ধপাস ধপাস ঢেঁকির শব্দে গমগম শিকদার বাড়ি।

ঘুমে ঢুলুঢুলু বউ দুটোর গা বেয়ে দরদর ঘাম নামে। এতক্ষনে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা। আঁচলটা কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে নিয়ে, সামনে হাত রাখার বাঁশের ওপরে গুটিয়ে রেখেছে দুইজনে। মাঝে মাঝে তুলে নিয়ে বুক আর গলার ঘাম মুছে নিচ্ছে। ঘামে কাপড়টা চপ চপ করছে ওদের।

সেদিকে খেয়াল নেই মকবুলের। ও ভাবছে অন্য কথা।

বাড়ির ওপরের জমিটাতে লাঙল না দিলে নয়। অথচ হাল যে একটা ধার পাবে সে সম্ভাবনা নেই। লাঙল অবশ্য যা হোক একটা আছে ওর। অভাব হল গরুর। গরু না হলে লাঙল টানবে কিসে। আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়। মকবুল ভাবল, বউ দুটোকে লাঙলে জুড়ে দিয়ে, দূর এটা ঠিক হবে না। লোকে গালাগাল দেবে ওকে। বলবে, দেহ বউ দুইডা দিয়া লাঙল টানায়। তাঁর চেয়ে এক কাজ করলে কি ভালো হয় না? না। বউদের দিয়েই লাঙল টানাবে সে। দিনে নয়, রাতে। বাইরের কোনো লোকে দেখবার কোনো ভয় থাকবে না তখন। বউরা অবশ্য আপত্তি করতে পারে। কিন্তু ওসব পরোয়া করে না মকবুল। মুফত বিয়ে করেনি সে। পুরো চার চারটে টাকা মোহরানা দিয়ে একটা বিয়ে করেছে। হু।

ভাবছিলো আর সোনারঙ ধানগুলো ঢেঁকির নিচে ঠেলে দিচ্ছিল মকবুল। হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ করে হাতটা চেপে ধরলো সে। অসতর্ক মুহূর্তে ঢেকিটা হাতের ওপর এসে পড়েছে ওর। আল্লারে বলে মুখ বিকৃত করলো মকবুল।

টুনি আর আমেনা এতক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়েছিলো ঢেঁকির ওপর। ঘোর কাটতে ছুটে নেমে এল ওরা। ওদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে ওদের গায়ের ওপরে থুতু ছিটিয়ে দিলো মকবুল, দূর-হ দূর-হ আমার কাছ থাইকা। বলতে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চাপালো মকবুল।

আমেনা বলল, দেহ কারবার, নিজের দোষে নিজে দুঃখ পাইল আর এহন আমাগোরে গালি দেয়। আমরা কি করছি।

তোরা আমার সঙ্গে শত্রুতামি করছস। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো মকবুল। তোরা দুই সতীনে ইচ্ছা কইরা আমার হাতে ঢেঁকি ফালাইছস। তোরা আমার দুশমন।

হ্যাঁ দুশমনই তো। দুশমন ছাড়া আর কি। কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো আমেনা। টুনি এগিয়ে গেলো ওর ফুলা হাতে একটা ভিজে ন্যাকড়া বেঁধে দেয়ার জন্যে। লাফিয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেলো মকবুল। দরকার নাই, দরকার নাই। অত সোহাগের দরকার নাই। বলে একখানা সরু কাঠের টুকরো নিয়ে ওর দিক ছুড়ে মারলো মকবুল।

বিষ উঠছে নাহি বুড়ার? এমন করতাছে ক্যান। চাপা রোষে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো টুনি। খোলা আকাশের নিচে এসে দাড়াতে ঠান্ডা বাতাসে দেহটা জুড়িয়ে গেলো ওর। হঠাৎ মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। উঠোন থেকে মন্তুর ঘরের দিকে তাকালো ও। একটা পিদিম জ্বলছে সেখানে। একবার চারপাশে দেখে নিয়ে মন্তুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো টুনি।

মাচাঙের ওপর থেকে কাঁথা বালিশটা নামিয়ে শোবার আয়োজন করছিলো মন্তু।

টুনি দোরগোড়া থেকে বলে, বাহ, বারে!

