‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ লেখিকা নীলিমা ইব্রাহিম রচিত একটি বই। এই বইয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষিত হওয়া সাত জন নারীর করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
লেখিকা বইটিতে সাত জন বীরাঙ্গনা নারীর কথা বলেছেন যারা ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক অবস্থা থেকে এসেছে। দর্জির মেয়ে আছে, গ্রামের বিত্তশালী কৃষকের মেয়ে আছে আবার শহরের উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিবিদের মেয়ে আছে। তবে এই বীরাঙ্গনাদের মধ্যে একটি মিল হচ্ছে তারা জীবন যুদ্ধে কেউই পরাজিত হয়নি।
মেহেরজান বলছে, “জীবনটা তো সরল সমান্তরালরেখায় সাজানো নয়। এর অধিকারী আমি সন্দেহ নেই, কিন্তু গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন – কি বললেন আল্লাহ, পাগল হয়েছেন! বাঙালি মেয়ের জীবন পরিচালিত হবে আল্লাহর নির্দেশে! তাহলে এদেশের মৌলবী মওলানারা তো বেকার হয়ে থাকবেন, আর রাজনীতিবিদরাই বা চেঁচাবেন কি উপলক্ষ করে? না এসব আমার নিজস্ব মতামত, অভিযোগের বাঁধা আটি নয়।”
যে কথা তাহের (ফাতেমার স্বামী) জানে না সেই কথাই চাঁপা ডাক্তারকে বলল। সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সে নিজেও কেঁদে উঠল। ডাক্তার নিচু হয়ে চাঁপাকে প্রণাম করল। দিদি, আপনারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আশ্চর্য এত ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করল বাঙালিরা, আর মা বোনদের দেওয়া ত্যাগের মূল্য দিতে পারল না। দূর্ভাগ্য সে দেশের!
আমি মাঝে মাঝে ওর ঘরে গিয়ে বসতাম। চোখ নিচু করে মিনা বেরিয়ে যেত অথবা ঘরে ঢুকত। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিত। বলতাম, জেরিনা এই মেয়েগুলোর বুকে আগুন জ্বেলে দিতে পারিস না, ওরা কেন মাথা নিচু করে চলে? নীলিমাদি তোমাদের এ সমাজ ওদের চারিদিকে যে আগুন জ্বেলে রেখেছে তার উত্তাপেই ওরা মুখ তুলতে পারে না। বেশি বেশি বক্তৃতা দিও না। ওদের সম্পর্কে জেরিনা খুব বেশি স্পর্শকাতর ছিল।
❀ ❀ ❀
সংসারের নিয়ম এই যে, কোন কিছু পেতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে পাওয়ার জন্য আমাদের জাতিকেও বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রাণ এবং বিপুল সম্পদের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই রাষ্ট্র। যারা সাধারণ মানুষ, দেশ ত্যাগ করে ভারতে যায়নি, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের আহার ও আশ্রয় দিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে। স্বাধীনতা-যুদ্ধে জনসমর্থন এবং জনগণের সাহায্য-সহযোগিতার মূল্যও অপরিসীম। বর্তমান গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধকালে নির্যাতিতা কিছু নারীর মর্মান্তিক কাহিনী। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেই, ১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধু সরকার পরম মহানুভবতায় এই নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলে ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতা অর্জনে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেন। নানাভাবে সরকার তাঁদেরকে আর সবার মতো মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। আমাদের সমাজ কিন্তু যথেষ্ট উদার মানসিকতার অধিকারী নয়। নানা রকম সংস্কার ও কুসংস্কার এবং ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্নকে আড়াল করে সামাজিক নিষ্ঠুরতাকে কেবল প্রশ্রয় নয়, প্রাধান্য দেয়। এই বৈরী বাস্তবতায় অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম সমাজকল্যাণের মনোভাব নিয়ে সাহসের সঙ্গে রচনা করেছেন এই গ্রন্থ। তিনি সরজমিনে তদন্ত করে তথ্য নির্ণয় করেছেন এবং বীরাঙ্গনাদের অন্তর্জালা তাঁদেরই জবানিতে সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করেছেন।