ভালবাসা

ডায়েক যুবকেরা এবং আমাজনের পাশীরা যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতে না পারিলে বিবাহ করিতে পায় না। নর-মাংসাহারী কারিব জাতিরা পুরুষ মারিয়া খাইতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকের মাংস খাইতে পায় না। আরবদেশে শেখেরা স্ত্রীলোকের সুমুখে দাঁড়াইয়া তীব্র চাবুকের আঘাত দাঁত বাহির করিয়া সহ্য করিতে না পারিলে যুবতীর হৃদয় অধিকার করিতে পারে না, এবং আরো কয়েকটা জাতির মধ্যে যথা সুমাত্রা-দ্বীপের বাটা প্রদেশে, আফ্রিকার সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের মধ্যে, আমেরিকার পেরুর অসভ্য জাতির মধ্যে এবং আরও কয়েকটা আদিম জাতির মধ্যে, বোধ করি আমাদের দেশের টোডাদের মধ্যেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার রমণীর দিক দিয়াই হয়, পুরুষের দিক দিয়া হয় না। এ-সকল উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও রমণীরা চিরদিন যে নিপীড়িত হইয়াই আসিতেছে, তাহা সহস্র প্রকারের উদাহরণ দিয়া প্রমাণ করিতে পারা যায়। রমণীরা যে সম্পত্তির মধ্যেই পরিগণিত হইত, তাহা ইতিপূর্বে অনেক প্রকারে বলিয়াছি, এবং এইজন্যই সম্পত্তির উত্তরাধিকার নারীর দিক দিয়াই আসিয়াছিল। একটা স্ত্রীকে লইয়া চার-পাঁচবারেরও অধিক কাড়াকাড়ি হইয়া যাইত, সুতরাং তাহার গর্ভের সন্তান যে কোন্‌ বংশের তাহা স্থির করিবার উপায় ছিল না; এই হেতুই নিজের স্ত্রীর সন্তান বিষয় পাইত না, বিষয় পাইত ভগিনীর সন্তান। তাহাকে লইয়াও যে কাড়াকাড়ি হইত না তাহা নহে, কিন্তু হাজার কাড়াকাড়ি হইয়া গেলেও ভগিনীটি যে অন্ততঃ নিজের বংশের এবং তাহার গর্ভের সন্তান যে কতকটা নিজের বংশেরই হইবে সে বিষয়ে তাহারা নিঃসন্দেহ ছিল। এই হেতু ভাগিনেয় বিষয় পাইত, পুত্র পাইত না। বিষয় যেই পাক, উত্তরাধিকার স্থির করিত পুরুষেরা, নারীর তাহাতে কিছুমাত্র হাত ছিল না। মানুষের বুদ্ধির তারতম্য-হিসাবে ছাগলের গলা ডানদিক ঘেঁষিয়াই কাটা হউক, কিংবা বাঁ দিক ঘেঁষিয়াই হউক, ছাগলের ভালোমন্দ তাহাতে নির্দিষ্ট হয় না। বোধ করি এই কারণেই টাইলার সাহেব সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন যে, বাহির হইতে নারীর অবস্থা ‘officially superior’ দেখাইলেও ‘practically very inferior’. আমার মনে হয়, সব জাতির মধ্যেই এই ইঙ্গিত খাটে। Crawley সাহেব সম্প্রতি তাঁহার Mystic Rose গ্রন্থে নারীর উন্নত অবস্থা সম্বন্ধে পাপুয়ানদের কথা তুলিয়া এই যে একটা তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন যে, ইহাদের নারী-নির্যাতন করা সম্বন্ধে যথেষ্ট দুর্নাম থাকিলেও, এই যে একটা প্রথা আছে, নারীরাই স্বামী মনোনীত করে এবং বিবাহের প্রস্তাব তাহারাই করিতে পারে, পুরুষে পারে না, এই প্রথাটাই তাহাদিগের অবস্থা যথেষ্ট উন্নত করিয়া রাখিয়াছে। কথাটা বাহির হইতে মন্দ না শুনাইলেও বিপক্ষে বলিবারও বিস্তর আছে। প্রথম এই যে মনোনীত করে বলিয়াই যে পুরুষের কাছে নিপীড়িত হয় না, তাহার কোন সঙ্গত হেতু নাই। যাহাদের মধ্যে দাম্পত্য প্রণয়ের কিছুমাত্র ধারণা নাই, যাহারা কথায় কথায় স্ত্রী-হত্যা করে তাহাদের মধ্যে নারীর এই একটুখানি ক্ষমতা পরিশেষে তাহাদিগের যে বিশেষ কোন কাজে আসে বলিয়া মনে হয় না।