মন্তু মুখ তুলে তাকায় ওর দিকে। বলে ক্যান কী অইছে?

টুনি ফিসফিসিয়ে বলে, আজ যাইবা না?

মন্তু অবাক হয়, কই যামু?

টুনি মুখ কালো করে চুপ থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, ক্যান ভুইলা গেছ বুঝি?

মন্তুর হঠাৎ মনে পড়ে যায়। বেড়ার সঙ্গে ঝুলানো মাছ ধরার জাল্টার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, অ-মাছ ধরতে?

যাইবা না? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে টুনি।

মন্তু হেসে বলে, যামু। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তিত হয়ে পড়ে সে, বুড়ো যদি টের পায় তাইলে কিন্তুক জানে মাইরা ফালাইবো।

হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয় টুনি। মাইররে ডরাও নাকি?

মন্তু সে কথার জবাব না দিলে টুনি বলে, ভাত খাইছ?

না! তুমি খাইছ?

হু। তুমি গিয়া খাইয়া আস যাও। জলদি কইরা আইসো। বিছানাটা আবার গুটিয়ে রেখে বেড়ার সঙ্গে ঝুলানো জালটা মাটিতে নামিয়ে নেয় মন্তু।

ও ঘর থেকে আমেনার ডাক শোনা যায়, টুনি বিবি কই গেলা, খাইতে আহ!

আহি বলে সেখান থেকে চলে যায় টুনি।

আজকাল রাতের বেলা আমেনার ঘরে শোয় মকবুল। টুনি থাকে পাশের ঘরে। আগে, ফাতেমা আর ওরা দুজনে একসঙ্গে থাকতো। মাসখানেক হল ফাতেমা বাপের বাড়ি গেছে। এখন টুনি একা। রাতের বেলায় ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ালেও ধরবার উপায় নেই। রাত জেগে মাছ ধরাটা ইদানিং একটা নেশা হয়ে গেছে ওদের। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের এ পুকুর থেকে অন্য পুকুরে জাল মেরে বেড়ায় ওরা। হাতে একটা টুকরি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে টুনি। জালে ওঠা মাছগুলো ওর মধ্যে ভরে রাখে।

পর পুকুরের মাছ ধরতে গিয়ে সমস্ত সময় সজাগ থাকতে হয় ওদের। চারপাশে দৃষ্টি রাখতে হয়। একদিন প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলো দুজনে। জমির মুন্সির বড় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলো সেদিন। আকাশে চাঁদ ছিলো কিন্তু চাঁদনী ছিলো না। কালো মেঘে ছেয়ে ছিলো পুরো আকাশটা।

এক হাটু পানিতে নেমে জালটাকে সন্তর্পণে ছুঁড়ে দিয়েছিলো সে। পুকুরের মাঝখানটাতে। শব্দ হয়নি মোটেও। কিন্তু পুকুর পাড় থেকে জোর গলায় আওয়াজ শোনা গেলো, কে কে জাল মারে পুকুরে?

এক হাটু পানি থেকে নীরবে এক গলা পানিতে নেমে গেল মন্তু। টুনি ততক্ষণে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। জমির মুন্সির হাতের টর্চটা বিদ্যুৎবেগে ছুটে গেল পুকুরের এপার থেকে ওপারে। মনে মনে বার বার খোদাকে ডাকছিলো মন্তু, খোদা তুমি সব।

একটু পরে পাড়ের ওপা থেকে টুনির চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, এই উইঠা আহ। মুন্সি চইলা গেছে। বলে খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে সে। ওর হাসির শব্দে রাগে সমস্ত দেহটা জ্বালা করে উঠেছে মন্তুর। এমন সময়ে মানুষ হাঁসতে পারে?

