নবীনগরের ছোট খালে এসে নাওয়ের নোঙর ফেললো মন্তু।
খালপাড়ে উঠে দাঁড়ালে টুনিদের বাড়ির লম্বা নারকেল আর তালগাছগুলো দেখা যায়। আর সেই তাল-নারকেলের বনের ফাঁকে ওদের দেউড়ি-ঘরটাও চোখে পড়ে এখান থেকে।
নৌকা থেকে নামবার আগে মুখ-হাতটা ভালো করে ধুয়ে নিলো মন্তু। পুরনো লুঙিটা পালটে নিয়ে নতুন লুঙিটা পরলো, ফতুয়াটা খুলে জামাটা গায়ে দিলো সে। তারপর খদ্দরের চাদরটা কাঁধে ফেলে, পুরনো ছাতাটা বগলে নিয়ে ধীরেধীরে নৌকো থেকে নেমে এলো মন্তু।
কিছুদূর এসে পকেট থেকে টুপিটা বের করলো।
আসার সময় বুড়ো মকবুল বারবার করে বলে দিয়েছে, কুটুমবাড়িতে গিয়ে যেন মন্তু এমন কিছু না করে যার ফলে বাড়ির বদনাম হতে পারে। টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো মন্তু। পথঘাট জানা আছে ওর। এর আগে মকবুলের বিয়ের সময় একবার এসেছিলো সে। দিন তিনেক থেকে গিয়েছে এখানে। রাস্তায় দু-চারজন অপরিচিত লোক ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ওকে।
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুর উড়ে যাচ্ছে এ—গ্রাম থেকে ও—গ্রামে! একটু-একটু করে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। এদিকের লোকেরা এরমধ্যে খেজুরগাছ কেটে রস নামাতে শুরু করে দিয়েছে। পথে আসতে তিন-চারজন গাছুনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো মন্তুর। ধারালো বাটাল দিয়ে গাছ কাটছে ওরা। তারপর মাটির কলসি ঝুলিয়ে দিয়ে নেমে আসছে গাছ থেকে।
টুনিদের বাড়ির সামনে এসে যার সঙ্গে মন্তুর প্রথম দেখা হলো সে টুনির চাচা মোতালেৰ শিকদার। সন্ধেবেলা গরু-বাছুরগুলোকে ঠেঙিয়ে গোয়ালঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। মন্তুকে আসতে দেখে হা করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, মন্তু মিয়া না? কী মনে কইরা।
মন্তু এগিয়ে এসে পা ধরে সালাম করলো ওর। তারপর বললো, ভাইজান পাডাইছে, টুনি ভাবীরে নিবার লাইগা।
অ। মুখখানা ঈষৎ ফাঁক করে গরুগুলোকে ঠেঙাতে ঠেঙাতে আবার গোয়ালঘরের দিকে চলে গেলে মোতালেব শিকদায়।
একটু পরে আবার ফিরে এল সে। বললো, আয়েন ভিতরে আয়েন।
টুপিটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিলো মন্তু, তারপর শিকদারের পিছুপিছু ভেতরে-বাড়িতে এগিয়ে চললো সে।
ভেতর-বাড়ির পর্দা রক্ষা করা হয়েছে। তারই পাশে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখের মধ্যে আঙুল পুরে দিয়ে অবাক চোখে দেখছে ওরা।
ভেতর-বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতে মন্তু দেখলো, ঘরের দাওয়ায় একটা বাঁশের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে টুনি। সারামুখে ওর হাসি যেন উপচে পড়ছে। নীরবে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
মন্তুকে টুনিদের ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল শিকদার।
রসুইঘর থেকে টুনির মা বেরিয়ে এলো বাইরে। মন্তু সালাম করলো তাকে।
মা বললো, কইরে টুনি। মিয়ারে একখানা জলচকি আইনা দে, বউক।
চৌকি এনে দিলে দাওয়ায় বসলো মন্তু।
টুনির মা সবার কুশল জানতে চাইলো। টুনি কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, শুধু মুখ টিপে বারবার হাসতে লাগলো সে।
টুনির মা বললো, টুনি তো কদিন ধইরা যাওনের লাগি উথালপাথাল লাগাইছে।
উ। যাইবো। যমুনা আমি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো টুনি।
মা বললো, দাঁড়ায়া থাইকো না। মিয়ার অজুর পানি দাও।
মন্তুর জন্যে হাতমুখ ধোয়ার পানি আনতে চলে গেল টুনি। মাও গেলো একটু পরে, বললো, তরকারিটা নামাইয়া আই।
চারপাশটা তাকিয়ে দেখছিল মন্তু। এ ক-বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে বাড়িটার। উঠানের কোণে পাশাপাশি দুটো জামগাছ ছিলো। কেটে ফেলা হয়েছে। রান্নাঘরের একপাশটা নুয়ে পড়েছে এখন। আগে অমনটি ছিলো না। আগে গোয়ালঘরটা পুকুরের পুবপাশে ছিলো, এখন সেটা উত্তরপাশে সরিয়ে আনা হয়েছে।
