চার : শেফা
আমার পরিচয় জানতে চান? আমি প্রকৃতপক্ষে একজন বীরাঙ্গনা। শুধু দেহে নয়-মনে, মননে, হৃদয়ে। হাসছেন তো? বীরাঙ্গনার আবার অন্তর, তার আবার মনন? জ্বী, দেহে আপনার সঙ্গে লড়াইতে জিততে পারবো কিনা জানি না তবে আপনি যদি বাঙালি মুসলমান ঘরের পুরুষ হন, আর আপনার বয়স যদি পঞ্চাশ পার হয়ে থাকে তাহলে মনোবলে আপনি আমার চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ একদিন আমি আপনাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম, আপনাদের আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করবার এবং দেহ ভেদ করে অন্তরের পরিচয় পাবার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। এদেশের মায়ের সন্তান যারা ছিল তারা হয় শহীদ, নয়ত গাজী। যুদ্ধকালে যারা খেয়ে পরে সুখে ছিলেন তাদের আমি ঘৃণা করি, আজ এই পঁচিশ বছর পরও থুথু ছিটিয়ে দিই আপনাদের মুখে, সর্বদেহে।
একজন বীরাঙ্গনার এতো অহঙ্কার কিসের? আমি তো বীরাঙ্গনাই ছিলাম। আপনারা বানাতে চেয়েছেন বারাঙ্গনা। তাইতো আপনারাও আমার কাছে কাপুরুষ, লোভী, ক্লীব, ঘৃণিত এবং অপদার্থ জীব। আমি আজও বীরাঙ্গনা, আজও আমি আপনাদের করুণা করবার অধিকার রাখি।
আমার পরিচয়? আমি এই বাংলার একজন গর্বিত নারী, যাকে অরক্ষিত ফেলে রেখে আপনারা প্রাণভয়ে পদ্মা পার হয়েছিলেন। ফিরে এসে গায়ে লেবাস চড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু সুযোগ সন্ধানী পুরুষ, অন্তরে ছিলেন রাজাকার, মুখে বলেছেন ‘জয়বাংলা’, মনে মনে উচ্চারণ করেছেন তওবা, তওবা’! নইলে এই যে রক্তবীজের ঝাড় রাজাকার, আলবদর-এরা কি পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে? না, এরাই আপনারা, আপনাদের ভাই-বন্ধুরা, যারা এখন পুত্রের নিহত হবার ভয়ে ভিটামাটি বিক্রি করে দেশ ত্যাগের জন্য মরিয়া হয়েছেন। কিন্তু যাবেন কোথায়? আপনার পেছনে ধাবিত হবে আজ বারোকোটি বঙ্গসন্তান। যাক এ সমস্যা আমার নয় আপনার, আপনার স্বগোত্রীয়দের।
আমি শেফা। মা ডাকতেন শেফালী। আব্বা থেকে শুরু করে বাড়ির অন্য সবাই পাড়া পড়শী সবাই ভাকতো শেফা। অবশ্য স্কুলে আমার একটা পোশাকী নাম ছিল। তবে সেটা এখন বলা যাবে না। তাহলে আবার আপনারা আমাকে ধরে নিয়ে কোন গুহায় বা বাংকারে ভরবেন বলতে পারি না। তাই যেটুকু পরিচয় পেয়েছেন তাই যথেষ্ট। আর যারা আমার উপকার করেছিলেন ঘর থেকে বের করে, তারা শেফা নামেই চিনবেন। আমি বড় হয়েছি একটা মফঃস্বল শহরে। অবশ্য তাই বলে সেটা পাড়া গাঁ নয়। জজকোট ছিল, হাসপাতাল ছিল, গোটা সাতেক উচ্চবিদ্যালয় ছিল, তার ভেতর দুটো মেয়েদের। আর দুটি ভালো মহিলা কলেজ ছিল, ছিল বড় সরকারি হাসপাতাল, খেলার মাঠ, সদ্বান্ত লোকের জন্য ক্লাব, ইউরোপীয়ান ক্লাব ইত্যাদি। বাবা ছিলেন আইনবিদ এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ত্রে সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত।
‘৬৯-এর আন্দোলনের সময় আমি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। মিটিং, মিছিল, পিকেটিং করেই স্কুলের পড়াশুনা চালিয়েছি। মা খুবই বকাবকি করতেন। মেয়েদের এতো ভালো না, এই কথা বহুবার বলেছেন। কিন্তু আমি পিতার আদরিনী কন্যা, আমাকে স্পর্শ করে কার ক্ষমতা। এরই ভেতর বাবা কারারুদ্ধ হলেন।
সরকারের প্রতি ক্ষোভ আমার এতো বেড়ে গেল যে প্রতিহিংসা মেটাবার বাসনায় অবাঙালি দোকান থেকে কিছু কিনতাম না। সুযোগ পেলে ওদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে চড়টা চিমটিটা দিতেও ইতঃস্তত করতাম না। তখন কি জানতাম এ সব ক্ষুদ্র অপকর্মও বিধাতা পুরুষের হিসাবের খাতায় জমা হচ্ছে! যাক্ মাস ছয়েক পর বাবা মুক্তি পেলেন। আমিও ডানা মেলে ‘জয় বাংলা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম দেশের কাজে। মিছিলে যাওয়া, সামনে এগিয়ে স্লোগান দেওয়া, লাঠির আঘাতে বাহাতখানা জখম করা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার বীরত্বের চিহ্ন।
দ্রুত ঘটনা এগিয়ে চললো। আগরতলা মামলা নস্যাৎ হয়ে গেল। শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। ঢাকার খবর শুনলাম। তখনকার রেডিওতে তো কিছু কিছু খবর পাওয়া যেতো। বর্তমানের মতো তার একটা মুখ ছিল না। তাছাড়া অনবরত ঢাকার খবর আসছে লোক মারফৎ, ফোনে, আর আমাদের কর্মকাণ্ড নব নব পথে চালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর হুকুমে স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালত, সব বন্ধ। আমি আইএসসি পরীক্ষা দেবো। বইপত্র স্পর্শ করি না। কারণ দেশ তো স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর বই ছুঁতে হবে কিনা আমার জানা ছিল না। আব্বার কোর্ট নেই। দু’বেলা বাইরের ঘরে