» » এক : তারা ব্যানার্জী

বর্ণাকার

এক : তারা ব্যানার্জী

প্রকৃতির মতো মনুষ্যসমাজও কত বিচিত্র। প্রকৃতিতে কোথায়ও সমভূমি ধূসর সুজলা সুফলা আবার কোথায়ও বারি বিন্দুহীন মরুভূমি। একদিকে সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নাগাধিরাজ হিমালয় পর্বত আর নিয়ে বয়ে চলেছে মহাসমুদ্র। কোথায়ও জ্যৈষ্ঠর দাবদাহ, কোথায়ও-বা হিম প্রস্রবণ বা তুষারপাত।

একা একা বসে যখন ভাবি আমার জীবনটাও তো এমনি! প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মতো স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, লজ্জা, রোষ, করুণার সমাহার। এ জীবনে সব কিছুরই স্পর্শ আমি পেয়েছি। কখনও মৃদু কোমল স্পর্শ বা আঘাত আবার কখনো অশনি পতনের দাবদাহ। সেকথা, আমার সে অনুভূতির গভীরতাকে কখনও দ্বিতীয় ব্যক্তির শ্রবণগোচর করবো এমন সাহস আমার ছিল না। কারণ এ সাহস প্রকাশের শিক্ষা শৈশব থেকে কখনও পেয়ে আসি নি। নামতা পড়ার মতো শুধু আউড়িয়েছি আমি মেয়ে, আমাকে সব সইতে হবে। আমি হবো ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা। প্রতিবাদের একটিই পথ, সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা বা পাতাল প্রবেশ। সীতা ছিলেন দেবী। তাই ও দু’টোর কোনোটারই সদ্ব্যবহার আমি করতে পারি নি! যখন চারিদিকে শুধু ছিঃ ছিঃ—ধ্বনি শুনেছি, সমাজপতি এবং অতি আপনজন বলেছেন, ‘মরতে পারলি না হতভাগী, আমাদের মারবার জন্য এই কালোমুখ নিয়ে ফিরে এসেছিস?’ তাদের মুখ ফুটে বলতে পারি নি, ‘না মরতে আর পারলাম কই? তার পথও তো তোমরা করে দিলে না। বাঁচাবার জন্য হাত বাড়াও নি, মরবার পথেও তো সহায়তা করো নি। না সে কথা মুখে বলতে পেরেছো, না কাজে পরিণত করবার মতো সৎসাহস সেদিন তোমাদের ছিল, আজও নেই, ভবিষ্যতের কথা ভবিতব্যই জানেন।’

সত্যিই আজ আমি শুধু বিস্মিত নই, আবেগাপ্লুতও যে আমার মাতৃতুল্য একজন বয়স্ক মহিলা আমার সম্মুখে এতো মমতামাখা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ দীর্ঘ বিশ বছর পর আমি দাঁড়িয়ে আছি বর্তমানের ওপর দু’পায়ে ভর করে। ভবিষ্যতের বুক ভরা আশা নিয়েও আমার অতীত নেই, মনের সমস্ত দৃঢ়তা ও ঘৃণাকে সম্বল করে আমি আমার কলঙ্ক আচ্ছাদিত গৌরবময় অতীতকে ভুলে গেছি। কারণ আমার যা ছিল গর্বের, আমার পরিবার ও সমাজের তাই ছিল সর্বাধিক লজ্জা, ভয় ও ঘৃণার।

ওহো, আমি দুঃখিত। নিজের পরিচয় দিতে আমি ভুলে গেছি। আজকাল আমার মাঝে মাঝে এমন হয়, কারণ বড় বেশি কাজের চাপে থাকি। এর সুবিধা দুটো। বর্তমানকে আমার চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও যোগ্যতা দিয়ে সব সময়ে পূর্ণ করে রাখতে চাই, যেন অতীত সেখানে কখনও কোনো ছিদ্রপথে প্রবেশ করতে না পারে। আমার বর্তমান যেন মসীলিপ্ত না হয়। আমার নাম মিসেস টি. নিয়েলসেন। আমার স্বামী যশস্বী সাংবাদিক ও ডেনমার্কের অধিবাসী। সঙ্গত কারণে আমিও তাই। আমাদের দুটি ছেলেমেয়ে টমাস ও নোরা! মেয়ের নাম নোরা রাখলাম কেন? সম্ভবত আমাকে দেখেই আমার শাশুড়ি নাতনির এ নাম রেখেছিলেন। তাঁর মত, শতবর্ষেরও আগে ইবসেন তাঁর দেশে যে নারীকে ব্যক্তি সচেতন করতে চেয়েছিলেন আজ পাশ্চাত্যেও নারী সে-অধিকার বা সম্মান অর্জনে সক্ষম হয় নি। তবে নোরা যেন তার কালের ওপর দাঁড়িয়ে ইবসেনের স্বপ্ন সফল করে। টমাস পেয়েছে আমার স্বভাব—জিন্দী, একগুয়ে আর নোরা তার বাবার মতো, আগুনের কাছে গেলেও গরম হয় না।

১৯৭৮ সালে মিসেস হায়দার ডেনমার্কে আসেন। যে-সংগঠনের তিনি সদস্য তারা কোপেনহেগেনে একটি প্রেসকনফারেন্স করে। আমার বান্ধবী এ্যালিস একজন নারীবাদী জবরদস্ত সাংবাদিক। সেও ওখানে ছিল। নিয়েলসেনের বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকায় সে মিসেস হায়দারকে বারবার ও দেশের স্বাধীনতা উত্তরকালের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করলো। মিসেস হায়দার অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং স্পষ্টভাষী। কিন্তু তিনি সব কথার সোজাসুজি উত্তর দিচ্ছিলেন না। তিনি আমার সাথীকে বললেন, আমার দেশে গণতান্ত্রিক সরকার নেই তাই তোমাদের মতো সরাসরি আমরা কথা বলতে পারি না। আশা করি আমার এ অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতাকে তোমরা ক্ষমা করবে। আনুষ্ঠানিক প্রেসকনফারেন্স শেষ হলে এ্যালি ও নিয়েলসেন বেশি সময় মিসেস হায়দারের সঙ্গে কাটিয়ে এলো। যে-সংগঠনের পক্ষ থেকে এ প্রেস-কনফারেন্স ডাকা হয়েছিল, এ্যালিস ঐ সংগঠনের ডেনমার্ক শাখার প্রচার সম্পাদক।

মিসেস টি. নিয়েলসেনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৮ সালে কোপেনহেগেনে এ্যালিসের বাড়িতে এক নৈশভোজে। ইন্টারন্যাশনাল এ্যালায়েন্স অব উইমেনের বোর্ডমিটিং ও বছর কোপেনহেগেনে হয়। সহ-সভানেত্রী লরেল ক্যাসিনাডার কন্যা, পদ্মিনী ডেনমার্ক শাখার সভানেত্রী। তাঁরই অনুরোধে আমরা কোপেনহেগেনে সভা করবার সিদ্ধান্ত নিই। পদ্মিনীর স্বামী ডেনিশ, পেশায় চিকিৎসক। তাছাড়া আরও কয়েকজন স্থানীয় সদস্য আমাদের পূর্ব পরিচিত, যে পরিচয় আজ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। এ্যালিস তাদের একজন। নৈশভোজে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন ছিলেন। এলিস আগ্রহ সহকারে মি. এবং মিসেস নিয়েলসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো, যদিও নিয়েলসেনের সঙ্গে আমি প্রেসকনফারেন্সে আগেই পরিচিত হয়েছি এবং তাকে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো।

মিসেস নিয়েলসেনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, একটু যেন চমকে উঠলাম। মহিলার বয়স বছর ত্রিশ মতো হবে। রীতিমতো সুন্দরী ও সুঠাম দেহের অধিকারিণী। কালো ঈষৎ কোঁকড়া চুলে পিঠ ছেয়ে আছে, যা এদেশে চোখে পড়ে না। বেশির ভাগেরই বব্‌কাট অথবা হাল ফ্যাশনের বয়কাট। সুতরাং চুলেই মহিলা সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম, গায়ের রঙটাও ঠিক পশ্চিমী দুধে আলতায় নয়, অনেকটা ল্যাটিন আমেরিকার মেয়েদের মতো হল্‌দে ছাট আছে। চুলের সঙ্গে মিল রেখে চোখ দুটিও বড় বেশি কালো। দৃষ্টি চঞ্চল, সম্ভবত স্বভাবেও কিছুটা চাঞ্চল্য আছে। ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে গল্প করছেন, হাসছেন একান্তভাবেই উচ্ছল প্রকৃতির। আমি কিন্তু বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছি। কোথায় কি যেন আমার মাথায় নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। উনি কি আমার পূর্ব পরিচিত? ওকে কি কোথায়ও দেখেছি। সম্ভবত মেক্সিকোতে দেখে থাকবো, কারণ ডেনমার্ক থেকে ওখানে বড় ডেলিগেশন গিয়েছিল। উনিও কিন্তু বারবার আমার দিকে চোখ ফেলছেন। কিন্তু কেন? আমার চোখের দৃষ্টি কি মনের ঔৎসুক্য প্রকাশ করছে? সে এগিয়ে এলো। হেসে বললাম, তোমাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় তোমাকে দেখেছি বলতো? মনে হয় আমাকেও তুমি কিছুটা চেনো। মিসেস নিয়েলসেন বললেন, তুমি তো বিশ্বপরিব্রাজক নও। হয়তো-বা তোমার বাংলাদেশের মাটিতেই আমাকে দেখেছো। চোখ দুটো কৌতুকে হাসছে। সত্যি? গিয়েছিলে তুমি নিয়েলসেনের সঙ্গে বাংলাদেশে? আমাকে একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে বললেন, লোকে বলে তুমি নাকি খুব জ্ঞানী, পণ্ডিত। কিন্তু একেবারে শিশুর মতো সরল। ‘হাই’ বলে আরেকজনের দিকে ছুটলেন তিনি। সে রাতের দেখা সাক্ষাৎ ওখানেই শেষ।

পরে এ্যালিসের সঙ্গে ওর সম্পর্কে অনেক আলাপ হয়েছে। এ্যালিসও আমার সঙ্গে একমত, খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা। না, ইনি ডেনমার্কের নন। হয়তো-বা তোমার কথাই ঠিক, ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশের হবে। কিন্তু কথায় তো ওসব দেশের টান নেই। জিভ একেবারে পরিষ্কার, মনে হয় অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তাও নয় নীলা, কারণ উনি পেশায় নার্স, অবশ্য খুবই দক্ষ। একটা বেশ সম্মান নিয়েই আছেন এখানে। আচ্ছা নীলা, কি পেয়েছো তুমি মিসেস নিয়েলসেনের ভেতর যে ওর সম্পর্কে এতো কিছু জানতে চাইছো? বললাম, কিছু না এ্যালী। এমনিই ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে।

