নারী ধর্ম

বিল্বমঙ্গল একখানি প্রসিদ্ধ নাটক। বহুদিন হইতে, ইহা প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইতেছে। বাঙালী আপত্তি করে না, কারণ ইহাতে ধর্মের কথা আছে। সহস্র লোকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বণিক লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিয়া নিজের সহধর্মিণীকে লম্পট অতিথির শয্যায় প্রেরণ করে। দর্শক অর্থ ব্যয় করিয়া দেখে এবং খুব তারিফ দিতে থাকে; বণিকের বক্তৃতার সারমর্ম এই, সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, এ বাড়িতে অতিথি বিমুখ করিবে না। পাছে তাহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, পাছে অধর্ম হয়, পাছে মৃত্যুর পরে যমদূতে ডাঙস্‌ মারে, এই তার ভয়। তাহার মনের ভাবটা এই যে, আমার পায়ে তৃণাঙ্কুরও না বিদ্ধ হয়—তোমার যা হয় তা হোক। তা ছাড়া, শাস্ত্রে আছে, সর্বস্ব দিয়াও অতিথি-সৎকার করিবে। অর্থাৎ, ধন-দৌলত, হাতি-ঘোড়া, গরু-বাছুর, যা-কিছু সম্পত্তি আছে সমস্তই। কিন্তু অতিথিটা যখন ও-সব চায় না, তখন তুমিই যাও। আমার কাছে সে তোমাকে চাহিয়াছে—এবং তুমি আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে। স্বামীর কাছে পতিব্রতা স্ত্রীর সম্মান এই! অপরিচিত পাপিষ্ঠ অতিথির সেবার তুলনায় স্ত্রীর মূল্য এই! যাহারা বিল্বমঙ্গলের ভক্ত, তাহারা প্রতিবাদ করিয়া বলিবে, অতিথির জন্য হিন্দু প্রাণ দিতে পারে—কর্ণ পুত্রহত্যা করিয়াছিল।

এ-সব কথা আমিও জানি। দাতাকর্ণ মস্ত কাজ করিয়াছিলেন, বণিকও মস্ত কাজ করিয়াছে! কিন্তু কথা সে নয়। প্রাণটা তোমার নিজের, ইচ্ছা হয়, সেটা না হয় দিতে পার, কিন্তু এই যে ধারণা,—স্ত্রী তোমার সম্পত্তি, তুমি স্বামী বলিয়া ইচ্ছা করিলে এবং প্রয়োজন বোধ করিলে, তাহার নারী-ধর্মের উপরও অত্যাচার করিতে পার, তাহাকে রাখিতেও পার, মারিতেও পার, বিলাইয়া দিতেও পার,—তোমার এই অনধিকার, এই স্বেচ্ছাচার তোমাকে এবং তোমার পুরুষজাতিকে হীন করিয়াছে, এবং তোমার সতী স্ত্রীকে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত নারীজাতিকে অপমান করিয়াছে! অতিথিসেবা খুব মস্ত ধর্ম হইতে পারে, কিন্তু সেজন্য যেমন চুরি-ডাকাতি করিতে পার না, এটাও ঠিক তেমনি পার না। ইহুদীরা যখন পশুর মত ছিল, তখন তাহারা সম্পত্তির সঙ্গে স্ত্রীর বখরা করিত। এখন অনেক অসভ্য জাতি বাড়ি-ঘর জমি-জমা গরু-বাছুরের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীগুলিকেও ভায়ে ভায়ে ভাগ করিয়া লয়। স্ত্রী-জাতি সম্বন্ধে বণিকের ধারণাও প্রায় এমনি। আর অতিথি-সৎকার যদি এতবড় ধর্মই হয়, যার কাছে সতী স্ত্রীর সর্বস্ব নষ্ট করিয়া ফেলাও ধর্মপালন, তবে এখনো যাহারা এই ধর্ম রাখিয়া চলে তাহাদের নীচ বলা শোভা পায় না।

