অবশেষে বুড়ো মকবুল মারা গেলো।

ধলপহর দেখা দেবার অনেক আগে যখন সারাগ্রাম ঘুমে অচেতন তখন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো সে।

সারারাতে কেউ ঘুমোল না।

গনু মোল্লা, আবুল, রশীদ, সালেহা, মন্তু, টুনি, সবাই জেগে রইল মাথার পাশে। সন্ধেবেলা ফকিরের মা বলছিলো, লক্ষণ বড় ভোলা না। তোমরা কেউ ঘুমায়ো না মিয়ারা, জাইগা থাইকো।

বহুলোককে হাতের ওপর দিয়ে মরতে দেখেছে ফকিরের মা। তাই, রোগীর চেহারা আর তার ভাবভঙ্গি দেখে সে অনেকটা আন্দাজ করতে পারে।

সারারাত প্ৰলাপ বকেছে বুড়ো মকবুল।

কখনো আমেনার নাম ধরে ডেকেছে সে। কখনো ফাতেমার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে। আবার কখনো প্ৰলাপের ঘোরে গরু তাড়িয়েছে। হুঁ হট হট। আরো মরার গরু চলে না। ক্যান; হুঁ হট হট।

মাথার কাছে বসে সারাক্ষণ কোরান শরিফ পড়ল গনু মোল্লা।

তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয় এলো বুড়ো মকবুল। প্ৰলাপ বন্ধ হলো। একটু পরে মারা গেল সে।

ওর বুকের উপর পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো টুনি।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো সে।

তাৱ বিলাপের শব্দ অন্ধকারে কেঁপে কেঁপে দূর পরীর দীঘির পড়ে মিলিয়ে গেলো।

বিস্ময়ভরা চোখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু।

পরদিন দুপুরে বুড়ো মকবুলের মৃতদেহটা যখন কাফনে আবৃত করে খাটিয়ার ওপর তোলা হলো তখন বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠোনের মাঝখানে ডাঙায় তোলা মাছে মতো তড়পাতে লাগলো টুনি। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা নানা সান্তনা দিতে চেষ্টা করলো ওকে। সালেহা, ফকিরের মা, সুরতের বউ ওরাও অনেক কান্নাকাটি করলো অনেকক্ষণ ধরে।

যেন কেমন শূন্য হয়ে গেছে। একটা থমথমে ভাব নেমে এসেছে গাছের পাতায়। ঘরের চালে। উঠোনে। বাড়ির পেছনে। ছোট্ট পুকুরে আর সবার মনে। একটি লোক দীর্ঘদিন ধরে যে একবারও ঘরের দাওয়ায় বেরুতে পারেনি, বিছানায় পড়েছিলো! যার অস্তিত্ব ছিলো কি ছিলো না সহসা অনুভব করা যেতো না। সে লোকটা আজ নেই। কিন্তু তার এই না-থাকাই যেন সমস্ত থাকার অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করছে।

সারা দুপুর টুনি কাঁদল।

সারা বিকেল।

সারা সন্ধ্যা।

সালেহা অনেক চেষ্টা করলো। ওকে কিছু খাওয়াতে। সে খেলো না।

ফকিরের মা বললো, কিছু খাও বউ। না খাইলে শরীর খারাপ অইয়া যাইবো। কিছু খাও।

তবু খেলো না টুনি।

মন্তু. সুরত আলী, আবুল, রশীদ কারো মুখে কোনো কথা নেই। কেউ দাওয়ায়, কেউ উঠোনে, কেউ দোরগোড়ায় বসে।

আজ সহসা যেনো সমস্ত কথা হারিয়ে ফেলেছে ওরা।

মিয়া-বাড়ির মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। মাথায় টুপিটা পরে নিয়ে গামছাটা কাঁধে চড়িয়ে নামাজ পড়তে চলে গেলো গনু মোল্লা, সুরত আলী, রশীদ। আর আবুলও উঠে দাঁড়ালো।

রোজ যে তারা নামাজ পড়ে তা নয়। কিন্তু আজ পড়বে। বুড়ো মকবুলের মৃত্যু হঠাৎ পরকাল সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে ওদের। পুকুর থেকে ওজু করে এসে সুরত আলী বললো, কই, যাইবা না মন্তু মিয়া?

মন্তু ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, চলো। বলতে গিয়ে গলাটা অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠলো ওর।

দিন তিনেক পর নৌকা নিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল মন্তু।

টুনি ডাকলো, শোনো।

মন্তু তাকিয়ে দেখলো এ কয়দিনে ভীষণ শুকিয়ে গেছে টুনি।

চোয়ালের হাড়দুটো বেরিয়ে পড়েছে; চোখের নিচে কালি পড়েছে তার।

মুখখানা বিষন্ন। মাথায় ছোট একটা ঘোমটা।

মন্তু বললো, কী।

টুনি চারপাশে তাকিয়ে আস্তে করে বললো, আমার একডা কথা রাইখবা?

