পাঁচ : ময়না
রোদ মরে আসা শীতের বিকেল। ভেতরের বারান্দায় একখানা পত্রিকা হাতে নিয়ে বেতের চেয়ারে বসেছিল ময়না। একবার ভেবেছিল আজ শুক্রবার ছুটির দিন, একটু বাইরে যাবে। কিন্তু আলসেমি করে আর যাওয়া হলো না। ও একা বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কষ্ট হয়। ওর অতীত ও বর্তমান দুদিক থেকে ওকে ক্ষতবিক্ষত করে। অনেকেরই পীড়াদায়ক যন্ত্রণাবিদ্ধ অতীত থাকে। এক সময় মানুষ। তার থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু ময়নার ভাগ্যে সবই ব্যতিক্রম। এ জায়গাটা ওর ভালো লাগে। এই বিশাল ঢাকা শহরের ইট, কাঠ, লোহালক্কড়ের জঠরে নিশ্বাস ফেলবার মতো এই মৃদুমন্দ নির্মল হাওয়া তো বেহেশতী সৌভাগ্য। অনেক চেষ্টা করে বাসস্টপ থেকে সিকি মাইল দূরে এ ঘরটুকু সে পেয়েছে। সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর এ ওর শান্তির স্বর্গ।
সবচেয়ে বড় মুস্কিল ছিল স্বামীহীনা কোনও মেয়েকে এ দেশের অতিমাত্রায় সৎ ও ধর্মভীরু বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া দিতে চান না। অনেক হয়রানি সইতে হয়েছে। ময়নাকে। কিছুদিন হোস্টেলে ছিল। কিন্তু সুপার ম্যাডামের কৌতূহল তাকে টিকতে দিলো না অর্থাৎ তার নিজেরই সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেল। প্রায় ছ’মাস চেষ্টা করে হঠাৎ তার সহকর্মী আসিফের দৌলতে এই জায়গাটুকু সে পেয়েছে। আসিফের চাচার বাড়ি এটা। তেতলা বড় বাড়ি। ওপরের দু’টো তালা ভাড়া দিয়েছেন। পাচ্ছেন বারো হাজার টাকা। আর এক তলায় তারা দু’জন অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী থাকেন। সেখানেই আসিফের চাচি তাকে দেখে কথা বলে তারপর রাজি হয়েছেন। ওঁর দু’ছেলে। একজন থাকে নিউইয়র্কে আর একজন ফিনল্যান্ডে। ৩৪ বছর বাদে সপ্তাহ দু’য়ের জন্যে আসে। সুতরাং নিচে যেমন খালি ঘর থাকাও নিরাপদ নয় তেমনি কথা বলার একটা মানুষ থাকলেও ভালো লাগে। তাই উভয় পক্ষই এ ব্যবস্থায় খুশি হলো। ময়না সাড়ে আটটার ভেতর বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে সাতটা সাড়ে সাতটা হয়ে যায়। ছুটির দিনেও সে খুব একটা বাইরে যায় না। আজ ভেবেছিল যাবে, কিন্তু হয়ে উঠল না।
হঠাৎ ডোর বেসটা বাজলো, চাচি যেন কার সঙ্গে কথা বলে বসতে বললেন। একটু পরেই পর্দা তুলে বললেন, ময়না তোর সঙ্গে কে যেন একজন মহিলা দেখা করতে এসেছেন। আলসেমী ভেঙে বসবার ঘরে ঢুকেই ময়না অবাক। আপা আপনি, আপনি কি করে এ বাড়ি চিনলেন? তার মানে? সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছি আর এতবড় বাড়িটা…! না না, তা বলছি না। ঠিকানা পেলেন কোথায়? কেন তুমিই তো একদিন দিয়েছিলে মনে নেই? চলুন আমরা ভেতরে গিয়ে বসি। চাচি কুণ্ঠিতভাবে বললেন, না না তোমরা এখানেই বসো। আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আগন্তক এগিয়ে এসে চাচির হাত ধরে বললেন, কিছু লাগবে না চাচি আম্মা, আমি এক জায়গা থেকে দাওয়াত খেয়েই আসছি। যদি কিছুক্ষণ থাকি আর চা খাই তবে আপনার কাছ থেকে চেয়েই খাবো। মনে থাকে যেন মা, কাকে আর চা খাওয়াবো। তবুও তো এ মেয়েটা আছে তাই সারাদিনে দু’একবার মুখ খুলতে পারি। মহিলা অন্য দরজা দিয়ে ভেতরে গেলেন আর ওরাও বারান্দায় এলো। বাঃ। সুন্দর তো জায়গাটা। তোমার পছন্দ আছে ময়না পছন্দ না, এটা আমার পরম সৌভাগ্য আপা, যেমন আপনার মতো বোন পেয়েছিলাম জানি না কি সুকীর্তির ফলে। আর এই চাচা চাচিও আল্লাহর রহমত। বেতের চেয়ারটা আপাকে দিয়ে ময়না একটা মোড়া নিয়ে আপার কাছে কোল ঘেঁষে বসলো। হাত দু’খানা আপার কোলের ওপর তুলে দিয়ে মাখাটা নামিয়ে আনলো সেই হাতের ওপর। আপা আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তারপর বললেন, ময়না, আমি তোমার কাছে এলাম গল্প করতে আর তুমি বসলে কাঁদতে। এমন করলে আমি চলে যাবো। এক ঝাঁকুনি দিয়ে মাথাটা তুলে ময়না বললো, না না আপা আর কাঁদবো না, বিশ্বাস করুন আমি আর কারও সামনে চোখের পানি ফেলি না।
বুঝেছি সেই প্রথম থেকেই আপাকে পেয়েছো কান্নার খুঁটি হিসেবে। মনে আছে একদিন পাশের হোস্টেল থেকে তুমি আমাদের সমিতির অফিসে এসেছিলে ফোন করতে। আমাকে দেখতে পেয়ে দ্রুত সরে যাচ্ছিলে। আমি তোমাকে ডাকলাম, ময়না। তুমি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলে আমার নাম আপনি জানলেন কি করে? ময়না অবাক হয়েছিল আমি ওর পরিচয় জানি দেখে। বলেছিলাম, জেরিনা, মিসেস জেরিনা আলিম, তোমার সব কথা আমাকে বলেছেন: ময়না দীর্ঘশ্বাস চেপে বললো, জেরিনা আপা তো নেই। আমি জানি, ও আমার ছোট বোনের চেয়েও বেশি ছিল। অতো বড় লোকের একমাত্র মেয়ে অমানুষ স্বামীর হাতে কি অত্যাচারই না সয়ে গেল। থাক ওর কথা আরেক দিন শুনো। তোমার কথা বলো। তোমার সময় আছে তো? সেদিন থেকেই তো আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম, তাই না আপা? তাই একদিন আপনার ঘরে বসে বলেছিলাম, আপা আমি একজন বীরাঙ্গনা। কিন্তু আপনাদের দেওয়া পরিচয় অঙ্গের ভূষণ হয়েই রইলো, তাকে না পারলাম পরতে, না পারলাম ফেলতে। লোকচক্ষে হয়ে গেলাম বারাঙ্গনা। সত্যি মানুষ তাই ভাবে। দুর্দিনে কেউ পাশে এসে দাঁড়ালো না কিন্তু ধিক্কার দের বেলায় দিব্যি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আপা আমি বেশি দূরের নই, আপনাদের একেবারে কাছের মানুষ, প্রতিবেশী বলতে পারেন আমি নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার মেয়ে! ও পাড়ার দস্যি মেয়ে বলে সবাই আমাকে চিনতো। আমি মর্গান স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে আইএতে ভর্তি হলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন নারায়ণগঞ্জ কলেজের প্রিন্সিপাল যোগেন্দ্র বাবু। বাংলা পড়াতেন। এই ভিকারুন্নেসার প্রিন্সিপাল হামিদা আলী এঁরা সবাই আমাকে চিনতেন। আমি লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিলাম না। কিন্তু ওদের স্নেহ আর আদর অনেক পেয়েছি।
রাজনীতি করতাম, ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। কলেজের ওই দল গঠন ও তার কাজ করতাম। কতোদিন সভা করতে সারোয়ার সাহেবদের বাড়িতে গেছি। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। খেলাধুলায় আমার ছিল প্রচুর আগ্রহ। এজন্য ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল একটু বেশি। আর সে কারণে অনেকে আমাকে খুব ভালো মেয়ে বলে মনে করতো না। অবশ্য তখন সমাজটা এরকমই ছিল।
’৬৯, ’৭০ চলে গেল উত্তাল গণ-আন্দোলনের স্রোতে। আইএ পাশ করলাম দ্বিতীয় বিভাগে। বাবা খুব অসন্তুষ্ট হলেন। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথী চিকিৎসক। কোনও মতে মধ্যবিত্তের সংসার চলছিল। বড় ভাই বিএ পাশ করে ঢাকেশ্বরী কটন মিলে একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ চাকুরি পেলো। পরিবার হাফ ছেড়ে বাচলো। তবুও আব্বা আম্মা ভেবেছিলেন আমি বিএটা ভালোভাবে পাশ করলে স্কুলে একটা চাকুরি পেলে হয়তো আমার বিয়ের জন্য তিনি সাহস করে এগুতে পারবেন। আমরা দু’ভাই, দু’বোন। ছোটভাই ম্যাট্রিক দেবে, বোন ক্লাস এইটে। মা সেলাই করে কিছু উপার্জন করতেন। মোটামুটিভাবে দারিদ্র ঠিক ছিল না। অবশ্য তাই বলে বিলাসী স্বচ্ছলতাও ছিল না। ধুমসে মিটিং মিছিল করে বেড়াচ্ছিলাম। শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন। একেবারে ছাড়া গরু হয়ে গেলাম। মাথায় যত দুষ্ট বুদ্ধি শত্রুপক্ষ অর্থাৎ মুসলিম লীগের লোকদের পেছনে লাগাবার ফন্দি ফিকির করা, এভাবেই হাল্কা উচ্ছ্বাস আর আনন্দে সময় কেটে যাচ্ছিলো। রাজনৈতিক পরিণামের গুরুত্বটা ঠিক অনুধাবন করতে পারি নি। নির্বাচনের পর নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলাম বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হবেন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, আমার যা হয় একটা গতি হয়ে যাবে। অন্তত হারুন ভাই এমএ পাশ করেছে ইকনমিকস এ ও একটা ভালোমত চাকুরি পেলে না হয় ওর গলাতেই ঝুলে পড়বো! এমনই একটা মোটামুটি হিসাব করে রেখেছিলাম।