একশো কাপ চা, ছোটভাইয়ের খেলে বেড়ানো, ছোটবোন মায়ের আঁচল ধরে ঘোরে আর চব্বিশ ঘণ্টা মায়ের বকুনি, বাবা থেকে শুরু করে কাজের মেয়ে নাসিমা পর্যন্ত রেহাই পেতো না। কেমন করে চলে এলো ২৫ শে মার্চ। স্বপ্ন ছিলো দু’একদিনের ভেতর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, আর একি হলো! কার্টু সব জায়গায়, আমাদের শহরেরও। বাবা, মায়ের জিদে গ্রামে চলে গেলেন একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে সঙ্গে নেবার জন্য খুব জিদ করেছিলেন কিন্তু এতো বড় মেয়েকে মা পথে বেরুতে দিলেন না। দিলে হয়তো শহীদ হতে পারতাম, বীরাঙ্গনা হতাম না। দুটো দিন নিশ্বাস বন্ধ করে কেটে গেল। তারপর মানুষ আতংকগ্রস্ত হলেও চলাফেরা করতে শুরু করলো। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম রাতের অন্ধকারে অনেকেই গ্রামমুখী হচ্ছে। এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হবার জন্য মাকে ধরলাম, চলো আমরা চলে যাই। মাও রাজি, কিন্তু আমার ও সতেরো বছর বয়সের ছেলের জন্য চিন্তিত হলেন। ওরা নাকি ছাত্র দেখলেই গুলি করে মারে।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমাদের পাশের বাড়িতে এক জজ সাহেব থাকতেন। ওরা যেন একটু অন্যরকম টানে কথা বলতো। ওদের মেয়ে ছিল না। তাই কারও সঙ্গেই আমার তেমন জমানো আলাপ ছিল না। ওদের বড় ছেলে ফারুক আমাদের কলেজে বিএ পড়তো। কেমন যেন গোবেচারা বোকা বোকা গোছের। বাবাকে একদিন বলেছিলাম, জানো বাবা ফারুক কখনও মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। মা বললেন, অমন চমৎকার ছেলে আজকালকার দিনে হয় না। বাবা বললেন, দ্যাখো গিয়ে ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়েছে। আমাদের সঙ্গে যেসব মাদ্রাসায় পড়া ছেলে কলেজে পড়তো তারাও সোজাসুজি মেয়েদের দিকে তাকাতো না, কিন্তু সুযোগ পেলে ওরাই সব চেয়ে বেশি হ্যাংলার মতো মেয়ে দেখতে। হাসাহাসির ভেতর ফারুকচর্চা শেষ হলো।
বাবা লোকমুখে অবিলম্বে আমাদের গ্রামে যাবার জন্য খবর পাঠালেন। কারণ বাবা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। মা যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। এমন সময় বাবা নেই জেনে ফারুক আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করলো। মা আগে থেকেই ওকে পছন্দ করতেন। ও মাকে না যাবার জন্য খুবই উৎসাহিত করতো। হঠাৎ একদিন আমার ছোট ভাই অদৃশ্য। ১৭/১৮ বছরের ছেলে। ছোট্ট কাগজে মাকে আর আমাকে লিখে গেল, যুদ্ধে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি দেশে চলে যাও। মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, ফারুককে খবর দে। এতোদিন পরিস্থিতি আমাকেও কিছুটা দুর্বল করে ফেলেছে। তবুও মাকে বললাম, সান্টুর যুদ্ধে যাবার কথাটা ওকে বলো না। আমার দিকে মা তাকিয়ে রইলেন। বললাম, ওকে জানি না ভালো করে, এ সব খবর গোপন রাখাই ভালো, আমাদের ক্ষতি হতে পারে। পরদিন আব্বার খোঁজে পুলিশ এলো। অসভ্যের মতো মাকে ধমকধমকি করলো। ঠিক করলাম মা, আমি আর সোনালি আজ রাতেই দেশে যাবো। কিন্তু হলো না। ঠিক সন্ধ্যায় ফারুক বললো, খালাম্মা চলে যাচ্ছেন। চলুন আমি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। কেন জানি না অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু মা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। দু’খানা বেবীট্যাক্সি ডাকা হলো। আমি মার সঙ্গে উঠতে যাচিছলাম ফারুক আমাকে তারটায় উঠতে ইঙ্গিত করলো। মা আর সোনালি সামনেরটায় উঠলেন। কিছুদূর যাবার পর আমাদের ট্যাক্সি সোজা স্টেশনের পথে না গিয়ে বাঁ দিয়ে সেনানিবাসের পথ ধরলো। আমি বললাম, ওকি? এ পথে কেন? ফারুক ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বললো, ও দিকে ছেলেরা ব্যারিকেড দিয়েছে। বললাম, তাহলে মা আর ওরাও ঘুরে আসতো। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম। চিৎকার করে বললাম, এই বেবী থামো। না, সে তার গতি বাড়িয়ে দিলো। আমি লাফ দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওই শয়তানের সঙ্গে গায়ের শক্তিতে না পেরে ওর হাতে আমার সব কটা দাঁত বসিয়ে দিলাম। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো পশুটা। তারপর বেবীট্যাক্সি থামিয়ে ওই জানোয়ারটা তার গামছা দিয়ে কষে আমার মুখ বাঁধলো। তারপর সোজা সেনানিবাস। আমি বন্দি হলাম। ফারুক আমাকে উপহার দিয়ে এলো। ফারুক এখন জজ সাহেব। আর কখনো হাফ হাতা শার্ট পরে না। কেউ হাতের দাগ দেখে ফেললে বলে মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছিল বেয়োনেট চার্জে। দেখুন তাহলে এ দেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা!