মন্তু বললো, কও।

মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো টুনি। তারপর আস্তে করে বললো, আমারে একদিন সময় কইরা আমাগো বাড়ি পৌছায়া দিয়া আইবা? টুনির চোখজোড়া পানিতে ছলছল করছে। বুড়ো মকবুলের মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে এ বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে টুনির। আর কতদিন এখানে এমনি করে পড়ে থাকবে সে।

মন্তু আস্তে করে বললো, ঠিক আছে যামুনি। কোনদিন যাইবা?

টুনি মৃদু গলায় বললো, যেইদিন তোমার সুবিধা হয়। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো সে।

মন্তু বিব্ৰতবোধ করলো। কী বলে যে ওকে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে পেলে না সে। টুনি একটু পরে কান্না থামিয়ে বললো, বড় ইচ্ছা আছিল তোমার বিয়া দেইখা যামু, তোমার হাতে মেন্দি পরাইয়া যামু। থাকন আর গেলো না।

এ কথার আর উত্তর দিলো না মন্তু। গাঁয়ে সবাই জানে, সামনের শীতে আম্বিয়াকে বিয়ে করছে ও। টুনিও জানে।

কাপড়ের আঁচলে চোখের পানি মুছে টুনি আবার বললো, বিয়ার সময় আমারে নাইয়র আনবা না?

নিস্তেজ গলায় মন্তু পরীক্ষণে বললো, আনমু।

সহসা ওর চোখের দিকে মুখ তুলে তাকালো টুনি। একটুকরো ম্লান হাসিতে ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠলো ওর। আস্তে করে বললো, কথা দিলা মনে থাহে যেন।

মন্তু বললো, থাকবো।

একে-একে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিল টুনি।

সবার গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষপ করে কান্দলো সে।

পরীর দীঘির পাড়ের উপর দিয়ে আসার সময় দূর থেকে বুড়ো মকবুলের কবরটি চোখে পড়লো। শুকনো মাটির সাদা ঢেলাগুলো ঢিপির মতো উঁচু হয়ে আছে। সেদিকে তাকাতে সারা দেহ কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী এক অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে যেন।

ভাটার স্রোতে নৌকো ভাসিয়ে দিলো মন্তু।

সেই নৌকো।

যার মধ্যে চড়িয়ে টুনিকে তার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলো সে; দু-ধারে গ্রাম। মাঝখানে নদী। যতদূর চোখ পড়ে শুধু অথৈ জলের ঢেউ। বর্ষার পানিতে নদী নালা ক্ষেত সব এক হয়ে গেছে। এ সময়ে ভরা নদী দিয়ে নৌকো চালানোর প্রয়োজন হয় না। ক্ষেতের ধারে গোরস্থ-বাড়ির পেছনের ডোবার পাশে দিয়ে নৌকো চালিয়ে নেয়া যায়। এতে করে পথ অনেক সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে।

টুনি ছইয়ের মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো; মাথায় ছোট একখানা ঘোমটা।

মন্তু সহসা বললো, বাইরে আইসা বসো না। গায়ে বাতাস লাইগবো।

টুনি পরক্ষণে বললো, আইতাছি।

কিন্তু সহসা এলো না সে। বাইরে কাঠের পাটাতনের উপরে ছোট হয়ে বসলো সে।

সেই নদী।

আগে যেমনটি ছিলো তেমনি আছে।

আজ নদীর জলে হাতের পাতা ডুবিয়ে দিয়ে খেলা করলো না টুনি। উচ্ছল দৃষ্টি মেলে দু তাকালো না কোনো দিকে।

শুধু বললো, আম্বিয়ারে বিয়া কইরলে এই নাওড়া তোমার আইয়া যাইবো না?

মন্তু সংক্ষেপে বললো, হুঁ।

টুনি বললো, বিয়ার পরে এই বাড়িতে থাকবা, না আম্বিয়াগো বাড়ি চইলা যাইবা?

এ কথার কোনো জবাব দিলো না মন্তু। সে শুধু দেখলো ঘোমটার ফাঁকে একজোড়া চোখ গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

উত্তর না-পেয়ে টুনি আবার বললো, চুপ কইরা রইলা যে?

মন্তু হঠাৎ দূরে আঙুল দেখিয়ে বললো, শান্তির হাট।

টুনি চমকে তাকালো সেদিকে।

ভাটার স্রোতে ঠেলে নৌকোটা ধীরেধীরে এগিয়ে চলেছে শান্তির হাটের দিকে। সার বাঁধা দোকানগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।

সহসা জোরে দাঁড় টানতে লাগলো মন্তু। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো নৌকো। পড়তে গিয়ে সঙ্গেসঙ্গে নিজেকে সামলে নিলো টুনি। মাথার উপর থেকে ঘোমটাটা পড়ে যেতে পরীক্ষণেই সেটা তুলে নিলো আবার।

মন্তু একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গভীরভাবে কী যেন দেখছে সে।

নৌকোটাকে ঘাটের দিকে এগুতে দেখে টুনি বললো, ঘাটে ভিড়াইতাছ কান, নামবা নাকি?

মন্তু চুপ করে রইলো।

টুনি আবার বললো, হাটে কি কোনো কাম আছে?