১৯৮৫ সালে আবার গেলাম ডেনমার্কে। এ্যালী এসেছিল এয়ারপোর্টে ক্রিশ্চিন আর মেটার সঙ্গে। এবার হোটেল নয়, মেটার অফিসিয়াল রেসিডেন্সটা ক্রিশ্চিন আমাদের দু’জনের জন্য রেখেছে। মেটা ঐ দশদিন ওর বাবার বাড়িতে থাকবে। মেটা আইনজীবী এবং সংসদ সদস্য। হাতে সব সময় ক্যারনের মতো একটা মোটা চুরুট। আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, চুরুট খাওয়া মহিলারা প্রায়ই পুরুষালী আরচণ করেন। হয়তো এও আমার একটা ভ্রান্ত ধারণা। কক্সবাজারে ক্ষুদ্রাকৃতি বয়স্ক মগ মহিলারা যেন পার্টিতে বসে চুরুট ফুকছে। সদ্য ক্রিশ্চিনের ছেলের বিয়ে হয়েছে। সে পার্টি থেকে জমিয়ে বেশ কিছু মুরগির রোস্ট, বীফ স্টেক, পানীয় এনে মেটার ফ্রিজে জমিয়েছে। সন্ধেবেলায় আমার অবস্থানের খবর পেয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি, আমাদের খুবই প্রিয়, লক্ষ্মী রঘু রামাইয়া এসে উপস্থিত। ক্রিশ্চিনের মুখে আষাঢ়ের মেঘ। আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলছে না। নিজের মনে বিড় বিড় করছে, এ জানলে হোটেলেই যেতাম। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ও নিরামিষাষী। মাছ-মাংস খায় না। ক্রিশ্চিন এতোক্ষণে আত্মস্থ হলো।

জিজ্ঞেস করলাম মিসেস নিয়েলসেনের কথা। সংক্ষিপ্ত উত্তর, ভালোই আছে। এ্যলীর খবর কি? দেখাই তো হবে কাল। একটা রাত না হয় আমার সঙ্গেই গল্প করে কাটিয়ে দিলে। ক্রিশ্চিন আমার থেকে দু’চার বছরের ছোট অথবা আমার সমবয়সী হবে। ও আমাকে ভয়ানক ভালোবাসে। পারিবারিক সুখ-দুঃখ-সমস্যার কথা আমাকে বলে খুব শান্তি পায়। তাই ওর সামনে আর কারো সম্পর্কে আগ্রহ দেখালে ও একটু বিরক্তই হয়। তাছাড়া একান্ত আড্ডা মারা আর সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় গিয়ে পিটজা খাওয়ায় ওর যতো সুখ। আর সেই সুখের জন্য মেটাকে ঘর ছাড়া করেছে দশদিনের জন্য।

একটা চেক ব্যাভিরিয়ন স্কার্ট পরা, সঙ্গে একটা লাল টুকটুকে ব্লাউজ—নিয়েলসেন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু চুমুটা দিলাম আমি, ও ঠিক সহজভাবে আমার মুখ চুম্বন করলো না। আগামীকাল থেকে মধ্যদশক নারী কংগ্রেস শুরু। আজ এসেছি রেজিস্ট্রেশন করতে আর ঘর-বাড়ি দেখতে। যেন কাল হাতড়ে বেড়াতে না হয়। টি. নিয়েলসেনের হাত ধরে আছে ৫/৬ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। হঠাৎ বললো, মিসেস হায়দার আমার মেয়ে, ‘নোরা’। নোরা মায়ের মতো অতো সপ্রতিভ নয়। ‘হাই’ বলেই মায়ের পেছনে মুখ লুকালো। বললাম, টমাসের খবর কি? আরে ও এখন জেন্টলমান। শোনো, এবার তুমি একা আমাকে একটা সন্ধ্যা দেবে, প্লিজ। বললাম, একা? বলল, হ্যাঁ, অনেক কথা আমার তোমার কাছ থেকে জানার আছে। বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছে। তারপর দিন ঠিক হলো কনফারেন্স থেকে আমি ক্রিশ্চিনের সঙ্গে ওর বাড়ি ‘রানু’ যাবো। তার আগের দিন ও চলে গেল। আমি মিসেস নিয়েলসেনকে ঐ দিন রাতে আসতে বললাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।

আমি কিছু খাবার এবং ফল এনে রাখলাম। বাইরে খেতে হবে না। কারণ ওর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জানবার আছে। আজ সাত বছর ধরে অনেক সময় আমি ওর কথা ভেবেছি। কাল রাতে ক্রিশ্চিন চলে গেলে আমি তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ একা। ভাবছিলাম নিজের দেশের কথা, অতীত সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। সামনে পর্বত প্রমাণ আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, তারপর একদিন একটি মহান প্রাণের বিদায়ের মাধ্যমে সব আশা ছাই হয়ে গেল। কতো সুখ, কতো আপনজন হারিয়ে গেছে। মানুষের মুখোশ পরা কতো অমানুষ আজ আমার চারদিকে ভীড় জমিয়েছে। এই দশটা বছর তো দেহে বেঁচে আছি। অন্তরে আমি মৃত। কিন্তু কোথায় পথের কোনো বাঁকে এই বিদেশিনীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল? ভ্যানকুভারের শার্লী আমাকে বলেছিল গতজন্মে আমরা বোন ছিলাম। তাই এত দূরের হয়েও এতো কাছে এসেছি। ও খুব বেশি স্পিরিচুয়াল বিষয় নিয়ে চর্চা করে। অতো ধনী কিন্তু কী বিনয়ী, নিরাভরণ, অহঙ্কারশূন্য। বছরে একবার লন্ডনে এসে আমার মেয়ের কাছে আমার বড়দিনের উপহার রেখে যায়। মিসেস নিয়েলসনের সঙ্গেও কি ওইরকম কিছু? হঠাৎ আমার চোখের সামনে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠলো। ঐ তো, ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রে অপারেশন থিয়েটারের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। রুক্ষ্ম চুল, রক্তিমাভ ঠোঁট ফ্যাকাশে, পরনে একখানা লালপাড় শাদা শাড়ি, ভারতের সাহায্য। একেবারে অভ্রান্ত, না এতে কোনও সংশয় নেই। ওই তারা, কতোদিন ওর কাছে গেছি, কথা জমাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু হ্যাঁ-না ছাড়া আর কোনও কথা হয় নি। এ নিশ্চয়ই সেই তারা কিন্তু জিজ্ঞেস করবো কি করে? মনে হয় ও আমাকে বলবে। কারণ যখনই ও কাছে আসে, আমার মেয়েদের মতো গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি বুঝি ও আমার স্পর্শ চায়। সে কি মাতৃস্পর্শ না দেশের মাটির স্পর্শ, জানি না।

ঠিক সাতটায় দরজায় কলিংবেলের শব্দ হলো। আমি হাসিমুখে দরজা খুলে বলতে চেয়েছিলাম—হাই মিসেস নিয়েলসেন। কিন্তু বলা হলো না। হাতে একরাশ ফুল নিয়ে ও ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকে। আমি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওর মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে বুলোতে বললাম কেঁদো না, অনেক কেঁদেছো আর না। আজ তো তুমি জয়ী। যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো। ও উঠে গেল। আমি টেবিলে কিছু পানীয়, কাজু বাদাম আর আলুভাজা রাখলাম। মিসেস টি. নিয়েলসেন গুছিয়ে বসে গলা ভিজিয়ে বললো, নীলাআপা আমি প্রথম দিন দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আর আপনিও আমাকে চিনেছিলেন তাই না? তারা, তারা ব্যানার্জী, মনে আছে আপনার? অতোটা স্পষ্ট করে মনে না থাকলেও, তারা নামটা মনে পড়লো। একদিন কথাচ্ছলে বলেছিল ওর বড় বোনের রং শ্যামলা তাই ওর দাদি নাম রেখেছিলেন কালী। তারপর ওর জন্মের লগ্নে দাদি ওকে ডাকলেন তারা। একমাত্র বড় ভাইয়ের নাম স্বয়ম্ভ প্রসাদ। দাদির দেবী ভক্তির নমুনা আর কি! আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি, আজ ওর বলার পালা। এক সময় ওর মুখ খোলাতে আমি অনেক চেষ্টা করেও পারি নি। বললো, আপনি যখন আপনার সব বান্ধবীদের নাম ধরে ডাকতেন আর আমাকে বলতেন মিসেস নিয়েলসেন, আমি তখন লজ্জা পেতাম কিন্তু প্রথমে নামটা বলতে পারি নি। এখন আমার কোনও সংকোচ থাকার কথা নয়, তবে এ বোধহয় সংস্কারের দৈন্য। সব গেছে– জাতি, ধর্ম, দেশ কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারকে সহজে বর্জন করতে আজও আমি দ্বিধান্বিত।

১৯৭১ সালের উত্তাল আন্দোলনে আমি ছিলাম রাজশাহীতে। বাবা শহরের উপকণ্ঠে ডাক্তারি করতেন। এক সময় সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর চাকুরি ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি শহরের উপকণ্ঠে বেশ কিছুটা জমি নিয়ে নিজের পছন্দমত ছোট্ট একটি বাড়ি করেন। মার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো বাগান করবার সুবিধে পেয়ে। দাদি ততোদিনে চলে গেছেন। বড়বোন কালীর বিয়ে হয়ে গেল। ও কলকাতায় চলে গেল স্বামীর ঘর করতে। দাদার মেডিক্যাল কলেজের শেষ পরীক্ষা দেবার কথা, কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে এমনভাবে মেতে উঠলো যে দেওয়া হলো না। মা ক্ষুণ্ণ হলেন কিন্তু বাবা কেন জানি না খুশিই হয়েছেন মনে হলো। বাবা চেম্বার থেকে বেশ রাত করে আসেন। মা খুবই উদ্বিঘ্ন ইন, অনুযোগ অভিযোগ করেন। বাবা হেসে উত্তরে বলেন, শোনোনি শেখ মুজিব বলেছেন– তোমাদের যার যা কিছু আছে…। শুনেছি কিন্তু তোমার কি আছে, যে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে? বাবা বলতেন, ছেলে আছে, মেয়ে আছে, তুমি আছো। এখনও এই হাত দুখানা আছে। কিন্তু রাতে মনে হয় বাবা ঠিকমতো ঘুমাতেন না। সামান্য শব্দ হলেই জেগে উঠতেন। বারান্দায় পায়চারি করতেন। তিনি কি কোনও অশুভ সংকেত পেয়েছিলেন? জানি না, কারণ তিনি জানতে দেন নি।

মার্চমাসের মাঝামাঝির পর থেকেই এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু জনতা এতো একতাবদ্ধ যে কোনো অপশক্তিই এদের রুখতে পারবে না বলে সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সব বিশ্বাসকে ভেঙেচুরে এলো ২৫শের কালোরাত্রি। পরদিন ছিল কার্ফু। এর ভেতরই কিছু লোককে আমাদের বাড়ির চারদিকে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেল। মা ঠাকুরের নাম জপ করছেন। বাবা করছেন অশান্ত পদচারণা। ছাব্বিশে মার্চ সারাদিনই আমরা ইঁদুরের মতো গর্তে রইলাম! ২৭ মার্চ অন্ধকার থাকতেই আমরা গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা হলাম সামান্য হাতব্যাগ নিয়ে। গাড়ি, রিকশা কিছুই চলছে না। হঠাৎ স্থানীয় চেয়ারম্যানের জিপ এসে থামলো আমাদের সামনে। বাবাকে সম্বোধন করে বললেন, ডাক্তারবাবু আসেন আমার সঙ্গে। কোথায় যাবেন নামিয়ে দিয়ে যাবো। বাবা আপত্তি করায় চার-পাঁচজনে আমাকে টেনে জিপে তুলে নিয়ে গেল। কোনও গোলাগুলির শব্দ শুনলাম না। বাবা-মাকে ধরে নিয়ে গেল না মেরে ফেললো বলতে পারবে না। গাড়ি আমাকে নিয়ে ছুটলো কোথায় জানি না। কিছুক্ষণ হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ছিল আমার। সচেতন হয়ে উঠে বসতেই বুঝলাম এটা থানা, সামনে বসা আর্মি অফিসার। আমার সঙ্গে ভদ্রভাবেই কথা বললেন। বললাম, আমাকে বাবা-মার কাছ থেকে কেড়ে এখানে আনা হয়েছে কেন? অফিসার হেসে উত্তর দিলেন—তোমার নিরাপত্তার জন্য। দেখলাম ওখানে আরও ২/৩টি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কখনও বা চিৎকার করছে। অবশ্য চেঁচালেই ধমক খাচ্ছে। চা এলো, রুটি এলো, কলাও এলো। আপা, সে দৃশ্য আজও আমার কাছে পরিচ্ছন্ন স্পষ্ট। আমাদের মফস্বলের ইংরেজি শুনে অফিসারটি খুশী হলেন যে আমি ইংরেজি জানি। সারাদিন সবাই ওখানেই রইলাম। সন্ধের কিছু আগে চেয়ারম্যান সাহেব এলো। সব কিছু জেনেও আমি ওর পা জড়িয়ে ধরলাম, কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন। উনি ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম আমাকে বাঘের মুখে উৎসর্গ করা হলো। মানুষ কেমন করে মুহূর্তে পশু হয়ে যায় ওই প্রথম দেখলাম। এরপর ১৬ ডিসেম্বরের আগে মানুষ আর চোখে পড়ে নি।