রেভারেন্ড সুটার সাহেব বলেন, নারীর অনেকটা মান-মর্যাদা আফ্রিকার কঙ্গো এবং উগান্ডা প্রদেশে আছে। বস্তুতঃ সেদেশে রমণী রানী পর্যন্ত হয়। অথচ Captain Speke তাঁহার Discovery of the Source of the Nile গ্রন্থে কঙ্গো ও উগান্ডা দেশের ওয়াহুমা বড় লোকেরা কি করিয়া কথায় কথায় প্রায় বিনা অপরাধে স্ত্রী-হত্যা করে, নিজের হাতে আঁকিয়া তাহার ছবি পর্যন্ত দিয়া গিয়াছেন; ঐ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, হাতে দড়ি বাঁধিয়া স্ত্রীগুলিকে বধ্যভূমিতে টানিয়া লইয়া যাইবার সময় তাহারা যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে যায়, শুনিলে অতি-বড় পিশাচেরও দয়া হয়, অথচ সেদেশের পুরুষগুলি তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। গ্রন্থকারের তাঁবুর পার্শ্বের পথের উপর দিয়া তাই প্রায়ই বামাকণ্ঠে কান্না উঠিত—“হে মিয়াঙ্গি, হে বাক্কা!” “ও আমার স্বামী! ও আমার রাজা!” স্বামী এবং রাজাটি বোধ করি তখন মৃদু-মধুর হাস্য করিতেন। সেই দেশের রাজা কিনেরার মৃত্যুর অব্যবহিত পরের ঘটনাগুলি যাহা কাপ্তেন স্পিক তাঁহার পুস্তকে চোখে দেখিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে মনে হয়, শিশুরা মাটির পুতুলের যে মূল্য দেয় সে মূল্যও তথাকার পুরুষেরা নারীকে দেয় না। একস্থানে লেখা আছে, মৃত পিতার সমস্ত কন্যাগুলিকেই ছোট রাজা বিবাহ করিলেন, এবং সাতদিন পরে তাহার তিনটিকে ঠিকমত ঙাজিগ (সেলাম) না করার অপরাধে জীবন্ত দগ্ধ করিলেন। প্রায় পর্যটকই পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদের সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভালবাসার ব্যাপার অধিকাংশ অসভ্য জাতিরাই অবগত নহে। মন্‌টেরো বলেন, “The Negro knows not love, affection or jealousy, they have no words or expression in their language indicative of affection or love”. স্যর জন লবক ঐ দেশেরই সম্বন্ধে বলেন, “are so cold and indifferent to one another that you would think there was no such thing as love between them”. কাফ্রিদের সম্বন্ধে ‘no feeling of love in marriage’. জারিবদের সম্বন্ধে ‘affection between man and wife out of the question’. অথচ ইহাদিগের মধ্যেই নারীর পতিপ্রেম, স্বামী-সেবার কথা শোনা যায় না, তাহা নহে। হইতে পারে জবরদস্তির চোটে, সে যাই হোক, অতিশয় নিষ্ঠুর ডাহোমান, মালগাসি, ফিজিয়ান, ছিপা, বেচয়ানা, ইহাদের সকলের ঘরেই পতিব্রতা স্ত্রী পাওয়া যায়। ডাহোমি ও ফিজি-দ্বীপে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবারা আত্মহত্যা করে, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আমেরিকান মন্ডান জাতির বিধবারা মৃত স্বামীর কপাল সংগ্রহ করিয়া আনিয়া গলায় মালা করিয়া গাঁথিয়া রাখে, রাত্রে মুণ্ডটাকে বিছানায় লইয়া শয়ন করে, স্নান করাইয়া দেয়, আহার করায়, শীতের দিনে কাঁথা চাপা দিয়া রাখে, এমন কি গান গাহিয়াও তাহাকে ঘুম পাড়ায়। অথচ, পুরুষেরা জীবিতাবস্থায় কি কীর্তিই না করিয়া যান! তবে এমন কথাও বলিতেছি না যে, সর্বত্রই পুরুষেরা ক্রমাগত অত্যাচার করিয়াই চলে, এবং তৎপরিবর্তে রমণীরা কেবল ভালবাসিতে, সেবা করিতেই থাকে।

এমন কথা বলিলে মানবের স্বভাবের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়; তবে কোন কোন স্থানে দারুণ অত্যাচার-অবিচারের পরিবর্তেও যদি স্নেহ-প্রেম সম্ভবপর হয়, তাহা রমণীতেই হয়, এবং সে দৃষ্টান্ত অনুসন্ধান করিলে নির্মম অসভ্য মানব-সমাজেও যে দুর্লভ নয়, তাহাই গোটা-দুই দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইলাম মাত্র। নারীর এই মূল্য পুরুষ স্বীকার করিতে চাহে না এবং করে না, তাহা বহুবিধ প্রকারেই বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য ইহার প্রতিকূলেও কিছু বলিবার আছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, তাহা অঙ্গীকার করিয়া লইলেও এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য তিলার্ধও বিচলিত হয় না।

