দুরের গঞ্জে চলে যেতো ওরা। ওখান থেকে যাত্রী কিংবা মাল নিয়ে ফিরতো। ক্ষেতের রোজগারের চেয়ে নৌকায় রোজগার অনেক বেশি।
মাচাঙের উপর থেকে আধ ময়লা ফতুয়াটা নামিয়ে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে মন্তু ভাবলো, আজ একবার করিম শেখের সঙ্গে দেখা করবে গিয়ে। তখন সন্ধ্যার কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে গ্রামের বুকে। মিঞা-বাড়ির মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। মাথায় টুপিটা পরে নিয়ে তসবিহ হাতে নামাজ পরতে চলছেন গনু মোল্লা। মোরগ হাঁসগুলো সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবার পর এখন উঠোনের এককোণে এসে জটলা বেঁধেছে। একটু পরে যার যার খোয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে ওরা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো মন্তু। মাঝি-বাড়িটা বেশি দূরে নয়।
সগন সেখের পুকুরটা বাঁদিকে রেখে ডান দিকে মিয়াঁদের খেজুর বাগানটা পেরিয়ে গেলে দুটো ক্ষেত পরে মাঝি-বাড়ি।বাড়ির সামনে দিয়ে দাঁড়াতে মন্তু শেখের গরু ঘরের পেছন থেকে একটা লোম উঠা হাড় বের করা কালো কুকুর দৌড়ে এসে বিকট চিৎকার জুড়ে দিলো। হেই হেই করে কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলো সে।
দেউড়ির সামনে বাঁশের উপর ঝুলিয়ে রাখা সুপুরি পাতার ঝালরের আড়াল থেকে একটা গানের কলি গুনগুন করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলো আম্বিয়া।
আরে মন্তু ভাই দেখি। কী খবর?
মন্তু বললো, করিম আছে নাহি?
মাথার চুলগুলো খোপার মধ্যে গুড়িয়ে নিতে নিতে আম্বিয়া বললো, আছে।
আইজ কয়দিন থাইকা জ্বর অইছে ভাইজানের।
কী জ্বর? কহন অইছে? মন্তুর চোখে উৎকণ্ঠা।
আম্বিয়া আস্তে করে বললো, পরশু রাইত থাইকা অইছে। কী জ্বর তা কইবার পারলাম না।
মন্তু কি যেন চিন্তা করলো। তারপর ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতে আম্বিয়া পিছন থেকে ডাকলো, চইলা যাও ক্যান? দেখা কইরা যাইবা না? আম্বিয়ার পিছু পিছু হোগলার বেড়া দেয়া ঘরটায় এসে ঢুকলো মন্তু। কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে ম্লান হেসে করিম বললো, মন্তু মিয়া যে, তোমারে তো আইজ-কাল দেখা যায় না। বাইচা আছি না মইরা গেছি তাও তো খোঁজ-খবর নাও না মিয়া।
মন্তু প্রথমে বিব্রত বোধ করলো, তারপর বললো, দেখা না অইলে কি অইবো মিয়া খোজ-খবর ঠিকই নিই।
কলকেতে তামাক সাজিয়ে এনে হুঁকোটা মন্তুর দিকে বাড়িয়ে দিলো আম্বিয়া। তারপর জিজ্ঞেস করলো পান খাইবা? মন্তু হাত বাড়িয়ে হুকোটা নিতে নিতে বললো, না থাউক। আপন মনে কিছুক্ষণ হুঁকো টানলো সে। তারপর আসল কথাটা আলোচনা করলো ওর সঙ্গে। করিম শেখের সঙ্গে আবার কিছুদিনের জন্য নৌকায় কাজ করতে চায় মন্তু।
শুনে খুশি হল করিম। বললো, নাওটারে একটু মেরামত করন লাগবো।
কাল পরশু একবার আইসো।
আবার আসবে বলে উঠতে যাচ্ছিল মন্তু।
করিম সঙ্গে সঙ্গে বললো, আহা যাও কই, বহ না।
না। রাইত অইছে যাই এইবার।
আম্বিয়া বললো, বহ মন্তু ভাই, চাইরডা ভাত খাইয়া যাও।
এর মধ্যে পাশের ঘরে গিয়ে ছেঁড়া ময়লা শাড়িটা পাল্টে একটা নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছে আম্বিয়া।
মুখখানা গামছা দিয়ে মুছে এসেছে সে।
কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু। আঁটসাঁট দেহের খাঁচে খাঁচে দুরন্ত যৌবন, আঁট হাত শাড়ির বাঁধন ভেঙ্গে ফেটে পরতে চায়। ওকে অমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত বোধ করলো আম্বিয়া, দাঁড়াইয়া রইলা ক্যান, বহ না।
মন্তু বললো, না আইজ না। আর এক দিন খামু।বলে বাইরে বেরিয়ে এলো মন্তু।
পিদিম হাতে দেউড়ি পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়ে গেল আম্বিয়া। মন্তু শুধালো তোমার আব্বা কই গেছে?