আমাকে বসতে দেওয়া হলো। চা দেওয়া হলো, আমি কোনও কিছু ক্ষেপ না করে অকপটে ফারুকের কাহিনী বর্ণনা করলাম। মা আর সোনালির কথা উল্লেখ করলাম না। যদি তাদেরও ধরে আনে। ভদ্রলোক মৃদুহাস্যে সব শুনলেন। তারপর পাশের ঘরে নিয়ে খাঁটি পাকিস্তানি মুসলমানি হুইস্কি পান করতে লাগলেন। আমাকেও অনেকবার সাধলেন। পাকিস্তানের গল্প করলেন। আমি কখনও গেছি কিনা। যাই নি শুনে আমাকে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। করাচির বর্ণনা করলেন। করাচির সীবীচ কতো সুন্দর তাও বললেন। তারপর নেশাটা জমে উঠলে চট করে একটানে আমাকে বিবস্ত্র করলেন। এলেন না কেউই রক্ষায়। প্রাণপণে চিৎকার করলাম। বাঘের থাবার মতো একটা মুখ চেপে ধরলো। বিবাহের প্রথম মধু যামিনী যখন শেষ হলো তখন আমার জ্ঞান নেই। চোখে মুখে রোদ লাগলো যখন চোখ খুলে দেখি একজন আয়া মতো মহিলা দাঁড়িয়ে। আমাকে গোসলখানা দেখিয়ে নিয়ে নাশতা আনছে বলে চলে গেল। উঠে গোসলখানায় ঢুকলাম। মনে হয় উচ্চ পদের কেউ ব্যবহার করেন। আঙুলে করে দাঁত মাজতে গিয়ে দেখি দাঁতে অসহ্য ব্যথী। শয়তানটাকে কামড়ে ধরার জন্যে। সরে গেলাম আয়নার কাছে। সারা মুখ আমার নখের আঁচড়ে অদ্ভুত এক রূপ নিয়েছে। আমার রূপের খ্যাতি ছিল। গায়ের রং-এর জন্য মা নাম রেখেছিলেন শেফালী। হঠাৎ করে কাপড় খুলে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেহটাকে ধোয়া দরকার। আমার অন্তর জানে সেখানে কোনও মালিন্যের ছাপ পড়ে নি। আমি চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ নিজের দিকে! কালকের আমি আর আজকের আমিতে আসমান-জমিন ফারাক। শেফা মরে গেছে, আর শেফালী আজ নীল অপরাজিতা। দেহের বর্ণ স্নান। কিন্তু যতক্ষণ জ্ঞান থাকবে, অন্তর থাকবে শুভ্র পবিত্র অম্লান। দরজায় চা নাশতা দিয়ে গেল সেই মহিলা। স্বাভাবিকভাবে খেতে পারলাম না। সমস্ত শরীরে দুঃসহ ব্যথা। কাগজ কলম চাইলাম। দিলো না। কথার উত্তরও দিলো না মেয়ে লোকটা। কিছুক্ষণ পরে দোপাট্টাহীন একটা সালোয়ার কামিজ দিয়ে গেল। আমার ছেড়ে দেওয়া সেই শাড়ি আমি আর দেখি নি।
পরের রাতে এলেন আরেকজন। গল্প করলেন। আমি ইংরেজি জানি দেখে খুব খুশি হলেন। কিছু শায়ের শোনালেন। কাংস্য বিনিন্দিত কণ্ঠে দু’এক কলি গজল পেশ করলেন। তারপর যথাকৰ্তব্য করে গেলেন। রাতের খাবার মুখে রুচলো না। ডাল রুটি পড়ে রইলো। বুঝলাম প্রতিদিন নতুন নতুন অতিথির মনোরঞ্জন করতে হবে। এই কি দোজখ? না, দোজখ দেখার তখনও অনেক বাকি। বদলি হতে লাগলাম এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। কখনও এক দল মেয়ের সঙ্গে, নানা বয়সী নানা রুচির, আবার কখনও একা নিঃসঙ্গ নিশ্চিদ্র কক্ষে, যেখানে রাত দিন বোঝা দুষ্কর। দিন চললো, কখনও কখনও জমাদারণীকে ধরে মাসের খবর জানতাম, কখনও তারিখ। একা কখনও ভাবতাম বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। সান্টু কি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পেরেছিলো? ও কি কখনও মার কাছে আসতে পেরেছিল? মা আর সোনালি বেঁচে গেছে। ওরা নিশ্চয়ই গ্রামে আছে। ভাবছে আমি ফারুকের সঙ্গে পালিয়ে গেছি। আমাদের গোপনে বোধ হয় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তা কি করে হবে? তারা তো জানতো আমি ওকে কোনও দিনই পছন্দ করতাম না।
চারদিক থেকে প্রায় রাতেই গোলাগুলির শব্দ আসে। ভাবি কোথায় এ যুদ্ধক্ষেত্র? কারা এ লড়াই করছে। এখানেও মত্ত অবস্থায় প্রণয়ী বলে শালা মুক্তি-শা-লাকে বহিন বলে আমার ওপর অকণ্ঠ্য কিছু গালি বর্ষণ করে। মাঝে মাঝে জমাদারণী, পাহারাদার ফিস ফিস করে কথা বলে। কান খাড়া করে শুনি। খুউব যুদ্ধ হচ্ছে। এরা হেরে গেলে তো মুক্তিরা আমাদের কুকুর দিয়ে খাওয়াবে। শেফার মগ্নচৈতন্য জেগে ওঠে। তাহলে মুক্তিদের জয়লাভের সম্ভাবনার কথা এরাও ভাবছে। আল্লাহ্ তুমি আলো দেখাও, আমার সান্টু যেন বেঁচে থাকে। আব্বা যেন ফিরে আসেন। মা সোনালি… হঠাৎ কয়েক ফোঁটা পানি শেফার গাল বেয়ে নামে। কি সব ভাবছে সে। সেই দিনই হঠাৎ ওদের পাঁচ-ছয়জনকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেল। শেফা ভাবলো মারতে নিয়ে যাচ্ছে। শেফার জীবন সম্পর্কে আর কোনও মায়া বা মোহ নেই এ দেহের খাঁচাটা থেকে মুক্তি পেলেই সে বেঁচে যাবে। কিন্তু তার যে বড় আশা একবার শুনে যাবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, একবার প্রাণভরে শুনবে ‘জয় বাংলা’। পর্দা বাঁধা ট্রাক তবুও শীত করছে। দু’জন সেপাই কম্বল ফেলে দিলো ওদের গায়ের ওপর। ট্রাক চলছে তো চলছেই। ট্রাকের আলোও মাঝে মাঝে ড্রাইভার নিভিয়ে ফেলেছে। মনে হয় শেফা ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটা অন্ধকার জায়গায় থামলো অবশেষে ট্রাকটা। কে একজন ভারি গলায় হুকুম দিলো, ব্যাংকার মে লে যাও। যাও জলদি যাও। তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো একটা সুড়ঙ্গে ঢুকলাম। এটাই তাহলে ব্যাংকার। ভেতরে ত্রিপলের ম্যাট্রেস। দু’একটা খাঁটিয়া আছে। পানির কলসী, গেলাম। কিছু স্তূপাকৃত কম্বল। শেফা ভাবলো তাহলে কি জ্যান্ত কবর দেবে এখানে? দিতেও পারে। পরে শুনেছে ওরা অনেককে জ্যান্ত কবর দিয়েছিল। পানির কলসী আর গ্লাস দেখে বুঝলো,, ওদের বাঁচিয়ে রাখা হবে নইলে পানি কার জন্য। এরপর সময়টা শেফা স্মরণ করতে পারে না। বোধ হয় চায়ও না। সে কি যন্ত্রণা। কোনও দিন খাবার আসতো, কোনো দিন না। অনেক সময় পানিও থাকতো না। হঠাৎ করে একদিন এসে সবার জামা কাপড়, যদিও সেগুলো শতচ্ছিন্ন এবং ময়লায় গায়ের সঙ্গে এঁটে গিয়েছিলো তা টেনে হেঁচড়ে খুলে নিয়ে গেল। সম্পূর্ণ নগ্ন অমরা। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছি না। দিনের বেলা ব্যাংকারে ঢোকার পথ দিয়ে কিছুটা আলো আসে। আমার মনে পড়ে তখন শীতের দিন ছিল। অপর্যাপ্ত কম্বল থাকায় এক কম্বলের নিচে দুতিন জন জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম। কিন্তু রাতের সাথীরা যেন এখন বন্যপশুর মতো আচরণ করছে। অবশ্য অনেক সময় রোজ তারা আসেও না।