কিন্তু ভেবেছিলাম কি, আর হলো কি? ঢাকার ২৫শে মার্চের জুলুম আর অত্যাচার থেকে নারায়ণগঞ্জ দূরে রইলো না। এখানেও অত্যাচার প্রচণ্ড আঘাত করলো। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই পালালো, আমরাও বাড়ি ছেড়ে গ্রামে গেলাম। কিন্তু মাসখানেক পরে বুঝলাম যে আগুন থেকে উত্তপ্ত কড়াইয়ে পড়েছি। এখানে মিলিটারি নেই, কিন্তু তাদের দেশীয় দোসররা সব রকম অপকর্মই করে চললো। বাড়িঘর জমি-জমা দখল করবার জন্য মিথ্যা নালিশ জানিয়ে থানা থেকে পুলিশ এনে পুরুদের ধরে নিলো, মেয়েদের প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করলো এবং সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখ বেঁধে নিয়ে দিয়ে এলো সামরিক ঘাঁটিতে। এভাবে এই ময়নাও একদিন জালে ধরা পড়লো। বড় ভাই ও ছোট ভাই দু’জনেই পালিয়েছে। সম্ভবত ভারতেই চলে গেছে। বাবাকে থানায় নিয়ে খুব মার ধর করলো। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম আমি ও মা। বাবাকে ছেড়ে দিলো, জামিন রাখলো আমাকে। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের দরজায় যখন আমি উৎসর্গীত হলাম তখন আর অনাঘ্রাতা পুষ্প নই। রাজাকারের উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছি। আমাকে গ্রামে রাখলো না, নিয়ে এলো নারায়ণগঞ্জে। খুব আশা ছিল নারায়ণগঞ্জ গেলে পালাতে পারবো। ওখানকার ফাঁক ফোকরও আমার চেনা। কিন্তু না, যে নারয়ণগঞ্জে আমি এলাম তা প্রায় জনমানব শূন্য বিরাণ পুরী। মিলিটারী জিপ ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির আওয়াজ নেই। কদাচিৎ রিকশার টুং টাং শোনা যায়। আসলে যে জায়গাটায় আমাকে নিয়ে এলো আমি সাতদিন চেষ্টা করেও এলাকাটা চিনতে পারলাম না। তারপর একদিন সন্ধ্যায় আমাদের জিপে তুললো। এই প্রথম বার আমরা দু’জন ছিলাম ওখানে। আমাদের চোখ বেঁধে দিলো। বুঝলাম না কোন পথে চলেছি। তবে রাস্তার অবস্থায় মনে হলো ঢাকামুখী যাচ্ছি না, চলেছি অন্যত্র। ভোররাতে এক জায়গায় থামলাম। আমাদের নামিয়ে নেওয়া হলো। চোখের বাধন খুলে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। চোখ রগড়ে দেখলাম ঘরটা বেশ বড়। আকারে লম্বা। মনে হলো কোনও স্কুল। লাইন করে বেঞ্চ সাজিয়ে কম্বল পেতে বিছানায় শুয়ে আছে আরও কিছু মেয়ে, যারা আগেই এসে সিংহাসন দখল করেছে। একজনের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে জানতে চাইলাম ওটা কোন জায়গা? মেয়েটি খেঁকিয়ে উঠে বললো, চুপ থাক, গলার আওয়াজ শুনলে মেরে ফেলবে। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। মনে হলো ভোর হয়ে আসছে। ঘরের জানালা সব পেরেক ঠুকে কাঠ লাগিয়ে বন্ধ করা, তাই আলো অন্ধকার ঠিক বুঝতে পারলাম না। দরজাটা খোলা ছিল, এতোক্ষণে আলো ঢুকলো, জানালার ফাঁক ফোকর দিয়েও আলো দেখা দিল। খুব গরম লাগছিল। এর ভেতর মেয়েগুলো কেমন করে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল তাই ভাবছিলাম। পরে নিজেও অমন থেকেছি। মার খাওয়া কুকুর যেমন ঘরের দরজায় মরার মতো পড়ে থাকে আবার মার খাবার জন্য, এরাও তাই।
সারারাত ওদের দেহ-মনের ওপর যে অত্যাচার চলেছে তাতে সোজা হয়ে বসবার ক্ষমতা আর থাকে না। সবগুলোরই প্রায় গায়ে জ্বর তাই কম্বল অত্যাবশ্যকীয়। আমার পরের অভিজ্ঞতা আমাকে এসব ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর তাগড়া রাক্ষুসীর মতো একটা মেয়েলোক ঘরে ঢুকলো। সামনে কুচি দিয়ে শাড়ি পরা এবং সহজেই অনুমেয় জমাদারণী। দুদিকে দু’টো গোসলখানা দেখিয়ে দিয়ে বললো, যাও, মুখ হাত ধুয়ে আর সব কাজ সেরে এসো। নাশতা লাগাবে বাবুর্চি। সারারাতের ক্লান্তি। বাথরুমে ঢুকে একটাই শান্তি পেলাম যে বাথরুমটা পরিষ্কার। পরে হাসি পেলো, দেহটাই যার নরককুণ্ড তার আবার পরিষ্কার বাথরুম! স্নান করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু শাড়ি ভেজালে পরবো কি? সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। জমাদারণী এসে শাড়িটা নিয়ে গেল এবং ছোটোখাটো একটা লুঙ্গী আমাকে পরতে দিলো। চোখ গরম করে বললো, শব্দ করবি না, সেপাই ডাকবো। গোসলখানার দরজা বন্ধ করা নিষেধ। লজ্জা বিসর্জন দিয়ে গোসল করে লুঙ্গী গেঞ্জি (সেটাও এদের দান) পরে নতুন ময়না বেরিয়ে এলাম। এবার তাকিয়ে দেখলাম কাল আমরা যে ছ’জন এসেছি তাদের বাকি চারজন শাড়ি পরে বসে আছে, একজন গোসলখানায় আর বাকি দু’জন, হ্যাঁ, ছু’জন যারা তখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল তাদের সব লুঙ্গী আর গেঞ্জি পরা। লুঙ্গীর ভেতর রক্ত ময়লা সব জমে আছে। কারণ ওগুলো কেউ ধুয়ে দেয় না। নিজেরা ধুয়ে ভিজেটাই গায়ে শুকাতে হয়।
নাশতা নিয়ে এলো একজন ছোকরা, ওরা বললো, কুক। দু’পিস করে পাউরুটি আর আধা মগ চা নামের একটা পদার্থ। তাই সবাই কি আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। সত্যি ক্ষিধেই তো সবচেয়ে বড় স্বাদ। দুপুরের রুটি আর ডাল এল। সন্ধ্যা হতেই ঘ্যাট আর একটা রুটি দিয়ে গেল এবং এবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন দরজাটা খোলা ছিল, গেটে দু’পাশে দুজন সেন্ট্রি। রাতে ঘরের বাতি জ্বলছে কিন্তু কারও মুখ দেখা যায় না। কারণ বুঝতে পারলো ময়না দু’এক দিনের ভেতরই। আপা, আপনারা ঢাকার পথে গণহত্যা দেখেছেন, জগন্নাথ হলে গণকবর দেখেছেন, কিন্তু আমার মতো হতভাগিনীরা দেখেছে গণধর্ষণ, প্রতি রাতে তিনজন চারজন করে একেক জন মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। একজনের অপকীর্তি অন্যেরা উপভোগ করেছে। কুৎসিত অশ্লীল আলাপ করেছে। আমরা ভয়-শঙ্কা অনুভুতি শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকেছি। শুধু নিজেদের হৃদয়ের স্পন্দন শুনেছি। টিপ টিপ শব্দ কানেও মনে হয় শুনেছি। কিন্তু আমি মরেও কেন মরছি না। সমস্ত পৃথিবীর ভালো মন্দ কোনও চিন্তাই আমার মাথায় নেই, শুধু এখান থেকে পালাবো কি করে! দিন পনেরো পর আমার মনে হলো আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। রাতে স্বপ্ন দেখলাম বঙ্গবন্ধু ফাঁসির দড়িতে ঝুলছেন। নিজের গলায় হাত দিয়ে দেখলাম গলা অসম্ভব ব্যথা। বুঝতে পারছি না আমি কি সম্বিত হারাচ্ছি। বাবা-মাকে মনে করতে চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। একদিন সকালে আমি বসে আছি। দরজার কাছে দিয়ে একটা লোক যাচ্ছে। তার কাঁধে একটা লাল গামছা অথবা ভোয়ালে আর মাথায় একটা সবুজ টুপি। হঠাৎ জ্ঞান হারা হয়ে জয় বাংলা’ চিৎকার করে ঘর থেকে ছুটে বেরুলাম। দু’চারটে গুলির শব্দও কানে শুনেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো পায়ে লাঠির বাড়ি পড়লো, এর পরে মাথায় প্রচণ্ড আঘাতে আমি পড়ে গেলাম। আসলে আপা আমিতো মরতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে কোনও একটা অপরাধে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে, এ যন্ত্রণার দায় থেকে মুক্তি পাবো।
চোখ খুলে দেখলাম আমি একটা ছোট ঘরে খাটে শুয়ে আছি। পাশে আরেকটা খাট একটু দূরে শাদা কাপড় পরা সম্ভবত পুরুষ নার্স, যাকে আমরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বলতাম ব্রাদার, খুব নিবিষ্ট মনে কি যেন পড়ছে। মাথা কাত করতে গেলাম পারলাম না। অসহ্য যন্ত্রণা। অস্ফুট শব্দ শুনে লোকটি দৌড়ে আমার কাছে এলো, বললো, যাক আপনার জ্ঞান ফিরে এসেছে। অতি কষ্টে বললাম, আপনি বাঙালি, এখানে কেন? আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, চুপ বাইরে সেন্ট্রি, দেওয়ালেরও কান আছে। আপনার বাঁ পায়ের দুটো হাড় ভেঙে গেছে, প্লাস্টার করা হয়েছে। তিন সপ্তাহ পর খোলা হবে। আস্তে করে বললাম, তাহলে আরও তিন সপ্তাহ আমাকে ওরা বাঁচিয়ে রাখবে। আমার মুখে হাত চেপে দিয়ে উনি দ্রুত গিয়ে নিজের জায়গায় বসলেন। আমি চোখ বুজলাম। কে যেন ঘরে ঢুকলো। জিজ্ঞেস করলো আমার জ্ঞান ফিরেছে কিনা। আশ্চর্য লোকটি কি মিথ্যা কথা বললো না। বললো, একটু আগে তাকিয়ে ছিল। হয়তো বা জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু আমি ওকে ডিসটার্ব করি নি। ভালো করেছে। ঠিক মতো অবজার্ভ করো। হেড ইনজুরি তো যে কোনও সময় খারাপ দিকে টার্ন নিতে পারে। চোখ বুজে ওদের সব কথা শুনছিলাম। আশ্চর্য হলাম ওরাই কি রাতে আমাদের ওই ঘরে যায়? মানুষ কি এক সঙ্গে দেবতা আর দানব হতে পারে। হয়তো পারে, জীবনে অনেক কিছুই তো জানতাম না। কিন্তু এখন জেনে লাভ! এ অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে আমি যাবো কোথায়?