আম্বিয়া বললো, যেই কাজ কইরা বেড়ায় সেই কাজ করতে গেছে। যাইবো আবার কই। ওর গলায় ক্ষোব।
ওর মুখের দিকে তাকালো মন্তু। ওর ক্ষোবের কারণটা সহজে বুঝতে পারলো। সাত গ্রামের মরা মানুষকে কবর দিয়ে বেড়ায় নন্তু শেখ। এ তাঁর পেশা নয় নেশা।
আম্বিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নেমে এলো মন্তু তখন সে অনুভব করলো বেশ রাত হয়েছে।
চারপাশে ঝিঁ-ঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ডাক। মাঝে মাঝে গাছের মাথায় দু-একটা পাখি হঠাৎ পাখা ঝাঁপটিয়ে আবার নীরব হয়ে যাচ্ছে। আকাশে ভরা চাঁদ হাসছে খলখলিয়ে।
বাড়ির কাছে এসে পৌঁছতেই সুরত আলীর সুর করে পুঁথি পড়ার শব্দটা কানে এলো মন্তুর।
কইন্যা দেইখা গাজী মিয়ার চমক ভাঙ্গিলো।
কইন্যার রূপেতে গাজী বেহুঁশ হইল।
উঠোনে বেশ বড় রকমের জটলা বেধেছে একটা। মাটিতে একটা চাটাই বিছিয়ে বসেছে সবাই। আর তার মাঝখানে একটা পিদিমের আলোতে বসে পুঁথি পড়ছে সুরত। পুরুষরা তার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেও মেয়েরা বসেছে একটু দূরে। যাদের বয়স কম তারা বসেছে আরো দূরে। দাওয়ার ওপরে।
বুড়ো মকবুল গুড়ুক গুড়ুক হুঁকো টানছে আর বার বার প্রশংসা করছে সুরত আলীর পুঁথি পড়ার। বড় সুন্দর পুঁথি পড়ে সুরত আলী। এ গাঁয়ের সেরা পুঁথি পড়ুয়া সে।
আকাশে যখন জোছনার বান ডাকে। ভরা চাঁদ খলখলিয়ে হাসে। দক্ষিনের মৃদুমন্দ বাতাস অতি ধীরে তার চিরুনি বুলিয়ে যায় গাছের পাতায় পাতায়। কাক ডাকে না। চড়ুই আর শালিক কোনো সাড়া দেয় না। গ্রামের সবাই সারা দিনের কর্মব্যস্ততার কথা ভুলে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেয়।নিঃশব্দ নিঝুম রাতে কুঁড়েঘরের ছায়াগুলো ধীরে ধীরে হেলে পড়ে উঠোনের মাঝখানে। তখন সুর করে পুঁথি পড়ে সুরত আলী। গাজী কালুর পুঁথি। ভেলিয়া সুন্দরীর পুঁথি।
শুন শুন বন্ধুগণরে, শুন দিয়া মন।
ভেলুয়ার কথা কিছু শুন সর্বজন॥
কী কহিব ভেলুয়ার রুপের বাখান।
দেখিতে সুন্দর অতিরে রসিকের পরাণ॥
আকাশের চন্দ্র যেনরে ভেলুয়া সুন্দরী।
দূরে থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকুলের পরী॥
উৎকর্ণ হয়ে শোনে সবাই। সুরত আলী পড়ে।ঢুলে ঢুলে সুর করে পড়ে সে।পুরুষেরা গুড়ুক গুড়ুক তামাক টানে। মেয়েরা পান চিবায়। মাঝে মাঝে কমলার পুঁথিটাও পড়ে শোনায় সুরত। কমলার কিচ্ছা বর্ণনা করে সবার কাছে। কিচ্ছা নয়, একেবারে সত্য ঘটনা। হিরণ্য নগরের মেয়ে ছিলো কমলা। যেমন রুপ তেমনি গুণ। ভোজ উৎসব করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে একদিন বিয়ে হয়ে গেলো তার। হিরণ্য নগরের রাজকুমারের সঙ্গে।