বুঝতে পারে শেফা, কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হলো দূর থেকে তার সেই চিরকাঙ্ক্ষিত ধ্বনি, ‘জয় বাংলা’ শুনতে পাচ্ছে। বিশ্বাস হয় না শেফার। আগেও কয়েকবার এমন ধ্বনি তার কানে এসেছে। কিন্তু পরে দেখেছে ওটা মনের ভ্রান্তি। কিন্তু কি হচ্ছে, দুপদাপ শব্দে কারা যেন দৌড়োচ্ছে। তবে কি পাকিস্তানিরা পালাচ্ছে। বাংকারের মুখ দিয়ে এখন যথেষ্ট আলো আসছে। জয় বাংলা’ ধ্বনি আরও জোরদার হচ্ছে। শেফার মনে হলো সান্টু তাকে নিতে আসছে। কিন্তু বাংকারের মুখের কাছে যাবে কি করে। ওরা যে উলঙ্গ।
হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা, চেঁচামেচি কানে এলো। একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করলো, কই হ্যায়। ইধার আও। মনে হলো আমরা সব এক সঙ্গে কেঁদে উঠলাম! ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করলো। কয়েকজনের মিলিত কণ্ঠ, এবারে মা, আপনারা বাইরে আসুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এতো লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ প্রথম আওয়াজ দিয়েছিলো, কোই হ্যায়, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতোটুকু সম্ভব আবৃত করলেন। ভেতরে আরও ছয়জন আছে বলায় আশপাশ থেকে কিছু লুঙ্গী, শার্ট যোগাড় করে ওরা একে একে বেরিয়ে এলো এবং ওদের কোনো রকমে ঢাকা হলো। আমি ওই শিখ অধিনায়কাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠলাম। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘রো মাৎ মায়ি।’ আমাদের একটা জিপে তুলে নিয়ে যেখানে আনা হলো তা একটা হাসপাতাল। আমাদের গায়ে ঘা, চামড়ায় গুঁড়ি গুঁড়ি উকুন! মানুষের মাথায় উকুন হয় জানতাম, গায়ে হয় জানতাম না। একে একে ওয়ার্ড মেইডরা এসে আমাদের গরমপানি সাবানে স্নান করালো। আমার মাথার চুলগুলো কেটে দিতে বললাম। মেয়েটি প্রায় আমার বয়সী, খুব সহানুভূতির গলায় বললো, এতো সুন্দর চুল কাটবে কেন দিদি? দু’তিন দিন পর পর শ্যাম্পু করে আমিই জট ছাড়িয়ে দেবো। ধুলো বালি মাথায় ভর্তি তো তাই এমন হয়েছে। অবাক হলাম। এমন সহানুভূতির সুরেও মানুষ কথা বলে? ভাবলাম তাইতো আমি তো বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে বনে ছিলাম। সভ্য মানুষের ভাষা ভুলে গেছি। প্রাথমিক চিকিৎসা নার্সই দিলো। তৃতীয় দিনে ডাক্তার দেখলেন, আমি নিজেই বললাম, ডক্টর আমি বোধ হয় অন্তঃসত্ত্বা ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি ওর হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেল্লাম, আমাকে বাঁচান। আমি এ পশুর বীজ দেহে রাখতে চাই না। ডাক্তার গম্ভীর কিন্তু কণ্ঠে সহানুভুতি, না না আপনার কোনও ভয়ের কারণ নেই, প্রাথমিক অবস্থা, আমরাই ব্যবস্থা করে দেবো।
দিন দশেকের ভেতর আমি পাপমুক্ত হলাম। শেফা বেঁচে উঠলো, জেগে উঠলো। এবার কবে যাবো আমরা? দেরি হলো না। মাসখানেকের ভেতর আমরা সুস্থ হয়ে ঢাকায় এলাম। অনেকের দেহেই অনেক ব্যাধি প্রবেশ করেছে। তাদের সব আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। ঢাকায় আমি এলাম ধানমন্ডিতে একটা বাড়িতে, নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আমার মতো হতভাগিনীদের প্রাথমিক অবস্থায় এখানেই আনা হতো। তারপর খোঁজ খবর করে আত্মীয় স্বজন পেলে তারা কেউ আপনজনের কাছে চলে যেতো আর কেউবা সরকারের আশ্রিত হিসাবে ওখানেই থাকতো। আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাবাকে চিঠি লেখা হলো। বাবা পাগলের মতো ছুটে এলেন। সঙ্গে মা আর সোনালি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমাদের বিরামহীন কান্না শুরু হলো। সান্টু ভালো আছে তবে এখনও স্থির হয়ে ঘরে থাকে না। আব্বা বললেন, কলেজ খুললে উন্মাদনা কমলে আপনিই ঠিক হয়ে যাবে, ওর জন্যে ভাবি না। চিন্তা ছিল তোর জন্যে, তোকে পাবো ভাবি নি। ওখানকার অফিসারকে বলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে এলাম। একটা হোটেলে পেট ভরে খেলাম।
বাবা বললেন, চলো মা আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাই। আমি তো এক পায়ে খাড়া। সংসদ ভবনের কাছে লেকের পাড়ে বসে আমার কাহিনী শোনালাম। ওরা হাপুস নয়নে কাঁদছেন আর সোনালি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। ফিরে এলাম পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কিন্তু ডাক্তার বাবাকে ডেকে কি যেন বললেন। বাবা রাজি হলেন। আমার একটা চিকিৎসা চলছে। আরও মাসখানেক লাগবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে। বাবা কি বাড়িতে আমাকে নিয়ে চিকিৎসা করাবেন, না এখানে থেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবো। আমি জিনিসটা বুঝলাম। বাবাকে বোঝালাম, বাবা এরা আমার অনেক যত্ন করেন। এই বিদেশী ডাক্তাররা দিন-রাত আমাদের কতো যত্ন করছেন। দশ মাস গেছে বাবা আর একটা মাস থাকি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই যাবো। মা চোখের জল মুছলেও শেষ পর্যন্ত হাসি মুখে ফিরলেন। বাবাকে বললাম, সান্টুর দিকে লক্ষ্য রেখো ও যেন বাউণ্ডুলে না হয়ে যায়।