টুনি একটি পানি রাখলো ওর সামনে, আর একজোড়া খড়ম। বললো, হাতমুখ ধুইয়া নাও।
মন্তু মুখ-হাত ধুয়ে নিলে ওর দিকে একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে টুনি বললো, চলো ভেতরে চলো, বাইরে শীত পড়তাছে।
মন্তু কোনো কথা বললো না। শান্ত শিশুর মতো ওকে অনুসরণ করে ভেতরে চলে গেলো সে।
পাশাপাশি দুটো ঘর। মাঝখানে একটা দরজা! ও পাশেরটাতে মা-বাবা থাকে আর টুনির ছোট-ছোট দুই ভাইবোন। এ পাশের ঘরটা দেখিয়ে টুনি মৃদু হেসে বললো, এইডা আমার ঘর।
ওর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো মন্তু। ছোটঘর মালপত্রে ভরা। কয়েকটা বড়বড় মাটির ঘটি এককোণে রাখা, তার পাশে তিন-চারটে বেতের ঝুঁড়ি। ঝুড়ি-ভর্তি লাল আলু রাখা আছে! দক্ষিণকোণে একটা কাঠের চৌকি। চৌকির ওপরে একটা কাঁথা বিছানো। একটা তেল চিটচিটে বালিশ। চৌকির নিচে দুটাে ছোট ছোট টিনের প্যাটরা। পশ্চিমের বেড়ার সঙ্গে একটা কাঠের তাক বসানো হয়েছে। তাকের ওপরে রাখা আছে কয়েকটা ছোট ছোট মাটির ভাঁড় আর একটা মুড়ির টিন। তারপাশে বেড়ার সঙ্গে একটা ভাঙা আয়না ঝোলানো। উত্তরকোণে একটা দড়ির সঙ্গে ঝুলছে টুনির দু-খানা শাড়ি, ব্লাউজ আর একটা ময়লা কাঁথা। তাছাড়া ঘরের ঠিক মাঝখানে চিলেকাঠের সঙ্গে কতগুলো ছিকে। ছিকের মধ্যে কয়েকটা হাঁড়িপাতিল রাখা।
মন্তু মুহুর্তে চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো ঘরটার ওপর।
টুনি চৌকিটা দেখিয়ে বললো, এইখানে বও।
মন্তু বসলো।
কিছুক্ষণ ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে টুনি বললো, অমন শুকায়া গেছ ক্যান?
মন্তু পরক্ষণে বললো, কই না, শুকাই নাই তো।
টুনি মৃদু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মন্তুর মনে হলো, এ ক-মাসে টুনি অনেক পালটে গেছে। ওর দেহ পা আগের থেকে অনেক বড় হয়ে গেছে আর পায়ের রঙে একটা চিকচিকে আভা জেগে উঠেছে। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে টুনি।
রাতে টুনির ঘরে ওর শোবার বন্দোবস্ত হলো। ময়লা কাঁথাটার ওপর ওর একখানা শাড়ি বিছিয়ে দিলো। বালিশটাকে ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে দিলো। তারপর বললো, আর বইসা থাইকো না, শুইয়া পরো।
মন্তু বললো, বেহান রাইতে কিন্তুক রওয়ানা দিতে অইবো।
ওর কথা শেষ না হতে শব্দ করে হেসে দিলো টুনি। বললো, ইস, কইলেই আইলো। তারপর একটুকাল থেমে আবার বললো, সে কম কইরা আইলেও তিনদিন আমাগো বাড়ি বেড়ান লাগবো। তারপরে যাওনের নাম।
মন্তু বললো, পাগল অইছ? তাইলে ভাইজানে মাইরা ফালাইবো আমারে। করিম শেখের নাও নিয়া আইছি…আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলো সে।
টুনি বললো, যাই শুই গিয়া, কথা যা অইবার কাইল সকালে অইবো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল সে।
কুপিটা নিবিয়ে দিয়ে একটু পরে শুয়ে পড়লো মস্তু। করিম শেখের কথা মনে হতে অম্বিয়ার কথাও মনে পড়ছে তার।
এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথে টুনিকে সব বলবে মন্তু। টুনি নিশ্চয় এ ব্যাপারে সাহায্য করবে ওকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।
ঘুম ভাঙলো কখন সে ঠিক বলতে পারবে না। রাতের গভীর অন্ধকারে সে শুধু অনুভব করলো একটা হাত তার চুলগুলো নিয়ে খেলছে। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো মন্তু।
গনু মোল্লার কাছ থেকে নেয়া তাবিজটা বাহুতে বাঁধা আছে কিনা দেখলো। তারপর কে যেন চাপাস্বরে ওকে ডাকলো, এই ৷
সহসা কোনো সাড়া দিলো না মন্তু। হঠাৎ ওর হাতখানা শক্ত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলো সে। নরম তুলতুলে একখানা হাত।
একটা অস্পষ্ট কাতরোক্তি শোনা গেলো, উহ্ এই।
পরমুহূর্তে হাতখানা ছেড়ে দিলো মন্তু। টুনি?