অফিসারটি পরম সোহাগে আমাকে নিয়ে জিপে উঠলো। কিছুদূর যাবার পর সে গল্প জুড়লো অর্থাৎ তার কৃতিত্বের কথা আমাকে শোনাতে লাগলো। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। হঠাৎ ঐ চলন্ত জিপ থেকে আমি লাফ দিলাম। ড্রাইভিংসিটে ছিল অফিসার, আমি পাশে, পেছনে দু’জন জোয়ান। আমার সম্ভবত হিতাহিত জ্ঞান রহিত হয়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান হলো দেখি মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, আমি হাসপাতালের বিছানায়। ছোট্ট হাসপাতাল। যত্নই পেলাম, সব পুরুষ। একজন গ্রামের মেয়েকে ধরে এনেছে আমার নেহায়েৎ প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য। মেয়েটি গুণ গুণ করে কেঁদে চলেছে। সন্ধ্যায় অফিসারটি চলে গেল। যাবার সময় আমাকে হানি, ডার্লিং ইত্যাদি বলে খোদা হাফেজ করল। দিন তিনেক শুয়ে থাকবার পর উঠে বসলাম। সুস্থ হয়েছি এবার। আমাদের ভেতরে সংস্কার আছে পাঁঠা বা মহিষের খুঁত থাকলে তাকে দেবতার সামনে বলি দেওয়া যায় না। আমি এখন বলির উপযোগী।

প্রথম আমার উপর পাশবিক নির্যাতন করে একজন বাঙালি। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। অসুস্থ দেহ, দুর্বল যুদ্ধ করতে পারলাম না। লালাসিক্ত পশুর শিকার হলাম। ওই রাতে কতজন আমার উপর অত্যাচার করেছিলো বলতে পারবো না, তবে ছ’সাত জনের মতো হবে। সকালে অফিসারটি এসে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখলো তারপর চরম উত্তেজনা, কিছু মারধরও হলো। তারপর আমাকে তার জিপে তুলে নিলো, আমি তৃতীয় গন্তব্যে পৌঁছোলাম। অফিসারটির হাত ধরে মিনতি করে বললাম, আমাকে রক্ষা করবার কথা বলছেন, আমি তো রক্ষা পেয়েছি। এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আপনি আমার ভাই। আপনার বয়সী আমার বড়ভাই আছে। হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মতো এই ভালোমানুষ লোকটির চোখ দু’টো জ্বলে উঠলো। বাঁ হাতে আমার চুলের মুঠি ধরে বললো, বল তোর ভাই কোথায়? বললাম, আমি তো এখানে ভাই কোথায় কি করে বলবো? অফিসারটি হঠাৎ আমার মুখে কতগুলো থুথু ছিটিয়ে দিয়ে কি সব গালাগালি দিলো। আমি নিস্তব্ধ নিথর বসে রইলাম। মনে হয়েছিল কেন আমি তার চরণে প্রথম অর্ঘ্য হলাম না, এটাই তার ক্ষোভ, কিন্তু সে তো তার অক্ষমতা। আমি তো এখন জড় পদার্থ, অনুভূতি প্রায় শূন্য। কয়েকদিন পর্যন্ত আমার মস্তিক মনে হয় কাজ করে নি। যন্ত্রের মতো যা দিয়েছে খেয়েছি, যে যেখানে টেনে নিয়ে যে অত্যাচার করেছে সয়ে গেছি। সামর্থ হলে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করেছি ‘জয় বাংলা’। যদি কারও বোধগম্য হয়েছে তাহলে কিছু থুথু, কিছু লাথি উপহার পেয়েছি। আমাদের দেশ-গ্রামে প্রচলিত আছে, বিড়াল আর কচ্ছপের প্রাণ আর মেয়ে মানুষের প্রাণ একই রকম, যতোই অত্যাচার করো না কেন, ধিকি ধিকি জ্বলে, কিন্তু মরে না। আমার ও আমার মরণ-সঙ্গিনীদের ওপর এরা যে অত্যাচার করেছে, পুরুষ মানুষ হলে কবে নিঃশেষ হয়ে যেতো। অবশ্য এর পেছনে আরও একটা কারণ আছে। আমরা এদের জীবন যাপনের একটা অত্যাবশ্যক পদার্থ ছিলাম। তাই যতো অত্যাচারই করুক না কেন, আমাদের এই রক্ত-মাংসের দেহগুলোকে জিইয়ে রাখবার প্রয়োজন ছিল। এবার আমি যেখানে আছি ওখানে প্রায় আট-দশজন মেয়ে ছিল। বয়স তেরো থেকে ত্রিশ অথবা আরও বেশি হবে। তবে এরা সবাই প্রায় গ্রামের। একটা শহরের শিক্ষিতা মেয়ে দেখেছিলাম, সামান্য কথা বলবার সুযোগও পেয়েছিলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড়, সুন্দরী। উনি নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী। ওর দুই ভাই সামরিক বাহিনীতে আছে। তারা নিশ্চয়ই এতোদিনে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, কোনও মতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো। আমাদের জয় হবেই। তার মুখেই শুনলাম ওটা জুলাই মাস। অবাক হলাম এতোদিন আমি এ নরকবাস করছি। ভগবান, যুদ্ধ আর কতোদিন চলবে। এদের দেখে তো এতোটুকু নিরুৎসাহ বা দুর্বল মনে হয় না। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে সেইদিনই সন্ধ্যায় নিয়ে গেল। সম্ভবত আরো কোনও বড় সাহেবকে ভেট দেবে।

আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন মেয়ে গলার শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই আমাদের পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ। যেমন ময়লা তেমনি ছেঁড়া-খোঁড়া। মাঝে মাঝে শহরের দোকান থেকে ঢালাও এনে আমাদের প্রতি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে। যেমন দুর্গাপূজা বা ঈদের সময় ভিক্ষা দেয় অথবা যাকাত দেয় ভিখারিকে। চোখ জলে ভরে উঠতো। বার বার বাবার কথা মনে হতো। মা এবার কি শাড়ি নিবি? বলতাম, তুমি যা দেবে। আদরে মাথায় হাত রেখে বলতেন, মা আমার যে ঘরে যাবে সে ঘর শান্তিতে ভরে উঠবে। বাবা তুমি কি জানতে তোমার মেয়ে কোনও ঘরের জন্যে জন্মায় নি। তার জন্মলগ্নে শনির দৃষ্টি ছিল। সে শতঘরের ঘরনী, যাযাবর রমণী।

হঠাৎ একদিন মনে হলো এতো অত্যাচার অনাচারে আমাকে এখন দেখতে কেমন হয়েছে? আয়না তো নেই-ই কাঁচের জানালা-দরজাও নেই। পাছে আমরা আত্মহত্যা করি। ওরা জানে না এই লাঞ্ছিত দেহটাকে পরম মমতায় লালন করছি প্রতিহিংসা নেবার জন্যে। ঐ যে, যাকে কাকাবাবু বলতাম ওই চেয়ারম্যান, ওকে কি করবো? আচ্ছা শ্যামলদা এখন কোথায়? শ্যামলদা ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। ঢাকায় ছিল ফলাফলের আশায়। ও আছে, না মরে গেছে? পুরুষ তো, নিশ্চয়ই মরে গেছে, ওকে ঘিরে কতো স্বপ্ন রচনা করতাম। সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী, লাজুক প্রকৃতির ছিল শ্যামলদা। সবার সামনে আমার সঙ্গে অল্প কথা বলতো। ওর বোন কাজলী আমাদের সঙ্গে পড়তো। বলতো, জানিস দাদা তোকে ভালোবাসে। শুনে আমার কান লাল হয়ে উঠতো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতো। সত্যি মানুষ ভাবে কি, আর হয় কি। কোথায় আছে এখন শ্যামলদা। জীবিত, না মৃত, হয়তো-বা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতে চলে গেছে। ভারতে এর বড়বোন, ভগ্নিপতি, কাকা, কাকিমা সব আছেন। ভালোই থাকবে ও। নিজের মনেই হাসে তারা, ঐ শ্যামলের কথা ভাববার কি কোনও যৌক্তিকতা আছে? ওর তন্দ্রাচ্ছন্ন ধ্যান ভাঙে মোতি মিয়ার চিৎকারে। মোতি মিয়া এখন রেশন সরবরাহ করে। মাঝে মাঝে তির্যক ভাষায় কিছু খবরাখবর দেয়। মাস-তারিখ হিসাবের ছলে উচ্চারণ করে। সেটা সেপ্টেম্বর মাস, মোতি মিয়া হিসাব করছিল। এ বছর যেতে আর তিনমাস। সাহেবরা তার থেকে বেশিদিন থাকবে না। হ্যাঁ, যুদ্ধ জয় করে দেশে বিবি বাচ্চার কাছে ফিরে যাবে। তারা বুঝলো মুক্তি আসন্ন। কারণ আজকাল ক্যাম্পে বসেই গোলাগুলির শব্দ শোনে। এখানকার অফিসার জোয়ান সবাই কেমন যেন উদ্বিগ্ন সন্ত্রস্ত। মাঝে মাঝে বাংলা খবর কানে আসে। না, ঢাকা-রাজশাহী নয়, উচ্চারণে বোঝা যায় আকাশবাণী। কে একজন বেশ ভরাট কণ্ঠে সংবাদ পরিবেশন করেন। শেষ হতেই রাজাকাররা গালাগালি দিতে থাকে মালাউনদের। তারা ভগবানকে ডাকে ওর প্রাণটুকু যেন থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে ‘জয় বাংলা’।

পরদিন হঠাৎ ওদের ভেতর একটি মেয়ে মারা যায়। অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সকাল থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ওরা বন্ধ দরজায় অনেক চেঁচামেচি করলো। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না। ব্যাপারটা বোঝা গেল না। মেয়েটার নাম ছিল ময়না। বছর পনেরো বয়স হবে। কাটা পাঁঠার মতো হাত-পা ছুঁড়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো, মুখখানা নীল হয়ে গেলো। বয়স্কা সুফিয়ার মা একটা ছোট কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলো কারণ ও ঘরে ওরা চাদর দেয় না। সন্ধের পর ওরা লাশটা নিয়ে গেল। আমাদের ভেতর এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এমন কি পশুগুলোরও নারীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে মনে হচ্ছে। তাহলে এবার হয়তো আমাদের মেরে ফেলতে পারে। তারা বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অস্থিরতা অনুভব করলো। এতো যন্ত্রণায় এরা সবাই রয়েছে–আর পারি না। আল্লাহ্ আমাদের তুলে নাও, ভগবান মুক্তি দাও, কিন্তু তারা কখনও মৃত্যু কামনা করে নি, শুধু বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছে।