ওরা চোখের বাইরে চলে গেলে শেফা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো সে আর কোনো দিন ওই পরিবারে ফিরে যাবে না। গেলেও সে অস্পৃশ্য হয়ে রইবে। দস্যরা তার এতো বড় ক্ষতি করে গেল! অবশ্য ডাক্তাররা বলেছেন গুরুতর কিছু হয় নি। মাস খানেক নিয়মিত চিকিৎসা করলেই সে তার সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন ফিরে পাবে। ভয়ের কোনও কারণ নেই।
শেফাদের বাড়ির কাছে একটা টাইপ শিখবার স্কুল ছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর কোনও কাজ হাতে ছিল না, শেফা ভর্তি হয়ে গেল ওখানে। ফলাফল বেরুবার পরও কলেজে ভর্তি হওয়া, ক্লাশ শুরু করতে আরও মাস তিনেক গেল। দু’মাস একটানা সেখানে নিয়মিত টাইপ শিখেছে। পরে সে আব্বাকে সার্ভিস দিতে এবং দু’দশ টাকা রোজগারও করতো। আব্বাকে অনেক আর্জি লিখতে হতো, বাইরে থেকে ভুল ভালো টাইপ করিয়ে আনতো বাবার কেরানী। বাবা রেগে যেতেন। পরে এ কাজটা শেফাই করতো।
তেমনি এখনও হাতে কোনো কাজ নেই। ওসব সেলাই এমব্রয়ডারী শিখতে ওর ভালো লাগে না। একদিন ও চুপি চুপি চেয়ারম্যান সাহেবের ঘরে ঢুকলো। কতোদিন ভেবেছে মোশফেকা আপাকে বলবে, কিন্ত্র ওকে তার বড় ভয়। উনি কখনও তাদের সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলেন না। অথচ বাসন্তী আপা, পরে জেনেছি উনি শহীদ ডঃ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার স্ত্রী, একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, নীলিমা আপা প্রায়ই এসে আমাদের সঙ্গে নানা গল্প করতেন। বাবা-মার কথা, নিজেদের এলাকার কথা, ভবিষাতে কি করতে চাই এসব কথা, কিন্তু দুজনেই ভুলেও কখনও আমাদের দুঃখ আর নির্যাতনময় জীবনটার কথা তুলতেন না। তবুও আমি নীলিমা আপার কাছে অনেক কথা বলেছিলাম। এমনকি ফারুক ও তার বাবার পরিচয়ও দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নি। ফারুকরা নাকি একজন ক্ষমতাশালী মন্ত্রীর আত্মীয়। তবুও সান্ত্বনা দিতেন, মন খারাপ করো না। আজ না হোক কাল ওর বিধান হবে। আল্লাহ এতো নিষ্ঠুর নন!
চেয়ারম্যান সাহেবকে সালাম দিয়ে দাঁড়াতেই উনি খুব মিষ্টিভাবে বললেন, কি চাও? আমাকে কিছু বলবে? মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। বললেন, বলো। বললাম, মার আমি মোটামুটি টাইপ জানি। আপনার এখানে কাজ করতে চাই। আমার বসে থাকতে ভালো লাগে না। উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। কতোদূর পড়াশুনা করেছি ইত্যাদি বলে মোশফেকা আপাকে ডেকে পাঠালেন। মোশফেকা আপা খুশি হয়ে বললেন, স্যার কাজ দিয়ে দেখি কেমন করে, তারপর বেতন… আমি কথা শেষ করতে দিলাম না। বললাম, না। আমি বেতন চাই না। দুজনেই হাসলেন। চেয়ারম্যান সাহেব শুনেছি হাইকোর্টের একজন জজ। পরে অবশ্য নাম জেনেছি। বিচারপতি কাজী সোবহান।
পরদিন সকাল আটটা থেকে আমার কাজ শুরু হয়ে গেল। কাজ দেখে দু’জনেই খুশি। মাঝে মাঝে বাসন্তী আপা আমার মেশিনটীয় বসতেন। ওঁর স্পিড খুব ভালো ছিল। আমাকে এটা ওটা নির্দেশ দিতেন। আমার সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিলো। মনে হতো আমি কলেজেই আছি। অতীত যেন একটা সাময়িক দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ একদিন ডাক্তার বললেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারি। অফিস থেকে বাবাকে চিঠি লিখেছিলাম। তৃতীয় দিনেই বাবা এসে হাজির। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমাকে নিয়ে এলেন একটা বেবীট্যাক্সিতে। প্রথম ধাক্কা খেলাম ওখানেই। বেবীট্যাক্সিওয়ালা বছর ত্রিশের এক যুবক। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনের মাইয়া? অন্যমনস্কভাবে সংক্ষিপ্ত জবাবে বললেন, হুঁ। তারপরই এলো একেবারে বিকট বোমা। ও বীরাঙ্গনা বুঝি। আঃ হাঃ হালারা এক্কেরে জানোয়ার। কি যে কইরা গেছে। ও বলে চললো আমি আর আব্বা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। সম্ভবত বেবীওয়ালা ও পাড়ায় পরিচিত এবং ও বাড়িতে কারা থাকে জানে। সোজা কমলাপুর স্টেশনে। তারপর ট্রেনে। এতোক্ষণ আব্বা কোনও কথা বলেন নি। ট্রেন ছাড়লে যেন তার মোহগ্রস্ত ভাবটা কাটলো। বললেন, আহা, খেয়ালই ছিল না, তোর নিশ্চয়ই খুব খিদে লেগেছে। দেখি পরের স্টেশনেই তোকে কিছু কিনে দেবো। আমি না বলে মাথা ঝাঁকাতেই কেঁদে ফেললাম। আব্বা আমার মাথাটা বুকের ভেতর নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বিড় বিড় করে কি যেন বললেন। মনে হলো ক্রমাগত বলছেন, ওটা একটা দুঃস্বপ্ন। কিছু হয় নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিকেল নাগাদ আমরা বাড়ি পৌঁছোলাম। সোনালি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়া এগিয়ে এসে আমার হাতটা খুব শক্ত করে ধরলো। বললো, আপা কিছু ভাবিস না। আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি, কোনও চিন্তা করিস না। হেসে বললাম, তোর হাতটা কিন্তু খুব শক্ত হয়ে গেছে। ও শিশুর মতো জোরে হেসে উঠলো। আরে একি যে সে হাত, স্টেনগান ধরা হাত! মুক্তিযোদ্ধার হাত। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো, অবশ্য আমার গৌরব করবার মতো কিছু নেই। নিজের বোনকেই হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি নি। আমি হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলাম। দেখলাম পুরোনো কাজের লোক দু’জন নেই! সম্ভবত আমার কারণেই ওদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আমি কাপড় জামা ছাড়িতে গিয়ে দেখি এ দশ মাসে সোনালি অনেক বড় হয়ে গেছে। সুন্দর করে, যেমন আমি করতাম ঘর গুছিয়ে রেখেছে, এমনকি আমি এসেই পরবো ভেবে ওর পছন্দ করা শাড়ি, ব্লাউজও বের করে রেখেছে। ও অবশ্য এখনও শাড়ি পরে না। তবে সালোয়ার কামিজ দেখলাম না, পরে আছে স্কার্ট, ব্লাউজ। ওর ছোট মনের প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ সম্ভবত এই বেশ পরিবর্তন।