ইস, কথা কয়ো না। মায় হুনব। ওর মুখের ওপরে একখানা হাত রাখলো টুনি। তারপর মুখখানা আরো নামিয়ে এসে আস্তে করে বললো, চুপ, শব্দ কইরো না। শোনো, চুপচাপ উইঠা আইও আমার সঙ্গে।
কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মন্তু। টুনির মুখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দুর্গ রইলো ও। তারপর ধীরেধীরে উঠে বসলো।
বাইরে এসে দেখলো টুনির হাতে একটা মাটির কলস। শীতে দুজনে রীতিমতো কাঁপছিলো।
মন্তু প্রশ্ন করলো, কী, কী অইছে।
টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, কিছু অয় নাই, এদিকে আইও।
ওর একখানা হাত ধরে অন্ধকারে টেনে নিয়ে চললো। বার-বাড়িতে এসে মন্তু আবার প্রশ্ন করলো, কই চললা?
টুনি শব্দ করে হাসলো আবার। বললো, কলসি গলায় দিয়ে দুইজনে পুকুরে ডুইবা মরুম চলো। তারপরেই মন্তুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সহসা প্রশ্ন করল সে, আমার সঙ্গে মরতে পারবা না?
কী উত্তর দেবে ভেবে পেলো না মন্তু। কিন্তু তার উত্তরের অপেক্ষা না-করে আবার হেসে উঠলো টুনি। হাসির দমকে দেহটা বারবার দুলে উঠলো তার। বললো, ঘাবড়ায়ো না মিয়া, তোমারে মারুম না।
বলে আবার চলতে লাগলো।
এতক্ষণ এত অবাক হয়ে গিয়েছিলো মন্তু যে শীতের প্রকোপটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতে-না-যেতে প্ৰচণ্ড শীতে দাঁতে দাঁত লেগে এলো ওর।
একটা লম্বা খেজুরুগাছের নিচে এসে দাঁড়ালো টুনি। কলসিটা মস্তুর হাতে দিয়ে বললো, এইটা রাখো হাতে।
তারপর পরনের শাড়িটাকে লুঙির মতো গুটিয়ে নিল সে। মন্তু কাঁপা গলায় শুধালো, কী করো?
ওর প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না টুনি। নির্বিকারভাবে খেজুরগাছটা বেয়ে উপরে উঠে গেলো সে।
মন্তুর মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে। একটু পরে একহাতে রসের হাঁড়িটা নিয়ে অন্যহাতে গাছ বেয়ে ধীরেধীরে নিচে নেমে এলো টুনি। কলসির মধ্যে রসটা ঢেলে হাঁড়িটা রেখে আসার জন্য আবার উপরে যাচ্ছিলো টুনি। মন্তু বললো, আরো কী করো। গাছ এখন পিছল। পইড়া যাইবা।
পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসলো টুনি। বললো, ইস্ কত উঠছি।
পাশের ঝোপ থেকে দুটাে শিয়াল ছুটে এসে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে মন্তুর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখজোড়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ওদের। মন্তু একটা ধমক দিতে ছুটে পালিয়ে গেলো ওরা।
টুনি নেমে এসে বললো, কারে ধমকাও?
মন্তু আস্তে করে বললো, শিয়াল।
আরো অনেকগুলো খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে কলসি ভর্তি করলো ওরা।
শীতের কুয়াশার বৃষ্টি ঝরিছে চারদিকে। মাটি ভিজে গেছে। গাছের পাতাগুলোও ভেজা। আশেপাশে তাকাতে গেলে বেশিদূরে দেখা যায় না। কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে চারদিক। হঠাৎ মন্তুর গায়ে হাত দিয়ে টুনি বললো, শীত লাগিতাছে বুঝি?
মন্তু কোনো জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো, তোমার লাগে না?
টুনি বললো, উঁহু। বলে মাথাটা দোলালো সে।
মন্তু বললো, রস দিয়া করবা কী?
টুনি বললো, সিন্নি রান্দুম।
মন্তু কোনো কথা বলার আগেই টুনি আবার বললো, তোমার নায়ে চলো।
মন্তু অবাক হলো, নায়ে গিয়া কী করবা?
টুনি নির্লিপ্ত গলায় বললো, সিন্নি রান্দুম।
মন্তু বললো, পাগল হইছ?
টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, হুঁ। মন্তুর মুখের দিকে তাকালো সে, কই নাওয়ে যাইবা না।
মন্তু কঠিন স্বরে বললো, না।
ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো টুনি। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহুর্তে একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো সে। হাতের কলসিটা উপরে তুলে মাটিতে ছুড়ে মারলো। মাটিতে পড়ে মাটির কলসি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রস গড়িয়ে পড়লো চারপাশে।
কিছুক্ষণের জন্য দুজনে বোবা হয়ে গেল।
কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরুলো না।
মন্তু নীরবে তাকিয়ে রইলো ভাঙা কলসির টুকরোগুলোর দিকে।
টুনি মুখখানা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পুকুরপাড়ে লম্বা তালগাছগুলোর মাথায় দুটো বাদুর হঠাৎ পাখা ঝাপটিয়ে উঠলো।
টুনি আস্তে করে বললো, চলো ঘরে যাই, চলো।
মন্তু কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করলো শুধু।
পরদিন যাওয়া হলো না মন্তুর।
টুনির মা বললো, কুটুমবাড়ি আইয়ে নিজের ইচ্ছায়, আর যায় পরের ইচ্ছায়। ইচ্ছা! করলেই তো আর যাইতে পারব না মিয়া। যহন যাইতে দিমু তহন যাইবা।
অগত্য থেকে যাওয়া হলো।
সারাদিন একবারও কাছে এলো না টুনি। অথচ সারাক্ষণ বাড়িতে ছিলো সে। ঘরদের ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ঘাটে নিয়ে বাসনপত্র ধুয়ে এনেছে। রান্নাবান্না করেছে।
তারপর খাওয়ার সময় মা ডেকে বলেছে, কইরে টুনি এইদিকে আয়। মন্তু মিয়াকে ভাত বাইড়া দে।
তখন শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থেকেছে সে। রাতের বেলা হঠাৎ বেঁকে বসলো টুনি। বললো, কাল সক্কালবেলাই চইলা যমু আমি। জিনিসপত্র সব গুছাইয়া দাও।
মা বললো, আরো দুইটা দিন থাইকা যা। আবার কবে আইবার পারবি কে জানে।
টুনি বললো, না, মন্তু মিয়ার কামকাজের ক্ষতি অইয়া যাইতেছে।
মা বললো, মন্তু মিয়াকে বুঝাইয়া কইছি। হে রাজি আছে।
টুনি তবু বললো, না কাল সক্কালেই চইলা যামু।
পাশের ঘরের বিছানায় শুয়ে—শুয়ে সব শুনলো মন্তু।
পরদিন ভোরে রওনা হয়ে গেলো ওরা।
মন্তু আর টুনি।
ওর বাবা আর চাচা দুই শিকদার খালপাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো ওদের। সঙ্গে ছোট দুই ভাইবোনও এলো। আর এলো ওদের কালো কুকুরটা।
ছই-এর মধ্যে টুনির জন্যে কাঁথাটা বিছিয়ে দিয়েছিল মন্তু। তার ওপর গুটিসুটি হয়ে বসালে সে।
খালের পাড়ে যতক্ষণ তার বাবা, চাচা আর ভাইবোনদের দেখা গেলো ততক্ষণ সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো টুনি।
তারপর মুখখানা ঘুরিয়ে এনে নীরবে বসে রইলো।
খাল পেরিয়ে যখন নৌকো নদীতে এসে পড়লো তখন দুপুর হয়ে আসছে। টুনি এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। মন্তু সারাক্ষণ কথা বলার জন্য আকুপাকু করছিলো। কিন্তু একবারও সুযোগ দিলো না টুনি। উজান নদীতে দাঁড় বেয়ে চলতে চলতে একসময়ে মন্তু বললো, বাইরে আইয়া কহো, গায়ে বাতাস লাগবো।
ও নড়েচড়ে বসলো কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এলো না।
একটু পরে একটা কাপড়ের পুঁটুলি থেকে কিছু চিড়া আর একটুকরো খেজুরের গুড় বের করে ওর দিকে, এগিয়ে দিলো টুনি। বললো, বেলা অইয়া গেছে খাইয়া নাও। বলে আবার চুপ করে গেলো সে।
মন্তু বললো, তুমি খাইবা না?
না।
না ক্যান?
ক্ষিধা নাই।
ঠিক আছে আমারও ক্ষিধা নাই। বলে আবার দাঁড় বাইতে লাগলো মন্তু। নদীর পানিতে দাঁড়ের ছপছপ শব্দ ছাড়া কিছুক্ষণ আর কিছুই শোনা গেলো না।
ক্ষণকাল পরে টুনি আবার বললো, খাইবা না?
না।
শেষে শরীর খারাপ করবো।
করুক গা। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল মন্তু।
আর বেশিক্ষণ ছাঁইয়ের ভেতর বুসে থাকতে পারলো না টুনি। অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। চিড়ার বাসনটা তুলে নিয়ে ওর সামনে এসে বসলো।
নাও, খাও।
কইলাম তো খামু না।
তাইলে কিন্তুক পানির মধ্যে সব ফালাইয়া দিমু আমি। টুনি ভয় দেখালো ওকে।
মন্তু নির্বিকার গলায় বললো, দাও ফালিইয়া।
কিন্তু ফেললো না টুনি। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো সে। হাসির দমকে মাথার ঘোমটাটা খসে পড়লো কাঁধের ওপর।
টুনি বললো, আমি খাওয়াইয়া দিই?
মন্তু বললো, না।
টুনি বললো, তাইলে নিজে খাও। আমিও খাই। বলে একমুঠো চিড়ে মুখের মধ্যে পুরে দিলো সে।
মন্তুর মুখেও একঝালক হাসি জেগে উঠলো। এতক্ষণে টুনির কোলের ওপরে রাখা বাসন থেকে একমুঠো চিড়ে নিয়ে সেও মুখে পুরলো।
টুনি বললো, গুড় নাও। খাজুরি গুড়।
চিড়ে খেতে খেতে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সহজ হয়ে এলো টুনি। একফাঁকে ওকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি পৌছাইতে কতক্ষণ লাগবো?