ডায়েক যুবকেরা এবং আমাজনের পাশীরা যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতে না পারিলে বিবাহ করিতে পায় না। নর-মাংসাহারী কারিব জাতিরা পুরুষ মারিয়া খাইতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকের মাংস খাইতে পায় না। আরবদেশে শেখেরা স্ত্রীলোকের সুমুখে দাঁড়াইয়া তীব্র চাবুকের আঘাত দাঁত বাহির করিয়া সহ্য করিতে না পারিলে যুবতীর হৃদয় অধিকার করিতে পারে না, এবং আরো কয়েকটা জাতির মধ্যে যথা সুমাত্রা-দ্বীপের বাটা প্রদেশে, আফ্রিকার সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের মধ্যে, আমেরিকার পেরুর অসভ্য জাতির মধ্যে এবং আরও কয়েকটা আদিম জাতির মধ্যে, বোধ করি আমাদের দেশের টোডাদের মধ্যেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার রমণীর দিক দিয়াই হয়, পুরুষের দিক দিয়া হয় না। এ-সকল উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও রমণীরা চিরদিন যে নিপীড়িত হইয়াই আসিতেছে, তাহা সহস্র প্রকারের উদাহরণ দিয়া প্রমাণ করিতে পারা যায়। রমণীরা যে সম্পত্তির মধ্যেই পরিগণিত হইত, তাহা ইতিপূর্বে অনেক প্রকারে বলিয়াছি, এবং এইজন্যই সম্পত্তির উত্তরাধিকার নারীর দিক দিয়াই আসিয়াছিল। একটা স্ত্রীকে লইয়া চার-পাঁচবারেরও অধিক কাড়াকাড়ি হইয়া যাইত, সুতরাং তাহার গর্ভের সন্তান যে কোন্‌ বংশের তাহা স্থির করিবার উপায় ছিল না; এই হেতুই নিজের স্ত্রীর সন্তান বিষয় পাইত না, বিষয় পাইত ভগিনীর সন্তান। তাহাকে লইয়াও যে কাড়াকাড়ি হইত না তাহা নহে, কিন্তু হাজার কাড়াকাড়ি হইয়া গেলেও ভগিনীটি যে অন্ততঃ নিজের বংশের এবং তাহার গর্ভের সন্তান যে কতকটা নিজের বংশেরই হইবে সে বিষয়ে তাহারা নিঃসন্দেহ ছিল। এই হেতু ভাগিনেয় বিষয় পাইত, পুত্র পাইত না। বিষয় যেই পাক, উত্তরাধিকার স্থির করিত পুরুষেরা, নারীর তাহাতে কিছুমাত্র হাত ছিল না। মানুষের বুদ্ধির তারতম্য-হিসাবে ছাগলের গলা ডানদিক ঘেঁষিয়াই কাটা হউক, কিংবা বাঁ দিক ঘেঁষিয়াই হউক, ছাগলের ভালোমন্দ তাহাতে নির্দিষ্ট হয় না। বোধ করি এই কারণেই টাইলার সাহেব সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন যে, বাহির হইতে নারীর অবস্থা ‘officially superior’ দেখাইলেও ‘practically very inferior’. আমার মনে হয়, সব জাতির মধ্যেই এই ইঙ্গিত খাটে। Crawley সাহেব সম্প্রতি তাঁহার Mystic Rose গ্রন্থে নারীর উন্নত অবস্থা সম্বন্ধে পাপুয়ানদের কথা তুলিয়া এই যে একটা তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন যে, ইহাদের নারী-নির্যাতন করা সম্বন্ধে যথেষ্ট দুর্নাম থাকিলেও, এই যে একটা প্রথা আছে, নারীরাই স্বামী মনোনীত করে এবং বিবাহের প্রস্তাব তাহারাই করিতে পারে, পুরুষে পারে না, এই প্রথাটাই তাহাদিগের অবস্থা যথেষ্ট উন্নত করিয়া রাখিয়াছে। কথাটা বাহির হইতে মন্দ না শুনাইলেও বিপক্ষে বলিবারও বিস্তর আছে। প্রথম এই যে মনোনীত করে বলিয়াই যে পুরুষের কাছে নিপীড়িত হয় না, তাহার কোন সঙ্গত হেতু নাই। যাহাদের মধ্যে দাম্পত্য প্রণয়ের কিছুমাত্র ধারণা নাই, যাহারা কথায় কথায় স্ত্রী-হত্যা করে তাহাদের মধ্যে নারীর এই একটুখানি ক্ষমতা পরিশেষে তাহাদিগের যে বিশেষ কোন কাজে আসে বলিয়া মনে হয় না।