পরদিন সকালে রোদে ঘর ভরে গেল। একজন মহিলা নার্স এলেন। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশি হলেন। ইনি অবশ্য অবাঙালি, উর্দু শুনে মনে হলো বিহারী। আমার মুখ পরিষ্কার করে আমাকে দুধে রুটি ভিজিয়ে খাওয়ালেন এবং পরে ওষুধ খাওয়ালেন। আমি উর্দু বলতে পারি না, তাই আমার ইংরেজির বিদ্যা দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম আমার কি হয়েছে? আমার মুখে ইংরেজি শুনে নার্স তো গদগদ। বললো, বহিন, বেশি কথা বলো না। তোমার একটা পা ভেঙেছে। ওটা ঠিক হয়ে গেলেই তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। অথবা নর্মাল লাইফ পাবে। হায়রে নর্মাল লাইফ! ডাক্তার একজন হলো কর্ণেল। খুবই ভদ্র এবং মৃদুভাষী। আমার সঙ্গে ইংরেজিতেই আলাপ করতেন। অসুখের বাইরে আর কোনও অতিরিক্ত কথা তিনি বলতেন না। একদিন ফাঁক পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুমি সেদিন অমন আচরণ করেছিলে কেন? আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম, ডাক্তার আমি মরতে চেয়েছিলাম। মুক্তি চেয়েছিলাম। ডাক্তার আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি ভয় পেয়ো না। তোমরা মুক্তি পাবে। তোমরা শব্দটির উপর অতিরিক্ত জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন। ভয় হলো সম্ভবত আমার মুখ থেকে কিছু কথা বের করতে চান। কে জানে, ময়না এখন কাউকে বিশ্বাস করে না তবে একথা ঠিক একটা শয়তানের সঙ্গে এক একটা ভালো মানুষ সে দেখেছে। তবে ওদের বেশির ভাগই পাঠান অথবা সিন্ধি। পাঞ্জাবী ভদ্রলোক ওর চোখে পড়ে নি। অবশ্য অতো সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করবার মন মানসিকতা, পরিবেশ কি তার ছিল? হাসপাতালে থাকতে তার দরজা জানালা খোলা থাকতো। জানালার কাছেই একটা পেয়ারা গাছ ছিল, তার পাশেই নিমগাছ। নিমের পাতায় দোলা খেয়ে ঝিরঝিরে হাওয়া আসতো তার ঘরে। পাতার রঙ দেখে মনে হতো আগস্ট সেপ্টেম্বর মাস। লালচে হলুদ রঙ ধরেছে পাতাগুলোয়। পেয়ারা গাছে কাক শালিক অনেক পাখি বসতো। সারাদিন খুঁটে খুঁটে খেতো।
হঠাৎ করে পাশের বেডে একজন রোগী এলো। সে হেঁটে বেড়াতে পারে কিন্তু তাকে বিছানা থেকে নামতে দেওয়া হয় না। মেয়েটি আমার চেয়েও বয়সে ছোট। খুব বেশি হলে বছর ষোলো হবে। মুখখানা কনো ম্লান। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো কিন্তু নার্সদের ভয়ে দুজনই কাঠ হয়ে থাকতাম। একদিন মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ডাক্তার আমাকে বললো ভালো চিকিৎসার জন্য ওকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। ভাবি ওর কতো সৌভাগ্য। তিনদিন এখানে থেকেই ঢাকা যেতে পারলো আর আমি তো প্রায় দু’মাস এখানে পড়ে আছি। সকাল বিকাল সিস্টারের হাত ধরে ধরে হাঁটি ওরা অবশ্য আশা করেন মাসখানেকের ভেতর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হবো পায়ের দিক দিয়ে। তারপর আমাকে ঢাকায় নেবে। সত্যি নিয়েও এলো। কিন্তু আসবার আগেই ওই ব্রাদারের কাছে শুনলাম ওই মেয়েটির টিবি হয়েছিল। তাই ওকে দূরে বিরান জায়গায় নিয়ে গুলী করে মেরে ফেলেছে। বললাম, তাহলে আমাকে মারছে না কেন? তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে তোমাকে ওরা অন্যভাবে ব্যবহার করবে বলে তোমাকে বাঁচাচ্ছে। আমার মুখ দিয়ে শুধু আল্লাহ’ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। বললাম, আপনি পালান না কেন? সে চেষ্টা করলে পেছন থেকে গুলি করবে। ওদের প্রয়োজন শেষ হলেই মেরে রেখে যাবে, আর তা না হলে মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ যাবে। বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে ব্রাদার দরজাতেই থেমে দাঁড়ালো। এর দিন পনেরো পর আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলো চিকিৎসার জন্য। পা ভালো হয়ে গেছে। আমাকে নার্সদের কোয়ার্টারে রেখেছে। এতোদিনে আমার ডাক এলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
সকাল সাড়ে আটটা। এখানে এসেই শাড়ি ব্লাউজ পেয়েছি। নতুন পুরোনো জানি না তবে লজ্জা ডেকেছে। ডাক পড়লো। বিশাল বপু এক ভদ্রলোক কাঁধে বুকে সব নানা কিসিমের ক্লিপ আটকানো। মালায়কুম স্যার। মনে হলো নিজের গলার স্বর নিজেই শুনতে পেলাম না। তিনি মাথা নেড়ে আমাকে বসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন ইংরেজি জানি কিনা। হঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তারপর বললেন তোমাকে একটা খুব গোপনীয় কাজের দায়িত্ব দেবো। আমার এখানে কয়েকজন অফিসার আছে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে তুমি আমাকে রিপোর্ট দেবে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন কেন? আমি তোমার সম্পর্কে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। সাহস করে বললাম, তাদের সম্পর্কে কি ধরনের অভিযোগ আনা যাবে? ও ভালো কথা মুখ্যত তারা স্থানীয় বেঈমানের সঙ্গে যোগাযোগ বা ওঠা বসা করে কিনা। করলে তাদের উদ্দেশ্য কি, আশা করি আমার কথাগুলো বুঝেছো। ঘাড় নেড়ে বললাম, ওই সব অফিসারদের লিস্ট আমাকে দিন। এবার চোখ ছোট করে বললেন, পরে দেওয়া হবে। তাহলে কাজও তো আমি তখন থেকেই আরম্ভ করবো। না কাজ আজ থেকেই শুরু করবে। তোমাকে বিস্তারিত জানানো হবে। এসো, আবার দেখা হবে। মনে হলো ঘর থেকে আমি হেঁটে এগুতে পারছি না। আমার সমস্ত শরীর যেন থর থর করে কাঁপছে। আমি বুঝলাম এ সব অর্থহীন কথা, আমার আরও কোনো বড় সর্বনাশ অপেক্ষা করে আছে। সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দিলো। ঘরে ঢুকে মনে হলো আমার মাথা ব্যথা করছে জ্বর আসছে একজন সিস্টারকে বলতে সে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হ্যাঁ আমার জ্বর এসেছে, ডাক্তার মাথায় এক্সরে করতে বললেন। কিন্তু সব কিছু করে আমাকে আমার জায়গায় ফেরত দিয়ে গেল। সারাদিন শুধু ছটফট করলাম। রাত দশটায় আমার ডাক এলো। ওই বিশাল বপু হাসি মুখে আমাকে অভ্যর্থনা করলো। আমাকে ওর ভালো লেগেছে। সকালে যেসব আলাপ করেছে তা ভুলে যেতে হুকুম করলেন। তারপর দীর্ঘদিন পর আমি আবার পশুর ভোগে লাগলাম। কিন্তু লোকটাকে খুব স্বাভাবিক মনে হলো না। কেমন যেন বিব্রত, অন্যমনস্ক। হঠাৎ আমাকে একটা ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলো। ফিরবার সময় লক্ষ্য করলাম সবাই খুব সন্ত্রস্ত্র। কোথা থেকে যেন যন্ত্রণা সূচক চিৎকার আসছে। মনে হয় কাউকে মারধর করা হচ্ছে। পরে দেখেছি এসব টর্চার চেম্বার! কি বীভৎস আমারও তো ওখানে শেষ হবার কথা ছিল। চারিদিকে তখন কেমন যেন ফিস ফিস আর ব্যস্ততা।
শারীরিক যন্ত্রণা, ক্লান্তি ও মনোকষ্টে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সাইরেন বেজে উঠলো। চেঁচামেচিতে আর সিস্টারদের কথায় বুঝলাম ইন্ডিয়ানরা বোমা ফেলছে আর নিচের থেকে অ্যান্ট্রি এয়ারক্রাফট ছোঁড়া হচ্ছে। আমার ম্যালেরিয়ার কাপুনি উঠে গেল। দুদাঁতের পার্টিতে যেন করতাল বাজছে। সিস্টাররা নেই সব শেল্টারে গেছে। বোকার মতো আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি মরলেই-বা কি আর বাঁচলেই-বা কি? আবার সাইরেন বাজলো, একে একে সব জায়গায় ফিরে এলো। পরদিন আরও ব্যস্ততা। শুধু ট্রাক আর জিপের আওয়াজ। আমি ঘরেই বন্ধ তবে কেউ কিছু আর বলে না। কোনো কর্মের নির্দেশও এলো না। এতোক্ষণে বুঝলাম কর্মকর্তা সে দিন আমাকে ডেকে কেন পছন্দ করলেন। তারপর তিন-চার দিন এরকম হলো। নির্যাতনের চিৎকারও আসে না। সিস্টাররা শুধু বলাবলি করছে মুক্তি বাহিনী ওদের মেরে ফেলবে। একজন আমার দু’হাত ধরে বললো বহিন, আমরা তো সাধ্যমত তোমার খেদমত করেছি, তুমি আমাদের বাঁচাও। হেসে বললাম, আমিও তো এখন তোমাদের একজন, আমাকে বাঁচাবে কে? আমাকে পেলেও ওরা ভোমাদের যা করবে আমার তাই-ই করবে। যে সেন্ট্রি সব সময় রক্তচক্ষু করে তাকাতো, তুই তোকারি ছাড়া কথা বলতে না আজ সকালে দেখি এক সিস্টারের হাত ধরে বলছে ওর দেশে জরু আছে বাল বাচ্চা আছে, ও মরে গেলে তাদের কি হবে। ইচ্ছে হচ্ছিল জোরে হেসে উঠি। ওয়োরের বাচ্চা আমার আব্বা আম্মার কি হয়েছে, কি করেছিস তোরা জানিস না? আমাদের যা করেছিস তোদের শাস্তি হবে তার চেয়েও হাজার গুণ, কুত্তার বাচ্চারা। আজ সবার কথা মনে পড়লো। হয়ত বা বেঁচে যেতে পারি। আবার সবার সঙ্গে দেখা হবে-কি সব ভাবছি আমি, তারাই কি আর বেঁচে আছে। কেউ কোনও কাজ যেন করে না, নিয়ম রক্ষা করে চলেছে। ডাল চাপাতিও পড়ে থাকে। দু’চার জন বাঙালি যারা আছে তাদের মুখ শুকিয়েছে এদের চেয়েও বেশি। এতোদিন দেখলে নাক সিটকাতে। এখন বলে, আপা ভালো আছেন তো? এই তো ছাড়া পেয়ে যাবেন। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল বলে। আপনি রেডিও শুনতে পান না। আজ কালের মধ্যেই এরা আত্মসমর্পণ করবে। বন্দি শিবিরে বসে শুনলাম বাইরের আওয়াজ ‘জয় বাংলা’। এরা কারা? কারা এ স্লোগান দিচ্ছে? কিন্তু এদের সবার হাতে তো অস্ত্র, এরা কেন ওদের গুলি করে মেরে ফেলছে না। ময়না কিছু বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত শুনতে পেলো আজ বিকেল ৪টায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে। তারপর ও মুক্ত। মুক্ত? কিন্তু কিসের থেকে মুক্তি, যে পাশবিক পরিস্থিতির পথ বেয়ে সে এখানে এসে পৌঁছেছে সে জীবন থেকে তাকে মুক্তি দেবে কে? সে যাবেই বা কোথায়? সত্যিই সন্ধ্যায় বাংলা ও হিন্দীতে জানানো হলো বাঙালি যারা আটক আছেন তারা নিজের নিজের বাড়িতে চলে যেতে পারেন। কেউ বাধা দেবে না। দৌড়ে বেরুলাম। পথ-ঘাট কিছু চিনি না বড় রাস্তা ধরে দৌড়োচ্ছি। আমার মতো আরো লোক দেখলাম। একজনকে বললাম ভাই শহরে যাবার পথ কোন দিকে। দেখিয়ে দিলো, সেও পালাচ্ছে। রাজাকার ছিল, এখন সবার সঙ্গে না মিশে গেলে মুক্তিবাহিনীরা গুলি করে মারবে।