মন্তু একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, মাইজ রাতে।
বেশ জোরে দাঁড় বাইছিলো মন্তু। হঠাৎ টুনি বললো, এত তাড়াতাড়ি করতাছ ক্যান? আস্তে বাও না।
মন্তু বললো, তাইলে বাড়ি যাইতে তিনদিন লাগবো।
লাগে তো লাগুক না। টুনির কণ্ঠস্বরে চরম নির্লিপ্ততা।
মন্তু কোনো জবাব দিলো না।
আঁজলা ভরে নদীর পানি পান করলো ওরা। তারপর ছইয়ের বাইরে বসে টুনি দু-হাতে নদীর পানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো। দু-পাশের অসংখ্য গ্রাম। একটার পর একটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝেমাঝে রবিশস্যের ক্ষেত, নারকেল আর ঘন সুপুরির বন। জেলেদের পাড়া। ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় চড়ে মাঝনদীতে এসে জাল ফেলেছে ওরা।
একখানা হাত পানির মধ্যে ছেড়ে দিয়ে টুনি বললো, তুমি এইবার জিরাও। আমি দাঁড় টানি।
মন্তু হেসে বললো, পাগল নাকি?
টুনি বললো, ক্যান?
মন্তু বললো, অত সহজ নয়, দাঁড় বাইতে ক্ষেমতার দরকার আছে।
টুনি আবার চুপ করে গেলো।
বিকেলের দিকে শান্তির হাটের কাছাকাছি এসে পৌছলো।ওরা। নদী এখন দম ধরেছে। পানিতে আর সেই স্রোত নেই। একটা থমথমে ভাব। একটু পরে জোয়ার আসবে। তখন আর নৌকো নিয়ে এগানো যাবে না। কুলে এসে বেঁধে রাখতে হবে। তারপর জোয়ার নেমে গিয়ে ভাটা পড়লে তখন আবার নৌকো ছাড়বে মন্তু।
দূর থেকে শান্তির হাটটা দেখা যাচ্ছে।
অসংখ্য লোক গিজগিজ করছে সেখানে।
ওদিকে তাকিয়ে টুনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ওইহানে কী?
মন্তু বললো, ওইটা শাস্তির হাট।
টুনি পানি থেকে হাতটা তুলে নিয়ে অপূর্ব ভঙ্গি করে বললো, ওইহানে চুড়ি পাওন যায়? আমারে কিনা দিবা?
মন্তুর ইচ্ছে, জোয়ার আসার আগে শন্তির হাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াবে। তাই সংক্ষেপে বললো, হু, দিমু।
শান্তির হাটে পৌঁছে, একটা নিরাপদ স্থান দেখে নৌকা বাঁধলো মন্তু। নদীর পাড়ে খালি জায়গাটায় তাঁবু পড়েছে একটা। বিচিত্র তার রঙ। বাইরে ব্যান্ডপার্টি বাজছে খুব জোরে জোরে। চারপাশে লোকজনের ভিড়।
হাটের কাছে আসার পর থেকে ছইয়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে টুনি। সেখান থেকে মুখ বের করে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, ওইহানে কী?
মন্তু বললো, সার্কাস পার্টি। সার্কাস পার্টি আইছে।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে টুনি আবার বললো, সেইটা আবার কী?
মন্তু বললো, নানা রকম খেলা দেহায় ওয়া। মানুষের খেলা, বাঘের খেলা। আরো কত কী?
বাঘের নাম শুনে ভয় পেয়ে গেলো টুনি। কিন্তু পরক্ষণে বললো, আমারে দেহাইবা?
মস্তুর কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু হাটের মধ্যে মেয়েমানুষ নিয়ে যাওয়াটা সমীচীন বলে মনে হলো না ওর। তাই বললো, না, তোমার যাইয়া কাজ নাই। তুমি বহ, আমি আইতাছি।
ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে সঙ্গেসঙ্গে ছইয়ের বাইরে বেরিয়ে এলো টুনি। বললো, ওমা, আমি একলা থাকবার পারুম না এহানে। তুমি যাইও না।
মুহূর্তে নিরাশ হয়ে গেলো মন্তু। ও নিজে এর আগে কোনোদিন সার্কাস দেখেনি। ভেবেছিলো এই সুযোগে একবার দেখে নেবে। কিন্তু টুনির কথায় ভেঙে পড়লো। সার্কাসের তাবুর দিকে চোখ পড়তে দেখলো শুধু পুরুষ নয়, অসংখ্য মেয়েছেলেও দলে দলে এসে ঢুকছে তাবুর মধ্যে।
মন্তু কী যেন ভাবলো। ভেবে বললো, আহো, দেরি কইরো না, আহে।
ওর পিছুপিছু নিচে নেমে এলো টুনি। মাথার ঘোমটাটা সে একহাত লম্বা করে দিয়েছে। আর সেই ঘোমটার ভেতর দিয়ে বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকায়ে দেখছে সে।
তাঁবুর সামনে বড় বড় দুটো হ্যাজাক জ্বলিয়ে দিয়েছে ওরা। একপাশে একদল লোক ব্যান্ড বাজাচ্ছে।
তাঁবুর দরজার ওপরে একটা মাচায় চড়ে দুটি মেয়ে ঘুরেঘুরে নাচছে। সারা গায়ে, মুখে নানা রকমের রঙ মেখেছে ওরা। টুনি অবাক হয়ে বললো, ওমা শরম করে না।
মন্তু বললো, শরম করবে ক্যান, ওরা মাইয়্যা লোক না, পুরুষমানুষ মাইয়্যা সাজছে।
অ! হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো টুনি।
দরজায় দাঁড়ানো লোকটার কাছ থেকে তিন আনা দামের দু-খানা টিকেট কাটলো মন্তু। ভেতরে ঢুকে দেখে ছেলে বুড়ো মেয়েতে তিলধারণের জায়গা নেই। তাবুর কোণে অল্প একটু জায়গা নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লো ওরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে সার্কাস শুরু হয়ে পেল। প্রথমে একটা মেয়ে দুটো লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা একখানা দড়ির উপর দিয়ে নির্কিকারভাবে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে হেঁটে চলে গেলো।
দর্শকেরা হাতে তালি দিয়ে উঠলো জোরে। তারপর এলো বিকটাকার লোক। হাতের মুঠোর উপরে তিনটে মানুষকে তুলে নিয়ে চৱকির মতো ঘোরাতে লাগলো সে।
সবাই একসঙ্গে বাহবা দিয়ে উঠলো। এরপর খুব জোরে ব্যান্ড বাজলো কিছুক্ষণ। তারপরেই এলো বাঘ। এসেই একটি হুঙ্কার ছাড়লো সে!