রেভারেন্ড সুটার সাহেব বলেন, নারীর অনেকটা মান-মর্যাদা আফ্রিকার কঙ্গো এবং উগান্ডা প্রদেশে আছে। বস্তুতঃ সেদেশে রমণী রানী পর্যন্ত হয়। অথচ Captain Speke তাঁহার Discovery of the Source of the Nile গ্রন্থে কঙ্গো ও উগান্ডা দেশের ওয়াহুমা বড় লোকেরা কি করিয়া কথায় কথায় প্রায় বিনা অপরাধে স্ত্রী-হত্যা করে, নিজের হাতে আঁকিয়া তাহার ছবি পর্যন্ত দিয়া গিয়াছেন; ঐ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, হাতে দড়ি বাঁধিয়া স্ত্রীগুলিকে বধ্যভূমিতে টানিয়া লইয়া যাইবার সময় তাহারা যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে যায়, শুনিলে অতি-বড় পিশাচেরও দয়া হয়, অথচ সেদেশের পুরুষগুলি তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। গ্রন্থকারের তাঁবুর পার্শ্বের পথের উপর দিয়া তাই প্রায়ই বামাকণ্ঠে কান্না উঠিত—“হে মিয়াঙ্গি, হে বাক্কা!” “ও আমার স্বামী! ও আমার রাজা!” স্বামী এবং রাজাটি বোধ করি তখন মৃদু-মধুর হাস্য করিতেন। সেই দেশের রাজা কিনেরার মৃত্যুর অব্যবহিত পরের ঘটনাগুলি যাহা কাপ্তেন স্পিক তাঁহার পুস্তকে চোখে দেখিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে মনে হয়, শিশুরা মাটির পুতুলের যে মূল্য দেয় সে মূল্যও তথাকার পুরুষেরা নারীকে দেয় না। একস্থানে লেখা আছে, মৃত পিতার সমস্ত কন্যাগুলিকেই ছোট রাজা বিবাহ করিলেন, এবং সাতদিন পরে তাহার তিনটিকে ঠিকমত ঙাজিগ (সেলাম) না করার অপরাধে জীবন্ত দগ্ধ করিলেন। প্রায় পর্যটকই পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদের সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভালবাসার ব্যাপার অধিকাংশ অসভ্য জাতিরাই অবগত নহে। মন্‌টেরো বলেন, “The Negro knows not love, affection or jealousy, they have no words or expression in their language indicative of affection or love”. স্যর জন লবক ঐ দেশেরই সম্বন্ধে বলেন, “are so cold and indifferent to one another that you would think there was no such thing as love between them”. কাফ্রিদের সম্বন্ধে ‘no feeling of love in marriage’. জারিবদের সম্বন্ধে ‘affection between man and wife out of the question’. অথচ ইহাদিগের মধ্যেই নারীর পতিপ্রেম, স্বামী-সেবার কথা শোনা যায় না, তাহা নহে। হইতে পারে জবরদস্তির চোটে, সে যাই হোক, অতিশয় নিষ্ঠুর ডাহোমান, মালগাসি, ফিজিয়ান, ছিপা, বেচয়ানা, ইহাদের সকলের ঘরেই পতিব্রতা স্ত্রী পাওয়া যায়। ডাহোমি ও ফিজি-দ্বীপে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবারা আত্মহত্যা করে, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আমেরিকান মন্ডান জাতির বিধবারা মৃত স্বামীর কপাল সংগ্রহ করিয়া আনিয়া গলায় মালা করিয়া গাঁথিয়া রাখে, রাত্রে মুণ্ডটাকে বিছানায় লইয়া শয়ন করে, স্নান করাইয়া দেয়, আহার করায়, শীতের দিনে কাঁথা চাপা দিয়া রাখে, এমন কি গান গাহিয়াও তাহাকে ঘুম পাড়ায়। অথচ, পুরুষেরা জীবিতাবস্থায় কি কীর্তিই না করিয়া যান! তবে এমন কথাও বলিতেছি না যে, সর্বত্রই পুরুষেরা ক্রমাগত অত্যাচার করিয়াই চলে, এবং তৎপরিবর্তে রমণীরা কেবল ভালবাসিতে, সেবা করিতেই থাকে।

এমন কথা বলিলে মানবের স্বভাবের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়; তবে কোন কোন স্থানে দারুণ অত্যাচার-অবিচারের পরিবর্তেও যদি স্নেহ-প্রেম সম্ভবপর হয়, তাহা রমণীতেই হয়, এবং সে দৃষ্টান্ত অনুসন্ধান করিলে নির্মম অসভ্য মানব-সমাজেও যে দুর্লভ নয়, তাহাই গোটা-দুই দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইলাম মাত্র। নারীর এই মূল্য পুরুষ স্বীকার করিতে চাহে না এবং করে না, তাহা বহুবিধ প্রকারেই বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য ইহার প্রতিকূলেও কিছু বলিবার আছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, তাহা অঙ্গীকার করিয়া লইলেও এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য তিলার্ধও বিচলিত হয় না।