আমেরিকার অসভ্য ছিনুক জাতির সম্বন্ধে কাপ্তেন লুইস্‌ বলিয়াছেন, ইহারা অতিথির শয্যায় বাটীর শ্রেষ্ঠ কন্যাটিকে, না হয়, স্ত্রীকে পাঠাইয়া দেওয়া অতি উচ্চ অঙ্গের ধর্মপালন বলিয়া মনে করে। এশিয়ার চুক্‌চি জাতি সম্বন্ধে অর্‌ম্যান সাহেব লিখিয়াছেন,—“The Chuckchi offer to travellers, who chance to visit them, their wives, and also what we should call their daughters’ honour.” কাপ্তেন লায়ন এবং সার্‌জন লবক, এস্‌কুইমো, কামস্কট্‌কানিবাসী ও কালমুখ্‌দের সম্বন্ধেও ঠিক এমনি অতিথিসেবার ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন। হারবার্ট স্পেন্সর তাঁহার Descriptive Sociology গ্রন্থে এমনি বহুতর দয়ার কাহিনী প্লস্‌ ও প্যালাস্ সাহেবদের ভ্রমণবৃত্তান্ত হইতে সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করি, ইহাদের সহিত আমাদের ধার্মিক বণিকটির প্রভেদ কোন্‌খানে? সে-দেশের পুরুষেরাও যাহা কর্তব্য এবং ধর্ম বলিয়া মনে করিয়াছে, তাহাই পালন করিয়াছে—ইনিও তাই; অতিথিকে সন্তুষ্ট করিবার ইচ্ছা উভয়েরই সমান, উভয়েই মনে করিয়াছে, অতিথি সন্তুষ্ট না হইলে আমার পাপ হইবে, আমি কষ্ট পাইব। কথাটাকে যেমন ইচ্ছা এবং যত ইচ্ছা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিলেও ঐ একটা ‘আমি’ ছাড়া আর কিছুই পাইবার জো নাই। ঐ ‘আমি’টার মধ্যেই নারীর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা যে কোথায় ডুবিয়া গিয়াছে, তাহার কোন চিহ্নই পাওয়া যায় না।

ভগবান শঙ্করাচার্য স্পষ্ট করিয়া বলিয়া গিয়াছেন, নরকের দ্বার নারী। বাইবেল বলিয়াছেন, root of all evil অর্থাৎ সমস্ত অহিতের মূল।

ইউরোপ-প্রসিদ্ধ লাটিন ধর্মযাজক টারটুলিয়ান নারীর সম্বন্ধে লিখিয়াছেন—“Thou art the devil’s gate, the betrayer of the true, the first deserter of the Divine law.” ধর্মযাজক সেণ্ট অগষ্টিন, যিনি সেণ্ট পদবী পাইয়া গিয়াছেন, তিনি তাঁহার শিষ্যমণ্ডলীকে শিখাইতেছেন, “What does it matter whether it be in person of mother or sister; we have to be beware of Eve in every woman.” সেণ্ট অ্যাম্‌ব্রোস—ইনিও ‘সেণ্ট’—তর্ক করিয়া গিয়াছেন, “Remember that God took a rib out of Adam’s body not a part of his soul to make her.”

৫৭৮ খৃস্টাব্দে আহুত ওসিয়ায় ক্রিশ্চান ধর্মসঙ্ঘে নাকি স্থির হইয়াছিল, স্ত্রীলোকের আত্মা নাই। ধর্মের জন্যে যে নারীজাতি মরে বাঁচে, যে ধর্মগ্রন্থের প্রত্যেক অক্ষরের প্রতি নারীর অচলা ভক্তি, সেই ধর্মগ্রন্থ লিখিবার সময় পুরুষ নারীজাতিকে কি শ্রদ্ধাই দেখাইয়া গিয়াছে! মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ সেণ্ট বার্ণার্ড (ইনিও সেণ্ট) জননীর উদ্দেশে পত্র লিখিয়াছেন, “What have I to do with you? What have I received from you but sin and misery? Is it not enough for you that you have brouhgt me into this miserable world, that you being sinners have begotten me in sin…”

