উপসংহার

আরো একটা কথা। সামাজিক নিয়ম-সম্বন্ধে যাঁহারাই আলোচনা করিয়া তাঁহাদের পরিশ্রমের ফল লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা এ সত্যটাও আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন যে, সমাজে নারীর স্থান অবনত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের স্থান আপনি নামিয়া আসে। কেন হয়, এবং হওয়াটা স্বাভাবিক কি না, এ কথা বুঝিতে পারা কঠিন নহে। আমিও ইতিপূর্বে কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়া বলিয়াছি, শিশুর জননীর সহিত যত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, পিতার সহিত তত নয়।

এই কারণেই সংসারে কৃতী লোকের জীবনী আলোচনা করিলে দেখা যায়, তাঁহারা সকলেই এমন মা পাইয়াছিলেন যাহাতে সংসারে উন্নতি করা অসম্ভব হইয়া উঠে নাই। কিন্তু, এই মায়ের অবস্থাটা সাধারণতঃ যদি দিন দিন নামিয়া পড়িতে থাকে, এবং তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলে দেশের কৃতী সন্তানের সংখ্যা কমিয়া আসিতেই থাকে, এই প্রতিযোগিতার দিনে সে জাতি, আর জাতির মত জাতি হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তবে এতকাল টিকিয়া রহিল কিরূপে? এই বলিয়া জবাবদিহি করিতে যাঁহারা চান তাঁহাদের শুধু এইটুকুমাত্রই বলিতে চাই যে, কোনমতে কেবল প্রাণধারণ করিয়া থাকাটাই মানুষের বাঁচা নয়।

সমাজে নারীর স্থান নামিয়া আসিলে নর-নারী উভয়েরই অনিষ্ট ঘটে, সে-সম্বন্ধে বোধ করি মতভেদ থাকিতে পারে না, এবং এই অনিষ্টের অনুসরণ করিলেই যে নারীর স্থান নির্দিষ্ট হইতে পারে, তাহাও বুঝিতে পারা কঠিন ব্যাপার নয়। সমাজ মানে নর-নারী। শুধু নরও নয়, শুধু নারীও নয়। উভয়েরই কর্তব্য সম্যক্‌ প্রতিপালিত হইতেছে কি না! কর্তব্য বলিতে শুধু নিজের কাজটাই বুঝায় না, অপরকেও ঠিক ততটা কাজ করিবার অবকাশ দেওয়া হইতেছে কি না, তাহাও বুঝায়। সেইটুকুই বুঝিতে বলিতেছি।

আরো একটা কথা এই যে, পুরুষের সমস্ত কাজ নারীর করিতে পারে না, নারীর সমস্ত কাজও পুরুষে করিতে পারে না; কিংবা যে কর্তব্য দু’জনে মিলিয়া করিলে তবেই সুসম্পন্ন হয়, তাহাও শুধু একার দ্বারা সর্বাঙ্গসুন্দর হইতে পারে না। অতএব, সমস্ত সমাজেরই দেখা উচিত তথায় নারীর কর্তব্য প্রতিপালিত হইতেছে কি না। এবং কাজ করিবার ন্যায্য স্বাধীনতা ও প্রশস্ত স্থান তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে কি না। জেলের কয়েদীদিগের কাছেও ভাল কাজ আদায় করিয়া লইতে হইলে তাহাদের শৃঙ্খলের ভার লঘু করিয়া দেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য শৃঙ্খল একেবারে মুক্ত করিয়া দিবার কথা বলিতেছি না—তাহাতে আমেরিকার মেয়েদের দশা ঘটে। তাহাদের অবাধ স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হইয়াছে। একদিন প্রাচীন রোমে আইন পাশ করিতে হইয়াছিল, “to prevent great ladies from becoming public prostitutes.” কোথাও একবার পড়িয়াছিলাম, তিব্বতের এক স্ত্রীর বহু-স্বামিত্বের প্রসঙ্গে গ্রন্থকার বোধ করি একটুখানি পরিহাস করিয়াই বলিয়াছেন—এ-সব কথা লিখিতে ভয় হয়, পাছে আমেরিকার নারীরাও খেয়াল ধরিয়া বসে, আমরাও ওই চাই! তাহাদের ব্যাপার দেখিয়া প্রায় সমস্ত পুরুষেরই হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়া যাইবার মত হইয়াছে। তাই কতকটা শৃঙ্খলের প্রয়োজন। অপরপক্ষে শৃঙ্খল একেবারে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিলে পুরুষেরাও যে কত অবিচারী, উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠে, এই ভারতবর্ষেই সে দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই।

যাই হউক, কথা হইতেছিল কাজ করিবার ন্যায্য স্বাধীনতা এবং ন্যায্য স্থান ছাড়িয়া দেওয়া, এবং কোন্‌ কাজটা কাহার, এবং কোন্‌ কাজটা উভয়ের এই মীমাংসা করিয়া লওয়া।

মানব-সমাজের যত নিম্নস্তরে অবতরণ করা যায়, ততই চোখে পড়িতে থাকে এই ভুলটাই তাহারা ক্রমাগত করিয়া আসিয়াছে, এবং তাহাতে কিছুতেই সুবিধা করিয়া উঠিতে পারে নাই। অধিকাংশ স্থলেই পুরুষ শুধু লড়াই করে, এবং শিকার করে,—আর কিছু করে না। জীবন-ধারণের বাকী কাজগুলা সমস্তই একা নারীকে করিতে হয়। তাহারা জল তোলে, কাঠ কাটে, মোট বয়, জমি চাষ করে, সন্তান প্রসব করে, রাঁধাবাড়া সমস্তই করে। এমন কি, শিকারলব্ধ পশুটাকেও বহিয়া আনিবার জন্য বনে-জঙ্গলে পুরুষের পিছনে পিছনে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়। এবং ইহার অনিবার্য ফলও যাহা হইবার ঠিক তাই হয়। অবশ্য স্বীকার করি, সব দেশেই কিছু নর-নারীর কাজের ধারণা এক হইতে পারে না—হয়ও না। কিন্তু একটু মনোযোগ করিলেই টের পাওয়া যায় সভ্যতার অনুপাতে কর্তব্য-বিভাগের একটা সাদৃশ্য আছে এবং, এই অনুপাত যত বাড়িতে থাকে সাদৃশ্যও তত কমিয়া আসিতে থাকে। যেমন, ব্যবহারের নিমিত্ত দূর হইতে জল আনিবার আবশ্যক হইলে একজন ফরাসী কিংবা ইংরাজ হয়ত তাহা নিজেরাই করিবেন, কিন্তু, আমরা লজ্জায় মরিয়া যাইব; এবং তাহার পরিবর্তে গর্ভবতী স্ত্রীর কাঁকালে একটা মস্ত ঘড়া তুলিয়া দিয়া জলাশয়ে পাঠাইয়া দিয়া লজ্জা নিবারণ করিব। পেরুর উন্নত অবস্থার দিনে পুরুষ চরকা কাটিত এবং কাপড় বুনিত, স্ত্রীলোক লাঙ্গল ঠেলিত। এখনো সামোয়ার অধিবাসীরা রাঁধাবাড়া করে, স্ত্রীলোক হাটেবাজারে যায়। আবিসিনিয়ার পুরুষদের বাজারে যাইতে মাথা কাটা যায়, কিন্তু প্রফুল্লমুখে ঘাট হইতে নর-নারী উভয়েরই কাপড় কাচিয়া আনে। এইরূপ কাজকর্মের ধারণা সব দেশে এক নয়, এবং ছোটখাটো বিষয়ে এক না হইলেও বেশিকিছু আসিয়া যায় না সত্য, কিন্তু এই ধারণা স্বাভাবিক নিয়মকে অতিক্রম করিয়া গেলে অমঙ্গল অনিবার্য। অর্থাৎ, পুরুষ সর্ববিষয়ে স্ত্রীলোকের কাজ করিতে গেলে যেমন করডোদের মত অকর্মণ্য হীন হইয়া পড়ে, তেমনি ডাহোমি রাজার স্ত্রী-সৈন্যও যথার্থ unsexed হইয়াই তবে লড়াই করিতে পারে। তাহাতে নিজেরও কল্যাণ হয় না, দেশেরও না। কিন্তু, এই সমস্ত পুরুষোচিত কাজকর্মের দরুনই একদল পণ্ডিতের এমন বিশ্বাসও জন্মিয়া গিয়াছে যে, আদিম যুগে নর-নারীর মধ্যে নারীর স্থানই উচ্চে ছিল। তাহারাই leader of civilization, অথচ কেন সংসারে নারীর স্থান এমন উত্তরোত্তর নামিয়া পড়িয়াছে তাহার কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিয়া স্পেন্সর সাহেব স্থির করিয়াছেন, দেশের লোক যত যুদ্ধপ্রিয়, অন্ততঃ আত্মরক্ষার জন্য যাহাদিগকে ঘরে-বাহিরে যত বেশী লড়াই করিতে হইয়াছে তাহারাই তত বেশী নারীর উপর অত্যাচার করিয়া আসিয়াছে, তত বেশি গায়ের জোর খাটাইয়াছে। নারী যে স্বাভাবিক কোমলতা ও নম্রতার জন্যই স্বেচ্ছায় এত নির্যাতন এবং অধীনতা স্বীকার করিয়াছে তাহা নয়। তাহারা গায়ের জোরে পারিয়া উঠে নাই বলিয়াই স্বীকার করিয়াছে, পারিলে স্বীকার করিত না।

কারণ, দেখা গিয়াছে যেখানে সুবিধা এবং সুযোগ মিলিয়াছে সেখানে নারী পুরুষ অপেক্ষা একতিলও কম নিষ্ঠুর বা কম রক্তপিপাসু নয়! এখানে এইটাই দেখিবার বিষয় যে, পুরুষ যদি এই বলিয়া জবাবদিহি করে, সে দুর্বলের উপর গায়ের জোর খাটাইয়া কর্তৃত্ব করে নাই, বুঝিয়া-সুঝিয়া ধীরস্থিরভাবে বিবেচনা করিয়া কর্তব্য এবং মঙ্গলের খাতিরেই বাধ্য হইয়া নারীর এই নিম্নস্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে, তাহা হইলে সে কথা সত্য নয়।

অবশ্য স্পেন্সরের এই মত সকলেই যে বিনা-প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু যতগুলা বিভিন্ন প্রতিবাদ অন্ততঃ আমার চোখে পড়িয়াছে তাহাতে স্পেন্সরের মতটাই সত্য বলিয়া মনে হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, “militancy implies pre-dominance of compulsory co-operation” এবং তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলের উল্লেখ করিয়া লিখিতেছেন, “Hence the disregard of women’s claims shown in stealing and buying them; hence the inequality of status between the sexes entailed by polygamy, hence the use of women as labouring Slaves; hence the life-and-death power over wife and child; and hence that constitution of the family which subjects all its members to the eldest male. Conversely, the type of individual nature developed by voluntary co-operation in societies that are predominantly industrial, whether they be peaceful simple tribes, or nations that have in great measure outgrown militancy, is a relatively-altruistic nature.”

বাস্তবিক এই compulsory co-operation যেখানে এত ‘binding’ তা লড়ায়ের জন্যই হউক, আর পরকালের জন্যই হউক, নারীর অবস্থা সেখানেই তত হীন। ধর্মের গোঁড়ামি, অধর্মের অত্যাচার নারীকে যে কত নিচু করিয়াছিল ইউরোপের মধ্যযুগ তাহার বড় প্রমাণ। প্রবন্ধের প্রারম্ভেই তাহার কতকটা ইঙ্গিত দিয়া গিয়াছি, এবং আবশ্যক হইলে আরও শতশহস্র দেওয়া যাইতে পারিত, কিন্তু সে আবশ্যক আশা করি নাই। ধর্মের গোঁড়ামি কেন নারীকে হীন করিল, সে আলোচনা এ প্রবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক হইবে, সুতরাং তাহাতে বিরত রহিলাম। শুধু এই স্থূল কথাটা বলিয়া রাখিব যে, ধর্মের বাড়াবাড়ির প্রধান উপাদান বিরক্তি। যা-কিছু সাংসারিক লোকের প্রার্থিত তাহাতেই আসক্তি নাই, এই ভাবটা দেখানো। বিষয়-আশয় টাকাকড়ি অতি বদ্‌ জিনিস—নারীও তাই। ‘The devil’s gate’ ‘নরকস্য দ্বারো নারী’ এইজন্যই শ্রেষ্ঠ ধর্মচর্চার বীজমন্ত্র। অর্থাৎ, যদি পরকালের কাজ করিতে চাও ত তাহাকে নরকের দ্বারস্বরূপ জ্ঞান কর, আর যদি ইহকালের কাজ করিতে চাও ত, আমাদের দেশের যে ব্যবস্থা ছিল তাই কর। যতগুলা পার বিবাহ কর,—তার আট-দশ রকম পথ আছে, এবং মরিলে যেমন করিয়া পার সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও। না পার অন্ততঃ জুজুর ভয় দেখাইয়া তাহাকে জড়ভড়ত করিয়া রাখিয়া যাও।

Monogamy যাহা নারীর যথার্থ সম্মানের ঠাঁই, এবং যাহা একমাত্র নর-নারীর প্রকৃত স্বাভাবিক বন্ধন, সে ধারণাই প্রায় এ দেশে নাই। অথচ, সতীত্বের এত অপর্যাপ্ত রীতি-নীতি, এটা বজায় রাখিবার এত অদ্ভুত ফন্দি আর কোন দেশে কোনদিন উদ্ভাবিতও হয় নাই। মনে হইতেছে, কোন এক মস্তবড় লোকের লেখায় পড়িয়াছি, আমাদের দেশ সমস্ত রকম সামাজিক প্রশ্নের যে একটা বড় রকম উত্তর দিয়াছেন, তাহা এখনও জগতের সম্মুখে আছে, এবং তাহার সফলতা অনিবার্য, না, কি এমনি একটা কথা। কি জানি আমাদের দেশ কি বড় উত্তর দিয়াছিল, এবং জগতের কাহারা সে-জন্য হাঁ করিয়া বসিয়া আছে, কিন্তু ফল যে তাহার অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহা টের পাওয়া যাইতেছে। তাঁহার দেখাদেখি আরো অনেকে—যাঁহারা সামাজিক ইতিহাসের কোন ধার ধারেন না, তাঁহারাও এই সমস্ত কল্পনার ধুয়া গাহিতে শুরু করিয়াছেন। ‘বড় রকম উত্তর দিয়াছিল’, ‘সমস্ত সামাজিক প্রশ্ন’, ‘জগতের সম্মুখে আছে’, ইত্যাদি বুলির অর্থ বোঝাও যেমন শক্ত, এই-সব সাহিত্যিক verbiage-এর প্রতিবাদ করিতে পারাও ততোধিক কঠিন। অন্যান্য জাতি চোখের উপর দিন দিন বড় হইয়া যাইতেছে, নর-নারী মিলিয়া পতিত সমাজটাকে দুইদিনে ঠেলিয়া উপরে তুলিয়া ধরিতেছে, যে যাহার ন্যায্য অধিকারের মধ্যে চলাফেরা করিয়া উন্নত হইয়া উঠিতেছে—তবু সে-সব কিছুই নয়। আর আমাদের দেশের সেই অবোধ্য বড় উত্তরটাই মস্তবড় এবং তাহার ভবিষ্যৎ কাল্পনিক সফলতাটাই সর্বোপরি বাঞ্ছনীয়। সেই জাতিভেদের অসংখ্য সঙ্কীর্ণতা, বালিকা-বিবাহ, বিবাহ না দিলে জাত যাওয়া, বারো বছরের বিধবা মেয়েকে দেবী করার বাহাদুরি, পঞ্চাশ বছরের বুড়ার সহিত এগারো বছরের মেয়ের বিবাহ এবং তাহার বছর-দুই পরেই তাহার গর্ভের সন্তান—এই-সমস্তই বড়-রকমের উত্তর। অথচ কথাটি বলিবার জো নাই। পণ্ডিতেরা হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিবেন, “তুমি আমাদের মুনি-ঋষিদের চেয়ে বেশি বোঝ?” মনে পড়ে, সেই আম কেনার কথা। লোকটা বলিল, “চেখে নিন—মিষ্টি গুড়।” খেয়ে দেখি তত টক আমার জীবনে খাই নাই। কিন্তু লোকটাকে কিছুতেই স্বীকার করাইতে পারিলাম না। সে ক্রমাগত চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, “টক বললেই শুনব? আমার গাছের আম আমি জানিনে!” এর আর উত্তর কি?

ইংরাজীতে যাহাকে ethics বলে, তাহার একটা গোড়ার কথা এই যে, বিসদৃশ হেতু না থাকিলে আমার স্বাধীনতাটা কেবল ততদূর পর্যন্ত টানিয়া লইয়া যাইতে পারি যতক্ষণ না তাহা আর একজনের তুল্য স্বাধীনতায় আঘাত করে। এই দুটো কথার দ্বারা মানুষের প্রায় সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রিত করা যাইতে পারে, এবং আমার বিশ্বাস, যে-কোন সামাজিক প্রশ্নের স্থানও ইহারই মধ্যে সঙ্কুলান হয়। ইহাকে যে সমাজ যত বেশি অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়াছে, সে তত বেশী নারীর উপর অন্যায় করিয়াছে, এবং তাহার প্রাপ্য অংশ হইতে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া নারীকেও নত করিয়াছে, নিজেরাও অবনত হইয়াছে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়া বলি।

একটি কন্যা হয়ত রুগ্না, দুর্বল, অশিক্ষিতা এবং অপটু তত্রাচ একটা বিশেষ বয়সে তাহার বিবাহ দিতেই হইবে, অর্থাৎ মাতৃত্বের গুরুভার তাহাকে মাথায় তুলিতেই হইবে; অথচ, আর একটি বিধবা মেয়ে হয়ত সবল সুস্থ, শিক্ষিতা এবং মাতৃত্বের সম্পূর্ণ উপযোগিনী—আদর্শ জননীর সমস্ত সদ্‌গুণে হয়ত ভগবান তাহাকে ভূষিত করিয়াছেন, তবুও তাহাকে তাহার স্বাভাবিক ন্যায়সঙ্গত অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে হইবে! ইহাতে শাস্ত্রকারের মর্যাদা যদি-বা বজায় থাকে, ধর্মের মর্যাদা যে বজায় থাকে না, তাহা নিসংশয়ে বলিতে পারা যায়। প্রথমটাতেও না, পরেরটাতেও না।

সুসভ্য মানবের সুস্থ সংযত শুভবুদ্ধি যে অধিকার রমণীজাতিকে সমর্পণ করিতে বলে, তাহাই মানবের সামাজিক নীতি এবং তাহাতেই সমাজের কল্যাণ হয়। কোন একটা জাতির ধর্মপুস্তকে কি আছে না আছে তাহাতে হয় না। নারীর মূল্য বলিতে আমি এই নীতি ও অধিকারের কথায় এতদূর পর্যন্ত বলিয়া আসিয়াছি। Supply এবং demand-এর মূল্যও বলি নাই, কবে পুরুষ বাড়িয়া উঠিবে, কবে নারী বিরল হইবে, সে আশাও করি নাই। নারীর মূল্য নির্ভর করে পুরুষের স্নেহ, সহানুভূতি ও ন্যায়-ধর্মের উপরে। ভগবান তাহাকে দুর্বল করিয়াই গড়িয়াছেন, বলের সেই অভাবটুকু পুরুষ এই সমস্ত বৃত্তির মুখের দিকে চাহিয়াই সম্পূর্ণ করিয়া দিতে পারে, ধর্মপুস্তকের খুঁটিনাটি ও অবোধ্য অর্থের সাহায্যে পারে না। ইহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাপান। সে কেবল তাহার নারীর স্থান উন্নত করিতে পারিয়াছে সেইদিন হইতে, যেদিন হইতে সে তাহার সামাজিক রীতি-নীতির ভালো-মন্দর বিচার ধর্মের এবং ধর্ম-ব্যবসায়ীর আঁচড়-কামড়ের বাহিরে আনিয়া ফেলিয়াছে। কিছুদিন পূর্বেও সেখানে চীনাদের মত নারীর দুর্দশার সীমা-পরিসীমা ছিল না। শুধু ইউরোপ সম্বন্ধেই “The clergy have been the worst enemies of women, women are their best friends” নয়, অনেক দেশের সম্বন্ধেই ঠিক তাই। নারীর স্থান অবনত করিবার জন্য ধর্ম-ব্যবসায়ীর স্পর্ধা যে কতদূর বাড়িতে পারে, তাহা St. Ambrose-এর একটা উক্তি হইতে জানা যায়। তিনি অসংশয়ে প্রচার করিয়াছিলেন, “marriage could not have been God’s original theme of creation.” গডের অভিপ্রায়টুকু পর্যন্ত তাহাদের অগোচর থাকে না, কিন্তু কাহার সাধ্য তাহাকে অবিশ্বাস করে!

ইহার ব্যতিক্রম দেখিতে পাওয়া যায় একমাত্র ইসলাম-ধর্মে। যদিও নারীর স্থানটি কোরানের মতে ঠিক কোন্‌খানে, তাহা বুঝাইয়া বলা অতি কঠিন, তথাপি মহম্মদ নারীজাতিকে যে শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে আদেশ করিয়া গিয়াছেন, পুত্র-কন্যার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া তুলিতে নিষেধ করিয়া গিয়াছেন, বিশেষ করিয়া বিধবাকে— যাহার অবস্থা আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় ও নিরুপায় ছিল—তাহাকে দয়া ও ন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখিতে হুকুম করিয়া গিয়াছেন, এ-সব কথা অস্বীকার করা যায় না।

বস্তুতঃ তদানীন্তন আরব-রমণীর ভয়ঙ্কর অবস্থার তুলনায় আরবের নব-ধর্ম যে নারীকে সহস্রগুণে উন্নত করিয়াছে তাহাতে লেশমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না। Hornback, Ricaut প্রভৃতি গ্রন্থকারেরা কি ভাবিয়া যে প্রচার করিয়া গিয়াছেন, মুসলমানদের মতে নারীর আত্মা নাই এবং নারীকে তাহারা পশুর মত মনে করে, তাহা বলিতে পারি না। আমি ত কোরানের কোথাও এমন কথা দেখিতে পাই নাই। বরং কোরানের তৃতীয় অধ্যায়ের শেষের দিকে এই যে একটা উক্তি আছে‚ মৃত্যুর পর দুষ্কৃতকারীকে ঈশ্বর শাস্তি দেন—তিনি নর-নারীর প্রভেদ করেন না—তাহা দেখিয়া মনে হয়, মহম্মদ নারীর আত্মা অস্বীকার করেন নাই। কোরানের চতুর্থ অধ্যায়ে এবং আরও অনেক স্থানেই নারীর প্রতি সদয় ব্যবহারের কথা ও তাহার ন্যায্য অধিকারের বিষয় এই ধর্মগ্রন্থে পুনঃ পুনঃ আলোচিত হইয়াছে। তথাপি অনেকের বিশ্বাস, ইসলাম-ধর্মে নারীর স্থান বড় নীচে; এটা বোধ করি পুরুষের বহু-বিবাহের অনুমতি আছে বলিয়াই। চতুর্থ অধ্যায়ের গোড়াতেই আদেশ আছে, “take in marriage of such other women as please you, two or three or four and nomore.” এ ছাড়া বিশ্বাসী এবং সাধু লোকেরা স্বর্গে গিয়া কিরূপ সুখ-সম্পদ আমোদ-আহ্লাদ ভোগ করিতে পাইবেন, সে-সম্বন্ধে মহম্মদ অনেক আশা দিয়া গিয়াছেন। স্বর্গে প্রতি বিশ্বাসীর নিমিত্ত কিরূপ ও কতগুলি করিয়া হুরানি নির্দিষ্ট হইবে, তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ আলোচনা আছে, কিন্তু মর্ত্যের মানবীর অবস্থাটা স্বর্গে কিরূপ দাঁড়াইবে এবং সেইরূপ দাঁড়ান বাঞ্ছনীয় কি না তাহা নিঃসঙ্কোচে বলা যায় না। Sale সাহেব তাঁহার কোরানের অনুবাদের একস্থানে লিখিয়াছেন, “but that good women will go into a separate place of happiness, where they will enjoy all sorts of delights; but whether one of those delights will be the enjoyment of agreeable paramours created for them, to complete the economy of the Mahamedan system, is what I have found nowhere decided.” এই যদি হয়, এত করা সত্ত্বেও যে নারীর যথার্থ অবস্থা-সম্বন্ধে লোকের দারুণ সংশয় ও মতভেদ ঘটিবে, তাহা বিচিত্র নয়। তা ছাড়া মহম্মদ নিজেও একস্থানে বলিয়াছেন, “when he took a view of paradise, he saw the majority of its inhabitants to be the poor, and when he looked down into hell, he saw the greater part of the wretches confined there to be women!”

যাঁহারা মনে করেন সংসারে নারী প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকার জন্যই স্বভাবতঃ তাহার হীন মূল্য নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাঁহারা যে সম্পূর্ণ ভুল করেন এ কথা বলি না। কারণ, যে-দেশেই মানুষ লড়াই করাটাই পুরুষের পরম গৌরবের বস্তু বলিয়া ধরিয়া লইয়াছে এবং সেই হিসাবে লড়াই করিয়াছে এবং লোকক্ষয় করিয়া বাহ্যতঃ নিজেদের নারীর অনুপাত বৃদ্ধি করিয়াছে, সেই দেশেই নারীর মূল্য হ্রাস হইয়াছে।

এ কথা সত্য হইলেও, এ কথাটাও বুঝিয়া দেখিবার বিষয়, বাস্তবিক নারীর অনুপাত তাহাতে বৃদ্ধি হয় কি না। কারণ, এই কথাটা অনেকেই গণনার মধ্যে আনেন না যে, প্রায় সমস্ত যুদ্ধপ্রিয় জাতিই নিজেদের নারীর অনুপাত বৃদ্ধি না পাইবার দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখিয়া থাকে। প্রধান উপায় নিজেদের শিশু-কন্যা হত্যা করিয়া। প্রায় সমস্ত আদিম অসভ্য জাতিরা শিশু-কন্যা বধ করিয়া ফেলিত। রাজপুতেরা করিত, আরব শেখেরা কন্যা জন্মিবামাত্রই গর্ত কাটিয়া পুঁতিয়া ফেলিত, কেঁধাপ্রদেশের আরবেরা শিশু-কন্যার পাঁচ বৎসর বয়সে তাহাকে হত্যা করিবার পূর্বে কন্যার জননীকে সম্বোধন করিয়া বলিত, “এইবার মেয়েকে গন্ধ মাখাইয়া দাও, সাজাইয়া দাও, আজ সে তার মায়ের ঘরে যাইবে!” অর্থাৎ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে। কোরিশের লোকেরা মক্কার নিকটবর্তী আবুদেলামা পাহাড়ে নিজেদের কন্যা বধ করিত। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক স্ট্রাবো বলিয়া গিয়াছেন, “the practice of exposing female infants and putting them to death being so common among the ancients, that is remarked as a thing very extra-ordinary in the Egyptians, that they brought up all their children.” চীনাদের মধ্যে শুনিয়াছি এ প্রথা আজও আছে। গ্রীকদের সম্বন্ধে Posidippus-এর একটা প্রচলিত উক্তি Sale উদ্ধৃত করিয়াছেন, “a man, though too poor, will not expose his son; but if he is rich, will scarce preserve his daughter.”

সুতরাং লড়াই করিয়া নিজেরা মরিলে, বা কন্যা হত্যা করিলে নারীর অনুপাত বাড়ে না, কমেও না, অনুপাতের উপর নারীর সম্মান বা অসম্মান (মূল্য) নির্ভরও করে না। করে পুরুষের এই ধারণার উপর—নারী সম্পত্তি, নারী শুধু ভোগের বস্তু! তাই নিজেদের কন্যা বধ, তাই পরের কন্যা হরণ করিয়া আনিবার প্রথা! নিজেদের কন্যা পরে লইয়া গেলে মহা অপমান, পরের মেয়ে কাড়িয়া আনিতে পারিলে মহা গৌরব! এই জন্যই এক পুরুষের বহু স্ত্রী সম্মান ও বলের চিহ্ন। Burckhardt বলিয়াছেন এই ধারণা ওয়াহাবিদের মধ্যে আজও এত প্রবল যে, তাহারা ইউরোপের এক পুরুষের একটিমাত্র স্ত্রীর কথা শুনিয়া বিস্ময়ে হাঁ করিয়া থাকে। কথাটা সত্য বলিয়া তাহারা মনের মধ্যে বিশ্বাস পর্যন্ত করিতে পারে না।

আর না।

এ প্রবন্ধ অতি দীর্ঘ হইয়া গেল, এইবার শেষ করি। জানি না, পুরুষ এই প্রবন্ধ পড়িয়া কি মনে করিবেন, কিন্তু যাহা সত্য বলিয়া অকপটে বিশ্বাস করিয়াছি, নারীর মূল্য কেন হ্রাস পাইয়াছে এবং বাস্তবিক পাইয়াছে কি না, এবং মূল্য হ্রাস পাইলে সমাজে কি অমঙ্গল প্রবেশ করে এবং নারীর উপর পুরুষের কাল্পনিক অধিকারের মাত্রা বাড়াইয়া তুলিলে কি অনিষ্ট ঘটে, তাহা নিজের কথায় ও পরের কথায় বলিবার চেষ্টা করিয়াছি—এইমাত্র। তাহাতে শাস্ত্রের অসম্মান করা হইয়াছে, কি হয় নাই, দেশাচারের উপর কটাক্ষ করা হইয়াছে, কি হয় নাই—এ কথা মনে করিয়া কোথাও থামিয়া যাইতে পারি নাই। যাহা সত্য তাহাই বলিব এবং বলিয়াছিও, অবশ্য ফলাফলের বিচার-ভার পাঠকের উপর।

নর-নারীর পবিত্র বন্ধনের সীমা ও পরিণতি সম্ভবতঃ একদিন কি হইবে এবং কি হওয়া উচিত উপসংহারে শুধু সেই কথাটাই হারবার্ট স্পেন্সরের ভাষায় ব্যক্ত করিব। “As monogamy is likely to be raised in character by a public sentiment requiring that the legal bond shall not be entered into unless it represents the natural bond; so, perhaps it may be, that maintenance of legal bond will come to be held improper if the natural bond ceases. Already increased facilities for divorce point to the probability that whereas, while permanent monogamy was being evolved, the union by law (originally the act of purchase) was regarded as the essential part of marriage and the union by affection as non-essential, and whereas at present the union by law is thought the more important; and the union by affection the less important, there will come a time when the union by affection will be held of primary moment and the union by law as of secondary moment; whence reprobation of marital relations in which the union by affection has dissolved. That this conclusion will be at present unacceptable is likelyI may say, certain … Those higher sentiment accompanying union of the sexes, which do not exist among primitive men, and were less developed in early European times than now, may be expected to develop still more as decline of militancy and growth of industrialism foster altruism; for sympathy which in the root of altruism, is a chief element in these sentiments.”