সে যাই হউক, আমি এতক্ষণ যাহা বলিয়া আসিয়াছি, তাহা এই যে, প্রায় কোন দেশেই পুরুষ নারীর যথার্থ মূল্য দেয় নাই; এবং তাহাকে নির্যাতন করিয়াই আসিতেছে। নির্যাতন করিয়া যে আসিতেছে, সে কথা অস্বীকার করিবার পথ নাই, কিন্তু ন্যায্য মূল্য হইতে যে চিরদিন বঞ্চিত করিয়াই আসিতেছে, এই কথাটার উপরেই তর্ক বাধিতে পারে। কারণ, কি তাহার সত্য মূল্য তাহা স্থির না করার পূর্বে বলা চলে না নারী যথার্থ মূল্য পাইয়াছে কিনা! পুরুষ এমন কথাও বলিতে পারে যে, যেদেশে নারী যে মূল্য লাভ করিয়া আসিতেছে, হয়ত, সেই দেশে সেই তাহার প্রাপ্য মূল্য। অতএব, এই কথাটা আলোচনা করা আবশ্যক। করিতে হইলে সর্বাগ্রে নর-নারীর সম্বন্ধের বিচারই করিতে হয়। সম্বন্ধ মুখ্যতঃ চারিটা : স্ত্রী, ভগিনী, কন্যা ও জননী—তাহাই আমি পর্যায়ক্রমে আলোচনা করিতেছি। আদিম মানব কি করিয়া স্ত্রী লাভ করিত, তাহার অনেক তথ্য John F. M’Lennan তাঁহার প্রসিদ্ধ Primitive Marriage গ্রন্থে নানা দেশ হইতে আহরণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মানুষ যখন পশুর মত ছিল, তখন কি করিয়া স্ত্রী লাভ করিত, আমিও এই প্রবন্ধের প্রারম্ভেই সে ইঙ্গিত একাধিকবার করিয়াছি। সবল দুর্বলের নিকট হইতে কাড়িয়া লইত এবং শখ মিটিলে ত্যাগ করিত; তাহার শখের কাছে, তাহার স্ত্রী-লাভের প্রয়োজনের কাছে সে কিছুই বিচার করিত না, কোন সম্বন্ধই তাহাকে বাধা দিতে পারিত না। M’Lennan একস্থানে বলিয়াছেন, “men must originally have been free of any prejudice against marriage between relations.” তাঁহার এ কথাটা বড় সত্য কথা। Primitive instinct বলিয়া তখন কোন বস্তু ছিল না। মা মেয়ে ভগিনী কিছুই না মানিবার অনেক উদাহরণ শুধু যে অসভ্য আদিম মানবের কাছেই পাওয়া যায় তাহা নহে, অর্ধ-সভ্য ও সুসভ্যের মধ্যেও পাওয়া যায়। অতিশয় সভ্য সমাজেও যে মাঝে মাঝে বীভৎস গোপন কলঙ্কের কথা শোনা যায়, এ-ও যে সেই আদিম মানবের খেলা, তাহা heredity সম্বন্ধে যে-কেহ কিছু আলোচনা করিয়াছেন, তিনিই অবগত আছেন।

পূর্বে বলিয়াছি, অসভ্য চিপিওয়েনরা জননীকে বিবাহ করে। অর্ধ-সভ্য আফ্রিকার গেবুন (Gaboon) প্রদেশের রাণী কিছুদিন পূর্বে স্বামীর মৃত্যুর পর রাজ্য হারাইবার আশঙ্কায় নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বিবাহ করিয়া সিংহাসনের দাবী বজায় রাখিয়াছিলেন। পারস্যের সম্রাট আর্টজারাক্সস্‌ নিজের রূপবতী দুই কন্যারই পানিগ্রহণ করিয়াছিলেন। সুসভ্য প্রাচীন মিশরের ফারাওরা সহোদরাকে বিবাহ করিতেন। সভ্য পেরু প্রদেশের রোক্কা ইঙ্কার বংশধর ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম ইঙ্কা আভিজাত্য বজায় রাখিবার জন্য দ্বিতীয় পুত্রের সহিত কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ দিয়া সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন। বশিষ্ঠ ঋষিও তাঁহার ভগিনী অরুন্ধতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। লঙ্কা-দ্বীপের অসভ্য ভেদ্দারা ছোট বোনকে বিবাহ করা সবচেয়ে গৌরবের ব্যাপার বলিয়া মনে করে। সমাজে কুলীন বলিয়া তখন তাহার মান বাড়ে। বৈমাত্র ভগিনী ও বিধবা ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ করা ত প্রায় সব দেশেই প্রচলিত আছে। অথচ ইহাদের কেহই এক অসভ্য ভেদ্দা ছাড়া একটিমাত্র স্ত্রী লইয়া সন্তুষ্ট থাকে না। সকলেই বহুবিবাহ করে। অর্থাৎ, মানুষ ঘরেরটাও পরকে দেয় না এবং পরেরটাও কাড়িয়া আনে। এখানে যদি মনে করা যায়, উপরে যে সব কথা বলা হইল, তাহা শুধু ওই-সব দেশ ও জাতির সম্বন্ধে খাটে, অন্যান্য দেশে খাটে না, তাহা হইলে