তারপর থেকে, আরো সাবধান হয়ে গেছে মন্তু। গনু মোল্লার কাছ থেকে তিন আনা পয়সা খরচ করে একটা জোরদার তাবিজ নিয়েছে সে। রাতে বিরাতে গাঁয়ের পুকুরে মাছ ধরে বেড়ানো, বিপদ আপদ কখন কী ঘটে কিছুতো ব্লা যায় না। আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো। সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে, বাজুর ওপরে বাঁধা তাবিজটাকে আজ একবার ভালো করে দেখে নিলো মন্তু। তারপর বুনো লতার ঝোপটাতে দুহাতে সরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল সে। টুনি পেছন থেকে বললো, বারে অত জোরে হাঁটলে আমি চলি কি কইরা? মন্তু জালটাকে গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, আস্তে আহ তাড়া কিসের? টুনি বলে, বারে, আমার বুঝি ডর ভয় কিছুই নাই। যদি সাপে কামড়ায়? সাপের কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ একটা আঁধি সাপ ফোঁস করে ওঠে সরে যায় সামনে থেকে। আঁতকে ওঠে দুহাত পিছিয়ে আসে মন্তু। ভয় কেটে গেলে থুতু করে বুকের মধ্যে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দেয় সে। পেছনে টুনির দিকে তাকিয়ে বলে, বুকে থুতু দাও তাইলে কিচ্ছু অইবো না। কোনো রকম বিতর্কে না এসে নীরবে ওর কথা মেনে টুনি। কপালটা আজ মন্দ ওদের। অনেক পুকুর ঘুরেও কিছু চিংড়িগুড়ো ছাড়া আর কিছু জুটলো না। মাছ গুলো কেমন যেন সেয়ানা হয়ে গেছে। পুকুরের ধারে কাছে থাকে না। থাকে গিয়ে একে বারে মাঝখানটিতে, এত দূর জাল উড়িয়ে নেয়া যায় না। টুনি বলে থাক, আইজ থাউক, চলো বাড়ি ফিইরা যাই। জালটাকে ধুয়ে নিয়ে মন্তু আস্তে আস্তে বলে, চলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুলো হাতটা কোলে নিয়ে বসে বসে আবুল আর হালিমার ঝগড়া দেখছিলো মকবুল।

অনেকক্ষণ কী একটা বিষয় নিয়ে তর্ক চলছে ওদের মধ্যে। দাওয়ায় বসে বসে যা মুখে আসছে ওকে বলে যাচ্ছে আবুল। হালিমাও একেবারে চুপ করে নেই। উঠোনে একটা লাউয়ের মাচা বাঁধতে বাঁধতে দুএকটা জবাবও দিচ্ছে সে মাঝে মাঝে। মকবুল হাতের ব্যথায় মৃদু কাতরাচ্ছিল আর পিটপিট চোখে তাকাচ্ছিল ওদের দিকে।

হঠাৎ দাওয়া থেকে ছুটে এসে মুহূর্তে হালিমার চুলের গোছাটা চেপে ধরল আবুল। তারপর কোন চিন্তা না করে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দিলো ওর তলপেটে। উঃমাগো, বলে পেটটা দুহাতে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল হালিমা। রাগে তখন ফোঁপাচ্ছে আবুল, আমার ঘরের ভাত ধ্বংস কইরা রাস্তার মানষের লগে পিরিত। জানে খতম কইরা দিমু না তোরে। কাইটা রাস্তায় ভাসায় দিমু না। বলে আবার ওর চুলের গোছাতে হাত দিতে যাচ্ছিল আবুল, বুড়ো মকবুল চিৎকার করে উঠল, খবরদার আবুইল্যা, তুই যদি বউয়ের গায়ে আরেকবার হাত তুলছস তাইলে ভালো অইবো না কিন্তুক।

আমার ঘরণীর গায়ে আমি হাত তুলি কি যা ইচ্ছা করি, তুমই কইবার কে অ্যাঁ? পরক্ষণে আবুল জবাব দিল, তুমি যহন তোমার ঘরণীরে তুলাপেডা কর তহন কি আমরা বাঁধা দিই।