মন্তুর একখানা হাত ওর মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখলো টুনি। দু-চোখে ওর অপরিসীম বিস্ময়। ঘোমটার ফাঁকে একবার চারপাশে দর্শকদের দিকে তাকালো সে। তাকালো মন্তুর দিকে। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো বাঘের ওপর।
ইতিমধ্যে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে মন্তুর বুকের মধ্যে সিঁধিয়ে গেছে টুনি।
মন্তু নিজেও জানে না। কখন টুনিকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে সে।
সার্কাস শেষ হতে, দুজনের চমকে ভাঙলো। শক্ত করে ধরে রাখা মন্তুর হাতখানা মুহূর্তে ছেড়ে দিলো টুনি। তারপর মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মন্তু নিজেও কিছুক্ষণের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। ইতস্তত করে বললো, চলো। ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ঘাটে আসার পথে মনোয়ার হাজীর চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসতে হয়। মন্তুকে দেখে হাজী দোকান থেকে চিৎকার করে উঠলো, আরে মন্তু মিয়া কই যাও, শুন শুন।
মন্তু এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো, পারলো না।
আরে মিয়া কাজের কথা আছে গুইনা যাও। দু-হাতে ওকে কাছে ডাকলো মনোয়ার হাজী।
টুনি পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। ওর দিকে একপলক তাকিয়ে নিয়ে দোকালের দিকে এগিয়ে গেলো মন্তু। কাউন্টারের আরো অনেকগুলো লোক কথা বলছিলো।
হঠাৎ মনোয়ার হাজী শব্দ করে হেসে উঠে বললো, বাহরে বাহ বিবিজানেরে সঙ্গে নিয়ে সার্কাস দেখবার আইছ বুঝি?
সঙ্গে সঙ্গে আটজোড়া চোখ অদূরে দাঁড়ানো টুনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলো।
মন্তু কিছু বলবার আগেই মনোয়ার হাজী সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো, কহন করলা, অ্যাঁ? একবার খবর দিলা না। দাওয়াত করলা না। এইডা কেমন কথা?
হতবুদ্ধি মন্তু কী বলবে কিছু ভেবে পেলো না, সে শুধু ইতস্তত করে একবার মনোয়ার হাজীর দিকে, আরেকবার টুনির দিকে তাকালো স্বারকয়েক। এক বিচিত্র অনুভূতির আবেশে মনটা ভরে উঠেছে ওর।
মনোয়ার হাজী শুধালো, কোনো কাজ কাম নাইতো?
একটা ঢোক গিলে মন্তু বললো, কিছু চুড়ি কিনন লাগব।
হ্যাঁ, তা কিনবা না, নিশ্চয়ই কিনবা; একগাল হাসলো মনোয়ার হাজী। তারপর বললো, এহন চলো মিয়া ভাবীরে নিয়া আজকার রাতে আমাগো বাড়ি মেহমান অইবা।
মন্তু পরক্ষণে বাঁধা দিলো, না না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরন লাগবো।
ওর কথাটা কানো নিলো না মনোয়ার হাজী; সে জানালো, থাকার কোনো অসুবিধে হবে। না ওদের। বাড়িতে ঘর আছে অনেকগুলি, তারই একটিতে সুন্দর করে বিছানা পেতে দেবে। তাতে যদি মন্তুর আপত্তি থাকে, তাহলে আরও একটা ভালো বন্দোবস্ত করে দিতে পারে মনোয়ার হাজী। সার্কাস-পার্টির ওখানে হোটেল উঠেছে কয়েকটা। এক-একটা ঘর একটাকায় একরাতের জন্যে ভাড়া দেয় ওরা। সেখানেও ইচ্ছে করলে থাকতে পারে মন্তু , পান-খাওয়া দাঁতগুলো বের করে মনোয়ার হাজী বললো, আরে মিয়া, নতুন বউ নিয়া যদি একটু ফুর্তি না কইরবা তাইলে চলে কেমন কইরা। এইতো বয়স তোমাগো।
এই শীতেও ঘামিয়ে উঠেছে মন্তু। টুনির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, ও ভীষণ বিব্রত বোধ করছে।
ক্ষণকাল পর মন্তু বললো, আরেকদিন আইসা আপনাগো বাড়ি মেহমান হিমু। আজকা যাই।
ওরা আমন্ত্রণ রক্ষা না-করার জন্যে কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করলে মনোয়ার হাজী। অবশেষে বললো, আরেকদিন কিন্তুক আইবা মিয়া। আর হ্যাঁ, ভাবী সাহেবেরে সঙ্গে নিয়া আইবা কিন্তুক। বলতে বলতে টুনির দিকে তাকালো হাজী।
