ডিভোর্স

কেহ কেহ বৈজ্ঞানিক তর্কের অবতারণা করিয়া বলেন, ভবিষ্যৎ বংশধরের ভালো-মন্দ লক্ষ্য করিয়া দেখিলে নারীর ভুল-ভ্রান্তিতেই ক্ষতি হয়, পুরুষের হয় না। অথচ চিকিৎসকেরাই বিদিত আছেন, কত কুলস্ত্রীকেই না অসতীর পাপ ও কুৎসিত ব্যাধিযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, এবং কত শিশুকেই না চিররুগ্ন হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে হয়, এবং সারাজীবন ধরিয়া পিতৃ-পিতামহের দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করিতে থাকে। অথচ, শাস্ত্র এ সম্বন্ধে অস্পষ্ট, লোকাচার নির্বাক্‌, সমাজ মৌন। তাহার প্রধান কারণ এই যে, শাস্ত্রবাক্যগুলা সমস্তই প্রায় ফাঁকা আওয়াজ। পুরুষের ইচ্ছা এবং অভিরুচিই আসল কথা এবং তাহাই সমাজের যথার্থ সুনীতি।

মনু, পরাশর, হারীত—মিথ্যাই ইহাদের দোহাই পাড়া! এই যে পুরুষের চোখের উপরে অন্যায় অধর্ম করিবে, অথচ সতীত্ব বজায় রাখিবার জন্য তাহার স্ত্রী কথাটি মাত্র বলিতে পারিবে না (শাস্ত্র-বাক্য!), এমন কি, তাহার বীভৎস জঘন্য ব্যাধিগুলা পর্যন্ত জানিয়া শুনিয়া নিজ দেহে সংক্রামিত করিয়া লইতে হইবে, এর চেয়ে নারীর অগৌরবের কথা আর কি হইতে পারে?

তথাপি অন্যান্য দেশে আছে divorce—তথাকার রমণীর কতকটা উপায় আছে, কিন্তু আমাদের এই যে স্বয়ং ভগবানের দেশ, যে দেশের শাস্ত্রের মত শাস্ত্র নাই, ধর্মের মত ধর্ম নাই, যেখানে জন্মাইতে না পারিলে মানুষ মানুষই হয় না, সে দেশের নারীর জন্য এতটুকু পথ উন্মুক্ত রাখা হয় নাই। এ-দেশের পুরুষ রমণীকে হাত-পা বাঁধিয়া ঠেঙ্গায়, সে বেচারী নড়িতে চড়িতে পারে না। তাই পুরুষ বাহিরে আস্ফালন করিয়া বলিতে পায়, এ দেশের নারীর মত সহিষ্ণু জীব জগতে আর কোথায় আছে?

নাই, তাহা মানি। কিন্তু যে জন্য নাই, সে কারণটা কি পুরুষের বড়াই করিবার মত? বিদেশের সংবাদপত্রে যাই খবর বাহির হয়, অমুক অমুকের সহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ ছেদ করিবার জন্য মকদ্দমা রুজু করিয়াছে, স্বদেশী কাগজওয়ালার তখন আর আহ্লাদ ধরে না—চেঁচাইয়া সে গাঁ ফাটাইতে থাকে, দেখ, চেয়ে দেখ, বিলাতী সভ্যতা!

তাহাদের মনের ভাব এই যে, পরের দোষগুলা প্রচার করিতে পারিলেই নিজেদের গুণগুলা মাথা ঝাড়া দিয়া উঠিবে। Divorce জিনিসটা যে বাঞ্ছনীয় নয়, সে কথা তাহারও বোঝে, কিন্তু মার খাইয়া তাহারা চুপ করিয়া থাকিতে পারে না—মারামারি করে। মারামারি জিনিসটা নিঃশব্দে হইবার বস্তু নয়, তাই সে কথা বাহিরের লোকে শোনে, এবং তাই শত্রুপক্ষ দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া আকুল হইয়া উঠিবার অবকাশ পায়। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, যে-কারণে ও-অঞ্চলে এ মকদ্দমা রুজু হয়, সে-কারণ কি হিন্দুর ঘরে ঘটে না? আমার বিশ্বাস, যে অতিবড় নির্লজ্জ, সেও বোধ করি, না বলিবে না। যদি তাই হয় তবে আহ্লাদ করিবার হেতু কোন্‌খানে থাকে? মকদ্দমাই কি আসল বস্তু, কারণটা কিছু নয়? ও-দেশেও এক সময় divorce ছিল না, কিন্তু মধ্যযুগের অকথ্য হীনতার মধ্যে পড়িয়াই এক সময় তাহাদের চৈতন্য হইয়াছিল। “Church’s irrational rigidity as regards divorce tended to foster disorder and shame. Sexual disorder increased. Woman became cheaper in the esteem of men, and the narrowing of her interest to domestic work the desire to please men proceeded apace.” শাস্ত্রের এই গোঁড়ামি নারীজাতিকে যে কত দুঃখে, কত নীচে নামাইয়া আনিয়াছিল, আচার্য K. Pearson তাঁহার Ethic of Free Thought গ্রন্থে অনেক রকমে তাহার আলোচনা করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন—নারী মাত্রকেই একবার তাহা পড়িতে অনুরোধ করি।

কিন্তু তাই বলিয়া আমাকে যেন এমন ভুল না বুঝা হয় যে, আমি divorce বস্তুটাকেই ভাল বলিতেছি।

মারামারি জিনিসটাও ভাল জিনিস নয়, সমাজের মধ্যে ওটা ঘটিতে থাকে এ কামনা কেহ করে না, কিন্তু স্ত্রী-ত্যাগ বলিয়া একটা ব্যাপার যখন আমাদের মধ্যে আছে, তখন উভয় পক্ষেই ও-জিনিসটা কেন থাকা উচিত নয়, তাহা বলিতে পারি না।

অবশ্য পুরুষ এ কথা কিছুতেই মানিবে না যে, তাহার মত ত্যাগ করিবার ক্ষমতা তাহার স্ত্রীরও থাকে। কিন্তু কেন থাকিবে না, কেন অন্যান্য দেশের নারীর মত এই ন্যায্য অধিকার তাহাকে দেওয়া হইবে না, ইহারও সে কোন সঙ্গত কারণ নির্দেশ করিতে পারিবে না, শুধু জ্বলিয়া উঠিয়া জবাব দিবে, “দূর,—এও কি একটা কথা!”

এটা কথা নয়, কারণ তাহার অপরাধ করিবার অবাধ স্বাধীনতা খর্ব হয় ইহা সে চাহে না। বিশেষ করিয়া এ-দেশের পুরুষ, সে নিজে কাপুরুষ, ভীরু,—অন্যান্য দেশের পুরুষের তুলনায় যে নারীর মতই নিরুপায়, যে নারীর কাছে পুরুষ বলিয়া পরিচয় দিবার যথার্থ ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত, সে কাপুরুষের মত তাহার অপেক্ষা দুর্বল ও নিরুপায়কেই পীড়ন করিয়া কর্তৃত্ব করার আনন্দ উপলব্ধি করিতে চাহিবে, তাহা স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার নহে। সে যে মরিয়া গেলেও স্বেচ্ছায় এ অধিকারের এক পাইও ছাড়িয়া দিতে চাহিবে না, তাহা বুঝিতে পারা কঠিন নয়। সে যে শাস্ত্র আওড়াইবে, বিজ্ঞানের দোহাই পাড়িবে, সুনীতির ছদ্ম অভিনয় করিবে, তাহাও জানা কথা। কিন্তু নারীরও বুঝিয়া দেখার সময় হইয়াছে। যে পুরুষ স্ত্রীকে পথে রক্ষা করিতে পারিবে না জানিয়াই শাস্ত্র বানাইয়াছে, “পথি নারী বিবর্জিতা,” তাহার শাস্ত্রের ততটুকু মূল্যই দেওয়া উচিত এবং ইহাই সুবিচার।

আমার মনে হইতেছে, আমার কথাগুলা পুরুষদিগের ভাল লাগিতেছে না, এবং অন্তঃপুরেও এগুলা পৌঁছায় ইহাও তাহাদিগের ইচ্ছা হইতেছে না। কিন্তু যে দেশে অর্থশূন্য অত্যাচার-অবিচারের একটা সীমা পর্যন্ত নাই, সেদেশে কোন-না-কোনদিন নারী কারণ জানিতে চাহিবেই, পুরুষ তাহা পছন্দ করুক, আর নাই করুক। ফ্রান্সের নেপোলিয়নও একদিন ম্যাডাম কন্‌ডোরসেটকে বলিয়াছিলেন, “I do not like woman to meddle with Politics.” তাহাতে ম্যাডামও জবাব দিয়াছিলেন, “You are right General, but in a country where it is the custom to cut off the heads of woman, it is natural that they should wish to know the reason, why.”