অমন কোণঠাসা উত্তরের পর আর কিছু বলার থাকেনা মকবুলের। শুধু জ্বলন্ত দৃষ্টিতে এক নজর ওর দিকে তাকালো মকবুল। আবুল তখন ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে চলেছে হালিমাকে। ভিতরে নিয়ে গিয়ে মনের সুখে মারবে। ওর ইচ্ছেটা হয়ত বুঝতে পেরেছিলো হালিমা তাই মাটি আকড়ে ধরে গোঙাতে লাগলো সে, ওগো তোমার পায়ে পড়ি, আর মাইরো না, মইরা যামু।

চুপ, চুপ তীব্র গলায় ওকে শাসিয়ে ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেয় আবুল। হেকচা টানে ওর পরনের ছেঁড়া ময়লা শাড়িটা খুলে নিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। তালি দেওয়া পুরান ব্লাউজটা আঁটসাঁট করে বাঁধা ছিলো, টেনে সেটাও খুলে ফেলে আবুল। তারপর দুপায়ে ওর নগ্ন দেহটাকে প্রচন্ডভাবে মাড়াতে থাকে সে। বেড়ার সঙ্গে পুরান একটা ছড়ি ঝোলানো ছিলো, সেটা এনে হালিমার নরম তুলতুলে কপালে কয়েকটা আঁচড় টেনে দেয় আবুল।এইবার পিরিত কর। আরো পিরিত কর রাস্তার মানষের লগে। আহারে। এরে মাইয়াডারে মাইরা ফালাইস না। ওরে অ পাষাইন্যা, দরজা খোল, মারিস না আর মারিস না, জাহান্নামে যাইবি, মারিস না। বাইরে থেকে দুহাতে ঝাঁপিটাকে ঠেলছে ফকিরের মা। আবুল এক বার তাকালো সেদিকে, ঝাঁপি খুললো না।

বউ মারায় একটা পৈশাচিক আনন্দ পায় আবুল। মেরে মেরে এর আগে দুটো বউকে প্রানে শেষ করে দিয়েছে সে।

প্রথম বউটা ছিলো এ গাঁয়েরই মেয়ে। আয়েশা। একটু বেঁটে, একটু মোটা আর রঙের দিক থেকে শ্যামলা। অপূর্ব সংযম ছিল মেয়েটির। আশ্চর্য শান্ত স্বভাব। কত মেরেছে ওকে আবুল। কোনো দিন একটু শব্দও করেনি। পিঠটা বিছিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। কিল, চাপড়, ঘুসি ইচ্ছেমতো মারতো আবুল।

একটা সামান্য প্রতিবাদ নেই। প্রতিরোধ নেই।

শুধু আড়ালে নীরবে চোখের পানি ফেলত মেয়েটা।

তারপর একদিন ভীষণভাবে রক্তবমি শুরু হল ওর। জমাট বাঁধা কালো রক্ত। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মারা গেলো আয়েশা।

আয়েশা টিকেছিলো বছর তিনেক। তাঁর পরেরটা কিন্তু ওর চাইতেও কম। মাত্র দুবছর।

অবশ্য জমিলার মাত্র দুবছর টিকে থাকার পেছনে একটা কারণও আছে। ও মেয়েটা ছিলো একটু বাচাল গোছের আর একটু রুক্ষ মেজাজের। সহজে আবুলের কিল চাপড়গুলো গ্রহণ করতে রাজি হত না সে। মারতে এলে কোমরে আঁচল বেঁধে রুখে দাঁড়াতো।

হাজার হোক মেয়েতো। পুরুষের সঙ্গে পারবে কেন? বাঁধা দিতে গিয়ে পরিণামে আরও বেশি মার খেত জমিলা। ও যখন মারা গেলো আর ওর মৃতদেহটা যখন গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করছিলো সবাই তখন ওর সাদা ধবধবে পিঠের ওপর সাপের মতো আঁকাবাঁকা ফুলে ওঠা রেখাগুলো দেখে শিউরে উঠেছিলো অনেকেই। ওরে পাষাইন্যারে এমন দুধের মতো মাইয়াডারে শেষ করলি তুই। আয়েশা মারা যাবার পর অবশ্য ভীষন কেঁদেছিল আবুল। গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছিল সারা উঠোনে। পাড়াপড়শিদের বলেছিলো, আহা বড় ভালো বউ আছিলো আয়েশা। আমি পাষাইন্যা তাঁর কদর বুঝলাম না। আহারে এমন বউ আর পামু না জীবনে।