জোয়ার পড়ে যাওয়ায় ভাটার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। যেখানে লোকোটা বেঁধে রেখে গিয়েছিলো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ওটা। মাঝখানের জায়গাটা পানি আর কাদায় ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। ওর ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে অতি সাবধানে আঙুলের নখগুলো দিয়ে মাটি চেপে রাখতে হয়! নইলে যে-কোনো মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নিচে নামতে গিয়ে অন্ধকারে মস্তুর ফতুয়াটার একটি কোণ শক্ত করে ধরে রেখেছে টুনি। একটু অসতর্ক হতে পা পিছলে যাচ্ছিলো সে। মন্তু ধরে ফেললো; মাথার অচলটা কাঁধের উপরে গড়িয়ে পড়লো, একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করলে টুনি। কাঁধের ওপর থেকে ওর মুখখানা সরিয়ে দিতে গিয়ে মন্তু সহসা অনুভব করলো, টুনির দু-চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। নিঃশব্দে কাঁদছে টুনি।
ভাটিগাঙে নাও ভাসিয়ে দিয়ে নীরবে বসে রইলো মন্তু! মনটা আজ ভীষণ ভেঙে পড়েছে ওর। সারা দেহে আশ্চর্য এক অবসাদ। সেদিন রাতে রসের কলসটা ভেঙে ফেললো টুনি, তখনও এত খারাপ লাগেনি ওর। আজ কেমন একটা ব্যথা অনুভব করছে সে। বুকের নিচটায়। কলজের মধ্যে।
নৌকোর ছইয়ের ভেতরে চুপচাপ বসে রয়েছে টুনি। একটা কথা বলছে না সে, একটু হাসছে না।
হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলো মন্তু।
বন্ধু রে—
আশা ছিলো মনে মনে প্ৰেম করিমু তোমার সনে।
তোমারে নিয়া ঘর বাঁধমু গহিন বালুর চরে।
ও পরান বন্ধুয়ারে।।
নদীর স্রোত নৌকোর গায়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। যেন বহুদিনের এই স্নেহের টানকে চিরন্তন করে ধরে রাখার জন্যে প্রাণহীন কাঠের টুকরোগুলোকে গভীর আবেগে বারবার জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওরা। টুনি এখনো নীরব।
খালের মুখের কাছে নৌকো থামাতে হলো।
ভাটার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। পাতা পানিতে নৌকো নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না। এখানে অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ-না আবার জোয়ার আসে। জোয়ারের স্রোতে নৌকো নিয়ে ভেতরে চলে যাবে মন্তু। কিন্তু সে এখনো অনেক দেরি। ভোর রাতের আগে জোয়ার আসবে না।
নৌকো থামাতে দেখে টুনি এতক্ষণে কথা বললো, কি, নাও থামাইলা ক্যান?
হঠাৎ নিজের অজান্তে একটা কথা বলে বসলো মন্তু। বললো, বাড়ি যামু না। এইহানে থাকুম আমরা।
ক্যান! ক্যান? টুনির কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।
শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো মন্তু। ওর হাসিটা কাঁটা বাঁশের বাঁশির মতো শোনাল। নৌকো থেকে নোঙরটা তুলে নিয়ে নিচে নেমে গেলো মন্তু! ভালো করে মাটিতে পাতলে ওটা। নইলে জোয়ারের প্রথম ধাক্কায় মাঝনদীতে চলে যাওয়ার ভয় আছে। তারপর পা-জোড়া ধুয়ে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে টুনির প্রশ্নের উত্তর দিলো মন্তু।
জোয়ার না-আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে ওদের।
এইহানে? বলতে গিয়ে চারপাশে তাকালো টুনি।
আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। দক্ষিণে যতদূর তাকানো যায় অথৈ পানির ঢেউ। নদী এখানে বাঁব নিয়ে ঘুরে গেছে দূর সাগরের দিকে। কয়েকটা জেলে-নৌকো মাঝ— নদীতে টিমটিম বাতি জ্বলিয়ে জলে পাহারা দিচ্ছে। মাঝেমাঝে একে অন্যকে জোর গলায় ডাকছে ওরা। নিশির বাপ জাইগা আছনি, ও নিশির বাপরে কুই-কুই।
পশ্চিমে চর পড়েছে। বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে কোনো লোকালয় নেই। শুধু বালু আর বালু। তার উপরে আরো এগিয়ে গেলে সীমাহীন বুনো ঘাসের বন। দিনের বেলায় অসংখ্য গরু— বাছুর নিয়ে রাখাল ছেলেরা আসে এখানে, রাতে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে থাকে সমস্ত প্ৰান্তর। পুবে, ফেলে আসা নদী। এঁকেবেঁকে চলে গেছে শান্তির হাটের দিকে।
উত্তরে খাল। খালের পাড়ে অসংখ্য বুনো ফুলের বন। একটু ভালো করে তাকালে ওপারে তৈরি লম্বা সাঁকোটা নজরে আসে এখান থেকে। চারপাশে একপলক তাকিয়ে চুপ করে গেলো টুনি।
ও মাঝি। মাঝি-ও-কু-ই। জেলে-নৌকো থেকে কে যেন ডাকলো, কোনহানের নাও, অ্যাঁঃ
গলা চড়িয়ে মন্তু জবাব দিলো, পরীর দীঘি।
জবাব শুনে চুপ করে গেলো জেলেটা।
এতক্ষণ নৌকা বেয়ে আসছিলো বলে শীতের মাত্ৰাটা বুঝে উঠতে পারেনি মন্তু। তাড়াতাড়ি ছাঁইয়ের মধ্যে এসে ঢুকলো সে।
টুনি নড়েচড়ে একপাশে সরে গেলো। ছাঁইয়ের সঙ্গে ঝোলানো হুঁকো আর কল্কেটা নামিয়ে নিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে এক ছিলিম তামাক ধরিয়ে নিল মন্তু। তারপর আবার বাইরে বেরিয়ে এসে গলুয়ের উপর আরাম করে বসে তামাক টানতে লাগলো। দক্ষিণ থেকে কনকনে বাতাস বইছে জোরে।
আকাশে মেঘ।
মেঘের ফাঁকে আধখানা চাঁদ মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে আবার মুখ লুকুচ্ছে তাড়াতাড়ি।
টুনি ডাকলো। ওইহানে বইসা ক্যান, ভেতরে আহে।
মন্তু কোনো জবাব দিলো না। আপন মনে হুঁকো টানতে লাগলো সে। টুনি আবার ডাকলে, আহো না, বাইরে ঠাণ্ডা লাগবো। মন্তু নীরব।
আইবা না? টুনির কণ্ঠে অভিমান।
বাইরে বেরিয়ে এসে ওর হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে নিলো টুনি।
চলো, ভেতরে গিয়া শুইবা।
এবার আর কোনো বাধা দিলো না। নিঃশব্দে ছইয়ের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। ওর গায়ের উপর কাঁথাটা টেনে দিয়ে মাথার কাছে চুপচাপ বসে রইলো টুনি।
বাইরে কনকনে বাতাস। শূন্য-প্ৰান্তরের উপর দিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে দূর থেকে দূরে। সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে বসে রইলো।
ভোরে গ্রামে এসে পৌছলো ওরা
মন্তু আর টুনি।
পরীর দীঘির পাড়ে তিনটে নতুন কবর।
দূর থেকে দেখে বুক কেঁপে উঠলো তার। নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, কে মরলো?
ঘোমটার নিচে থেকে টুনিও চোখ বড় বড় করে দেখছিলো কবরগুলো। পথে আসতে মাঝি-বাড়ির কুদ্দুছের সঙ্গে দেখা হতে সব শুনলো মন্তু। প্রথম কবরটা এ গায়ের তোরাব আলীর। আশির উপরে বয়স হয়েছিলো ওর। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে চলাফেরা করতে পারতো না।
মরে বেঁচেছে বেচারা। নইলে আরো কষ্ট সহ্য করতে হতো।
দ্বিতীয় কবরটা আসকর ফকিরের। পেটে পিলে হয়েছিলো। প্রায় রক্তবমি করতো। বুড়োরা বলতো, শত্রুপক্ষ কেউ নিশ্চয় তাবিজ করেছে, নইলে অমন হবে কেন।
তার পাশের কবরটা হালিমার; আবুলের বউ হালিমা। গতকাল দুপুরে ঘরের মধ্যে হঠাৎ চিতল মাছের মতো তড়পাতে তড়পাতে মারা গেছে হালিমা।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল মন্তুর। হালিমার মৃত্যুর সংবাদে কাঁদতে শুরু করেছে টুনি। ঘোমটার নিচে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
ইতস্তত করে মন্তু বললো, কান্দ ক্যান, কাইন্দা কী আইব।
বাড়ি ফিরে এলে বুড়ো মকবুল গভীর অসন্তোষ প্ৰকাশ করলো। একদিন নয়, দুদিন নয়, চার চারটি দিন। দুশ্চিন্তায় বারবার ঘর-বার করেছে সে। আইতে এত দেরি অইলো ক্যান? অ্যাঁ।
মন্তু খুলে বললো সব। কুটুমবাড়িতে গিয়ে কুটুম যদি আসতে না দেয় তাহলে কী করতে পারে সে? তাছাড়া নদীতে যে জোয়ার-ভাটা আসে সেটাও কারো ইচ্ছেমতো চলে না। তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে ওদের।
মকবুল শুনলো সব, শুনে শান্ত হলো। তারপর, কোদালটা হাতে তুলে নিয়ে বাড়ির উপরের ক্ষেতটার দিকে চলে গেলো সে! যাবার পথে আমেনা আর ফাতেমাকে ডেকে গেলো মকবুল। মাটি কুপিয়ে সমান করে মরিচের চারা লাগাতে হবে।