এক সময় বুঝলাম আর্মি সেনানিবাসের বাইরে এসে গেছি, আর দৌড়োবার দরকার নেই। কিন্তু আমি তো যাবো চাষাড়া, কোন পথে বাস যায়। কতো বাসে করে ঢাকায় এসেছি মিটিং মিছিল করতে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তৃতা। ময়নার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। হঠাৎ থেমে গেল ময়না, সেতো মুক্তি পেয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি? রাস্তায় একজনকে জিজ্ঞেস করলো বঙ্গবন্ধু কোথায়? লোকটা ওর দিকে এমন করে তাকালে মনে হলো সে পাগল। বুঝলো এভাবে যাকে তাকে সব কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না। দেশতো বদলে গেছে, মানুষের আচার আচরণ তো বদলেছেই। শরীর ক্লান্ত, উত্তেজনায় হেঁটে চলেছে। কিছু দূরে গিয়ে সে চেনা পথ পেলো। কোনও রকমে নারায়ণগঞ্জের বাসে সে চড়ে বসলো। সত্যিই সে চাষাড়া যাচ্ছে? বাস ছেড়ে দিলো। হঠাৎ মনে হলো তার কাছে তো একটা পয়সাও নেই। যদি অপমান করে নামিয়ে দেয়। আব্বার নাম বলবে। হাতে পায়ে ধরবে। তবে সত্যি কথা বলা যাবে না। সিস্টারদের কথা মনে পড়লো, মুক্তিবাহিনী যদি মেরে ফেলে। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। স্টেনগান থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মুক্তিবাহিনীরা চলেছে, সঙ্গে দু’চারজন হ্যাঁ ভারতীয় সৈন্য ওদের গলায় ফুলের মালা। এরা চিৎকার করেছে ‘জয় বাংলা’, ময়নাও বাসের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলো জয় বাংলা। বাসের সব মানুষ ওর দেখা দেখি চেঁচিয়ে উঠলো ‘জয় বাংলা’। ও কনডাক্টরকে ডেকে বললো ওর পয়সা নেই। কনডাক্টর হেসে বললো, ঠিক আছে আপা, দ্যাশ স্বাধীন অইছে। হগগল কিছুই স্বাধীন। আমারে আরেক দিন দিয়া দিয়েন।
বাড়ির কাছে নেমে দৌড়ে গলিতে ঢুকে দেখলো দরজায় তালা। কিন্তু ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে ঘন অন্ধকার, চারদিকে সব ছড়ানো ছিটানো। তবে কি ওরা আব্বা আম্মাকে মেরে ফেলেছে। এখন তো রাত। এতোক্ষণে মনে হলো ওর পরনে লুঙ্গী। দরজা বন্ধ করে আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে সামনে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। সকালেই সে কাপড় বদলে সালাম চাচার দোকানে গেল। সালাম চাচা দোকান খুলেছে। তবে জিনিসপত্র নেই। ময়নাকে দেখে বললো, এসে গেছিস তোরা? কি চেহারা হয়েছে তোর। ময়না বললো, চাচা, আমাকে পাঁচটা টাকা দেবেন। আঝা এলে দিয়ে যাবো। নিয়ে যা, বাবা এলেই দেখা করতে বলিস। মাথা নেড়ে ময়না আরেকটু এগিয়ে গেল। ডালপুরীর দোকানও খুলেছে। চারটে ডালপুরী এনে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। পানির একটা জগ আর গ্লাস ভালো করে ধুয়ে পেট ভরে পুরী চারটে খেয়ে প্রাণভরে পানি খেলো। বাবা-মার শোবার ঘরটা ঝেড়ে ঝুড়ে আলমারি খুলে পুরোনো ফেলে যাওয়া চাদর বের করে বিছানা করে ময়না ঘুমিয়ে পড়লো। দরজায় ধাক্কা ধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে? আরে আমি দরজা খোল। আব্বা দাঁড়িয়ে। ময়নাকে দেখে প্রথম দু’পা পিছিয়ে গেলেন তারপর ময়না বলে চিৎকার দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। আব্বাকে ভেতরে টেনে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো ময়না। ঘর দোরের অবস্থা দেখে চোখ মুছে বললেন, কোনো ভয় নেই, তুই ফিরে এসেছিস, খোকা খবর পাঠিয়েছে আবার সব হবে। তোর মুখ শুকনো কিছুই তো জানি না। ময়না সালাম চাচার কাছ থেকে যে টাকা এনেছে তা আব্বার হাতে দিয়ে সব ঘটনা বললো। মাথা নিচু করে বললো আমি যে এখানে একা এসেছি এ কথা তুমি বাড়িতে বলো না। বোলো আমি আগে তোমার সঙ্গে এসেছি, আম্মারা পরে আসবে। আব্বা বললো, তুই দরজা বন্ধ করে থাক। আমি দুটো লোক ডেকে আনি বাড়িঘর পরিষ্কার করার জন্য, আর আমাদের দু’জনের জন্য খাবারও নিয়ে আসি। বাবা বাও কিনে আনলেন। সন্ধ্যা নাগাদ সবকিছু এক রকম গোছানো হলো। আব্বা বললেন, তোর আম্মা আমার জন্য খুব চিন্তা করবেন। কারণ কথা ছিল বিকেলে ফিরে ওদের নিয়ে আসবো। কিন্তু তোকে একা রেখে যাবো না। কাল সকালে নাশতা খেয়ে চলে যাবো। দু’টা নাগাদ ফিরে আসবো! সকালটুকু একা থাকতে পারবি না মা? বাবার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো ময়না। আব্বা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তার সবটুকু কষ্টই যেন নিজের বুকে টেনে নিলেন। রাতে ডালভাত আর আলুসেদ্ধ দিয়ে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেলো দু’জনে। তারপর মায়ের আর তার ছোট বোন চায়নার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে যখন জেগেছে সারাবাড়ি তখন রোদে ভরে গেছে। আব্বা শোবার ঘরে নেই। গোসলখানা থেকে পানির শব্দ আসছে। সম্ভবত গোসল করছেন। ওহো আব্বা তো সকালেই আম্মাকে আনতে যাবেন। মুখ হাত ধুয়ে নিলো ময়না। আব্বা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাশতা আনতে গেলেন। আজ সালামের দোকানের পুরী আর ভাজি। ময়নার পেটে যেন রাক্ষস ঢুকেছে। খেয়েই চলছে। আঃ আর কোনও দিন নিজেদের ঘরে বসে খাবে এ কথা তো সে কল্পনাও করে নি। ভাবতে গেলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আব্বা ওকে যে কেউ এলে দরজা না খুলতে বলে সতর্ক করে দিয়ে দুটোর ভেতরেই ফিরে আসবেন বলে গেলেন। ময়না ঘুরে ঘুরে ঘরের টুকি টাকি জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো। ওর বেশ কিছু পুরোনো সালোয়ার কামিজ পেলো। এগুলো আর কষ্ট করে লুট করে নি। ভাগ্যিস আব্বার ডিসপেনসারী ঘরটায় হাত দেয় নি। ওষুধের বাক্সগুলো ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে রাখলো ময়না। কাল থেকেই আব্বা চেম্বার খুলতে পারবেন। এবার ওর বিএ পরীক্ষাটা দিতে হবে এবং একটা চাকুরিও যোগাড় করতে হবে। কারণ এ ধাক্কার পর আব্বার নতুন করে জীবন শুরু করতে বেশ কষ্ট হবে। তারপর ভাইয়া এলে আস্তে আস্তে তার ঘটনাটা লোক জানাজানি হবে। তখন আব্বাকে কি সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হবে তা ময়না ভাবতেও চায় না। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলো ময়না। এতো ঘুম কোত্থেকে আসছে সে ভেবে পায় না। উঃ না সে আর ভবিষ্যতের কথা ভাববে না। যে কটা দিন থাকবে বাবা-মায়ের বুকে থেকে একটু শান্তি পেয়ে যাক। সে বাইরে বেরুবে না। কারও সামনে যাবে না। কারণ এ ছোট জায়গায় কি সেই ঘৃণিত সংবাদ এসে পৌঁছোয় নি? যারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেইদিন থানায় যারা তাকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরে এসেছিল তারা কি এ বিজয় গৌরবের কথা এখানকার লোকজনকে বলেনি? তবে সালাম চাচা কিছু জানে না মনে হলো। ডালপুরী ওয়ালাও তো স্বাভাবিক ব্যবহার করলো। তাহলে ওই শয়তানদের কি মুক্তিবাহিনী মেরে ফেলেছে। হতেও তো পারে। আব্বা ডিম এনে রেখে গেছেন। হাতড়ে হাতড়ে সামান্য মসলা পাওয়া গেল। ও ভাত-ডাল আর ডিমের তরকারি রান্না করে রাখলো। এতো বেলায় সবাই কি প্রচণ্ড খিদে নিয়েই না আসবে।
দরজায় কড়া নড়লো, চায়নার গলা পেলো ময়না। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। চায়না চিৎকার করে ময়নাকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো ময়না। মা কঙ্কালসার হয়ে গেছে, মুখের ওপর যেন কেউ কালি লেপে দিয়েছে। মা চিৎকার করে উঠলো ‘ময়না’। মা তার হাতের ওপর ঢলে পড়লেন। মুখে চোখে পানি দিয়ে মাকে সুস্থ করা হলো। অনেকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে ময়নার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। যেন চিনতে পারছেন না, অস্ফুটে বললো, ময়না, আমার ময়না। ময়না ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ধীরে সুস্থে সবাই স্বাভাবিক হয়ে এলো। পাঁচদিন পর বড় ভাইয়া ফিরে এলো কিন্তু একা, মন্টু আসে নি। ও অসুস্থ, হাসপাতালে আছে। ওর একটা হাতে স্প্রিন্টার লেগেছিল, ওটা অপারেশন হয়েছে। ওকে আরও দু’সপ্তাহ কোলকাতায় থাকতে হবে। সব খবর শোনা হলো। মন্টুটা থাকলে কতো আনন্দ হতো। ওর বাঁ হাতটায় কিছুটা খুঁত হয়ে গেছে। অবশ্য ওর কাজ কর্মে কোনও অসুবিধা হবে না। ভালো হাসপাতালে আছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই চলে আসবে। মাঝে একবার বড় ভাই যাবে। কিন্তু তার আগে চাকুরিতে জয়েন করতে হবে। টাকা পয়সা দরকার। আব্বার অবস্থা তো বুঝতেই পারছো। তাছাড়া ময়নার ব্যাপারটা এতো সহজে নিষ্পত্তি হবে না। লোকজন সবে আসতে শুরু করেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল থানায়। সুতরাং সেখানে তামাসা দেখবার লোকেরও অভাব হয় নি। ঠিক আছে এখন তো আর পেছন পেছন পাক আর্মি তাড়া করছে না। ধীরে সুস্থে ভেবে-চিন্তে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তার আগে ওর বিএ পরীক্ষাটা দেবার ব্যবস্থা করা দরকার। ঘরের জিনিসপত্র সব লুট হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সেগুলোও কিনতে হবে। একা তো, সব দায় দায়িতুই তার। চায়নাকে স্কুলে পাঠাতে হবে। মন্টু এলে আবার কলেজে যাবে। মা তো শুধু বলে, খাই না খাই কি আসে যায়, আল্লাহ তো আমাদের জানগুলো রেখেছেন। ময়নাও তাই ভাবে বেঁচে আছি বলে নানা সুবিধা অসুবিধার বায়নাক্কা। আর যদি এর ভেতরে একজন ফিরতে না পারতো? সত্যিই এর চেয়ে বড় সত্য হয় না। তাইতো আমাদের দেশে বলে, বসতে পারলে শুতে চায়।