আয়েশার শোকে তিনদিন এক ফোঁটা দানাপানিও মুখে পোরেনি আবুল। তিন রাত কাটিয়েছে ওর কবরের পাশে বসে আর শুয়ে। পাড়াপড়শিরা ভেবেছিলো ওর চরিত্রে বুঝি পরিবর্তন এলো এবার। এবার ভালো দেখে একটা বিয়ে শাদি করিয়ে দিলে সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার ক্রবে আবুল।

কিন্তু জমিলার সঙ্গেও সেই একই ব্যবহার করেছে আবুল। একই পরিনাম ঘটেছে জমিলার জীবনেও।

দ্বিতীয় বউয়ের মৃত্যুতে আবুলের গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার কোনো মূল্য দেয়নি পড়শিরা। মুখে বিরক্তি এনে বলেছে, আর অত ঢঙ করিস না আবুইল্যা। তোর ঢঙ দেইখলে গা জ্বালা করে।

আমার বউয়ের দুঃখে আমি কাঁদি, তোমাগো গা জ্বালা করে ক্যান? ওদের কথা শুনে ক্ষেপে ওঠে আবুল।

কপালে এক মুঠো ধুলো ছুঁয়ে সহসা একটা প্রতিজ্ঞা করে বসে সে, এই তওবা করলাম বিয়া শাদি আর করমু না। খোদা, আমারে আর বিয়ার মুখ দেখাইও না। বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে আবুল।

পড়শিরা গালে হাত দিয়ে বলেছে, ইয়া আল্লা, এই কেমনতর কথা। বউ মারলি তুই, সেই কথা বইলা কি শত্রুতামি করলাম নাকি আমরা? সাচা কথা কইলেই তো মানুষ শত্রু হয়। ঠিক কইছ বইচির মা, সাচা কথা কইলেই এমন হয়। তা, আমাগো সে দিন থেকে আবুলের সাতে পাঁচে আর কেউ নেই ওরা।

আজকাল হালিমাকে যখন প্রহর অন্তর একবার করে মারে আবুল তখন কেউ কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বুড়ো মকবুল এক-আধটু বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। আবুইল্যা, তোর কি মানুষের পরান না, এমন কইরা যে মার্চ বউডারে তোর মনে একটুও চোট লাগে না আবুইল্যা? বউদের অবশ্য মকবুলও মারে। তাই বলে আবুলের মতো অত নির্দয় হওয়াটা মোটেই পছন্দ করে না সে। মারবি তো মার। একটুখানি সইয়া মার। অপরাধের গুরুত্ব দেইখা সেই পরিমাণ মার। এ হল মকবুলের নিজস্ব অভিমত।

অপরাধ, এমন কোনো সাংঘাতিক করেনি হালিমা। পাশের বাড়ি নুরুর সঙ্গে কী একটা কথা বলতে গিয়ে হেসেছিলো জোরে। দূর থেকে সেটা দেখে গা জ্বালা করে উঠেছে আবুলের। একটা গভীর সন্দেহে ভরে উঠেছে মন।

এমন মন খোলা হাসি তো আবুলের সঙ্গে কোনোদিন হাসেনি হালিমা।

বেহুঁশ হালিমাকে ভেতরে ফেলে রেখে আবুল যখন বাইরে বেরিয়ে এলো তখন সর্বাঙ্গে ঘামের স্রোত নেমেছে ওর। পরনের লুঙ্গি দিয়ে গাঁয়ের ঘামটা মুছে দাওয়ার ওপর দম ধরে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলো আবুল। মাটির হুঁকোটাকে নেড়েচেড়ে কি যেন দেখলো, তারপর কলকেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

রশীদের বউ সালেহা উঠোনে বসে চাটাই বুনছিল। আবুলকে এদিকে আসতে দেখে মুখ টিপে হেসে বলল, বউ-এর পিরিত বুঝি আর সইলো না মিয়ার। আর সইবো, বহুত সইছি। মুখ বিকৃত করে পুরনো কথাটাই আবার বলে গেলো আবুল, আমার ঘরের ভাত খাইয়া রাস্তার মানষের সঙ্গে পিরিত। তুমি কও ভাবী, এইডা কি সহ্য করণ যায়?