মন্তু মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ মরিয়া গলায় বললো, মনোয়ার হাজীরে কথা দিছিলাম ওর ওইখানে এক রাইতের লাইগা নাইয়ার থাকুম। চলো যাই।

টুনির দেহটা ধরে কে যেন একটা সজোরে নাড়া দিল। মুহূর্তে চোখজোড়া পাথরের : মতো স্থির হয়ে গেল ওর। মন্তুর মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে।

মন্তু আবার বললো, মনোয়ার হাজীরে কইলে ও মোল্লা ডাইকা সব ঠিক কইরা দিব। আবেগে গলাটা কাঁপছে ওর।

টুনির চোখের কোণে তখন দু-ফোটা জল চিকচিক করছে। অত্যন্ত ধীরেধীরে মাথাটা নাড়ালো সে; আর অতি চাঁপা-স্বরে ফিসফিস করে বললো, না তা আর অয় না মিয়া। তা অয় না। বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।

হাতের বৈঠাটা ছেড়ে দিয়ে বোবা চাউনি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু। একটা – কথাও আর মুখ দিয়ে বেরুলো না ওর।

তারপর

তারপর নদীর স্রোত বয়ে চললো। কখনো ধীরে কখনো জোরে; কখনো মিষ্টি মধুর ছন্দে।

সেদিন হাটবার। সওদা করে বাড়ি ফিরছে মস্তৃ। দু-পয়সার পান। একআনার তামাক আর দশপয়সার বাতাসা কাৰ্তিকের শেষে অগ্রহায়ণের শুরু। ঘরে ঘরে ধান উঠছে। অনেক রাত পর্যন্ত কারো চোখে ঘুম থাকে না। কাজ আর কাজ। সারাদিন ধান কেটে এনে পালা দিয়ে রাখে। রাতে গরু দিয়ে মাড়ায়। তারপর ঝেড়েমুছে সব পরিষ্কার করে রাখতে রাখতে রাত অনেক গড়িয়ে পড়ে।

হাট থেকে বাড়ি ফিরে এসে মন্তু দেখে, উঠোনে আসর জমিয়ে বসে পুঁথি পড়ছে সুরত আলীর বড় ছেলেটা। মৃত বাবার এ গুণটি অতি সুন্দরভাবে আয়ত্ত্ব করেছে সে। দূর থেকে শুনলে অনেক সময় বোঝাই যায় না। মনে হয় সুরত আলী বুঝি বসে বসে পুঁথি পড়ছে।

শুন শুন বন্ধুগণৱে শুন দিয়া মন।

ভেলুয়ার কথা কিছু শুন সর্বজন।

আজ উঠোনে এসে দাঁড়াতে ওদের সবার কথা মনে পড়লো মন্তুর।

বুড়ো মকবুল, রশীদ, আবুল, সুরত আলী।

কেউ নেই।

জীবনের হাটে সকল বেচাকেনা শেষ করে দিয়ে একদিন আকষ্মাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ওরা।

টুনির সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক বছর। প্রথম-প্ৰথম খোঁজখবর নিতো। আজকাল সে সময় হয়ে ওঠে না মন্তুর। সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে।

হীরন আজকাল বুড়ো মকবুলের ঘরে থাকে। বহু আগে প্রথম স্বামী তালাক দিয়েছে ওকে। আবার বিয়ে হয়েছিলো। বছর তিন-চারেক ঘর-সংসার করার পর সেখান থেকেও তালাক পেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। তারপর আর বিয়ে হয়নি।

এবার ওর একটা ভালো দেখে বিয়ে দেবার চেষ্টা করছে মন্তু। এখন সে বাড়ির কর্তা। সবার বুড়ো। যে-কোনো কাজে সবাই এসে পরামর্শ নেয় ওর।

উঠোনে এসে দাঁড়াতে ওর হাত থেকে পান, তামাক আর বাতাসাগুলি এগিয়ে নিলো আম্বিয়া। তারপর কোলের বাচ্চাটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, দুপুর থাইকা কানছে, একটু কোলে নাও।

কোলে নিয়ে ছেলেকে আদর করলে সে। মন্তুকে এগিয়ে আসতে দেখে সবাই পথ ছেড়ে আসরের মাঝখানে বসালো ওকে। এক ছিলিম তামাক সাজিয়ে এনে হাতে দিয়ে গেলো আম্বিয়া।

ধীরেধীরে রাত বাড়তে লাগলো। চাঁদ হেলে পড়লো পশ্চিমে। উঠোনের ছায়াটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। পরীর দীঘির পাড়ে একটা রাতজাগা পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেলো। সুরত আলীর ছেলেটা তখনো একটানা পুঁথি পড়ে গেলো।

কি কহিব ভেলুয়ার রূপের ব্যাখান।

দেখিতে সুন্দর অতিরে রসিকের পরাণ।

আকাশের চন্দ্ৰ যেনরে ভেলুয়া সুন্দরী

দূরে থাকি লাগে যেন ইন্দ্ৰকূপের পরী।

সুর করে চলে একমনে পুঁথি পড়ছে সে। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত।

Leave a Reply