খাবার গুছিয়ে মা তাকালেন। কতোদিন, কতোদিন পর আবার ওরা একসঙ্গে খেতে বসেছে। মা এটা ওটা শেফার পাতে তুলে দিচ্ছেন। শেফা হেসে বললো, আমি কি মেহমান নাকি? এমন করে আমাকে তুলে দিচ্ছ কেন? মা হঠাৎ মুখে আঁচল তুলে দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। সবার হাত থেমে গেল। আব্বা হেসে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, দু’চার দিন একটু কষ্টতো সবারই হবে। একটা বড় অসুখ থেকে উঠলেও তো পরিবারে একটা বিপর্যয় আসে, আসে না? এবার সোনালি ফোড়ন কাটে। চিৎকার করে বলে, আম্মা আমরা টেবিল ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার সব খাবার পড়ে রইলো। সোনালি বেশ পাকা হয়ে উঠেছে। ওর ধমকে কাজ হলো। মা মুখ মুছে নিজের জায়গায় বসলেন। হাসি গল্পে খাওয়া শেষ হলো। মনে হলো যেন ঈদের সকাল। রাতে শুয়ে শুয়ে দু’জনে কত গল্প। শেফাকে না দেখে মা নাকি বিশেষ চিন্তিত হন নি। সোনালিকে বলেছিলো দেখিস, আমরা বাড়ি পৌঁছোবার পর ওরা এসে হাজির হবে। চারদিকের গোলমাল দেখে ফারুক ভয় পেয়েছে। ও সম্ভবত কাজী অফিসে গেছে। শেফাকে বিয়ে করেই ফিরবে। ওর বাবা যে মেজাজী, জানতে পারলে ছেলেকে আস্ত রাখবে না। কিন্তু রাত গেল দিন এলো, দিনের পর দিন গেল। মা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। আব্বা চলে যাবার জন্য খবর পাঠালেন কিন্তু তোমাকে ফেলে আমরা যাবো কি করে? আব্বাকেই-বা মা কি জবাব দেবেন। বাড়ির লোকদের বলেছেন সামনে ওর পরীক্ষা তাই আব্বার এক বন্ধুর বাড়িতে ওকে রেখে এসেছেন। কিন্তু দুঃসংবাদ চাপা থাকে না। গ্রামে খবর পৌঁছোলো শেফাকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। মা শেষ পর্যন্ত ছোট খালার শ্বশুর বাড়ি গেলেন। ভাইয়ারও কোন খবর নেই। শেফাকে ওরা নিশ্চয়ই মেরে ফেলেছে। শুধু আব্বা ভালো আছেন। এটুকুই আমার সান্ত্বনা ছিল। তবে মা যতোটা ভেঙে পড়বেন ভেবেছিলাম, মা কিন্তু পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন বেশ শক্তভাবেই। কখনও কাঁদতেন না, আর আমার নাম ভুলেও উচ্চারণ করতেন না। কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছিলেন। সকালে অনেকক্ষণ কোরান তেলাওয়াত করতেন। নফল নামাজও বেড়ে গেল। মনে হতো আম্মা সব আশা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহকে দু’হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছেন। এমনিভাবেই দীর্ঘ ন’মাস কেটে গেল। যুদ্ধ শেষ হলো। আব্বা ফিরে এলেন খুশি মনে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাইয়ার সঙ্গে ওখানেই দেখা হয়েছিল! ছেলে মুক্তিযোদ্ধা এটাও তার একটা বড় গর্ব। ফিরে এসে আম্মাকে দেখেই আব্বা আঘাত পেলেন। একি শেফার আম্মা, কি হয়েছে তোমার? অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? তারপর মা চোখের জলে আব্বাকে সব বললেন। কিছুক্ষণ কঠিন শিলার মতো স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললেন, চলো, আজই বাড়ি ফিরে যাবো। আমরা শহরের বাড়িতে ফিরে এসে দেখি বাড়ির জানালা দরজা ছাড়া আর কিছু নেই। ফার্নিচার, বইপত্র এমন কি ইলেকট্রিকের তারগুলোও পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে দস্যুরা। না পাকিস্তানিরা এসব করে নি, করেছে পাড়ার লোকেরা। কেউ কেউ ভালো মানুষ হয়ে এটা ওটা, যেমন টেলিফোনটা ফেরত দিয়ে গেলেন। আব্বাকে বললেন, লুটপাট দেখে আমি এটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। ভাইয়া তখনও এসে পৌঁছোয়নি। কিন্তু আব্বার শরীরে যেন হাতির বল এলো! লোকদের ডেকে ‘২/৩ দিনের ভেতর মোটামুটি বাড়ি বাসযোগ্য হলো। আব্বা আম্মাকে বললেন, এবার তোমরা নিরাপদে থাকো আমি শেফার খোঁজে ঢাকায় যাবো। কিন্তু ভাইয়া না ফেরা পর্যন্ত আম্মা আব্বাকে আটকে রাখলেন তার মুখে একটাই কথা, যা হবার তাতো হয়েছে। মেয়ে যদি বেঁচে থাকে ফিরে পাবো। কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না।
দিন পনেরো পর ফিরে এলো ভাইয়া, যেন একটা বেবুন। মুখ ভর্তি দাড়ি, গোফ, মাথায় বড় চুল। কিছুতেই সে এগুলো ফেলছে না। বাবা নিজে সেলুনে গিয়ে ওকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আনলেন। বললেন, দুঃখের দিন পার হয়ে গেছে। এবার মানুষের মতো বাঁচার সংগ্রাম করো। বইপত্র তো সব গেছে। যা পারো যোগাড় করে পড়াশুনায় মন দাও! শেফার জন্য কেউ মন খারাপ করো না। ও আমার মেয়ে, ওকে আমরা খুঁজে পাবোই। আমাদের ওপর আল্লাহর রহম আছে। এমন সময় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে আমার খবরসহ চিঠি এলো। আব্বার সে কি আনন্দ আর উত্তেজনা। যাবার আগে আমার পছন্দের মাছ পর্যন্ত মাকে কিনে দিয়ে গেলেন। ভাইয়া সঙ্গে যাবে জিদ ধরলো কিন্তু আব্বা নিলেন না। বললেন, মা বোনকে দেখো। বিপদ আমাদের এখনো কাটে নি। আব্বা চলে