হ্যাঁ তাতো খাঁটি কথাই কইছ। সালেহা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ঘরনী যদি মনের মতো না হয় তাইলে কি তারে নিয়ে আর সুখে ঘর করণ যায়?

আর ভাবী, দুনিয়াদারী আর ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে দুই চোখ যেই দিকে যায় চইলা যাই। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে আবুল। তারপর কলকেটা সালেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চুলায় আগুন আছে? একটুহানি আগুন দাও।

এই দিই, বলে কলকেটা হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সালেহা। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এলো সে। ও কাছে আসতে গলার স্বরটা একেবারে খাদে নামিয়ে এনে আবুল বলল, আইজ আর ছাড়ি নাই ভাবী। যতক্ষণ পারছি মারছি। তুমি একটু তেল গরম কইরা মালিশ কইরা দিও ওর গায়ে। হাডডি না দুই একখানা ভাইঙ্গা গেছে কে জানে। তাইলে তো বড় বিপদ অইব। কাম কাজ কত পইর‍্যা রইছে। সব কিছু বন্ধ অইয়া যাইব।

সেই কথা আগে খেয়াল আছিলো না মিয়ার? সালেহা মুখ বাঁকাল। কাম কাজের যখন ক্ষতি অইবো জান, তহন না মারলেই পাইরতা। মারলা ক্যান।

উঁহু, আবুল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, মারছি ঠিক করছি, না মারলে আস্কারা পাইয়া যাইত।

আর আস্কারা কি এমনে কম পাইছে? চারিদিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে সালেহা বলল, নুরুর সঙ্গে আজকা কথা কইছে? ওতো রোজরোজ কথা কয়।

কী? চোখ জোড়া আবার ধপ করে জ্বলে উঠলো আবুলের, আমারে এতদিন কও নাই ক্যান?

সালেহা বলল, কী দরকার বাবু আমাগো মিছামিছি শত্রু বইনা। কইতাম গেলে তো অনেক কথাই কইতে অয়। তাকি আর একদিনে শেষ করা যায়।

কি কথা কও ভাবী। খোদার কসম ঠিক কইরা কও। তামাক খাওয়াটা একেবারে ভুলে গেলো আবুল।

সালেহা আস্তে করে বললো, যাই কও বাবু কারো বদনাম করার অভ্যাসই আমার নাই। কিন্তুক কই কী বউডা তোমার বড় ভালো অয় নাই। আমরা তো আয়শাকেও দেখছি, জমিলারেও দেখছি। ওরা তো আমাগো হাতের ওপর দিয়েই গেছে।

ওগো তুলনা আছিলো না। কিন্তু হালিমার স্বভাব চরিত্র বাবু আমার বড় ভালো লাগে না। বলতে গিয়ে বার কয়েক কাশলো সালেহা। কাশটা গিলে নিয়ে আবার সে বলল, ইয়ে মানে, বাইরের মানুষের সঙ্গে হাসাহাসি আর ঢলাঢলি। একটুখানি লজ্জা শরমও তো থাকা চাই। কথা শেষে আবুলের রক্তলাল চোখ জোড়ার দিকে দৃষ্টি পড়তে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলো সালেহা। একটু ধমকের সুরে বলল, দেইখো বাপু, তুমি আবার মাইয়াডারে মারতে শুরু কইরো না। এমনিতেই বহুত মারছ। এতে যদি শিক্ষা না হয় তাইলে আর এ জন্মেও হইবে না। সালেহার কথাটা শেষ হবার আগে সেখান থেকে চলে গেছে আবুল। কলকেটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে সে। একটু পরে আবার হালিমার কান্নার শব্দ শোনা গেলো ঘর থেকে। আবুল আবার মারছে তাকে।

Leave a Reply