বড় সুখে দিন কাটছিলো ওদের।
এক বছর পরে একটা দুধের মত মেয়ে জন্ম নিলো ওদের।
আট বেহারার পালকি চড়ে একদিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লাল পরি নীল পরী আর সবুজ পরির দীঘির পাড় দিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছিল কমলা। দীঘি দেখে পালকি থেকে নামলো সে। চৈত্র-মাসের খর রোদে ভীষন তেষ্টা পেয়েছিলো ওর। দীঘির স্বচ্ছ পানি দেখে বড় লোভ হল কমলার। পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে আঁচল ভরে পানি খেলো সে। তারপর যখন উঠতে যাবে, দেখলো, চুলের মতো কি যেন একটা কড়ে আঙ্গুলের গোড়ায় আটকে রয়েছে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলো। পারলো না কমলা। যত টানে তত লম্বা হয় সে চুল। তার এক প্রান্ত পানির ভেতরে, অন্য প্রান্ত কড়ে আঙ্গুলের সঙ্গে গিটে আঁটা। ছাড়াতেও পারেনা কমলা, এগুতেও পারেনা। এগুতে গেলে পানির ভেতর চুলে টান পড়ে। কে যেন টেনে ধরে রেখেছে ওটা। চারিদিকে হই চই পড়ে গেলো।
কত লোক এলো। কত লোক গেলো।
কত কামার কুমার ওঝা এসে জড়ো হল। কেউ কিছু করতে পারলো না। ইস্পাতে তৈরি কুড়োল দিয়েও কাটা গেলো না চুলটা? তিন মাস তিন দিন চলে গেলো।
তারপরে—
এক রাতে স্বপনে দেখিলো সুন্দরী।
দীঘির পানিতে আছে এক রাজপুরী॥
সেইখানে আছে এক রাজপুত্র সুন্দর।
আসেক হইয়াছে তার কমলার উপর॥
কমলারে পাইতে চায় আপন করিয়া।
কমলার লাইগা তার কান্দিছে হিয়া॥
কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো কমলার। কাঁদলো সবাই। বাবা, মা। স্বামী সবাই।
দীঘির পানি থেকে চুলে টান পড়লো এতদিনে। পাতা পানি থেকে হাঁটু পানিতে নেমে গেলো কমলা। হাঁটু থেকে বুক। তারপর গলা। ধীরে ধীরে দীঘির পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেলো কমলা সুন্দরী।
চাঁদ হেলে পড়ে পুব থেকে পশ্চিমে।
ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
ঢুলে ঢুলে পুঁথি পড়া শেষ করল সুরত আলী।
হীন মোয়াজ্জেমে কহেরে শুন সর্বজন
কমলা সুন্দরীর কিচ্ছা হইল সমাপন॥
ভুল চুক হইলে মোরে লইবেন ক্ষেপিয়া।
দোয়া করিবেন মোরে অধীন জানিয়া॥
পুঁথি পড়া শেষ হয়। কমলা সুন্দরী আর ভেলুয়া সুন্দরীর জন্যে অনেক অনেক আফসোস করে মেয়ে বুড়োরা। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছে আমেনা। টুনির চোখ জোড়াও পানিতে টলটল করে ওঠে। ফকিরের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সব খোদার ইচ্ছা, খোদা মাইরবার চাইলে কিনা করতে পারে। বুড়ো মকবুল কিছুক্ষণের জন্য হুঁকো টানতে ভুলে যায়। সে চুপ করে কি যেন ভাবে আর নীরব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।