গেলেন। কিন্তু যখন একা ফিরে এলেন, আপা বিশ্বাস করবি না, রাত্রিতে মহরমের মাতম। বাবার মুখ থেকে কিছু শুনবার জন্যও আমরা অপেক্ষা করলাম না। ধরে নিলাম তুই-তুই মরে-হেসে বললাম, সোনা, আমি তো সত্যি অর্থেই মরে গেছি। ও লাফ দিয়ে উঠে আমার মুখ চেপে ধরলো তারপর আমার বুকে মাথা রেখে সে কি আর্তনাদ। মনে হলো এই দশ মাসের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাই সব উজাড় করে ঢেলে দিলো। সকালে চোখে মুখে রোদ লাগায় উঠে বসলাম। সোনালি তখনও ঘুমুচ্ছে। চোখের কোণে তখনও এক ফোঁটা পানি জমে আছে। আস্তে আস্তে আমরা স্বাভাবিক হতে শুরু করলাম। একদিন ভাইয়াকে বললাম, কলেজে যাবো। ও বারণ করলো। বললো, আপু আরও কটা দিন যাক। তোকে কেউ যদি অপমান করে আমি তো খুনাখুনি করে ফেলবো। অপমান করবে কেন? কি করেছি আমি? আমার কণ্ঠে বিস্ময়। ভাইয়া উত্তর দিলো, কিছু করলে তো তোকে দোষ দেওয়া যেতো। আমরা তোদের রক্ষা প্রতে পারি নি সেই লজ্জা আর দুর্বলতাকে চাপা দেবার জন্য তোদের ওপর অত্যাচার করতে পারি। তুই বুঝিস না আপু। মুক্তিযুদ্ধ এতো রক্ত নিয়েছে। কিন্তু আমাদের নোংরা স্বভাবটা ধুয়ে মুছে দিতে পারে নি। যত্তোসব রাজাকারের বাচ্চা। তবুও সাহস করে গেলাম কলেজে। ছেলে মেয়ে অনেকেই দৌড়ে এলো, কোথায় ছিলাম, কেমন ছিলাম। এখানে সবাই বলছে তোকে পাকআর্মি ধরে নিয়ে গেছে। যাক বাবা বেঁচে গেছিস। আর্মি ধরলে কি হতো বলতে? সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। না, সত্যি কথা এদের সামনে বলা যাবে না। কিন্তু আমি এ মিথ্যার বোঝা কেমন করে বয়ে বেড়াবো? এ মুখোশ কি সারাজীবন মুখে এঁটে থাকবো? ভাবলাম, আমাদের ঘরে পরিবর্তন না হলেও আমাদের চার দেওয়ালের বাইরের জগতটা অনেক উল্টে-পাল্টে গেছে। না শেফা আর বাইরে যেতে চায় না। দেখা যাক ওরা কতো দিন এসব নিয়ে নোংরামি করতে পারে।
এর ভেতর একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এলো। ছোট চাচার শালীর বিয়ে। বিয়েতে সব আত্মীয়ই নিমন্ত্রিত হয়েছেন। কিন্তু আমরা হই নি। চাচার কানে কথাটা গেছে। চাচা এসে আম্মাকে জিজ্ঞেস করে গেলেন। তারপর কিছু না বলে চাচীকে তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছেন। এই বিয়েতে শুধু নিজে যান নি তাই নয়, চাচি ও তাঁর দু’ছেলে-মেয়েকেও যেতে দেন নি। চাচার শশুর এসে আব্বার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। মেয়ের বিয়ে নানাজনে নানা কানা ঘুষা করছিল বলে উনি আমাদের দাওয়াত দিতে সাহস পান নি। এজন্য চাচা নাকি ওকে যথেষ্ট অপমান করেছে। বাবা বললেন, শেফা ওর ভাইয়ের মেয়ে তার সম্পর্কে কুৎসা করলে ওর তো লাগবেই। কিন্তু আমার কাছে আগে আসেন নি কেন, তাহলে তো আপনার মেয়ের বিয়েতে যেতে পারতো। চাচার আরও রাগ ছিল। চাচা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন। চাচি তার বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিল, তার বাবা আশ্রয় দেন নি। চাচি শেষ পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে খালার বাড়িতে ছিলেন। চাচা অসম্ভব পেয়ার। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আপাতত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম। বুঝলাম এমনি করে একটার পর একটা ঝড় ঝাপ্টা আসবে, আমার জন্য আব্বা যন্ত্রণাকাতর হবেন। তার চেয়ে আমি যদি ঢাকা গিয়ে একটা কাজ দেখে নিই তাহলে বিএ পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়ে যাবে, কিছুদিনের জন্য আব্বাও একটু স্বস্তিবোধ করবেন।
চিঠি লিখলাম মোশফেকা আপার কাছে, আমি গেলে আমার চাকুরিটা পাবো কিনা। উনি উৎসাহ দিয়ে লিখলেন চাকুরি আরও খালি আছে। আমি বিনা দ্বিধায় ঢাকা আসতে পারি। আমি সব সংকোচ বিসর্জন দিয়ে আব্বার সঙ্গে সরাসরি কথা বললাম। সব ব্যাপারে বুঝিয়ে বললাম। আব্বা কোনও প্রতিবাদ করলেন না। এর ভেতর আব্বা আরেকটা আঘাত পেলেন। আব্বা এক বন্ধু এমপি’র কাছে ফারুকের ও তার বাবার অপকীর্তির কথা জানিয়ে কিছু প্রতিকার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু এমপি সাহেব অপারগ, কারণ ফারুকরা একজন বড় নেতার আত্মীয় তাই ওরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আব্বা এই প্রথম দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, শেফার মা, এ বয়সে যুদ্ধে গিয়েছিলাম কেন? এই দেখে ক্রল করে করে আমার কনুইতে কেমন ছাল উঠে চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। আমরা সবাই কেঁপে উঠলাম। আব্বা তাহলে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে এসেছেন? আজ তিনিও এত অসহায়! ঠিক করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে যাবেন। কিন্তু আম্মা বাধা দিলেন। বললেন, তার মাথায় রাজ্যের বোঝা, কি হবে আমাদের দুঃখের কথা তাঁকে জানিয়ে? আব্বা বললেন, তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি এর একটা বিহিত করবেনই। আব্বা নাছোড়বান্দা। গেলেন এবং ফারুকের বাবার ডিমোশন করিয়ে এলেন। আব্বার সেকি আনন্দ। মনে হলো এতোদিনে তিনি যুদ্ধ জয় করে এলেন। আমার কেন জানি না একটা তৃপ্তি এলো।, বিচার আছে। স্বাধীন বাংলায় মানুষ বিচার পাবে। তবুও আমি চলে গেলাম।