গোলাগুলির শব্দ ক্রমশ কমে আসছিল। বেশ শীত পড়েছে। ছোট্ট কম্বলের টুকরোটা গায়ে দিয়ে জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকি। তারপর একদিন ভোররাতে সব কেমন নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ মনে হলো। সুফিয়ার মা বললো, হালারা পালাইলো নাকি? ওর কথায় যেন শরীরে অসুরের বল পেলাম। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। চেঁচাতে আরম্ভ করলাম। হঠাৎ শুনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। যে সুফিয়ার মায়ের সঙ্গে কখনও কথা বলি নি আজ মায়ের মতো ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। সাতাশে মার্চের পর আর কখনও কেঁদেছি কি? মনে হয় না। হঠাৎ করে আমাদের দরজা খুলে গেল। আমরা ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। লোক যে ক’জন এসেছে তাদের ভদ্ৰশ্রেণীর মনে হলো না। সুফিয়ার মা ওদের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে কথা বললো। ওরা বললো ওরা মুক্তি। কিন্তু ওদের চাহ নি দেখে বিশ্বাস হলো না। ঠিক এমনি সময় একটি জিপের শব্দ পেলাম, কারা যেন খুব উচ্চ স্বরে ‘জয় বাংলা’ বলে উঠলো। আমরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে উঠলাম, ‘জয় বাংলা’। জিপ থেকে নেমে এলো খাকি কাপড় অর্থাৎ ইউনিফর্ম পরা তিনজন আর লুঙ্গি, গেঞ্জি, প্যান্ট পরা স্টেনগান হাতে সাত আটজন। ওদের নেতা এগিয়ে এলো। আমি একেবারে অন্ধকার কোণে গিয়ে ঢুকলাম। সেই সাতাশে মার্চের দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ইউনিফর্ম পরা একজন বুঝলো আমি ভয় পেয়েছি। আমার কাছে এগিয়ে এসে কোমল কণ্ঠে বললো, আইয়ে… আমার কি হলো জানি না। প্রচণ্ড একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলাম। পরে শুনেছি ওরা মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। কাছের গ্রাম থেকে কাপড় জামা এনে বাকিদের পরিয়ে নিয়ে গেছে। আমি অচৈতন্য থাকায় সরাসরি নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে।

জ্ঞান হলে দেখলাম একটা ছোট্ট হাসপাতাল। তবে ওখানকার লোকজনদের কথায় বুঝলাম উত্তরবঙ্গেই আছি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোন্ জায়গা? মনে হলো শুনলাম ঈশ্বরদী। অকথ্য অত্যাচার আর যন্ত্রণাকে আঁকড়ে থাকার ফলে আমার বোধহয় কিছুটা মাথায় গোলমাল হয়েছিল। এরপর বলছিলাম—বাবার কাছে যাবো, বাবার কাছে যাবো। কিন্তু যখন বাবার নাম জিজ্ঞেস করলো তখন কিছুতেই বাবার নাম বলতে পারলাম না। শুধু ভেউ ভেউ করে কাঁদলাম। ফলে আমার লাভ হলো আমাকে সরাসরি ঢাকায় নিয়ে এলো, সম্ভবত আমি হেলিকপ্টারে এসেছিলাম, কারণ প্লেনে খুব শব্দ হচ্ছিল। ওখানেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। বুঝলাম, আমি মেডিক্যাল কলেজের মহিলা ওয়ার্ডে এসেছি। তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিকে দেখছিলাম, মনে হলো এতো লোক আমি কখনো দেখি নি। তখন ঠিক কটা বলতে পারবো না, তবে দুপুরের খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দিলো। একজন সিস্টার সাহায্য করলেন। মুখ ধুয়ে ভাতের থালা টেনে নিলাম। ঝরঝর করে আমার দু’গাল বেয়ে নামা চোখের জলে ভাত ভিজে উঠলো। সিস্টার পিঠে হাত বুলিয়ে হাতে ধরে খেতে বললেন। সত্যিই কি সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আমাকে পেয়ে বসলো জানি না। ওই ভাত তরকারি অমৃত জ্ঞানে খেলাম। মনে হলো আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু জানতাম না তখনও যে কত মরণ আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিন-চারদিন ওখানে থাকার পর একজন ডাক্তার আমাকে জানালেন আমি গর্ভবতী। আমি কোথায় কার কাছে যেতে চাই? ঠোঁট চেপে বললাম, কারও কাছে নয়, আমার মতো দুস্থ মেয়েদের জন্য আপনারা যে ব্যবস্থা করবেন আমার জন্যেও তাই করুন। আপনার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই? জিজ্ঞেস করলেন মমতাময়ী চিকিৎসক। না সূচক মাথা নাড়লাম। তিনিও বুঝলেন।

প্রায় মাসখানেক পর আমি ধানমন্ডি পুনর্বাসনকেন্দ্রে এলাম, যেখানে বহুবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে থাকতে বেশ কৌতূহলী নারী-পুরুষের ভীড় হতো আমার সামনে। জিজ্ঞেস করে জানলাম—ওরা বীরাঙ্গনা দেখতে আসে। সিস্টার সবিস্তারে ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যেসব রমণী মাতৃভূমির জন্য তাদের সতীত্ব, নারীত্ব হারিয়েছে তিনি তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম সেই মহানায়কের উদ্দেশে। আমি বীরাঙ্গনা, এতোবড় সম্মান আমি পেয়েছি। আমি ধন্য কিন্তু চোখের জল কেন জানি না বাধা মানে না। বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী অফিসার মোসফেকা মাহমুদকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙে গেছে সেসব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে। শুধু উচ্চারণ করলাম, ‘বাবা তুমিও’। এখন বাইরের লোক দেখলেই সরে যাই। শেষপর্যন্ত সেই যে পোলিশ লেডী ডাক্তার ছিলেন তাকে ধরলাম আমাকে কাজ শেখাবার জন্য। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। সব চিন্তা বিসর্জন দিয়ে কাজে লাগলাম।

ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হলো। আমি কঠিন মুখে প্রস্তুতি নিলাম। কারণ এতোদিনে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরেছি। আপা, আপনি তো দেখেছেন মেয়েরা কিছুতেই গর্ভপাতে রাজি হয় নি। সন্তান আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে। নারীর প্রচণ্ড দুর্বলতা, কারণ জীবনে মা হবার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি নারীর সহজাত কামনা। কিন্তু এ সন্তান নিয়ে যাবো কোথায়? আপনার মনে আছে মর্জিনার কথা? সেই যে, পনেরো বছরের ফ্রক পরা মেয়েটি, যে কিছুতেই তার ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চায় নি। আপনাকে দেখলেই চিৎকার করতো ওর ছেলে চুরি করবেন এই ভয়ে। শেষপর্যন্ত ছেলেকে পাঠানো হলো। কিন্তু তারপর আপনি আর ওখানে বিশেষ আসতেন না, কেন আপা? আপনার কি কষ্ট হয়েছিল? মাথাটা নামিয়ে বললাম, তারা আমি এ জীবনে যতো কঠিন কাজ করেছি মর্জিনার ছেলেকে সুইডেনে পাঠানো বোধহয় তার ভেতর সবচেয়ে কষ্টদায়ক। বঙ্গবন্ধুকে যখন বলেছিলাম উনি বললেন, ‘না আপা, পিতৃপরিচয় যাদের নেই সবাইকে পাঠিয়ে দেন। মানুষের সন্তান মানুষের মতো বড় হোক। তাছাড়া ওই দূষিত রক্ত আমি এদেশে রাখতে চাই না। ওদের খ্রিস্টান করে নেবে এই বলে অনেক পরামর্শদাতা বঙ্গবন্ধুকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। আমি পৃথিবীতে একাই লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হলাম।

হঠাৎ বাবা এলেন। বাবা যেন এক বছরে কেমন বুড়ো হয়ে গেছেন। দু’হাত শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। ঠিক একদিন এমন করে আমরা ৭৮ জন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম অফিসের মাধ্যমে। সেদিন আমাদের চোখের জলে বঙ্গবন্ধুর বুকটা ভিজে গিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কি? সত্যিই সেদিন মনে হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন, আমাদের চিন্তা কি? কিন্তু বাবার বুকে তো সে অশ্রুপাত করতে পারলাম না। আমার মাথায় রাখা বাবার হাতও তো তেমন কোনও আশ্বাস দিলো না। মুখ তুলে বললাম– বাবা এখন কি তোমার সঙ্গে আমি যাবো? অফিসে বলতে হবে। বাবা একটু থেমে ইতস্তুত করে বললো, না মা, আজ তোমাকে আমি নিতে পারবো না। বাড়িঘর মেরামত হচ্ছে। তোমার মামাও এসেছে। কালী আসবে জামাইকে নিয়ে। ওরা চলে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো মা। আস্তে করে বাবার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ঠিক আছে বাবা তুমি আর এসো না। বাবা না, না বলে আমতা আমতা করতে লাগলেন। আমার হাতে একটা ফলের ঠোঙা দিলেন। ওটা স্পর্শ করতে মন চায় নি। কিন্তু ফেলে দিয়ে নিজেকে হাসির পাত্র করতে চাইলাম না। বাবা আবারও এসেছেন, কিন্তু আমাকে নেবার কথা বলেন নি। দাদা এসেছে কলকাতা থেকে আনা শাড়ি নিয়ে। এমন কি শ্যামলদাও এসে বীরাঙ্গনা দেখে গেছে। দাদা অবশ্য একটা কথা বলে গেলেন যা বাবা মুখ ফুটে বলতে পারে নি। দাদা বললো, তারা, আমরা যে যখন পারবো তোর সঙ্গে দেখা করে যাবো। তুই কিন্তু আবার হুট করে বাড়ি গিয়ে উঠিস না। আমার মুখের পেশিগুলো ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছিল। দাদা সে-দিকে এক নজর তাকিয়ে চট করে বললেন, তাছাড়া আমাদের ঠিকানায় চিঠিপত্র লিখবারও দরকার নেই। তুই তো ভালোই আছিস। আমিও চাকুরি পেয়েছি, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছি তা দিয়ে বাড়িঘরও মেরামত হয়েছে। ওপরে দুটো ঘরও তোলা হয়েছে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালাম, ওর দিকে আর তাকাই নি। তারপর যখন দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন আর আমি হতভাগিনী তারা নই, গর্বিতা মিসেস টি. নিয়েলসেন।