ভুল বুঝা হইবে। সব দেশে এবং সব জাতির সম্বন্ধেই যে ওই কথা খাটে, কোথাও ও-প্রথা লুপ্ত হইয়াছে, কোথাও আজিও প্রচলিত আছে। আমাদের এ-দেশে আজ বড় ভাই ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করিতে পারে না, কিন্তু এই দেশের পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই এক দ্রৌপদীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এবং ঠিক স্মরণ হইতেছে না, দীর্ঘতপা ঋষিরাও সাত ভাই বুঝি এক স্ত্রী লইয়াই ঋষিযাত্রা নির্বাহ করিয়াছিলেন। এবং ইহাকেই মহাভারতের আদিপর্বে সনাতন প্রথা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এবং যাহাকে অসভ্যদিগের ‘marriage by capture’ বলা হয়, তাহার যে বহুল প্রচলন এই সভ্য ভারতভূমেও ছিল, সে দৃষ্টান্তেরও অসদ্ভাব নাই। নারী লইয়া এই যে ঘরে-বাহিরে টানাটানি, কাড়াকাড়ি, অথচ দুইদিন পরে তাহার কোন দাম নাই—এইটা বুঝাইবার জন্যই নারীর আদিম অবস্থার ইঙ্গিত করিয়াছি। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আবিসিনিয়ার লোকেরা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইলে সর্দারকে নিজের মাথার পরিবর্তে যুবতী কন্যা কিংবা স্ত্রী দান করিত, এই মূল্যবান উপহার আবার সর্দার দু’দিন পরে যাহাকে ইচ্ছা বিলাইয়া দিতেন।

Captain Speke এই দেশের রাজার সম্বন্ধে একটা দিনের ঘটনা বিবৃত করিয়াছেন—“next the whole party (King and Queens) took a walk winding through the trees and picking fruit, enjoying themselves amazingly, by some unlucky chance, one of the royal wives, a most charming creature and truly one of the best of the lot plucked a fruit and offered it to the king, thinking doubtless to please him greatly, but he, like a mad man flew into a towering passion, said it was the first a woman ever had the imprudence to offer him anything and ordered the pages to seize, bind and lead her off to execution”. তাঁহার পরে স্পিক লিখিতেছেন,—“it was too much for my English blood to stand; and of course I ran imminent risk of losing my own in trying to thwart the capricious tyrant but I saved the woman’s life.” নারী লইয়া পুরুষের এই যে পুতুল-খেলা, এই যে স্বার্থপরতা, পাশব বৃত্তির এই যে একান্ত উন্মত্ততা, সে শুধু নারীজাতিকেই অপমানিত ও অবনমিত করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, পুরুষ যে, সমাজকে এবং সমস্ত মাতৃভূমিকে ঐ সঙ্গে টানিয়া নামাইয়া আনিয়াছে। বিভিন্ন দেশের নজীর দিয়া দেখাইবার স্থান এ প্রবন্ধে নাই, তাই আমি শুধু কাপ্তেন স্পিকের আর একটা কথা বলিয়াই থামিব। তিনি বলিয়াছেন, আফ্রিকার এতবড় দুর্দশার বারো-আনা হেতু পুরুষের এই উচ্ছৃঙ্খলতা। তথায় সর্দারদিগের এবং ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদিগের মৃত্যুর পরেই একটা যুদ্ধ-বিগ্রহ ওলটপালট অনিবার্য। সেখানে, কে যে কার বৈমাত্র ভাই হয়, কাহার সম্পত্তিতে কাহার যে অধিকার নাই, তাহা গায়ের জোর এবং বল্লমের ফলা ভিন্ন প্রতিপন্ন করার দ্বিতীয় পথ নাই। আরো একটা কথা। ঐ কাপ্তেন সাহেব যখন তাঁহার একজন ওয়াবিম্বি নিগ্রো ভৃত্যের মুখে শুনিলেন যে, তাহারা নরমাংস আহার করে এবং বড় ভালবাসে, তখন প্রশ্ন করিয়াছিলেন, “বাপু, নরমাংস এত পাও কোথায়? নিজেদের লোক মারিয়া আহার কর কি?” সে লোকটা জবাব দিয়াছিল, “না, নিজেদের লোক মারি না, আশপাশের গাঁ হইতে কিনিয়া আনি।” “অর্থাৎ?” লোকটা বলিল, “যে সব ছেলেমেয়েদের বাপ নাই, তাহারা খাইতে না পাইয়া প্রায়ই পীড়িত