আজ ইউরোপবাসীরা অহঙ্কার করিয়া বলে, তাহারা যেমন নারীর dignity বোঝে, এমন আর কেহ নহে। অথচ, নারীজাতিকে গত ১৩|১৪ শত বৎসর ধরিয়া যেরূপ অসহ্য ঘৃণা করিয়াছে, যত ক্লেশ দিয়াছে, যত অবনত করিয়াছে, তত আর কোন জাতি করিয়াছে কিনা সন্দেহ! ইহাদের Sacredotal celibacyর ইতিহাস, চার্চের ইতিহাস প্রভৃতির পাতায় পাতায় যে পুণ্য-কাহিনী লিপিবদ্ধ হইয়া আছে, তৎসত্ত্বেও ইহাদের মুখের শ্রদ্ধাভক্তির কথা উপহাস ব্যতীত যে আর কি হইতে পারে জানি না।

যে ধর্ম বনিয়াদ গড়িয়াছে, আদিম জননী ইভার পাপের উপর, যে ধর্ম সংসারের সমস্ত অধঃপতনের মূলে নারীকে বসাইয়া দিয়াছে, সে ধর্ম সত্য বলিয়া যে কেহ অন্তরের মধ্যে বিশ্বাস করিয়াছে, তাহার সাধ্য নয় নারীজাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাহার শ্রদ্ধা শুধু ততটুকুই হইতে পারে, যতটুকুতে নিজের স্বার্থ জড়িত হইয়া আছে। তাহার অধিক শ্রদ্ধাই বল, ন্যায্য অধিকারই বল, সহস্র বৎসর পূর্বেও পুরুষে দেয় নাই, সহস্র বৎসর পরেও দিবে না। মিল সাহেব তাঁহার Subjection of Women গ্রন্থে ‘isolated fact’ বলিয়া মিথ্যা দুঃখ করিয়া গিয়াছেন।

শুনিতে পাই, এক মহানির্বাণতন্ত্রের “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ” আদেশ ছাড়া আর কোন শাস্ত্রেই নারীকে শিক্ষা দিবার হুকুম নাই। স্বর্গীয় অক্ষয় দত্ত মহাশয় তাঁহার ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের উপক্রমণিকা-খণ্ডে ইহার বিরুদ্ধে বিস্তর আলোচনা করিয়া দেখাইয়াছেন, প্রাচীনকালে স্ত্রীলোক বেদ পর্যন্ত তৈরি করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এ-সমস্ত তর্ক কোন কাজেই লাগে না, পুরুষ যখন শাস্ত্রের “ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা” শ্লোকের সন্ধান পাইয়াছে।