আমার জিভ শুকিয়ে আসছে। তারার গ্লাসটা ভরে দিয়ে নিজেরটাতেও চুমুক দিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না, ও নিজেই একটু থেমে আবার শুরু করলো, আমার ভেতর প্রচণ্ড একটা ঘৃণা ও জেদ এক সঙ্গে কাজ করছিল মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু দেখে। মর্জিনা বলেছিল ওর স্বামী সরকার থেকে ওর এ অবস্থার জন্যে টাকা পেয়েছে। বাবা, দাদাও কি তাহলে আমার সতীত্ব-মাতৃত্বের দাম নিয়েছে সরকারের কাছে থেকে। বাড়ি মেরামত করেছে, ওপরে ঘর তুলেছে, ওরা ও ঘরে থাকবে কি করে? তারা নামের একটি মেয়ে আঠারো বছর যে বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে মিশে ছিল তাকে ওরা অনুভব করবে না? অথচ আমি তো চোখ বুজলেই পশ্চিম কোণের বৃষ্টি ধোয়া কদমফুলের গাছটা দেখতে পাই। চৈত্র-বৈশাখে মালদার আম গাছের মৌলের সৌরভ বাতাসে উপলব্ধি করি। না, বাস্তব বড় কঠিন। আমি বীরাঙ্গনা, আমাকে নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে হবে। সেই যে পোলিশ মহিলা ডাক্তার যিনি আমাকে মাতৃত্বের সর্পবেষ্টনী থেকে মুক্ত করেছিলেন, যার সঙ্গে আমি আজ ছ’মাস কাজ করছি তাঁকে শক্ত করে ধরলাম। আমাকে উনি কোনও রকমে বিদেশে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন কিনা। বাইরে যেতে না পারলে আমি মরে যাবো। এ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না। আমার পরিবারের সব আচরণ আমি ওঁকে খুলে বললাম। উনি স্তম্ভিত হলেন। ব্যথায় ওর সুন্দর মুখখানা ম্লান হলো। আমাকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, সাহস হারিও না, তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি তো জানো না, পঙ্গু হাসপাতালে কতো তরুণ চিরকালের জন্য বিছানা পেতেছে। আমি তোমার জন্য চেষ্টা করবো মাই চাইল্ড। একটু ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁর শাড়িপরা হালকা শরীরটা ধীরে ধীরে চেয়ারম্যানের ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুঝলাম ওঁকে দিয়ে যা করাবার দ্রুত করাতে হবে কারণ ওঁরা আর চারমাসের বেশি থাকবেন না। গর্ভপাতের রুগী শেষ হয়েছে, এখন তো সন্তান প্রসব করানো, সে তো দেশী ডাক্তার দিয়েও হবে।

সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি নার্সিং-এর কাজ করে যাই। ডাক্তার দেখলেই হাসিমুখে উৎসাহ দেন, সবার কাছে আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। তারপর একদিন আমাকে জানালেন পোল্যান্ডে নার্সিং শিখবার জন্য তিনি একটি বৃত্তি যোগাড় করেছেন। আমাকে একটা আবেদনপত্র দিলেন পূরণ করে দেবার জন্য। পরদিন আমাদের বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি সোবহানের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন এবং একখানা সুপারিশপত্রও চাইলেন। চেয়ারম্যান সাহেব খুবই সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করলেন।

হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন, তারা, শিগ্‌গির তৈরি হয়ে এসো, আমার সঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরে যেতে হবে। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিল। এ মাসে এ আমার দ্বিতীয়বার পথে বেরুনো। একবার গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ওখানে গণভবনে আর এবার সেক্রেটারিয়েটে। ইন্টারভিউ হলো। আমি কিছুতেই বাবার নাম বললাম না। ভদ্রলোক সব বুঝলেন, তবে আবেদনপত্রে নামটি লিখেছি। বাইরে এসে ডাক্তার শক্ত করে আমার হাত ধরলেন। বুঝলাম আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে। এক মাসের ভেতর আমার ছাড়পত্র এসে গেল। সব খরচ এরা দেবেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বলে কিছু বিশেষ সুবিধাও দেবে। জুলাইমাসের এক বিকেলে আমার আপন বলতে যা ছিল অতীতের সঙ্গে সব অতল জলে ডুবিয়ে দিয়ে আমি এয়ারফ্লোটে উঠে বসলাম। অন্তরে উচ্চারণ করলাম, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। তোমার দেওয়া বীরাঙ্গনা নামের মর্যাদা আমি যেন রক্ষা করতে পারি। একদিন আমি মাথা উঁচু করে এসে তোমাকে সালাম জানিয়ে যাবো। না, মাথা উঁচু করে বহুবার এসেছি, কিন্তু তোমাকে সালাম করতে পারি নি। তুমি তখন আমার স্পর্শের অতীত।

আপা আপনাকে বিরক্ত করছি নাতো? বিস্ময়ে চমক ভেঙে বললাম– না, না বলো, আমি এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম যে মনে হচ্ছে আমিও সেই ’৭৩ সালে তোমার সঙ্গে এসেছি। সোফিয়া আমার খুব ভালো লেগেছিল। সুন্দর দেশ, দেশবাসীর ব্যবহার সুন্দরতর। আমাদের মতোই অতিথি পরায়ণ। ওখানে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েও দেখলাম। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে এখানে আসার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে দেখলাম অধিকাংশই বিত্তশালীর পুত্র-কন্যা, তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। কিছু ছিল রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পুত্র-কন্যাও। আমার মতো আঘাতপ্রাপ্ত এখানে কেউ আসে নি অর্থাৎ আসবার পথ পায় নি। আমার সব কৃতজ্ঞতা ওই ডাক্তারের কাছে। আচ্ছা আপা, আপনারা কি আমার মতো কাউকে বিদেশে যেতে সাহায্য করেছেন। মাথাটা নত হলেও সত্যি কথা বললাম না, কারণ এমন কেউ আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসে নি। কেন? আপনি, বাসন্তীদি, মমতাজ বেগম—আপনারা তো সব সময়েই বোর্ডে আসতেন, তবে কেন এ ধরনের চেষ্টা করেননি? তারা, দেশ ছেড়ে যাবার মতো মানসিক প্রস্তুতি সম্ভবত তাদের ছিল না। মাটি আর মানুষকে ভালোবেসেই তারা ওখানে থাকতে চেয়েছিল। বঞ্চনার স্বরূপ তখনও তারা দেখে নি। যাক তোমার কথাই বলো।

মাস তিনেকের ভেতরই একটি বাঙালি মেয়ে আমার পেছনে লাগলো। জানি না কিভাবে জেনেছে, অথবা আমার আচার আচরণ, মন-মানসিকতা থেকে বুঝেছে আমি সহজ স্বাভাবিক পরিবার থেকে আসি নি। আমার কোনও চিঠিপত্র এ তিনমাসে আসে নি। ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাই। সুতরাং আমি ভালো মেয়ে নই। দু’এক করে কথাটা ইন্সটিটিউটে ছড়ালো। পোলিশ ছেলে-মেয়েরা আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে নি, কিন্তু অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাই গর্বভরে মনে মনে উচ্চারণ করতাম আমি বীরাঙ্গনা। পরে একটি বাঙালি ছেলে বললো যে ঐ মেয়েটি একজন মুসলিম লীগ নেতার মেয়ে। দেশে ফিরে যাবার অসুবিধা তাই নিজের ভোল পাল্টে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরে ঐ মেয়েকে এখানে পাঠিয়েছে। দেখো না ও পড়ালেখা কিছুই করে না। দেশের অবস্থা শান্ত হলেই ফিরে যাবে। ছেলেদের কাছ থেকে অবশ্য খারাপ ব্যবহার পাই নি।

পরের বছর হাতে কিছু টাকা জমলো। ভাবলাম দু’একটা দেশ দেখবো, আমার সঙ্গে ডেনমার্কের এক মেয়ে পড়তো ও আমাকে ওর দেশে আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। বললো শুধু প্যাসেজ মানি ছাড়া তোমার আর কিছু লাগবে না। আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারবে। ডানার কথায় নেচে উঠলাম। ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে আমি ডানার সঙ্গে কোপেনহেগেনে পা রাখলাম। ওর বাবা এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে ভরে দিলেন। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন হালকা করে। চুমুও দিলেন ডানার বাবা মি. হ্যারি, খাটো কিন্তু বেশ সুঠাম স্বাস্থ্যবান দেহের অধিকারী। তবে তার চুল বেশ হালকা—মাঝখানে টাক, আলো পড়লে বোঝা যায়। তবে কেশের দৈন্য পুষিয়ে নিয়েছেন লালচে মোটা গোঁফে। একখানা পিক আপ ভ্যানে এসেছেন ওর বাবা। ওদের গ্রাম শহর থেকে মাত্র বাইশ কিলোমিটার দূরে। বাবা-মেয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে নিজেদের ভাষায়, যার একবর্ণও আমি বুঝি না। আমি বাইরে তাকিয়ে একটা অনন্ত নীল আকাশ, শ্যামল বনানী আর আমারই মতো উড়ে যাওয়া কটা পাখি দেখলাম।

বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হলো। দেড়তলা বাড়ি। পাকা গাঁথুনি তবে ছাদটা আমাদের দেশের টালির ছাদের মতো ঢালু। ওটা শীতের দেশের উপযোগী করে করা যেন বরফ না জমে। দেড়তলায় নিচু ছাদের একটা ঘর। দু’পাশে হালকা দুটো খাট বিছানো। সম্ভবত আমি আসবো বলে ঠিক করে রাখা হয়েছে। টয়লেট অবশ্য একতলায়। সামনে দু’পাশে বেশ জমি এবং জমির সীমানায় একটি ছোট্ট ঘর। যাই হোক, হাত ধুয়ে, লাঞ্চ খেতে বসলাম। ডানার মা, বাবার তুলনায় একটু বয়স্কা মনে হয়, বছর ষোলো বয়সের এক ভাই আর বছর চারেকের সবচেয়ে ছোট ভাই। ডানার বাবা ব্যাংকে কাজ করেন মা স্কুলের শিক্ষিকা। বড়ভাই সামনের বার স্কুল ফাইনাল দেবে আর ছোটটা একেবারে কিন্ডারগার্টেনে। বড়ভাই সম্ভবত উইলিয়াম, ছোটটির নাম স্যালী। ওর মা বললেন, ও কিন্তু জন্মেছিল তোমার দেশে। আমরা যখন ওকে নিয়েছি তখন এর বয়স সতেরো দিন, তাই না? বলে স্বামীর সমর্থন চাইলেন। খাওয়া খুব সাদাসিধা। রুটি, বাঁধাকপি আছে সেদ্ধ আলু দিয়ে বিরাট একটা কাঁচের বাটি ভর্তি সালাদ, আর পাতে বিফস্টেক। সঙ্গে ওয়াইন, তবে উইলিয়াম আর স্যালীকে দুধ দেওয়া হলো। খাবার পর একটু বিশ্রাম নিতে গেলাম।

পাঁচটায় ওর বাবা ওকে ডেকে ওঠালেন। চা খেয়ে নিয়ে গেলেন একটা লং ড্রাইভে। সন্ধ্যায় স্থানীয় একটা ছোট্ট ক্লাবে গান বাজনার আসরে উইলিয়াম গীটার বাজালো। ওর বাবা-মা সহ আমরা সবাই নাচলাম। সোফিয়াতেই মাস দু’য়েকের ভেতর এটা রপ্ত করে নিয়েছিলাম। ড্রিঙ্কস ওর বাবা কিনে সবাইকে দিলেন, স্যালী খেলো অরেঞ্জ জুস আর পটেটো চিপস্। দেখতে দেখতে সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন দাওয়াত এলো তোমার বান্ধবী এ্যালিনের বাড়ি থেকে। আমি আগেই বলেছি আর তুমিও জানো এ্যালী সাংবাদিক। ডানাদের সঙ্গে ওদের কি যেন একটা আত্মীয়তা আছে, ও দেশের লোক ওটার হিসাব রাখে না, তবে সেই সূত্রে পারিবারিক সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা বেশ নিবিড়।

এ্যালীর এ্যাপার্টমেন্ট কোপেনহেগেনে। ডানাই ওদের ছোট গাড়িটা চালিয়ে এলো। তখন সন্ধে সাতটা। আকাশে সূর্য মনে হয় মাঝখানে। একেবারে দুপুরের মতো আলো, ঐ পথের আলো বোধহয় আমার জীবনের আলোর রশ্মি দেখিয়েছিল। এ্যালীর এ্যাপার্টমেন্ট বেশ ছোটই। ঢুকতেই বসবার মতো ছোট্ট একটু জায়গা। খান চার পাঁচ গদী মোড়া চেয়ার। তারপর ঢুকতেই খাবার ঘর, মাঝারি টের্কিল, টেবিল ঘিরে দু’টা চেয়ার, একপাশে রান্নার ব্যবস্থা চুলা, ও-পাতিল রাখার জায়গা। বাঁ দিকে দরজা নেই কিন্তু পাতলা পর্দার ব্যবধান আছে এবং ওটাই বসবার জায়গা। দুতিনজন গল্প করছিলেন আমাদের দেখে হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। এ্যালী আমার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম ব্যক্তি হ্যানসেন এ্যালীর স্বামী, দ্বিতীয় মহিলা ক্রিস্টিন আইনজীবী, তৃতীয় জন সাংবাদিক নিয়েলসেন। আমার হাতটা ওর হাতের ভেতর কি একটু কেঁপে উঠেছিল? নাকি ওটা বুকের কাঁপুনির প্রতিক্রিয়া।