হইয়া পড়ে, তখন তাহাদের জননীরা একটা ছাগল পাইলেই শিশুগুলিকে দিয়া দেয়, আমরা ঘরে আনিয়া মারিয়া খাই।” সুসভ্য দেশেও বাপ আর একটা বিবাহ করিয়া তাহার দ্বিতীয় পক্ষের শিশুগুলির তুলনায় প্রথম পক্ষের সন্তানগুলির উপরে যেমন অনেক সময়েই নির্দয় হইয়া উঠেন, এ-ক্ষেত্রে জননীরাও বোধ করি সেইরূপই হয়, তবে অসভ্য বলিয়া কিছু বাড়াবাড়ি করে এবং করাই বোধ করি স্বাভাবিক! আন্দামান দ্বীপের অসভ্যদিগের একটা প্রথা আছে, শিশুর দাঁত না-ওঠা পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকে, তার পর যে যাহার পথ দেখে। পুরুষটি আর একটি স্ত্রী খোঁজে, তাহার স্ত্রীটিও তাই। সে সময়ে জননীরা প্রায়ই তাহাদের দাঁত-ওঠা শিশুটিকে কোন একটা জলাশয়ের ধারে ফেলিয়া দিয়া দ্বিতীয় সংসার করিতে যায়।

সেইজন্যই ডাক্তার Francis Day রিপোর্ট দিয়াছিলেন, আন্দামান দ্বীপবাসীরা ‘are fast dying out’ এবং অনেক অনুসন্ধান করিয়াও তিনি এমন একটি জননী খুঁজিয়া পান নাই যাহার একসঙ্গে তিনটি সন্তানও জীবিত আছে। আমেরিকার কুচিল জননীরা সন্তান পীড়িত হইয়া পড়িলেই বনের ভিতর ফেলিয়া দিয়া আসে। হারবার্ট স্পেন্সর Savage Life and Scenes in Australia and New Zealand (by G. F. Angas)-এর উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন, Angas সাহেবের কথা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না যে, সত্যই অস্ট্রেলিয়ার অসভ্যেরা অভাবে নিজেদের জীবন্ত ছেলেমেয়েদের বঁড়শিতে গাঁথিয়া কুমীর হাঙ্গর ধরিবার টোপ (bate) প্রস্তুত করে এবং চর্বি লইয়া মাছ ধরে। কিন্তু তাঁহার কথা অবিশ্বাস করিবার বিশেষ হেতু নাই। কারণ, অনুসন্ধান করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, যে-কোন দেশে যে-কোন জাতির মধ্যে সমাজে নারীর স্থান নীচে নামিয়া আসিবার সঙ্গেই শিশুর স্থান আপনি নামিয়া আসে। এ শুধু মানবের নিম্নস্তরের কথা নহে। অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরেও চোখ ফিরাইলে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, নারী যেখানে উপেক্ষার পদার্থ, জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ শিশুরাও সেখানে উপেক্ষা অবহেলার জিনিস। এ কথার সত্যতা উদাহরণ দিয়া প্রমাণ করিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। সে-জাতির ভবিষ্যত উত্তরোত্তর অন্ধকার হইয়াই আসিতে থাকে। কিন্তু নর-নারীর শিথিল বন্ধনই তাহার একমাত্র হেতু বলিয়া যাঁহারা মনে করেন, তাঁহারা ভুল করেন। নারী উপেক্ষিত ক্রীড়ার সামগ্রী,—এইটিই সর্বপ্রধান হেতু। হারবার্ট স্পেন্সর তাঁহার Sociology গ্রন্থে আদিম মানবের Strong emotion-এর দোহাই পাড়িয়া কি করিয়া এই বিষয়টার মীমাংসা করিতে চাহিয়াছেন ঠিক বুঝিতে পারা যায় না। রাগের মাথার “Will slay a child for letting fall something it was carrying.” ‘ইমোশন’ হইতে পারে, কিন্তু “kill their children without remorse on various occasion,” মাছ ধরিবার টোপের জন্য ছেলে মারিয়া ধীরে ধীরে তাহার চর্বি বাহির করা, কিংবা desert sick children কি করিয়া ঠিক ‘ইমোশন’ হইতে পারে বলিতে পারি না। আর তাহাও যদি হয়, তাহাতেও আমার কথাটা অস্বীকৃত হয় না। আদিম মানবের যত কিছু দোষ থাকিবার তাহা ত আছেই, নর-নারীর বন্ধন প্রায় সর্বত্রই শিথিল, সেকথা ত বটেই, কিন্তু তাহাতেও তাহার সামাজিক অবস্থা উত্তরোত্তর নামিয়া আসে না, দিন দিন সে সংসার হইতে অপসৃত হইয়া যায় না, যদি না সে তাহার নারীর অবস্থা নামাইয়া আনে। টাহিটির কথা দৃষ্টান্তের মত উল্লেখ করিতেছি। কাপ্তেন কুক তাঁহার ভ্রমণ-কাহিনীতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, ইহাদের দাম্পত্য-বন্ধন অতি কদর্য— very low, very degraded এমন কি, যে স্ত্রী সুন্দরী, তাহার কিছুতে একটা স্বামীতে মন ওঠে না; বাপের বাড়ির অবস্থা শ্বশুর বাড়ির অবস্থা হইতে ভাল হইলে, স্ত্রী “as a right demand and obtain more husbands” এবং পরবর্তী পর্যটকেরাও এ-সব কথা সত্য করিয়াই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।