ইউরোপের কোন এক প্রাচীন ধর্মযাজক লিখিয়া গিয়াছেন, “Shall the maid Olympias learn philosophy? By no means, Woman’s philosophy is to obey laws of marriage.” মার্টিন লুথার সর্বদাই বলিতেন, “No gown worse becomes a woman than the desire to be wise.” চীনেদের দেশে একটা প্রচলিত বাক্য আছে, জ্ঞান যেমন পুরুষের শোভা বৃদ্ধি করে, অজ্ঞান তেমনি স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ইহার পর সে আর পুরুষের হাত হইতে কি মঙ্গল আশা করিতে পারে? কবে উর্বশী বেদ রচনা করিয়া গিয়াছেন, কেন শ্রৌতসূত্রে পত্নীকে বেদ প্রদান করিবার কথা ছিল, স্বামী প্রবাসে থাকিলে কি-হেতু দশ পৌর্ণ-মাস ব্রতে স্ত্রীর হোম করিবার অধিকার হইয়াছিল, বৃহদারণ্যকোপনিষদের যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী, যাজ্ঞবল্ক্য-গার্গী-সংবাদ কেন রচিত হইয়াছিল, এ-সব আলোচনা অরণ্যে রোদন। ছয় সহস্র বৎসর পূর্বে মিশর প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতার দিনে নারীর অধিকার সম্বন্ধে মাস্‌পেরো “husband a privileged guest”, “she inherited equally with her brothers”, “mistress of the house”, “judicially equal of man”, “having the same rights and being treated in the same fashion” ইত্যাদি অনেক কথা বলিয়াছেন। এই সভ্যতার আলো রোম পাইয়াছিল বলিয়া তাহার নারীজাতিও এ সময় যথেষ্ট উন্নত হইয়াছিল। এই pagan law পরবর্তী সুসভ্য আইন-কানুনের মধ্যে কোথায় ডুবিয়াছে, মেম-সাহেব তাঁহার Ancient Law গ্রন্থে যথেষ্ট আলোচনা করিয়াছেন।

সার্‌ হেনরীর এই অধ্যায়টা আমি সকল শিক্ষিতা রমণীকেই পড়িয়া দেখিতে অনুরোধ করি।

ইউরোপের আইন-কানুনের মধ্যে প্রাচীন রোমের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষিত হইলেও, নারী সম্বন্ধে ইহুদীদের কড়া ব্যবস্থাই অধিক স্থান পাইয়াছে। কেন না, এইগুলাই পুরুষের ভাল লাগিয়াছে এবং মনের সঙ্গে মিলিয়াছে। প্রথমে মনে হয় বটে, ধর্মের নৈকট্যহেতু ইহাই ত স্বাভাবিক; কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলেই দেখিতে পাওয়া যায়, স্বাভাবিক বটে, কিন্তু শুধু তাহা ধর্মের ঘনিষ্ঠতা হেতুই স্বাভাবিক নয়, তাহা পুরুষের মনোনীত হইয়াছে বলিয়াই স্বাভাবিক হইয়াছে। অবশ্য ধর্মের চাপ ত আছেই। যীশুখৃস্ট অনেক কথাই বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু স্ত্রীজাতির উপর অত্যাচার সম্বন্ধে স্পষ্ট করিয়া একটি কথাও কোথাও বলিয়া যান নাই। জগৎবিখ্যাত সেন্ট পল শিখাইয়াছেন, ধর্ম সম্বন্ধে নারী পুরুষের মত কোন প্রশ্ন করিতে পারিবে না। সে সর্বদাই তাহার স্বামীর অধীন। যেহেতু ঈশ্বর নারীকে পুরুষের জন্যই সৃজন করিয়াছেন, পুরুষকে নারীর জন্য সৃজন করেন নাই। আরও বলিয়াছেন, নারী কোন পুরুষকে শিক্ষা দিতে পারিবে না। সে-ই সংসারে পাপ প্রবেশ করাইয়াছে। তাহারা অনন্ত নরকে ডুবিবে, সদ্গতির কোন উপায় নাই। তবে সদ্গতি হইতে পারে, গর্ভে সন্তান ধারণ করিতে পারিলে।

ঈশ্বর-জানিত পল ঠাকুরের উক্তি কি সুন্দর! নারীর মুক্তির কি সোজা পথ! এবং এই পথের পরিচয় বিলাতের যে-কোন ধর্মগ্রন্থ খুলিলেই চোখে পড়ে। আমাদের শাস্ত্রে সন্তানের জন্যই নারী মহাভাগা, এবং পুত্রের জন্যই ভার্যাগ্রহণের ব্যবস্থা আছে। এবং সংসারের যে-কোন দেশের ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ আলোচনা করিয়া দেখিলে কম-বেশি এই-রকমের ব্যবস্থাই দেখিতে পাওয়া যায়।