এভাবে প্রায় এক মাস কেটে গেল। ছোটভাই মন্টু ফিরে এলো। বাঁ হাতের কব্জিটা নেই, ফেলে দিতে হয়েছে। আম্মার এক দফা কান্নাকাটি সুখের ও দুঃখের মিশ্র অনুভূতি। মন্টু প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে। নিঃসন্দেহে সুখের আর হাতখানা গেল সে দুঃখ তো কম না। সংসারে কিছু অনটন বোঝা যায়। কারণ আব্বার প্রাকটিস আগের মতো নেই। দশ মাসের অত্যাচারে আর অর্থাভাবে মানুষ মরলেও আর চিকিৎসা করাতে পারছে না। বড় ভাইয়ের মিলের অবস্থা ভালো না। ক্ষমতাসীনরা। বাড়ির আসবাবপত্র থেকে আরম্ভ করে মিলের যন্ত্রপাতি পর্যন্ত সরাতে শুরু করেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ নেতৃত্বের লোভে রাজনীতির নামে সেখানে হচ্ছে প্রচণ্ড দলাদলি আর যারা সুযোগ সন্ধানী পাকিস্তানি মনে প্রাণে) তারা ইন্ধন যোগাচ্ছেন তাতে। সুতরাং বড় ভাই চাকুরি খুঁজছে। অস্বস্তি লাগে ময়নার। সে তো যে কোনও একটা প্রাইমারি স্কুলেও তিন চারশ টাকা মাইনের একটা কাজ করতে পারে। আচ্ছা নার্সিং-এর ট্রেনিং-এ ঢুকলে কেমন হয়? কিন্তু সেখানেও তো সে এখনই নগদ টাকা আব্বাকে এনে দিতে পারবে না। এমন যখন পারিবারিক অবস্থা তখনই ঘটনাটা ঘটলো। নিরুপায় আব্বা হারুণের আব্বার কাছে গিয়েছিলেন। ময়না আর হারুনের সম্পর্কটা দু’পরিবারই বুঝতো। এর শেষ কোথায় তাও তারা স্থির করে রেখেছিলেন। সেই আশায় বুক বেঁধে ময়নার আব্বা গিয়েছিলেন হারুনের বাবার কাছে যদি এখন তারা বিয়েটা দিতেন। কার হারুন ঢাকায় একটা বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থায় ভালো চাকুরি পেয়েছে। হারুনের আব্বা ময়নার আব্বাকে যতোদূর পারা যায় কথা শুনিয়েই ক্ষান্ত হন নি, রীতিমতো অপমান করে চলে যেতে বলেছেন। আব্বা শিশুর মতো কাঁদছেন। ময়না কিছু বুঝবার বা জানবার আগেই আম্মা ছুটে এসে তার দু’গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। রাগে কথা বলতে পারছেন না, চিবিয়ে বললো, ফিরে এলি কেন? যে নরকে গিয়েছিলি সেখানেই থাকতে পারলি না? ওরা এতো লোক মেরেছে, তোকে চোখে দেখলো না? কোন সাহসে ওই পাপদেহ নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিস বল? বল? আব্বা দৌড়ে এসে আম্মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, এ তুমি কি করছো? জানো না কি দাম দিয়ে তোমরা আমাকে পেয়েছে? ধিক্কার আমাকে। ও মান দিয়ে আমাকে বাঁচালো আর আমি কিছু করতে পারলাম না ওর জন্যে। তুমি, তুমি কেমন করে ওর গায়ে হাত দিলে ময়নার মা এবার আম্মা আমার ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন, ক্রমাগত চিৎকার করছেন মা, মাগো তোর এই হতভাগী মাকে ক্ষমা করে দে। আমি পাথর হয়ে গেছি। ছোটবেলা থেকে কতো দুষ্টুমি করেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত মনে পড়ে না আব্বা-আম্মা কেউ কখনো ভুলেও আমার গায়ে হাত দিয়েছেন। আমার সমস্ত দেহটা জ্বলে যাচ্ছে। আঘাতের দুঃখে নয়, অকারণ আপমানে। আমি তো আব্বার জন্যেই থানায় গিয়েছিলাম। আব্বা ছাড়া পেলেন আমি বন্দি হলাম। আর সে কারণে আম্মা আমাকে মরতে বলছেন। অথচ আমি ফিরে এলে ওরা যে খুশি হয়েছিলেন তাও তো মিথ্যে নয়। মায়ের হাত থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ততোক্ষণে বড়ভাই ফিরে এসেছে। সব কিছু শুনে বাবাকে অনুযোগ করলো, তুমি আমাকে বা ময়নাকে না জানিয়ে এ কাজ করতে গিয়েছিলে কেন? তোমার মনে হয় বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আমি সোজা গিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। না, আর না। এ বাড়ির অন্ন এবং আশ্রয় দুই-ই আমার উঠে গেছে। ভোরবেলা কেউ ওঠবার আগে ছোট একটা ব্যাগে সামান্য কিছু কাপড়-জামা, ছোট ব্রাশ, তোয়ালে নিয়ে ঘর ছাড়লাম। বড় ভাইকে একটা চিঠি লিখে এলাম। সম্মানজনক আশ্রয় পেলে ওদের জানাবো। আব্বা আম্মাকে সালাম জানিও। আমার খোঁজ করো না। এসে সোজা উঠলাম নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে, ধানমন্ডীতে। কিছুদিন ধরে কাগজে এ প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিচিতি বেরুচ্ছিল।
সাড়ে আটটা থেকে নটার ভেতর অফিসে পৌঁছোলাম। ওখানকার অফিসার সুন্দর মতো মধ্য বয়সী এক মহিলা। পরে নাম জেনেছি মোসফেকা মাহমুদ। তিনি সব শুনে বললেন-তোমার আব্বা-আম্মা আছেন তোমাকে আশ্রয় দিতে চান, তবুও কেন তুমি চলে আসতে চাও? আমি তাকে সব খুলে বলেছিলাম। ঠিক এ সময় আপা আপনি ওখানে ঢুকলেন। আমি থেমে গেলাম। মোসফেকা আপা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তাঁর সামনে বলতে পারো উনি আমাদের আপা। পরে আপা আপনার নামই শুধু জানলাম না। যখন আপনি, বাসন্তী আপা, জেরিনা আপা, নূরজাহান আপা আমাদের কাছে আসতেন, নিজেদের কথা বলার ছলে আমাদের কথা জেনে নিতেন। আমি আপাতত ওখানে আশ্রয় পেলাম। ওরাই খোঁজ করে চাকুরি দেবেন এবং তখন আমি হোস্টেলে চলে যাবো।
মাস খানেকের ভেতর আমি একটা সাহায্য সংস্থায় কাজ পেলাম। বলতে গেলে কনিষ্ট কেরানির পদ। কিন্তু আমার জন্য ওটা আশাতীত। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে বাবাকে দু’শ টাকা পাঠালাম। রশিদ এলে বুঝলাম বাবা টাকা পেয়েছেন। পরে একটা চিঠি দিয়ে সব জানালাম। আমি ভালো আছি, সুখে আছি, আবার পড়াশুনা শুরু করেছি ইত্যাদি। মনে হলো আব্বা বেঁচে গেছেন। খুব সুন্দর চিঠি লিখেছেন। বাড়ি যেতে বলেছেন ছুটিতে। এই হোস্টেলে থাকার সময় জেরিনা আপার কাছ থেকে যে স্নেহ আর উপদেশ পেয়েছি তা কখনও ভুলবো না আপা। ওঁর মৃত্যুর সময়। আমি দেশে ছিলাম না, তাই শেষ দেখাটুকু দেখতে পারি নি। উনি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে খুব মন খুলে আলাপ করতেন এবং বলা বাহুল্য অধিকাংশ আলোচনাই আমার সম্পর্কে।
আমার বিএ পরীক্ষার ফল বেরুলো। ভালো করলাম। চাকুরিতে উন্নতি হলো। একেবারে শক্ত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করলাম। হারুন নাকি প্রায়ই ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করে আমার ঠিকানা জানতে চায়। ওর বাবার ব্যবহারের জন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছেন ভাইয়ার কাছে। আমি গায়ে লাগাই নি। এখন আমার কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই অতএব ওকে একটু নাড়া দেওয়া যেতে পারে। গাইড দেখে ওর অফিসের ফোন নম্বর বের করলাম। হারুন-উর রশিদকে চাইতেই পেয়ে গেলাম। মনে হলো পদমর্যাদা আছে। হ্যালো বলতেই ও চমকে উঠলো। বললো, কে? কে বলছেন? গলা শক্ত করে বললাম, আমি। এক সময় কোনও কালে আপনি আমাকে চিনতেন। নরম গলায় বললো, ময়না, কোত্থেকে চলছে? নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব দিয়ে শনিবার আমার সঙ্গে হোস্টেলে দেখা করতে আসতে বললাম। ও ঠিক সময় মতো এলো। আমাদের উল্টো দিকেই একটা চাইনীজ বেঁস্তোরা ছিল ওখানে গিয়ে বসলাম কথা কারও শেষ হয় না। পর দিনের প্রোগ্রাম করে সেদিন দুজনেই চোখের জলে বিদায় নিলাম। এ কথা সত্যি আমি হারুনকে ভালোবাসতাম। প্রেম চেতনার প্রথম মুহূর্ত থেকে বধূবেশে ওর ঘরে যাবো-এ আমার স্বপ্ন ছিল না, ছিল বাস্তব সত্য। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, মনে হয়েছিল ওকে পাবার অধিকারও আমি হারিয়েছি কিন্তু ওর বাবার ব্যবহার আমাকে প্রতিহিংসার পথে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম আমার বাবার অপমানের প্রতিশোধ নেবো। হ্যাঁ আমি বীরাঙ্গনা, যুদ্ধ করে এসেছি। আমার শেষ জয় পরাজয় হারুন তোমার আব্বার সঙ্গে যুদ্ধের পরিণতি। পরদিন হারুন এলো সন্ধ্যায় ঠিক নির্ধারিত সময়ে বাইরে উদার আকাশ আর কেমন যেনো স্নেহ কোমল স্পর্শ বাতাস বইছে। ময়না বললো, চলো, আজ বাইরে কোথাও গিয়ে বসি। রেস্তোরাঁয় বসতে ভালো লাগছে না। হারুনের একটু অসুবিধা, সে নিজে অফিসের গাড়ি চালায় না। তাই ড্রাইভারের সামনে ময়নাকে নিয়ে যেখানে সেখানে বসতেও পারে না। তবুও বললো সংসদ ভবনের দিকে। গাড়ি রেখে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে লেকের পাড়ে বসলো। হঠাৎ ময়না হারুনকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, এই ঝালমুড়ি, খাবো। হারুন কৃত্রিম গাম্ভীর্য দেখিয়ে বললো, আমরা কি এখনও ছেলে মানুষ আছি নাকি যে মুড়ি খাবো? খেতে চাইলে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে হবে। লেকের হাওয়া এবং বস্তু ভক্ষন এক সঙ্গে চলবে না। এক সঙ্গেই চলবে, বলে ময়না ডাকলো মুড়িওয়ালাকে। হারুন মাথা ঘুরিয়ে দেখলো ড্রাইভার দেখছে কিনা। ও চিরকালই একটু শান্তি প্রিয় দুর্বল প্রকৃতির। সে মানুষ হিসেবে সত্যিই ভালো কিন্তু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার মতো ধৈর্য ও মনোবল তার কোনও দিনই ছিল না। তাই সাহস করে নিজে গিয়ে ময়নার সামনে সঁাঁড়াতে পারে নি। অথচ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ময়নার ভাইয়ের সঙ্গে অন্তত সপ্তাহে সে একদিন দেখা করেছে। তাই ওকে ময়নার ঠিকানা, ফোন নম্বর সব দিয়েছে। সে একান্তভাবেই চেয়েছে, হারুন ময়নার সঙ্গে দেখা করুক। অবশ্য ফলাফল সম্পর্কে সে খুব আশাবাদী নয়, এ কথা হারুনাকে জানিয়েছে। ময়নার জিদ তার জানা আছে তার ওপর আব্বার সেদিনের শিশুর মতো কান্না সেও তো ভুলতে পারে না।
তবুও সময়ে সব সয়ে যায়, মানুষ অনেক কিছুই ইচ্ছে করে হোক আর অনিচ্ছাতেই হোক ভুলে যায়, চেষ্টা করে ভুলে যেতে। এতে বোঝানো সত্ত্বেও সে পারে নি মুখ উঁচু করে ময়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে, ময়না আমি এসেছি। চলো তোমার আশ্রয় হোস্টেলে নয়, আমার ঘরে। কতোদিন ওর হোস্টেলের সামনে এসে গাড়ি থামিয়েছে। ভেতরে ঢুকেছে আর তখনই বেরিয়ে এসেছে। নিজের থেকেই যেন ড্রাইভারের কাছে কৈফিয়ৎ দিয়েছে, না সে হোস্টেলে নেই, বেরিয়ে গেছে। চতুর ড্রাইভার সবই জানে। চুপ করে থেকে সাহেবের মান রক্ষা করে। ময়না নিজের থেকে ফোন না করলে আজও সে দূরেই রয়ে যেতো। কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো ময়না, এই মুখে ক্লিপ আটকেছো? হেসে ওঠে হারুন। তোমার ধ্যান ভাঙাতে সাহস পাই নি। বাজে কথা, জানো আমি প্রাণভরে আকাশ দেখছিলাম। জানো দশটা মাস আমি একবিন্দু আকাশ দেখতে পাই নি। ভেবেছিলাম হয়ত লাশ হয়ে আকাশের নিচে মাটি দেবে আমাকে। কিন্তু আমি তো আর সেই নীল আকাশ, বিকেলের সিঁদুর মাখা আকাশে অথবা কালবৈশেখীর সেই কালি ঢালা আকাশে… ওর কথা শেষ করতে দেয় না হারুন চট করে পকেট থেকে টান দিয়ে একটা ডট পেন ওর সামনে দিয়ে বলে, কবিতা লিখে ফেলুন নাম থাকবে। ময়না চোখ গরম করে বলে, খালি দুষ্টুমি। তোমার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ নেই। বেশ তো আনন্দ না পেলে দুঃখ নিও না। আমাকে বয়স, উচ্চতা, মোটামুটি চেহারা বলে দাও আমি ধরে এনে দেবো যতো ইচ্ছে গল্প করে। ওর দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে ময়না বললো, সইতে পারবে? বুকে বালিশ দিয়ে বিছানায় উপুড় হবে নাতো? না বাবা উপুড় না হলেও শোবার ঘরেই থাকবো। ওটা কল্পনাতেও সইতে পারি না ময়না। তাইতো প্রতিটি মুহূর্ত আমি জ্বলেছি। আমি পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছি ময়না, তুমি বিশ্বাস করো। ওর কাছে আরও নিবিড় করে বসে ওর হাত দুটো ধরে বলে ময়না, তোমাকে আমি এক বর্ণও অবিশ্বাস করি না হারুন। তুমি তো আমার কথা ভাবতে পারছে। কখনো-বা আশা করেছে আমাদের দেখা হবে, আবার আমরা পুরোনো জীবনে ফিরে যাবো। কিন্তু আমি? আমি প্রথম দিন থেকেই মনের দরজায় কপাট লাগিয়ে দিয়েছিলাম। জানতাম আমি আর কখনও মুক্তি পাবো না। হঠাৎ একদিন আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে। আশ্চর্য জানো হারু, তোমার কথা, আব্বা, আম্মা, মন্টু, চায়না, ভাইয়া কারও কথাই আমার মনে হয় নি। মনে হয়েছে বন্দি বঙ্গবন্ধুর কথা, মনে হয়েছে আমাদের মিটিং-মিছিলের কথা তাও খুব বেশি নয়, জানো হারুন আমার মাথাটা কেমন যেনো শূন্য হয়ে গিয়েছিল। শুধু ভাবতাম আমি কখন মরবো, কেমন করে মরবো। তারপর একদিন…। ওর দিকে তাকিয়ে হারুন শক্ত হাতে ওর মুখ চেপে ধরলো, না, ময়না না, তোমার কষ্টের কথাগুলো আমাকে বলল না। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, চলো, বড্ড খিদে পেয়েছে। কিছু একটা খাবো, তারপর তোমাকে হোষ্টেলে ড্রপ করে চলে যাবো নারায়ণগঞ্জ। পৌঁছেতে পৌঁছেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। মা-ভাইবোন নারায়ণগঞ্জ? অবাক হয়ে ময়না উচ্চারণ করলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মা এ দু’দিনেই আমাকে সন্দেহ করেছেন। আমি তো দেরি করে কখনও বাড়ি ফিরি না। মীরপুর রোডে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে হাম বার্গার আর কেক নিলো। না, পুরো রাতের খাবার তারা খেতে চায় না। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য কথা বলা সামান্য স্পর্শ হাসি বিনিময় এর চেয়ে বেশি কিছু না। আর ময়নার তো ভয়ই যেতে চায় না। হারুন সব জানে তো? সব টুকুই কি ভাইয়া ওকে বলেছে? ভাইয়াও তো বিভীষিকার মুহূর্তগুলোর কথা জানে না। জানি না এই খেলার শেষ কোথায়। ময়না ঠিক করেছে হারুন যদি বিয়ের প্রস্তাব না দেয় সেও কিছু বলবে না। এমনিভাবে যদি জীবনটা কেটে যায় যাবে। খুব হাল্কা ছন্দে হোস্টেলে ফিরে এলো সে। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে, একটা ছোট বাসা নিলে কেমন হয়? হারুনের ইচ্ছে না হলে রোজ রোজ সে নারায়ণগঞ্জ নাই-বা গেল। কিন্তু মুখ ফুটে এ প্রস্তাব দেবে কেমন করে? কি ভাববে হারুন। ভাববে যে জীবন সে যাপন করে এসেছে তেমনই একটা জীবনে সে আবার ফিরে যেতে চায়। না ও আর ভাবতে পারে না।
তবে অফিসে গিয়ে আজকাল সে কিন্তু অতো ক্লান্তি বোধ করে না। আরেকটা জিনিস ময়না নিজেই লক্ষ্য করেছে সে কারও সঙ্গেই প্রয়োজন ছাড়া কখনও একটা কথাও বলে নি। আজকাল কিন্তু বলে। কুশল জিজ্ঞেস করে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভালোমন্দ আলাপও করে। মনে হয় তার জীবনের জমাট পাথরখণ্ডগুলো বুঝি গলতে শুরু করেছে। সে পাশে কাউকেই সইতে পারতো না। আজকাল কিন্তু অনেক সময় পাশে কাউকে সে কামনা করে। অন্যকে হঠাৎ ডেকে চা খাওয়ায়। তার ঘনিষ্ঠ দু’একজন মেয়ে মন্তব্য করে। ময়নার কানে আসে, হেসে উড়িয়ে দেয়। আগের দিন হলে চাকুরি যেতো। একি হারুনের সান্নিধ্যের ফল, হবেও বা! ময়না গোপনে জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। পরদিন বিকেলের দিকে হারুন ওকে ফোন করলো, ময়না আমি আজ আসতে পারবো না। তাড়াতাড়ি নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে। কাজ পড়েছে। যদি কাল না আসি তাহলে হয়তো আর ফোন করবো না। কারণ তাহলে ধরে নিও আমি নারায়ণগঞ্জে আটকে গেছি। তবে পরও নিশ্চয়ই আসবো। ময়না বললো, এসো, তবে পরশু এসেই ফোন করো। আমি একটু চিন্তায় থাকবো। পরদিন বিকেলে ফোন পেলো ময়না। ও নারায়ণগঞ্জ থেকে কথা বলছে। ওর ছোট বোন আসিয়ার বিয়ের কথা পাকা হলো। আগামী মাসে বিয়ে হয়ে গেলে হারুণের দায়িত্ব কর্তব্য সব শেষ। বড় আপা, মেজো আপার বিয়ে হয়ে গেছে যুদ্ধের আগে। একমাত্র আসিয়াই বাকি ছিল। ওর ছোট দু’ভাই দুজনেই পড়া শেষ করে চাকুরি করছে। বেশ স্বচ্ছল গোছানো সংসার। তাকে নিয়ে অমন অঘটন না ঘটলে আজ তো তাদেরও সুন্দর ছিমছাম সংসার হতো। বড় ভাই আর সে চাকুরি করতো, মন্টু পড়া শেষ করে যা হয় একস্টা করতো। সে অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা ব্যাংকে চাকুরি পেয়েছে। এক বছর পর আরেকটা পরীক্ষা হবে। পাশ করলে অফিসারের গ্রেড়ে যাবে। এতেই আব্বা-আম্মা খুশি। তাছাড়াও দৈনিক শ’ দুশ আব্বা এখনও উপার্জন করেন। তার জন্যে ভাইয়া বিয়ে করছে না। কারণ বলে না। কিন্তু ময়না বোঝে, ভাইয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ভাইয়া কোনও কথাই কানে নেয় না।
দু’দিন পর হারুন ঠিকই ফোন করলো। ময়নার কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। বোনের বিয়ের নাম করে নিজেরও একটা ব্যবস্থা করে আসবে নাতো? অসম্ভব কিছু না। পুরুষের চরিত্র তো তার দেখা হয়ে গেছে। কামনা জেগে উঠলে ওদের কি স্ত্রী-পুত্র কন্যার কথা মনে থাকে? আর ময়নাতো ওর ছোট বেলার বান্ধবীর চেয়ে বেশি কিছু নয়। হারুন বলেছে একটু আগে আসবে। ময়নাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবে। একটু সেজেগুজে থাকতে বলেছে। ময়না রাজি হয়ে ফোন রেখে দেয়। কোথায় নেবে তাকে? কাকে দেখাবে যে সেজেগুজে থাকতে হবে। হবে কোনও বন্ধু বান্ধবীর ওখানে। আসলে ময়না কারও সামনেই যেতে চায় না। হারুম সমস্ত ব্যাপারটা ওর কাছে সহজ করতে চায়। ওকে স্বাভাবিক দেখতে চায়। কিন্তু ময়না কিছুতেই তার জড়তা কাটাতে চায় না। হারুন এখন জোর করে না। ঠিক করেছে সব কিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসুক সেই ভালো। জানি না হারুনকে কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে, হোক। সে তো সারা জীবন অপেক্ষা করবার প্রস্তুতি নিয়েই ছিল।
বিকেলে হারুন এলো। ময়নার উপর থেকে ও চোখ ফেরাতে পারে না। মুসুরি ডাল রঙের একখানা জরিপাড় শাড়ি পরেছে। ময়নার গায়ের রঙ ফর্সা। মনে হচ্ছে চারিদিক আলো হয়ে উঠালো। কানে আর গালায় মুক্তো। হারুণের দৃষ্টি দেখে লজ্জা পেলো ময়না। বারে, তুমি তো সেজে থাকতে বলেছো, লজ্জা জড়িত কণ্ঠে বললো ময়না। হারুন বললো, কিন্তু আমার কথাতো রাখে নি। এটা কি সাজা হলো? একখানা সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরে তুমি অফিসে যাও না? যাও একটা দামি বেনারসি পরে এসো।
গম্ভীর হলো ময়না, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? বেনারসি? বেনারসি আমি কোথায় পাবো? স্বর তীক্ষ্ণতর হলো। হারুন নিরুত্তাপ গলায় বললো, নেই বেনারসি, বেশ তো চলো আমি কিনে দেবো তোমাকে। গাড়ির কাছে এসে পড়েছে। ময়নার গতি স্তব্ধ হলো। হারুন তুমি আমাকে নিয়ে, আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কৌতুক করছো। আই এ্যাম সরি, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারবো না আর। হারুন ওর হাত শক্ত করে ধরলো। রাস্তার পাশে সীনক্রিয়েট করো না ময়না। গাড়িতে ওঠো তারপর না হয় আমাকে দু’চার ঘা দিয়ে দিও। ততোক্ষণে ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। গাড়িতে উঠে ময়না আর কোনও শব্দ করলো না, হারুনও রাস্তার দিকে মুখ করে বসে রইলো। সম্ভবত গন্তব্য ড্রাইভারকে আগেই বলে ছিল, সে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগলো। ঈদগাহ রোডের থেকে ওঠা একটা রাস্তায় গাড়ি ঢুকে থামলো। এবার হারুন নিজেই দরজা খুলে দিল। একেবারে অন্যমনস্ক কেমন যেন অভিভূতের মতো ময়না ওর পেছন পেছন বেরুলো। দোতালায় উঠে একটা দরজায় চাবি লাগালো হারুন। ঘরে ঢুকে বাতি জ্বাললো। সুন্দর ছিমছাম বসবার ঘর, আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজনের অভাব নেই। একটা সোফাসেট আর একটু দূরে একটি বেতের সেট। দু’জায়গায় দুই টুকরো কার্পেট, বেতের দিকে মাখন রঙের আর অন্যদিকে চকোলেট রঙের। ময়না অতিকষ্টে উচ্চারণ করলো, এ তুমি আমাকে কোথায় আনলে হারুন? গলাটা এতো ক্লান্ত যে মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এবার হারুন ওর দিকে এগিয়ে এলো। হাত দুটো ধরে নিজের ভেজা চোখের ওপর বুলিয়ে বললো, তোমার নিজের ঘরে এনেছি ময়না। এসো ভেতরে তোমার ঘর, কিচেন, বাথ, একটি অতিরিক্ত ঘরসহ এ্যাপার্টমেন্টটা বেশ সুন্দর। জানালাগুলো বেশ বড়। ময়না তাকিয়ে দেখলো সুন্দর আকাশ দেখা যায়।
একটু বসি? ক্লান্ত ময়নার কণ্ঠ। নিশ্চয়ই, চলো বসবার ঘরে যাই, নতুবা আবার আমার কোন ব্যবহারে তুমি ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়বে। একটু সুস্থির হয়ে ময়না বললো, কবে নিয়েছে এ বাড়ি। আমাকে বলোনিতো? এ বাড়ি নিয়েছি ‘৭৩ সালে তখন তুমি তো আমার কাছে ছিলে না। কেন তোমার পছন্দ হয়নি? ময়না ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। কেন হবে না। ময়না, আমরা তো আলাদা নই। ভেতরে গিয়ে দুটো কোক, দুটো গ্লাস আর একটা চীপসের প্যাকেট প্লেটে বসিয়ে ট্রে করে নিয়ে এলো। ময়না জিজ্ঞেস করলো, একা থাকো তোমার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কি? না না একা থাকি না। নারায়ণগঞ্জের একটা ছেলে আমার কাজ করে, সঙ্গে থাকে। আজ তোমাকে আনবো বলে ওকে ছুটি দিয়েছি। ছেলেটা খুবই কাজের। এবার হারুন একটু অন্তরঙ্গ হয়ে বসে ময়নার পাশে। ওর হাত দুটো তুলে নিয়ে বলে, ময়না, কবে আসবে তুমি আমার এ ঘরে, কবে এ সুর আমাদের ঘর হবে?
হারুনের হাতের ভেতর ময়নার হাত কাঁপছে, ঘামছে। ও কথা বলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হারুন উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বুকে টেনে নিলো। বলে, ময়না, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার বাবা আমাদের বাড়ি থেকে আসার পর আমার ভাই হাশেম আমাকে সব কথা বলে। আমি কাউকে কিছু বলি নি। কোম্পানির কাছে বাড়ি চেয়েছি। ওরাই এটা ঠিক করে দিয়েছে। ভাড়া ওরাই দেয়। আমি তারপর এক রাতও ও বাড়িতে থাকি নি। সেদিন আসিয়ার বিয়ের কথা ঠিক হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে এসেছি। তুমি ওর কাছ থেকে জেনে নিও। মা তোমাকে খুব ভালোবাসেন ময়না। সব সময় জিজ্ঞেস করেন আমি তোমার খবর রাখি কিনা। এবার মাকে বলেছি। মা বললেন, তোর বাবার তখন মাথা ঠিক ছিল না। তুই বলে দেখ। ময়না রাজি হলে আমরা ওদের বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দিব। মাকে বলেছি ওর মতের দরকার হবে না। সে রাজি হলে আমরা নিজেরাই বিয়ে করে নেবো। মা হাতটা চেপে ধরে বললেন, না বাবা, যেখানেই করিস আমাকে আর ময়নার মাকে ডাকিস। আমরাও মেয়ে মানুষের জাত, এটা ভুলিস না।
ময়না ডুকরে কেঁদে উঠলো সত্যিই হারুণের মা ওকে খুব ভালোবাসতেন। ডাকতেন পাগলী বলে। ময়না এবার বললো, হারুন তোমার এক দেহে এত গুণ জানতাম না। হারুন লাল হয়ে বললো, দেখো ময়না, স্বামীকে শ্রদ্ধা করতে হয়, সম্মান করতে হয়, নাম ধরে ডাকতে নেই। ওগো, হ্যাঁগো বলতে হয়। ময়না বললো, ব্যাস, মাত্র এই? না না আরও আছে। রোজ সকালে স্বামীর পা ধুয়ে দেবে, এই লম্বা চুল দিয়ে পা মুছে দেবে! ব্যাস ব্যাস আর না, সব শেষে শক্ত একটা লাঠি দিয়ে ঐ পা দুটো ভেঙে দেবে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি যে বলো, নাও এটুকু মুখে দাও। রাতের খাবার আজ আর রেস্তোরাঁয় নয়। হাকিম রান্না করে রেখে গেছে। ভাতটা আমি করে নেবো। আর চাইলে তুমিও করতে পারো। হারুণের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে ময়না বলে আমার বড় ভয় করে হারুন। সবল হয়ে হারুন বলে কিসের ভয় ময়না? আমার দিকে তাকাও, আমার এ বিশাল বুকের ভেতর থেকে কে তোমার কি ক্ষতি করবে? আমার উপর ভরসা করতে পারে না? পারা তো উচিত হারুন, তবুও কেন জানি না কিসের ভয় আমার। আমি জানত স্ব ইচ্ছায় কোনও পাপ, কোনও অন্যায় করি নি। তবুও পর্বত প্রমাণ অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে আজ দু’বছর পথ চলেছি। আমি বড় ক্লান্ত হারুন। একা একা আর পারছি না। শোনো, আগামী মাসের সতেরো তারিখে আসিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুমি যাবে না। কিন্ত্র খালাম্মা খালু সবাইকে আঝা গিয়ে দাওয়াত করে আসবেন এবং আমার বিশ্বাস তাদের অন্তরে যতো ব্যথাই তারা পান না কেন, দাওয়াতে তারা ঠিকই আসবেন। তারপর আম্মা-আব্বা গিয়ে সব কথাবার্তা বলে আসবেন।
ময়না হঠাৎ মুখ তুলে বললো, বিয়ে কিন্তু ঢাকায় হবে। নিশ্চয়ই বলে পাশের ঘরে চলে গেল হারুন। একটু পরে একটা শাড়ির বাক্স নিয়ে এলো। কমলা রঙের এটা দারুণ কাজ করা বেনারসি। ময়না, এই শাড়ি দিয়ে আমি আজ নতুন করে তোমার মুখ দেখলাম। ছিঃ ছিঃ কি যে ছেলেমানুষী করো, লজ্জায় কুঁকড়ে গেল ময়না। হারুন উঠে এসে ওর হাত ধরে বললো, প্লিজ ও ঘরে গিয়ে শাড়িটা পরে এসো। ওর কথা ফেলতে পারে না ময়না, শাড়িটা পরেই আসে। বাঃ চমৎকার। আমার রুচির প্রশংসা করলে না ময়না? রাজ্যের লজ্জা ওকে ঘিরে ধরেছে। ধুপ করে একটা সোফায় বসে পড়লো ময়না হাত থেকে ছোট বাক্সটা বের করে একটি ছোট ডায়মন্ড আংটি ময়নার অনামিকায় পরিয়ে দিলো হারুন। সহজাত রীতিতে ময়না নিচু হয়ে হারুনকে সালাম করতে গেলে বন্দি হলো তার হাতের ভেতর। হারুন অনুমতি নিয়ে তার চোখের ওপর উষ্ণ ওষ্ঠ ছেলো, তারপর যথাস্থানে।
রাত দশটায় বাড়ি ফিরে এলো ময়না বেবিট্যাক্সি করে। আজ হারুন তাদের প্রথম অভিসারের লগ্নে আর কারও উপস্থিতি চায় নি। কি দ্রুত কেটে গেল মাসটা, আসিয়ার বিয়ে হয়ে গেল, ময়নাদের বাড়িতে হারুণের বাবা-মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। চোখের জলে সব ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে গেল। বিয়ে হলো ঢাকায়। দু’তরফের আত্মীয়, বন্ধু সবাই এলেন কয়েকজন তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের জোহা সাহেবও এসেছিল।
বলাবাহুল্য ময়না হোস্টেল ছেড়ে দিলো। ওর সৌভাগ্যে সত্যিই অনেকে ঈর্ষাকাতর হলো। চারমাস পর হারুনকে কোম্পানি থেকে একটা ব্যবসায়িক ট্যুরে ইউরোপের কয়েকটা দেশে পাঠালো। ময়নাও দু’মাসের ছুটি নিয়ে মহানন্দে হারুণের সঙ্গী হলো। কতো দেশ দেখলো, কতো লোকের সঙ্গে পরিচয় হলো, কতো শপিং করলো সবার জন্যে। কিন্তু পথে চলতে চলতে হঠাৎ করে একটা মুখকে কেমন যেন পরিচিত মনে হয়। ময়না ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। হারুন লক্ষ্য করেছে তবে এ নিয়ে ওকে কিছু বলে নি। ভাবে সময় মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। ময়না ভাবে দেশে ফিরে গিয়ে এবার সে একটা সন্তান চাইবে হারুণের কাছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। মানুষ করে রেখে যেতে হবে তো।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের খবর ওদের কানে পৌঁছালো পর দিনই। দুজনেই ভীষণভাবে বিচলিত। ময়নার কান্না থামাতে পারে না হারুন। ও শুধু বলছে, বাবা তোমার জন্যে সব দিলাম, তবুও তোমাকে রাখতে পারলাম না। হারুন আমি টাকা যাবো, বাড়ি যাবো। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার ডেকে ওকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। না, পরদিন সকালে ওকে সুস্থ মনে হলো তবে কিছুটা দুর্বল। হারুন তার নির্ধারিত কাজে বেরিয়ে গেল, ময়না সারাদিন বিশ্রামই নিলো।
সফর শেষ করে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে এলো ওরা। বাইরে খুব একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল না কিন্তু সর্বত্রই যেন একটা ভয় এটা শংকা। বঙ্গবন্ধুর কিছু ঘনিষ্ঠ সাথী কেউ স্বেচ্ছায় কেউ বাধ্য হয়ে মুস্তাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেন। জেলে গেলেন তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও আরও বহু আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী। ময়নাকে আবার পুরোনো ভয় পেয়ে বসেছে। হারুন কার সঙ্গে পরামর্শ করবে বুঝে পায় না। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার কিন্তু পুরোনো গণ্ডির মাঝে ময়নাকে ফেলতে তার সাহস হয় না। আস্তে আস্তে ময়না স্বাভাবিক হলো। অফিসে যায় আসে তবে বাইর বিশেষ যেতে চায় না। একটা সুখবর অন্তঃসত্ত্বা হলো ময়না। সবাই খুশি বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি। হারুন চায় মেয়ে আর ময়না অসম্ভব জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে না ছেলে’। মেয়ে আমি চাই না। অপ্রত্যাশিত না হলেও আরেকটা ধাক্কা এলো নভেম্বরে।
খালেদ মোশারফসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলেন। পথে হঠাৎ করে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর, শোনা গেল। হারুন বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো ময়নার জন্য। কিন্তু না এবার সে ভবিষ্যত মাতৃত্বের আনন্দে ও কল্পনায় বিভোর। বাইরের হুজুগ, চার নেতার মৃত্যু তাকে আঘাত করলো বলে মনে হয় না। শুধু মাঝে মাঝে বলতে কি যে হবে, কি যে হবে তাই ভাবি।
সন্তান ভূমিষ্ট হলো। পুত্রসন্তান, হারুন নাম রাখলো গৌতম। ময়না হেসে সম্মতি দিলো। অবশ্য দু’তরফ থেকে ডজন খানেক নামকরণ হয়ে গেল। তিন মাসের ছুটি। ময়নার মা এসে সঙ্গে আছেন। শাশুড়ি মাঝে মাঝে আসেন কিন্তু থাকতে পারেন না। হঠাৎ করে একদিন ময়না আবিষ্কার করলো, ইদানীং হারুণের মুখ যেন কিছু মলিন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। জিজ্ঞেস করলে বলে না না, ও কিছু না। তুমি আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো কিনা। একটু মনোযোগ দাও নিজের দিকে। কিন্তু ময়নার চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ময়নাকে বলে, কারা যেন টেলিফোনে প্রায়ই ওকে ভয় দেখায়। ময়নাকে নিয়ে যা তা কথা বলে। মুক্তিযোদ্ধার ওস্তাদী ওরা শেষ করে দেবে। ময়না উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি থানায় একটা ডায়েরি করে রাখো। অবশ্য সাহস থাকলে সামনে আসতো। যতো সব ভীতুর দল। এ নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। কি করবে আমাদের? না ময়না, করতে ওরা সবই পারে। ‘৭১-এ দেখেছো এদের চেহারা, এদের চরিত্র। তাই একেবারে উপেক্ষা করতে পারি না। তবে মনে হয় কিছুদিন ঘ্যান ঘ্যান করে নিজে থেকেই থেমে যাবে। ময়না ভাইয়াকে কথাটা বলে। ভাইয়াও নাকি ওরকম ফোন কল পাচ্ছে। বললো, আমি খুব একটা ভয় না পেলেও সাবধানে থাকি। চায়নার বিয়ে হয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে। গৌতম মহারাজের আগমনের জন্য দিন স্থির করতে একটু দেরি হয়ে গেল। এভাবেই দিন গড়িয়ে যায়। চায়নার বিয়ে হয়ে গেল। গৌতমের আকিকা হলো। ধুম ধামের অভাব নেই। ফোন কল কমে এসেছে। হয়তবা থেমে গেল তবে। প্রতিবারই কিছু একটা কণ্ঠ নয়। একেক বার একেক জন অথবা কণ্ঠ বিকৃত করে তাও হারুন জানতে পারে না।
আসিয়ার ভাশুর বিদেশে থাকেন। দেশে এসেছেন। সেই উপলক্ষ্যে হারুণের আম্মা অনেককে দাওয়াত করেছেন। হারুন আর ময়নার যাবার কথা কিন্তু হঠাৎ গৌতমের শরীরটা খারাপ করায় ও যেতে পারলো না। মা তো এ যজ্ঞের বাবুর্চি হবার জন্য আগেই বেয়ানের কাছে চলে গেছেন। দশটার ভেতরই হারুন চলে গেল। ময়নার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই ওদের নারায়ণগঞ্জে যাওয়া হয় না। তার ওপর গৌতমটা কি বাঁধিয়ে বসলো! হতভাগা ছেলে আর অসুস্থ হবার সময় পেলো না।
বেলা সাড়ে বারোটায় হঠাৎ ফোন এলো নারায়ণগঞ্জ থেকে। বড়ভাই ফোন করেছে। হারুন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওরা ওকে নিয়ে এক্ষুনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসছে। ও যেন বাসায় থাকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ ময়না পেলো না। পাগলের মতো একবার জানালায় একবার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত হারুণের অফিসে ফোন করে খবর পেলো। হারুন এ্যাকসিডেন্ট করেছে, ওকে ঢাকায় আনা হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে। এক্ষুনি ময়নার কাছে গাড়ি যাচ্ছে। ময়না বুয়ার হাতে গৌতমকে বুঝিয়ে দিয়ে কোনও মতে শাড়ি জড়িয়ে তৈরি হতেই অতি পরিচিত গাড়ির হর্ণ তার কানে এলো। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। কি হয়েছে ড্রাইভার, সাহেব? ড্রাইভার কি উত্তর দিলো বোঝা গেল না। মেডিকেল কলেজে ইমার্জেন্সীর সামনে ভাইয়া ও অফিসের লোকজন দাঁড়ানো। ময়না ওদের সঙ্গে দৌড়ে ঢুকলো। রক্তভেজা বিছানায় শুয়ে আছে হারুন। হারুন নেই। বাসার সামনে কটা লোক কি নিয়ে যেন ঝগড়া হাতাহাতি করছিল। হারুন ওদের থামাতে গিয়েছিল। ও পাড়ার ছেলে নামকরা মুক্তিযোদ্ধা সবাই ওকে মানে আর হারুনও সে ভাবে চলে। যারা কাছে ছিলেন তারা বলছেন, হঠাৎ কয়েকটা লোক ছুটে পালায়। পরে মনে হলো ঝগড়া, ফ্যাসাদ সব বানানো। এতদিনে প্রতিপক্ষের কাজ হাসিল হলো। ময়নার জ্ঞান ছিল না! ওকে বাসায় আনা হলো। মা, চায়না, ননদ, আসিয়া সবাই এসে পৌঁছেছে। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল ময়না জানে না। শুধু এটুকু উপলব্ধি করলো তার ভাঙা কপাল এবার ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেল আর কখনোও জোড়া লাগবে না।
অফিসে খুবই ভালো ব্যবহার করলো। ময়নাকে একটা উপযুক্ত চাকুরি দেওয়া হলো এবং বাড়িটাও ওর নামে এ্যালোটে হলো। ময়না শুধু পুরোনো অফিলকে জানালো তার যদি ভালো না লাগে তাহলে কি তারা ওকে আবার নেবেন। তারা শুধু আশ্বাস নয়, আশ্বস্ত করলেন ময়নাকে।
নতুন জায়গায় কাজে যোগ দিলো ময়না। হারুন নেই তাও ভাবতে পারে না। ছোট গৌতমকে নিয়ে সব ভুলতে চায় ময়না। ভাবে আল্লাহ কি আমার জন্য শুধু দুঃখই সঞ্চয় করে রেখেছিলেন? তাহলে ক্ষণিকের সুখের মুখ কেন দেখালেন, কেন? দিন চলে যায়। ময়নারও যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো তার নতুন বম তার সুবিধা-অসুবিধার সম্পর্কে একটু বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে। ময়না দেখেও দেখে না। শুনেও শোনে না। কিন্তু এভাবে কতোদিন চলে, সাত বছর হয়ে গেল হারুন চলে গেছে। গৌতম না এলে ও তো বিষ খেয়ে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারতো। এখন মাঝে মাঝে গৌতম সব অদ্ভুত প্রশ্ন করে। ওর বাবাকে কারা মেরেছে? কেন মেরেছে, কি করেছিল ওর বাবা? ময়না উত্তর দিতে পারে না। ইতোমধ্যে আব্বা মারা গেছেন তাই মা বেশির ভাগ সময়ই ওর কাছে থাকেন। ভাবি বড় ভালো মেয়ে। সংসার ভালোবাসে তাই মাকে আর ভাবতে হয় না। ময়না এখন মনে মনে গৌতমের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। ময়মনসিংহ ক্যাডেট স্কুলে একদিন ও গেল। হ্যাঁ দশ বছর বয়স হয়েছে। সুতরাং ও ছেলেকে আনতে পারে। পরীক্ষা দিতে হবে। গৌতম বাবার মতোই লেখাপড়ায় ভালো। পরীক্ষা দিলো, খুব ভালো ফল করলো। একদিন স্যুটকেস গুছিয়ে ময়না গৌতমকে ময়মনসিংহ রেখে এলো। তারপর বাসা খুঁজতে শুরু করলো ওর কলিগের সহায়তায়। এ বাড়ি পেয়ে কোম্পানির সাজানো বাড়ি ছেড়ে দিলো। বস্ দুঃখ করলেন, অফিসে অনেকেই আছে যাদের বাড়ির একান্তই প্রয়োজন। তারপর দশ বছর পরে ওর পুরোনো অফিসে ফিরে এলো। ময়না টাকা চায়না। চায় শান্তি। এ অফিস চাকুরি দিয়েছিলো একজন দুঃস্থ বীরাঙ্গনাকে, আর ওখানে মিসেস হারুন-অর-রশীদ সে লেবাস ও ছেড়ে এলো। ওর ঠিক এখন টাকার দরকার নেই। ও ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছে। ঐ টাকা থেকে গৌতমের সব খরচ চলে যায়। আর ময়নার তো বলতে গেলে কোনো খরচই নেই। মা চলে গেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি আগেই গেছেন। ছেলের শোক সহ্য করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। আপা, আমি আবার রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি একজন বীরাঙ্গনা। যারা বারাঙ্গনা বানাতে চেয়েছিল তারা আমার স্বামীকে নিয়েছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি গৌতমের মা হয়ে। গৌতম হবে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। বাবা দেশ স্বাধীন করে গেছে। গৌতম সে দেশের জঞ্জাল সরিয়ে সোনার বাংলা গড়বে। এই সন্তানকে গড়ে তোলাই আজ বীরাঙ্গনা ময়নার শপথ।