কিন্তু এ সমস্ত থাকা সত্ত্বেও ঐ-দেশের পুরুষেরা নারীকে শ্রদ্ধা-সম্মানের চোখে দেখে। বোধ করি এইজন্যই এ-দেশের শিশু-সন্তানেরা অত্যন্ত যত্নের সহিত প্রতিপালিত হয়; এবং সেদিনেও সকলে এ কথাটা একবাক্যে স্বীকার করিয়া গিয়াছিলেন যে, ইহাদের মত শান্ত, সুশীল, অতিথি-বৎসল এবং সৎ অনেক সভ্য-সমাজেও দেখা যায় না। চুরি-ডাকাতি ইহারা জানিত না। সামাজিক অবস্থা তাহাদের অনুকরণীয় এমন কথা বলিতেছি না, কিন্তু তাহারা কোনদিন নারীর অসম্মান করে নাই, অন্যান্য অসভ্যদের মত রমণীর স্থান টানিয়া নীচে নামাইয়া আনে নাই বলিয়াই ১৯০৬ সালে C. L. Wragge ‘The Romance of the South Seas’ গ্রন্থে টাহিটি দ্বীপের অধিবাসীদের সম্বন্ধে উচ্চকণ্ঠে লিখিয়া গিয়াছেন “And what are the duties of women? To look after the house and mind the children; to be good wives, good mothers, to leave politics alone and darn the clothes. Tahitian woman, in woman’s sphere, are superior by far, in my opinion, to their sisters in the Bois and few Belgraviennes can give them points.”

সিলোনের অতি অসভ্য ভেদ্দারা, যাহারা নারীজাতিকে অতিশয় শ্রদ্ধা-সম্মান করে, প্রাণান্তেও এক স্ত্রী বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে না, এবং কিছুতেই স্ত্রী ত্যাগ করে না, তাহাদের সম্বন্ধে জার্মান বিজ্ঞানাচার্য হেকেল বলিয়া গিয়াছেন, সততা ও ন্যায়পরতায় ইহারা ইউরোপের অনেক সভ্য জাতিকেই শিক্ষা দিতে পারে। ইহাদের অপত্যস্নেহের মত মধুর বস্তু জগতে দুর্লভ। ডায়েক ও টোডাদের সম্বন্ধেও প্রায় এই কথা খাটে। তিব্বতের রমণীদের চরিত্র-বিষয়ে খুব সুনাম নাই। শুধু যে তাহারা সব কয়টি ভাইকেই স্বামীত্বে বরণ করে তাহা নহে, করুণা হইলে পাড়া-প্রতিবেশীর আবেদেন-নিবেদনও অগ্রাহ্য করে না। তথাপি দেশের পুরুষেরা তাহাদের নারীকে অত্যন্ত সম্মান করে। বোধ করি এইজন্যই রাজা রামমোহন রায় এই তিব্বতী রমণীদের সম্বন্ধে বলিয়া গিয়াছেন, “বিপদের দিনে এই তিব্বতের রমণীর দয়াতেই প্রাণ যায় নাই এবং আজিও চল্লিশ বৎসর পরে সেই রমণীগণের কথা স্মরণ করিলে চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হয়”; এবং ইহাদের কাছেই তিনি সারাজীবন ধরিয়া নারীজাতিকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করিতে শিখিয়াছিলেন, এ কথা তিনি নিজের মুখেই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।

এইখানে আমার পাঠকের কাছে একটা অতি বিনীত নিবেদন আছে। এই-সব দৃষ্টান্ত হইতে আমাকে যেন এমন ভুল না বোঝা হয় যে, আমি অসচ্চরিত্রার গুণ গাহিতেছি। আমি গুণ গাহিতেছি না,—শুধু এই কথাটা বুঝাইয়া বলিতে চাহিতেছি যে, এমন অবস্থাতেও পুরুষ নারীকে সম্মান দিয়া, তাহার একটা মূল্য দিয়াও ঠকে নাই। তাহার একটা স্বাভাবিক সত্য-মূল্য আছে বলিয়াই, এমন অবস্থাতেও পুরুষ জিতিয়াছে বৈ হারে নাই। এইবার একটা বিপরীত দৃষ্টান্ত লইয়া দেখি। ফিজিদ্বীপের রমণী; এমন পতিব্রতা স্ত্রী আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ—স্বামীর গোরের উপর ইহারা স্বেছায় উদ্বন্ধনে প্রাণ দেয়, তাহা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি।