হাত-পা ছুঁড়ে ছুটবার চেষ্টা করল রানা। সফল হলো না। রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে দড়াম করে এক বাড়ি মারল একজন রানার পশ্চাদদেশে। কয়েক পা এগিয়ে গেল রানা সে ধাক্কায়। বুঝল, বাধা দেয়ার চেষ্টা বৃথা। একজন বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে ওর ফুলে ওঠা কব্জি। বাম হাতে এতগুলো লোকের সঙ্গে পারবে না ও।

তা ছাড়া ওয়ালী আহমেদের কাছে পৌঁছবার আগেই শেষ হয়ে যেতে চায় না ও। খোদা কিছু শক্তি অবশিষ্ট রেখো। ওয়ালী আহমেদের কণ্ঠনালীটা ছিঁড়ে ফেলতে পারলে আর কিছুই চায় না ও। তারপর ওর কপালে যা হয় হোক।

সমুদ্রের দিকে স্টোর-হাউসের একটা দরজা খুলে হাঁ করা। ওই পথেই এসেছে ওরা। ওই পথেই বের করে আনল রানাকে বাইরে। কোথায় নিয়ে চলেছে ওকে ওরা? তা হলে কি প্রতিশোধ নেয়া হলো না? লঞ্চ ঘাটের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল ওরা রানাকে।

বাইরে খোলামেলা জোলো-হাওয়া। সমুদ্রের একটানা শোঁ শোঁ গর্জন। আর আকাশে আধখানা চাঁদ। সারা আকাশ জুড়ে টিপ টিপ করছে অসংখ্য ম্লান তারা। রানার হাতঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। রানা ভাবল, কার বারোটা বাজল? ওর, না ওয়ালী আহমেদের।

সরু দুটো তক্তা জোড়া দিয়ে লঞ্চে ওঠার গ্যাংওয়ে বানানো হয়েছে। কয়েকটা ঝটকা দিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার বৃথা চেষ্টা করল রানা। সতর্ক রয়েছে লোকগুলো। দড়াম করে পিঠের ওপর পড়ল রাইফেলের কুঁদো। সামনের টানে এবং পিছনের কয়েকটা প্রবল ধাক্কায় লঞ্চের ওপর উঠে এল ও চোখের সামনে প্রচুর শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে। কিন্তু এই ধস্তাধস্তিতে কাজ হলো। বুকের কাছে শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে গেল।

একটা কেবিনের দরজায় তিনটে টোকা দিল একজন।

‘ভেতরে এসো,’ গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

ওয়ালী আহমেদ! চিনতে পারল রানা গলার স্বর। লাফিয়ে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। আল্লা! এখনও সুযোগ আছে! শেষ চেষ্টা করে দেখবে ও। নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করল রানা। মাথা ঠিক রাখতে হবে এখন।

প্রশস্ত একটা কেবিন। ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে ওয়ালী আহমেদ। হাতের কাগজটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখা।

‘শেষ পর্যন্ত আসতেই হলো আপনাকে, মিস্টার মাসুদ রানা। কিন্তু দুঃখ, আমার ইচ্ছেমত এক্সপেরিমেন্টাল মৃত্যু দিতে পারলাম না আপনাকে। অবশ্য মোহাম্মদ জানের ওপর দিয়ে সে কাজটা সেরে নেয়া গেছে অনেকটা। বোঝা গেল আড়াই মিনিটের বেশি লাগবার কথা নয়। ভীতু বেড়াল-ছানার মত সারা দিন হোটেলের মধ্যে বসে থাকলেন হোটেলময় একঝাড় টিকটিকি ছড়িয়ে। ভাবছিলাম ফস্কে গেলেন বুঝি। কিন্তু বিদায়ের আগে ঠিক দেখা হয়ে গেল। কপালের লিখন খণ্ডাবে কে!

রানা কোনও উত্তর দিল না। ডান হাতের কব্জির ব্যথায় মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল একটা। হাতটার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল ওয়ালী আহমেদ। একটা পান ফেলল মুখে।

আজ আর গত কালকের মত লেকচার দিয়ে আপনার বিরক্তি উৎপাদন করব না। আর তিন মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু ঘটবে আপনার। পাথর বেঁধে ফেলে দেয়া হবে লাশটা সাগরে। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টোর হাউসটা ঘিরে ফেলবে আর্মড ফোর্স। আমার বিরুদ্ধে কিছুই পাবে না তারা সেখানে। তবু ওরা এসে পড়বার আগেই আমি ইয়টে পৌঁছে যেতে চাই। সন্দেহজনক কিছু নেই। ওই ইয়টে। বিনা বাধায় দু’হাজার নয় শ’ মাইল, অর্থাৎ চিটাগাং পর্যন্ত চলে যাবে ইয়ট। এখান থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণে একটা হেলিকপ্টার এসে তুলে নিয়ে যাবে আমাকে রাওয়ালপিণ্ডি।’

ঘড়ির দিকে চাইল ওয়ালী আহমেদ।

‘আর দু’মিনিট আছে। আপনার শেষ ইচ্ছা কিছু থাকলে বলতে পারেন, মিস্টার মাসুদ রানা।’

‘দুই মিনিটের আগে মারবেন না আমাকে?’

‘না।’

‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনার দু’মিনিট পূর্ণ হবার আগেই আমি ঢলে পড়ব মৃত্যুর কোলে,’ বলল রানা। চোখের ইঙ্গিতে বোতাম ছেঁড়া শার্টের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওয়ালী আহমেদের। বিষ ছিল এ বোতামে। খেয়ে নিয়েছি আমি।’

বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চাইল ওয়ালী আহমেদ রানার দিকে। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে রানার দেহটা। ঢুলছে ও অল্প অল্প। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর। টেনে টেনে বলল, ‘আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবেন?’

মাথা নাড়ল ওয়ালী আহমেদ। ‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে চিঠি দেব একটা। আমার…আমার বাগদত্তা স্ত্রীর কাছে। উহ! আপনার বিরুদ্ধে কিছুই…কিছুই থাকবে না সে চিঠিতে। উহ্, পানি!’

হাঁপাতে থাকল রানা। লাল হয়ে উঠল ওর চোখ-মুখ। মুচকি হাসল ওয়ালী আহমেদ। সামনের টেবিলে রাখা একটা সাদা প্যাডের দিকে ইঙ্গিত করতেই একজন তুলে ধরল সেটা রানার সামনে। পা দুটো কাঁপছে রানার থরথর করে। ডান হাতটা ছেড়ে দেয়া হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে বল পয়েন্ট পেন বের করল রানা।

কিন্তু বোতাম টেপার আগেই টের পেয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ। চট করে পেপার তুলে ধরায় মুখ পর্যন্ত গেল না অ্যাসিড—কাগজে বেধে গিয়ে টপ টপ করে পড়ল কয়েক ফোঁটা ভুঁড়ির ওপর। ফড়ফড় করে পুড়তে থাকল ভুড়ির চামড়া। জ্বলুনির চোটে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার করে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ।

এক ঝটকায় বাঁ হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। বাকি অ্যাসিডটুকু শেষ করল স্যাঙাতদের ওপর। পাগলের মত নাচানাচি আরম্ভ করল লোকগুলো। অন্ধের মত ছুটাছুটি শুরু করল ঘরের মধ্যে।

ওয়ালী আহমেদ দৌড়ে গিয়ে একটা ড্রয়ার ধরে টান দিল। পরমুহূর্তে সিংহের মত লাফিয়ে পড়ল রানা ওর ওপর। পিস্তলটা আর বের করা হলো না। শিরদাঁড়ার ওপর রানার কনুয়ের এক প্রচণ্ড গুঁতো খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল ওর দেহটা। তারপর পাঁজরের ওপর এক লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল ওয়ালী আহমেদের মেদ বহুল দেহটা মেঝেতে। কব্জির ব্যথার কথা ভুলে গেল রানা। বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিপে ধরল ওর টুটি। ঠিকরে বেরিয়ে এল ওয়ালী আহমেদের চোখ দুটো বাইরে।

এমন সময় স্যাঙাতদের একজন এসে চেপে ধরল রানার চুলের মুঠি। ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিল রানা। পায়ে বাঁধা ছুরিটা বের করে চালিয়ে দিল ও লোকটার পেট আন্দাজ করে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। চুল ছেড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে চিত হয়ে পড়ল লোকটা। আর রিস্ক নেয়া যায় না। লাফিয়ে উঠে ড্রয়ার থেকে বেরেটা অটোমেটিক পিস্তলটা বের করল রানা। স্লাইড টানতেই ইজেক্টারের টানে ছিটকে বেরিয়ে একটা গুলি পড়ল মেঝেতে। লোডেড।

উঠে বসেছিল ওয়ালী আহমেদ। মুখের ওপর রানার বুটের এক লাথি খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার। থুক করে দুটো রক্ত মাখা ভাঙা দাঁত বের করে ফেলল মুখ থেকে। তারপর জ্ঞান হারাল। লঞ্চটা চলতে আরম্ভ করেছে তখন। ঘরের মধ্যে দুজন এবং দরজার কাছে একজন স্যাঙাত পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে। বাকি দুজন কেবিন থেকে বেরিয়ে বোধহয় সংবাদ দিয়েছে অন্যান্যদের। দ্রুত সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে ওরা লঞ্চটাকে ঘাট থেকে। একবার ইয়টে পৌঁছতে পারলে আর রক্ষা নেই রানার।

ওয়ালী আহমেদের একটা পা ধরে হিড় হিড় করে টেনে কেবিন থেকে বের করে আনল রানা ডেকের ওপর। রাইফেলটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। গলার ফাঁসটা খুলে ওয়ালী আহমেদের গলায় পরাল। তারপর বেঁধে ফেলল ওকে রেলিং-এর সঙ্গে ছাগলের মত।

কয়েক পা এগোতেই সারেংকে দেখা গেল।

লঞ্চ ঘুরাও।

চমকে উঠেই পালাতে যাচ্ছিল সারেং—পিস্তলটা দেখে থেমে গেল। ঘুরিয়ে দিল লঞ্চ। ঘাট থেকে অল্পদূরেই গিয়েছিল, ফিরে চলল আবার সেটা ঘাটের দিকে।

চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখল রানা। আর লোকগুলো কোথায় গেল? কোনদিক থেকে আক্রমণ আসবে এবার?

নড়েচড়ে উঠল ওয়ালী আহমেদের দেহটা। জ্ঞান ফিরে পেয়েছে সে।

‘খবরদার! এক ইঞ্চি নড়েছ কি খতম করে দেব!’ বলল রানা সারেং এবং ওয়ালী আহমেদকে লক্ষ্য করে। চোখ মেলে চাইল ওয়ালী আহমেদ। চারদিকে চেয়ে সবটা পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করল সে।

আর গজ পঁচিশেক আছে। হঠাৎ ডান ধারে পায়ের শব্দ শুনে সেদিকে চাইল রানা। পিস্তল হাতে রানাকে দেখে থমকে দাঁড়াল ওরা। সেই দুজন স্যাঙাত। বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা। বিনাবাক্যব্যয়ে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ।

এমনি সময় ঘটল ঘটনাটা। রানা অন্যদিকে চাইতেই বাঁধন খুলে ফেলেছিল ওয়ালী আহমেদ, এবারে তড়াক করে রেলিং টপকে পানিতে গিয়ে পড়ল।

‘সার্চ লাইট পানিতে ফেল, সারেং। জলদি।’

হুকুম করল রানা। ‘জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে না পারলে মেরে রেখে যাবে।’

জ্বলে উঠল তীব্র আলো। সে আলোয় বিস্মিত হয়ে দেখল রানা খলখল করে হাসছে যেন সাগরের জল। জীবন্ত হয়ে উঠেছে লঞ্চের চারটা পাশ প্রাণচাঞ্চল্যে।

ব্যাপার কী? প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। বুঝতে পারল ওয়ালী আহমেদ ভেসে উঠতেই। ভুস করে মাথাটা ভেসে উঠল ওর পানির উপর।

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ চিৎকার করে উঠল ওয়ালী আহমেদ ভাঙা গলায়। অবাক হয়ে দেখল রানা ওর সারা মুখ কামড়ে ধরে ঝুলছে আট দশটা ছয় সাত ইঞ্চি লম্বা মাছ। আলো পড়ে চকচক করছে ওগুলোর রূপালী পেট।

পিরানহা! সাগরে বেরিয়ে এল কী করে? ওয়ালী আহমেদ আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে। দুই হাত দিয়ে সরাবার চেষ্টা করছে মাছগুলোকে সর্বাঙ্গ থেকে। কিন্তু একটা সরলে দশটা ঝাঁপিয়ে আসছে সেই জায়গায়। সর্বশরীরে ছেঁকে ধরেছে ওরা। তিন মিনিটেই শেষ করে ফেলবে।

কিন্তু এল কোত্থেকে ওরা? হঠাৎ রানার মনে পড়ল জিনাতের সেই চাকা ঘোরানোর কথা। মাটির তলা দিয়ে যখন সাগরের সাথে স্টোররুমের নীচের ট্যাঙ্কের যোগ আছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও এক জায়গায় তারের জাল দিয়ে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। জিনাতের ওই চাকা ঘোরানোর ফলে হয়ত সেই জালের বেড়া সরে গিয়ে থাকতে পারে। হয়ত ওই চাকা দিয়েই বেড়া উঠানো—নামানোর ব্যবস্থা করেছিল ওয়ালী আহমেদ। ছাড়া পেয়ে সব বেরিয়ে এসেছে বাইরে।

এবার পাগলের মত সাঁতার কাটতে আরম্ভ করল ওয়ালী আহমেদ তীরে আসার জন্যে। কন্ট্যাক্ট লেন্স থাকায় চোখ দুটো বেঁচে গেছে পিরানহার ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে। কিন্তু সারা দেহের জ্বলুনি আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ক্ষতস্থানে লাগলে কেমন জ্বালা করে, কত কষ্ট হয় হাড়ে হাড়ে টের পেল সে এতদিনে।

মৃত্যু-যন্ত্রণায় শেষবারের মত কেঁদে উঠল ওয়ালী আহমেদ। আর এগোতে পারছে না। রক্তে লাল হয়ে গেছে পানি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ডুবে গিয়েছিল—আবার যখন ভেসে উঠল, রানা দেখল নাক-কানের চিহ্নমাত্র নেই সে মুখে। কয়েক সেকেণ্ড রানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ডুবে গেল ওয়ালী আহমেদের মুমূর্ষ দেহটা। সেই সঙ্গে পিরানহার রূপলী ঝিলিক নেমে গেল সাগর গভীরে।

কপালের লিখন খণ্ডাবে কে? ঠিকই বলেছিল ওয়ালী আহমেদ।

ঘাটে ভিড়ল লঞ্চ। ইশারা করতেই সারেংসহ তিনজন নেমে গেল আগে আগে। কসম খেয়ে বলল আর লোক নেই লঞ্চে। আবার স্টোর হাউসে ঢুকল ওরা খোলা দরজা দিয়ে। যে ঘরে জিনাত ছিল সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না রানা।

এখনও আর্মড ফোর্সের পাত্তা নেই কেন? অনীতা কি তা হলে আসেনি?

দোতলা বাড়ির পাশ দিয়ে বাইরে বেরোবার গেটের দিকে এগোচ্ছে রানা বন্দি তিনজনকে নিয়ে। হঠাৎ কানে এল: ‘হুকুমদার (who comes there)! হল্ট! হ্যাণ্ডস আপ!’

রানাকে ‘ফ্রেণ্ড’ বলবারও সুযোগ দিল না—ব্যাপার কী? ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল। পিল পিল করে চারপাশ থেকে এরিয়ার মধ্যে ঢুকছে লোহার শিরস্ত্রাণ পরা সশস্ত্র বাহিনীর জোয়ানরা।

সামনের তিনজনের মত রানাও দাঁড়িয়ে গেল হাত তুলে। এমন সময় গেট দিয়ে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর করাচি চিফের সঙ্গে ঢুকলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। তাদের পিছন পিছন ঢুকল সাধু বাবাজি সোহেল। সামনের তিনজনের ভার গ্রহণ করল মিলিটারি।

রানার বিধ্বস্ত চেহারা আর ফোলা হাতের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রাহাত খান। অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিল রানা রাহাত খানকে। ফাস্ট এইডের কথা তোলায় বলল বাইরে লোক আছে তার সঙ্গে যাবে। তারপর সোহেলকে একবার চোখ টিপে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। রাহাত খান করাচি চিফের সঙ্গে চললেন স্টোরের দিকে।

এমন সময় ছুটে এসে রানার হাত ধরল অনীতা গিলবার্ট।

‘এ কী চেহারা হয়েছে তোমার, রানা! যাক, বেঁচে আছ যে এ-ই বেশি। ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গিয়েছিল একেবারে।’

‘শিগগির আমাকে কোনও হাসপাতালে নিয়ে চলো, অনীতা। ফার্স্ট এইড দরকার।’

‘নিশ্চয়ই।’

এগোল ওরা গেটের দিকে। হঠাৎ ওপর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল অনীতা।

‘আরে! ছাতের ওপর কে! আঙুল দিয়ে দেখাল সে ছাতের দিকে।’

অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে দেখল রানা বিশাল এক দৈত্যের মূর্তি! গুংগা! ভূত দেখার মত চমকে উঠল রানা গুংগাকে দেখে। চট করে রাইফেলটা নামাল কাঁধ থেকে। বুঝল সব পিরানহা সাগরে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ফেলেছিল ও তাকে গর্ত দিয়ে পিরানহার ট্যাঙ্কে।

প্রকাণ্ড একটা পাথর তুলেছে গুংগা দুই হাতে মাথার ওপর। বোধহয় এতক্ষণ ছাতে উঠে বসেছিল সে রানার অপেক্ষায়।

পর পর দুটো গুলি করল রানা আধ সেকেণ্ডের মধ্যে।

ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মত বাঁকা হয়ে গেল গুংগার দেহটার পিছন দিকে। তারপর এগজিবিশনের প্রফেশনাল ডাইভারের মত সোজা নেমে এল সে ছাত থেকে মাথা নীচের দিকে করে। মড়াত করে ভেঙে গেল বিশ বছরের দুরমুজ করা গর্দান।

এগিয়ে যাচ্ছিল সেদিকে রানা, হঠাৎ অনীতার এক হেঁচকা টানে থেমে দাঁড়াল।

গুংগার হাতের প্রকাণ্ড পাথরটা হাত থেকে খসে প্রথমে পড়েছিল কার্নিশের উপর। ওখান থেকে গড়িয়ে সোজা নেমে এল নীচে। ঠিক গুংগার মাথার ওপর এসে পড়ল তিনমণ ওজনের প্রকাণ্ড পাথর। ঠুস করে একটা শব্দ করে ফেটে গেল খুলি। মগজ আর তাজা রক্ত ছিটকে এসে লাগল রানা আর অনীতার চোখে-মুখে, কাপড়ে।

‘সেই পিশাচ, তাই না, রানা! ইটস আ জায়ান্ট!’

কানের পাশে রাহাত খানের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল রানা। দেখল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। অনীতার হাতটা ছেড়ে দিল ও চট করে।

‘জী, স্যর।’

‘তা তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও, কুইক। কোনও হসপিটালে ফাস্ট এইড নিয়ে নাও।’

‘সাতদিনের ছুটি দিতে হবে, স্যর।’ বলল রানা একটু ইতস্তত করে।

ভুরু কুঁচকে রানা এবং অনীতার মুখের দিকে চাইলেন একবার রাহাত খান। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অলরাইট।’

ঘৃণাভরে চাইল একবার অনীতা গুংগার মৃতদেহের পানে। তারপর এগিয়ে গেল ওরা স্টার্ট দিয়ে রাখা লাল করোনা ডিলাক্সের দিকে।

‘আজকে ড্রাইভিং-এর কী মজুরী পাওয়া যাবে?’

ফার্স্ট গিয়ারে দিয়ে ক্লাচটা ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করল অনীতা গিলবার্ট।

‘গল্পের বাকি অংশটুকু,’ বলল রানা।

‘শুধুই মজুরী? বখশিশ মিলবে না কিছু?’

‘ভাল ড্রাইভ করলে মিলতে পারে।’

‘আর যদি বিপথে ড্রাইভ করি?’

‘তা হলে আরও বেশি মিলবে।’

‘অলরাইট!’ রাহাত খানের অনুকরণে বলল অনীতা গিলবার্ট, ‘বিপথেই নিয়ে যাব তোমাকে!’