বাড়ি ফিরলাম প্রায় রাত একটায়। আজ ঢাকার রাস্তার কথা ভাবি। রাত একটা দূরের কথা, গতবার তো দুপুর একটায় আমাদের চোখের সামনে মতিঝিলে এক ভদ্রলোককে ছুরি মেরে তাঁর ব্রিফকেস নিয়ে গেল। অবশ্য এতো ১৯৭৪ সালের কথা বলছি, ঢাকাও তখন এমনটি ছিল না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডানা বললো, তারা, তোমার ভালো লাগেনি না? আমি ওর কাঁধে একটা চাপ দিয়ে বললাম, এতো ভালো সন্ধ্যা আমি আমার জীবনে উপভোগ করি নি। ডানা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। বললো, আমাদের আরও অনেক ভালো বন্ধু আছে কিন্তু এখন সামারে সবাই বাইরে গেছে ছুটি ভোগ করতে। তবে ঐ যে আইনজীবী মহিলাকে দেখলে, উনি ঠিক আসবেন আমাদের বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। উনি সমাজসেবামূলক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ, তাদের মেয়েদের অবস্থা, এসব জানতে চাইবেন। আর আশা করি নিয়েল আসবে নিজের গরজে। কেন, নিজের গরজে কেন? হয়ত অলক্ষ্যে আমার মুখে কিছুটা লজ্জার ছাপ পড়েছিল। ডানা হেসে বললো এখন বুঝলে তো নিজের গরজ।

স্বপ্নের মতো কুড়িটা দিন কাটিয়ে এলাম যেন বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, যাদের তিন-চারটি সন্তান আছে তাদেরও পালক পুত্র আছে এবং বুঝবার উপায় নেই কে পালিত আর কে গর্ভজাত। এক মহিলা ডানার মাকে তাদের পালিত পুত্রের যে প্রশংসা করলেন আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আবার এক সকালে ওর বাবা আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেলেন, সঙ্গে ওর মা। নিয়েল এসেছিল, কথা ও বেশি বলে না। শুধু বলেছিল সোফিয়াতে দেখা হবে শিগ্‌গির। ও ডানার গালে চুমু খেলো, আমার শুধু হাতটাই ধরেছিল। তাকিয়ে রইলাম আমি যতোদূর দৃষ্টি যায়। ঢাকা ছেড়ে আসবার দিন একবারও চোখে জল আসে নি। আজ যেন কিসের অভাবে আমার সমস্ত বুকজুড়ে সুখের অনুভূতি নামলো আমার দু’গাল বেয়ে। ডানার বাবা-মা জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন, আবার আসতে বললেন, এ তোমার নিজের বাড়ি যখন অসুবিধা হবে চলে এসো। হ্যাঁ, আজ ওবাড়ি আমার নিজের বাড়ি। এটাই ডেনমার্কে আমার বাপের বাড়ি আপা। আপনি তো দেখেছেন ওরা কেমন মানুষ। আর স্যালীর জন্য কেমন একটা মমতা অনুভব করি। স্যালী তো এখন পড়ছে। বড় হবে, উপার্জন করবে, বিয়ে করলে একটা পূর্ণ সুখী জীবন পাবে। আপা, আপনার মনে আছে এখান থেকে না গিয়ে নিয়ে এসেছিল এদের। বঙ্গবন্ধুর কতো সমালোচনা হয়েছে তখন। উনি নাকি বলেছিলেন কার ধর্ম কি হবে জানি না, তবে মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। সত্যিই তাই, স্যালী জানে ও ডেনিশ আর এখানকার জন্মানো একজন নাগরিকের সঙ্গে সব কিছুতে ওর সমান অধিকার।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আপনি এসেছিলেন মেক্সিকো যাবার পথে। পদ্মিনী ও আপনারা আর কয়েকজন গেলেন, আমি তখন এখানে এসে গেছি। অর্থাৎ নিয়েল চেষ্টা করে কোপেনহেগেনের বড় একটা হাসপাতালে আমার চাকুরির ব্যবস্থা করে দিল। নার্সদের কোয়ার্টারে জায়গা পেলাম। উইকেন্ডে কিছু কিনে নিয়ে ডানাদের বাড়িতে যাই আমরা দুজনে মিলে। সারাদিন থেকে নিয়েল আমাকে সন্ধ্যায় নামিয়ে দিয়ে যায়। ওর সঙ্গে সিনেমা দেখি, অপেরাতে যাই, আর ঘরে সময় পেলেই ডেনিশ ভাষা রপ্ত করি। কথাটা শিখতে খুব বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু লেখাপড়ায় যথেষ্ট সময় লেগেছে। আমরা ঠিক করেছিলাম ঐ সামারে আগস্ট মাসের শেষের দিকে বিয়ে করবো। এর ভেতর বহুবার নিয়েলদের বাড়িতে গেছি। ওর বাবা প্রথিতযশা চিকিৎসক, মা আমারই মতো নার্স থেকে এখন মিডওয়াইফ—এ তো আর আমার দেশ নয়! নার্স, মিডওয়াইফ এদের যথেষ্ট সম্মান সমাজে। বড় এক বোন আছে ওর। বিয়ে করে ওরা এখন অ’লিয়াতে ঘর করছে। ছোট ভাইও ডাক্তার। যখন তখন ওদের বাড়িতে যাই। আমি ওদেরই একজন। ওর বাবা-মা সব বিবেচনা করে ১৬ আগস্ট বিয়ের দিন ঠিক করলো! মহাসমারোহে যখন বিয়ের পর প্রকৃত বীরাঙ্গনার গর্ব নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় গেছি তখন সেই ছোট কুঞ্জকাননে বিবিসির সংবাদে শুনলাম বঙ্গবন্ধু নেই। মনে আছে নিয়েলের বুকে মাথা দিয়ে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম আমার পিতৃবিয়োগের ব্যথা-বেদনায়। উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, এই বীরাঙ্গনা তুই আমার মা। সে মুখ আমি আজও ভুলি নি। আমি বঙ্গবন্ধুর মা এই অহংকারই আমাকে জীবনযুদ্ধে জয়ী করেছে। ভাবলাম—না, নিজেকে আর বাঙালি বলে পরিচয় দেবো না। আমরা পিতৃহন্তা!

নিয়েলের ভালোবাসা ওদের স্নেহ-মমতা আমার অতীতকাল মুছে ফেললো। আশি সালে নিয়েল হঠাৎ প্রস্তাব দিলো ও একটি ছেলে দত্তক নিতে চায় যদি আমার সম্মতি থাকে। সমাজকল্যাণ দপ্তরে দরখাস্ত, হাঁটাহাঁটি অনেক চেষ্টা চরিত্র করে টমাসকে পেলাম। ও আইরিশ। গৃহযুদ্ধে বোমা পড়ে ওর বাবা-মা নিহত হয়। কেমন করে ও ডেনমার্কে এসেছে আমি ঠিক জানি না। তবে ওর মা ওকে হাসপাতালে দেখে নিয়েলকে জানান। কারণ ওকে এ বয়সে দত্তক দেবে না। ওখানে ইচ্ছে করলেই কিন্তু দত্তক নেওয়া যায় না। বিবাহিত দম্পতি এক সঙ্গে থাকতে হবে, বাচ্চা মানুষ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি থাকতে হবে, উপযুক্ত লোকের দেওয়া চরিত্র সম্পর্কিত প্রশংসাপত্রও লাগবে। সবই হলো। আমরা টমাসকে দত্তক নেবার মতো সক্ষম দম্পতি বলে বিবেচ্য হলাম। টমাসকে পেয়ে নিয়েল মহাখুশি। আমি একটি মেয়ে প্রত্যাশা করেছিলাম। ওকে সাজাবো, আদর করবো, মনের মতো করে বড় করবো। আমার শাশুড়ি তো মুখ ফুলিয়ে রইলেন। যাক কয়েক ঘণ্টার ভেতর টমাস আমাদের ব্যস্ত করে তুললো। বার বার নিয়েলকে বাইরে যেতে হলো ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে। আমার সমস্যা ছিল ভাষার ব্যবধান। পরদিন ওকে নিয়ে খেলনার দোকানে গেলাম, তারপর চকোলেট কিনতে। মুহূর্তে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। দু’বছর পর নিয়েল একটা আমন্ত্রণ পেলো দিল্লী থেকে। আমাকেও সঙ্গে নিতে চাইল টমাসসহ। রাজি হলাম। আমাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। আমি তো স্কার্ট ব্লাউজ অথবা জিনস্ পরি, চেহারাও বদলে গেছে। ঠিক করলাম যাবো।

১৯৮২ সালে দিল্লীতে এলাম। সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে যেন দেশের আকাশ-বাতাস স্পর্শ করলাম। হোটেল অশোকা নির্ধারিত ছিল। এসে উঠলাম। নিয়েলের একটা মিটিং ছিল সন্ধ্যা ছ’টায় ঐ হোটেলের লাউঞ্জে। আমি কলকাতায় দিদিকে ফোন করলাম। বললাম স্বামীর সঙ্গে এসেছি ছেলেকে নিয়ে। সায়েব বিয়ে করেছি শুনে দৌড়ে জামাইবাবুকে ডেকে আনলো। জামাইবাবু মনে হয় ফোনের ভেতর দিয়েই আমাকে টেনে নেবেন! বললাম তিনদিন নিয়েলের কনফারেন্স তারপর কলকাতা যাবে। যাবার আগে ফ্লাইট নাম্বার জানিয়ে ফোন করতে বললো। আমি নিয়েলকে সব বললাম। নিয়েল খুব খুশি হলো। বললো এবার বাঙালি জামাই হয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। নিয়েল ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে। টমাস ইংরেজি গোটা কয়েক শব্দ জানে। তার বেশি এখনও আয়ত্ব করতে পারে নি।

দিল্লী থেকে দিদির জন্য শাড়ি আর জামাইবাবুর জন্য শাল কিনলাম। বাবার জন্যেও একখানা শাদা শাল কিনতে চাইলাম কিন্তু না যদি ও পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারি তাহলে একটি বাড়তি দুঃখ থেকে যাবে। বাচ্চারা ক’জন কতো বড় হয়েছে জানি না। থাক, কলকাতায় কতো কিছু পাওয়া যায়। এই দিদিকেই পোল্যান্ড থেকে ফোন করেছিলাম। দিদি ছিঃ বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিল। না, আমার অতীত মৃত। আমি বর্তমান মিসেস টি. নিয়েলসেন।

দিদি, জামাইবাবু ঠিকই এয়ারপোর্ট এসেছেন। দিদি বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আমার চোখে এখন আর জল আসে না। সব ঝরে ভাণ্ডার শুকনো হয়ে গেছে মনে হয়। সোজা ওদের বাসায় গিয়ে উঠলাম ভবানীপুরে। ফ্ল্যাটটা মোটামুটি মন্দ না। আমরা অবশ্য হোটেলেই থাকবো দিল্লী থেকে বুকিং করে এসেছি। হোটেল পার্ক স্ট্রীটে। চা খেয়ে দিদিকে বললাম সে কথা। দিদি কিছুতেই শুনতে চায় না। জামাইবাবু বুঝলেন। বললো, ওরা ক্লান্ত, যাক মুখ-হাত ধুয়ে স্নান সেরে এসে রাতে এখানে খাবে আবার সকালে উঠেই চলে আসবে। রাগ হলো। দিদি পাশের ঘরে টেনে নিয়ে বললো, তুই ভাগ্যবতী, বড় সুন্দর জামাই হয়েছে তোর। আর ছেলেটাও যেন কার্তিক। হারে রাজশাহী যাবি না। আমি কেঁপে উঠলাম। বললো, কাল বাবাকে ফোন করেছিলাম। বাবা-মা দুজনেই বারবার করে তোদের যেতে বলেছেন। কোনও অসুবিধে হবে না। জামাই মনে মনে হাসলেন কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে কিছু বলবে। বাবার নাম্বার নিলাম ওর কাছ থেকে। ভাবলাম নিজেই ফোন করে সঠিক অবস্থা জেনে নেবো। যে লাঞ্ছনার জীবন পেছনে ফেলে এসেছি, স্বামী-সন্তান নিয়ে সে কালি আর গায়ে মাখবো না।

পরদিন সকালে বাবাকে ফোনে পেলাম। বাবা হাউ মাউ করে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন। শুধু বারবার বলতে লাগলেন মাগো, আমায় ক্ষমা কর। বললাম আগামী পরশু ঢাকা যাবো। তুমি কষ্ট করে ঢাকায় এসো না, আমি ঢাকা পৌঁছে ফোন করবো। মাকে ফোন দিতে বললাম, মার গলা পেলাম, শুধু মা মা করে কয়েকবার ডাকলেন এবং ডুকরে কেঁদে উঠলেন! নিয়েলকে সব বললাম। ও অবশ্য আগেই ঢাকায় প্রোগ্রাম করে রেখেছিল কারণ ‘৭১ সালের পর ও আর ঢাকায় যায় নি। তাই ও আনন্দে রাজি হয়ে গেল। এয়ারপোর্টে বাবা, দাদা আর ওর এগারো বছরের ছেলে জয় উপস্থিত ছিল। এতো সাদর অভ্যর্থনার পরও দাদার শ্বশুরবাড়িতে উঠতে রাজি হলাম না। হোটেল বুকিং নিয়েল আগেই করে এসেছিল। তাই সবাই শেরাটনে গেলাম, খাওয়া দাওয়া সেরে বাবাকে চলে যেতে বললাম। আমরা কদিন ঢাকা থেকে যাবো। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না, বললেন একা ফিরে গেলে মা তাকে বাড়ি ঢুকতে দেবেন না। অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য ওরা চলে গেলে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাভার গেলাম জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে, ফিরে এসে বত্রিশ নম্বরের সামনে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এসেছেন। পুলিশ পাহারা আছে, তবে ঢুকতে দেয়। ভাবলাম ফিরে যাবার পথে নিয়েল অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই এ বাড়িতে আসবে, তখন আমিও অনুমতি পাবো ঢুকবার জন্য। টমাসকেও দেখানো দরকার। আমি কখনও ভুলি না ও ডি ভ্যালেরার দেশের ছেলে। জিদ্দীও হয়েছে খুব। গেটের সামনে থেকে কিছুটা ধুলা তুলে নিজের ও টমাসের কপালে মাখালাম। নিয়েল নিজেই নিজের কপালে ধুলো ছোঁয়ালো। ও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছে, কথা বলেছে। তাই ও যথেষ্ট আবেগতাড়িত ছিল। শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ফিরে এসে যাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। এবার রাজশাহী পর্ব। আমার জীবনের সর্বকঠিন অগ্নিপরীক্ষা।

ফিরবার পথে বাবা অনর্গল কথা বলে চলেছেন। একপাশে টমাস, এক পাশে দাদার ছেলে জয়। মনে হলো টমাসের নামকরণ যদি আমি করতাম তাহলে হয়তো জয় রাখতাম। মেয়ে হলে রাখবো জয়া। সেখানেও পরাস্ত হয়েছি। শাশুড়ি আগেই নাতনির নাম ঘোষণা করেছেন। তারার মেয়ে হবে নোরা, মায়ের মতোই দৃঢ়চেতা সংস্কারমুক্ত, তাঁর আবেগ ও যুক্তি কোনোটাকেই আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। আমি বাবার দিকে তাকিয়েই আছি। ট্রেন চলছে দ্রুত গতিতেই। বাবা টমাসের সঙ্গে কখনও বাংলা কখনও ইংরেজিতে কথা বলছেন। নিয়েল নিচু গলায় দাদার সঙ্গে আলাপ করছে। আমি দীর্ঘ দশ বছর পর ফিরে গেছি শৈশবে। মনটা এখন বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাদা একটা বুদ্ধির কাজ করেছিল। বাড়িতে কাউকে জানায় নি আমরা কোন ট্রেনে আসবো। এটা দাদার আত্মরক্ষার প্রয়াস কিনা জানি না তবে অতিরিক্ত হৈ চৈ নিয়েল পছন্দ নাও করতে পারে।

খুব ধীর পায়ে গেট ঠেলে সবার আগেই ঢুকলাম। বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের চিহ্ন বর্তমান। বাবা বাগানের যত্ন বাড়িয়েছে মনে হয়। তেমনই বেড়ার গা দিয়ে সারিবদ্ধ রজনীগন্ধা আর দোলনচাঁপা। আর চাইতে পারলাম না। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। গাড়ির শব্দ পেয়ে মা বেরিয়ে এলেন। প্রণাম করবার জন্য মাথা নিচু করতেই মা সন্তানহারা জননীর মতো আর্তনাদ করে উঠলেন। মাকে টেনে ভেতরে নিলাম। নিয়েলও আমার মতো নিচু হয়ে মায়ের পা ছুঁতে গেল। মা জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। এরপর সবটুকু যত্ন, ভালোবাসা, আদর সোহাগ পেলো টমাস। মা বললেন টমাস তার বাবা-মা কারও মতো হয় নি। হয়েছে তার দাদুর মতো অর্থাৎ আমার বাবার মতো। হবে না কেন রক্তের ধারা বইছে না! ওদের আনন্দ গর্ব নিয়ে ওরা থাকুক, এর থেকে ওদের বঞ্চিত করবো না। বউদি সম্ভবত আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। মুখখানা মিষ্টি। এবার মুখ-হাত ধুয়ে ব্যাগ খুলে যার জন্য যা এনেছি সব বের করলাম। সবাই খুশি।

পাড়ায় খবর রটে গেল। বাড়ি প্রায় ভরে উঠলো। নিয়েল সবার সঙ্গে হাত মেলালো কেমন আছেন, ভালো ইতাদি বলে অসংখ্য হাততালি পেলো। দাদাকে ডেকে বললাম নিয়েলের জন্য স্থানীয় কোনও রেস্টহাউজ বা হোটেলে দু’দিনের জন্যে ব্যবস্থা করে দিতে। ওর সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। দাদা বুঝলো, ঘণ্টাখানেকের ভেতর নিয়েল ও ছোট পিঠ ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল। ভুললে চলবে না ও সাংবাদিক। শহর ঘুরে পাঁচজনের সঙ্গে কথা না বলে ওর শান্তি হবে না। টমাসের টিকিটিও দেখছি না। মনে হয় বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরেও নেই।

বউদি মাঝে মাঝে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। গরমে আমার প্রাণ বেরুচ্ছে। মা আমাকে ওপরে নিয়ে এলেন। বললেন, শুধু শুধু জামাইকে হোটেলে পাঠালি এই দেখ তোদের জন্য ঘর গুছিয়ে রেখেছি। সঙ্গে রাথরুমও আছে। হঠাৎ মনে পড়লো বাবা বলেছিলেন সরকারি সাহায্য পেয়েছেন। তাই দিয়ে ওপরে ঘর তুলেছেন। আমার নারীত্বের মূল্য এই ঘর! আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি অতীতকে কখনও আর সামনে আনবো না। ঠিক আছে এতোবড় মূল্য যখন দেশের মুক্তির জন্যে দিয়েছি তখন অভাবগ্রস্ত পিতা না হয় একটু স্বাচ্ছন্দ্য পেলেন। আজ মনে হচ্ছে গৃহদাহের অচলার বাবা কেদার বাবুর কথা। আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করেছি—মহিম, অচলা, সুরেশ, বৃক্ষলতা, পশু-পক্ষী সবাইকে। আমিও, হ্যাঁ আমিও, তাই করলাম মা। মা হঠাৎ ঘুরে বললেন কিরে ডাকলি কেন? বললাম না তো, এমনিই মাঝে মাঝে তোমাকে ডাকি। ঘরে বসিয়ে মায়ের কতো কথা। জামাই কি ওসব জানে। বললাম, তুমি ভেবোনা মা। তোমার জামাই, তার-বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সবাই জানে। সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে আর সম্মান করে। ওরা অনেক বড়, অনেক উদার তা না হলে এমন স্বভাব হয়, মা নিশ্চিত হলেন।

সন্ধ্যাবেলায় দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের সেই মকবুল চেয়ারম্যানের খবর কি রে? নিয়েল একবার ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ও তো নেই ‘৭২-এর ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ওকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। একটা বড় করে নিশ্বাস নিলাম। কিছু প্রতিকার হয়েছে তাহলে। দাদা ভারাক্রান্ত গলায় বললো, কিন্তু হলে কি হবে, ওর ছেলেটা এখনই বাবার পথ ধরেছে। এখন তো রাজাকার পুনর্বাসন চলছে, ও লাইন দিয়েছে। হয়তো-বা কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়ে যাবে।

না, আমি নির্বাসিত হলেও রাজাকার আলবদর নির্বাসিত হয় নি। বরং আমাদের উপর অত্যাচার চালাবার জন্য পুরস্কার পেয়েছে ও পাচ্ছে। তবে দেশের অবস্থা কিন্তু খারাপ মনে হলো না। বিশেষ করে পথে-ঘাটে-দোকানে-বাজারে অনেক মেয়ে ও মহিলা দেখলাম, যা ‘৭১-এর আগে চোখে পড়ে নি। দাদা বললেন ত্রিশলক্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ায় অনেক পরিবারের মহিলাদের পথে বেরুতে হয়েছে উপার্জনের তাগিদে, বাঁচবার আশায়। ভাবলাম মুক্তিযুদ্ধ নারীমুক্তি সহজ করেছে কিন্তু পুরুষেরা মনে হয় আরও বীর্যহীন পৌরুষহীন হয়ে পড়েছে, নইলে রাজাকার আলবদর মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী? তারার মনে হয় বিশ্বপৌরুষ যেন আজ নারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থেমে যাচ্ছে। সময় স্বপ্নের মতো কেটে গেল। নিয়েল উপভোগ করলো আর টমাসের তো কথাই নেই। পাটালি গুড়ের আমসত্ত্ব থেকে শুরু করে আমড়া, চালতা পর্যন্ত ভক্ষণ করা হয়েছে ওর। সারাদিন পুকুর, বাগান, মায়ের পূজোর ঘর, রান্নাঘর করে বেড়ালো। এক নতুন জগৎ দেখে গেল।

বাবাকে আগেই বলেছি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। কারণ আমাকে আনতে যাবার কারণ স্পষ্ট, কিন্তু দিয়ে আসাটা আমি সহ্য করতে পারবো না। নিয়েল স্থানীয় প্রেসক্লাবেই সময় কাটালো, তবে তার মুখ দেখে বুঝলাম ও ওর প্রত্যাশিত সংবাদ বা ইপ্সিত মন মানসিকতা খুঁজে পায় নি।

আসবার আগে দাদা এবং বাচ্চারা স্টেশনে এলো। বাবা আর মা গেটের বেড়া ধরে দাঁড়ানো। প্রণাম করতেই বাবা শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। শুধু অস্পষ্ট উচ্চারিত একটি শব্দই আমার বোধগম্য হলো। বাবা আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন, কিন্তু কেন? বাবার কি আর কিছু করবার ছিল? সেদিনের বাঙালি-দেহে স্বাধীন হলেও মনটাকে তো পরিচ্ছন্ন করেতে পারে নি। কই একজন বীরাঙ্গনার খোঁজ তো আমি অর্ধবিশ্ব প্রদক্ষিণ করেও পাই নি। ছিঃ ছিঃ ধিক্কার দিলাম আমি নিজেকে নয়, বাঙালির জরাব্যাধিগ্রস্ত সামাজিক ন্যায়নীতি বোধকে। ওদের কাছে মানুষের চেয়ে প্রথা বড়!

মা জড়িয়ে ধরে হাতে কি যেন একটা গুঁজে দিলেন, বললেন, টমাসের বউকে দিস, বলিস ওর দিদিমা দিয়েছে। মুঠি খুলতে দিলেন না। বললাম মা, এখুনি কেন, আমি আবার আসবো। বললেন–এসো, তবে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। তোমাকে দেখবার জন্যই প্রাণটুকু বেরিয়ে যায় নি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। বাঁক ফিরতেই হারিয়ে গেলেন বাবা-মা, আমাদের বাড়িঘর, আমার শৈশবের লীলাভূমি তারুণ্যের স্বপ্নসাধ ঘেরা জন্মস্থান। কিন্তু কেন যেন আর ভাবতে পারছি না। সারাটা পথ টমাস শুধু আমাদের দুজনকে ক্রমাগত বিরক্ত করে গেল। কেন আমরা ফিরে যাচ্ছি, কোপেনহেগেন কেন? কেন দাদুর বাড়ি থাকছি না, ইত্যাদি। নিয়েল শুধু সান্ত্বনার স্বরে বললো, তারা মন খারাপ করে না, আমরা আবার আসবো। আমি শুধু জানি, আসবার জন্য তারা ব্যানার্জী কাঁদবে, কিন্তু মিসেস টি. নিয়েলসেন নাড়ির বন্ধন কেটেই এবার ফিরে যাচ্ছে? কেন একথা ভাবলাম বলছি তোমাকে আপা।

ফিরে এসে ভেবেছিলাম খুব মন খারাপ হবে কিন্তু সামলে নিলাম। শুধু ফিরবার পথে ট্রেনে হাতের মুঠি খুলে দেখলাম মা তার গলার হার দিয়েছেন তাঁর নাতি টমাসের বউয়ের জন্য। জন্ম থেকে এ হার মায়ের গলায় দেখেছি। ভাবি, সত্যিই কার্যকারণ দিয়ে মানুষের মনকে বিচার করা যায় না। কোথায় জন্মেছে টমাস আর কোথা থেকে এলো তার এই দিদিমা! জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উপহার রেখে গেল মা এই পালক নাতির জন্য, অবশ্য টমাসের প্রকৃত পরিচয় আমার পরিবার কেন, আমাদের পরিচিতরাও অনেকেই জানেন না।

কিছুদিন পর নোরার জন্ম হলো। আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে নোরা মনে হয় যাদু করলো। ওরা মাঝে মধ্যে শুক্রবার বিকেলে আসতেন আর রবিবার ডিনার শেষে যেতেন। অবশ্য পরে নোরাই শুক্র-সোম করতো দাদা দাদির বাড়িতে।

তোমার তো এখন পরিপূর্ণ স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, আদর, ভালোবাসা, কর্মক্ষেত্রের সাফল্য, যশ, খ্যাতি। তোমার তো আর কিছুরই অভাব নেই। তুমি সব ভুলে নিজেকে এখন সম্পূর্ণ একজন সুখী ও সার্থক নারী বলে ভাবতে পারো। এখন তোমার কিসের অভাব ও অস্বস্তি তারা? গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

গভীর রাতের তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে তারা যেন হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সন্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো আপা দেশ স্বাধীন হয়েছে, কেউ গাজী—কেউ শহীদ। কেউ বীরউত্তম, বীরশ্রেষ্ঠ, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রদূত সবার কতো সম্মান সুখ্যাতি। আর আমি? আমি কিছু চাই নি, চেয়েছিলাম শুধু আমার নারীত্বের মর্যাদা আর প্রিয় জন্মভূমির বুকে আশ্রয়। স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে। সেখানে সেদিন সম্মান মর্যাদা সবই পেলো মিসেস টি. নিয়েলসেন আর টমাসের মা। আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য, নিন্দিত, মৃত।

আর বাংলার মাটি–তাকেও তো আমি হারিয়েছি। আমি আজ ডেনমার্কের নাগরিক। আমাকে তো কেউ বাঙালি বলবে না। তোমার কাছেও তো আমার দু’বছর লাগলো নিজের পরিচয় তুলে ধরতে। আমার এ সংকোচ, এ লজ্জাবোধ কেন বলতে পারো? সমগ্র জীবনে আমার চলার পথে অপরাধটা কোথায়? যে বাবা, ভাই আমাকে দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে নি তারাই বিচারকের আসনে বসে আমাকে অপবিত্র অশুচি জ্ঞানে পরিত্যাগ করলেন। কি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা ভাবলে ঘৃণা হয়। আর যে আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন সে এক ছদ্মবেশধারী বিদেশিনী। আপা আমি যখন ছোট্ট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ির পাশে একজন সরকারি উকিল ছিলেন। প্রায়ই দেখতাম সুন্দর এক তরুণী সেজেগুজে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ও বাড়িতে আসতো। এদের বাড়ির মেয়ে মিলি ছিল আমার বন্ধু। কৌতূহলবশে একদিন জিজ্ঞেস করলাম মিলিকে ওই মহিলার কথা। মিলি বললো, ও তো বাবার মক্কেল শরীয়ত উল্লাহ্‌র বউ। ওকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল গুণ্ডারা। চার-পাঁচদিন পর ও ফিরে এসেছে। ওর স্বামী তাই মামলা করেছে গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে।

এবার আমার অবাক হবার পালা। বললাম, ও থাকে কোথায়? কেন, ওর স্বামীর বাড়িতে। ওমা ওর স্বামী ওকে ঘরে নিলো? হ্যাঁ নিয়েছে। বউটা আমার মাকে বলেছে, জানেন মা, আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্মে বাজারের মেয়ে বিয়ে করে আনা যায়। আমার স্বামী বলে, তোমাকে রক্ষা করতে না পেরে এক গুনাহ করেছি আবার ত্যাগ করবো? মরলে আল্লাহর কাছে আমার তো মুখ দেখাবার পথও থাকবে না।

আমি যখন পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছিলাম, কতো স্বামী-ভাই-বাবা এসেছেন মুসলমান সমাজের কিন্তু মেয়ে, বউকে কেউ ফিরিয়ে নেন নি। একজন আর্মি অফিসারও ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। বউকে বললেন মাসে মাসে টাকা দিতে পারে কিন্তু ঘরে নিতে পারবেন না। মনে হয় তিনি এতোদিনে জেনারেল হয়ে গেছেন তার বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছেন, আর সুলতানা সম্ভবত টান বাজারে জীবনযুদ্ধের শেষ লড়াইয়ে ব্যস্ত। ভাবি ওই মিলিদের বাড়ির সেই শরীয়তউল্লাহ্‌রা কি সব মুক্তিযুদ্ধে মরে গেছে। আমার কি মনে হয় জানো, মুসলমানরা লেখাপড়া শিখে বেশি বেশি ভদ্র হয়েছে, হিন্দুদের অনুকরণ করে তাদের সমান হয়েছে। তাই তারাও ঘর পায় নি আর সুলতানার স্বামী সন্তান জোটে নি।

হঠাৎ হাতঘড়িটা দেখে বললো তারা, কি সর্বনাশ! তিনটে বাজে যাও যাও তুমি শুতে যাও। ছিঃ ছিঃ আমি তোমাকে এতো কষ্ট দিলাম। হেসে বললাম, আমরা তো তোমার প্রাপ্য তোমাকে দিই নি। আমাকে কষ্ট দেবার অধিকার তো তোমার আছে। না না, তবুও হ্যাঁ, তোমাকে শেষ কথাটা বলে যাচ্ছি নীলা আপা, আমি নিয়েলকেও বলে রেখেছি আমার মৃত্যুর পর আমাকে কেউ বাংলাদেশে নেবার চেষ্টা করো না। জন্ম দিলে জননী হওয়া যায় কিন্তু লালন পালন না করলে মা হওয়া যায় না। আমি জন্মেছিলাম সোনার বাংলায়, লালিত হচ্ছি ডেনমার্কের কঠিন ভূমিতে। তবুও সেই মাটিতেই হবে আমার শেষ শয্যা। দেশে ফিরে আমি সামান্য একটি অজ্ঞাত উপেক্ষিত মেয়ে। কিন্তু প্রতি নিশ্বাসে আমি অভিশাপ দেই বাঙালি সমাজকে তার হীনমন্যতার জন্যে, মাকে অসম্মান, অপমান করাবার জন্য। একটি মাত্র মানুষ ও দেশে জন্মেছিল, তার স্নেহস্পর্শে আমি ধন্য হয়েছি। আমি তো তুচ্ছ অনাদরে কন্যা। তোমরা পিতৃঘাতী, সমস্ত বিশ্ব আজ তোমাদের ধিক্কার দিচ্ছে কুচক্রী পিতৃহন্তা, লোভী ইতর। বিশ্বসভায় তোমাদের স্থান নেই। ওখানেই সোফায় আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে তারা শুয়ে পড়লো।

তারপর দেখা হয়েছে নব্বইয়ে। টমাস সাংবাদিক, নোরা ডাক্তার হবার পথে। নিয়েলের মা মারা গেছেন। বাবা আছেন। ওরা পালা করে দেখাশোনা করে। কিন্তু তারা কেমন যেন নিভে যাচ্ছে। ওকে আড়াল করে নিয়ে আমাকে বললো, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। দেহ সুস্থ। আমার মা মারা যাবার পর ও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র টমাসের সঙ্গে কথা বলে আর আমরা জিজ্ঞেস করলে জবাব পাই। নীলা, তুমি ওকে একটু বোঝাও। সন্ধ্যায় দু’জনে বসে আছি মুখোমুখি। তারা হঠাৎ উঠে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কেন? কেন? সবাই সব কিছু পারে আর আমি শুধু হারবো? কেন? কেন নীলা আপা, বলো? আমি ওর মাথাটা বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ও উঠলো। মুখ ধুয়ে কফি করে নিয়ে এলো। আগের মতোই তারা জ্বলছে, ওর চোখের আলো আবার যেন আমার সারা দেহমন আলোকিত করে দিলো। নিয়েল ঠিকই ধরেছে ও, ওর মা এবং শাশুড়ি উভয়ের সমন্বয়ে যাকে পেয়েছিল তাকে হারানোর পর থেকেই এ রক্তক্ষরণ। এতো কষ্ট ও সহ্য করেছে যে তারও সীমারেখায় যেন পৌঁছে গেছে ওর সহিষ্ণুতা।

নববর্ষে কার্ড পাই। ভালো আছি, মঙ্গল চাই। বিনিময়ে আমারও ওই একই শুভেচ্ছা ভালো থেকো, আনন্দে থেকো।