ঢাকায় দেড় হাজার টাকা মাইনের স্টেনো-টাইপিস্টের চাকুরি পেলাম রেডক্রসে। আমার চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা। মা ছাড়া কখনও আমাদের নাম ধরে ডাকে নি। ঠিক আব্বার মতো স্নেহ পেয়েছি সেখানে। ওই বাড়িটাতে অনেক অফিস ছিল। লিফটে ওঠানামার সময় অনেকের সঙ্গেই দেখা হতো। নিত্য দেখার পরিচয়ে কখনও-বা মৃদু হাসি বিনিময় বা আসোলামু আলাইকুম কিম্বা কেমন আছেন পর্যন্তও হতো। লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় বাড়তে লাগলো। একদিন দুপুরে লাঞ্চে ডাকলেন পূর্বাণীতে। এর আগে ঢাকায় এতো বড় হোটেলে আমি কখনও খাই নি। নিজেকে বেশ অভিজাত বলে মনে হলো। ধীরেধীরে আমার সব কথাই ভদ্রলোককে বললাম। তিনি শুনে কষ্ট পেলেন। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। বাবা আছেন। আরও দু’ভাই আছেন। একজন ওর বড়, একজন ওর ছোট। বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি ধানমন্ডিতে থাকেন। আর ওঁরা দু’ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর একবোন বনানীতে বাবা-মার সঙ্গে থাকেন।
যুদ্ধের সময় তারা তিন ভাই’ই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ছোটভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ওরা বিশেষ কিছু করেন নি। বাবা-মা এখানেই ছিলেন। কয়েকদিন গ্রামে গিয়েছিলেন। ওঁদের কোনো অসুবিধা হয় নি। ব্যবসা-বাণিজ্য সবই বন্ধ ছিল। এখন আবার নতুন করে শুরু করেছেন। তিনভাই ব্যবসায় অংশীদার, তবে পৃথক পৃথক কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসা বড় দু’ভাইয়েরই আছে। সেদিন বড়দিন, হঠাৎ ভদ্রলোক, ধরুন ‘ইমাম’ আমাকে দাওয়াত দিলেন সন্ধ্যায় ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতে। আস্তে আস্তে আমার সাহস আর লোভ দুটোই বেড়ে গেছে। দাওয়াত খাওয়ার পর গল্প করতে করতে তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। লজ্জায়, ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম। বার বার প্রশ্ন করায় বললাম, আমার আব্বাকে বলুন। কারণ তার মতোই সবার উপরে। ইমাম বললেন, আগে তোমার মতটা বলো, বলো রাজি। ঘাড় নাড়তেই পকেট থেকে ছোট একটা আংটির বাক্স বের করে আমার হাতে ছোট্ট একটা ডায়মন্ড বসানো আংটি পরিয়ে দিলেন। বেইলী রোডের হোস্টেলে পৌঁছে দেবার সময় ওর উষ্ণ ওষ্ঠ আমার ঘাড় স্পর্শ করলো। আমি হাল্কা পালকের মতো উড়তে উড়তে হোস্টেলে ঢুকলাম। রুমমেট আগেই জানতো আমি কোথায় গেছি। হাতের আংটি দেখে বললো, নিশ্চয়ই সব সেরে এলি, আমাদের করবার জন্যে আর কিছুই রাখলি না। নে মিষ্টি খা। একখানা মিষ্টি দু’জনে ভাগাভাগি করে খেলাম।
আমার রুমমেটের নাম জয়া। ও হিন্দুর মেয়ে। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওরও একই অবস্থা। ওকেও বাংকার থেকে বের করে এনেছিল মুক্তিবাহিনী। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে সেখানে পড়ে আছে শুধু ছাই। ওদের মেরে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সব। পুড়িয়ে দেয় ওর মা আর দু’ভাই বেঁচেছিল। ওরা পরে ভারতে চলে গেছে। আর ফিরবে কিনা জানে না। তবে এখন জয়ার সঙ্গে পত্রালাপ হয়। সে তো জানে পারিবারিক জীবনে এ কতো বড় ক্ষত। জয়া বলে আমি জন্ম বিধবা হিসাবে জীবন কাটাবো। কারণ হিন্দু সমাজে আমি ব্যাভিচারিণী, তার উপর আবার মুসলমান দ্বারা ধর্ষিত। ও কিন্তু কথাগুলো বলে হেসে হেসে, মনে হয় যেন দু’চোখ উপচে পড়া জল ও হাসি দিয়ে আটকে রেখেছে। শেফার বুকটা কেঁপে ওঠে। ওদের যদি ও রকম সমাজ হত তাহলে ইমাম কি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে সাহস পেতো। সারাটা রাত শেফা ঘুমালো না। নানা রকম বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখলে। কেন এমন হলো। আব্বার চিঠি পেলো শেফা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে লিখেছেন আব্বা। শেফার বুকটা কেঁপে উঠলো, কে জানে কোনও আশংকাজনক কিছু হলো নাতো। যে তার কপাল কিছুই বলা যায় না। সোনালি ওকে টেনে নিয়ে বললো, আপু। তোর বিয়ে। বাবার কাছে দুলাভাই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। বাবা রাজি হয়েছে। এখন তার সাথে নাকি কি সব কথা বাকি। তাহলেই আর দেরি করা হবে না। দুলাভাইয়ের বাবা ফোনে কথা বলেছেন আব্বার সঙ্গে। আব্বাকে ঢাকা যেতে বলেছেন।
বাবা শেফাকে পরিষ্কারভাবে সব জিজ্ঞেস করলেন। ইমামের চরিত্র সম্পর্কে শেফার কি ধারণা তাকে কতো দিন ধরে চেনে ইত্যাদি। সব শেষে জিজ্ঞেস করলেন সে ইদানিং ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা, তার শরীর সুস্থ তো? শেফা ধীর স্থিরভাবে। আব্বার সকল প্রশ্নের উত্তর দিলো। মনে হয় আব্বা খুশি হলেন। বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু বিয়ে হবে ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে। এ শহরে এখনও আৰু সাহস পান না। আব্বা মনে হয় নিঃস্ব হয়ে মেয়ের বিয়ে দিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দলের অনেক গন্যমান্য বন্ধুরা এলেন। ইমামের আব্বা-আম্মা আত্মীয়-স্বজন সবাই এলেন। শেফা যা কখনও কল্পনাও করে নি। সেই সৌভাগ্যের ছোঁয়া সে পেলো। ইমাম তাকে স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা সবার উপরে সম্মান দিয়ে রেখেছে। ধর্ষিত শেফার সেটাই সব চেয়ে বড় আনন্দ। ছোট দেওর আমানও খুব হাসি খুশি। ভাবি ভাবি করে তাকে বিব্রত করে রাখে। বড় ভাশুর গম্ভীর মানুষ, জাও কথা কম বলেন। কিন্তু কারও আচরণেই তার কাছে কোনও অবহেলা বা ঘৃণার ছায়া দেখলেন না। শশুর তো মা মা বলে পাগল। এ সুখ কি সে কখনও কল্পনা করেছে। ননদ তো সর্বক্ষণ সঙ্গেই থাকে। ইমাম দ্রুত ব্যবসায়ে উন্নতি করতে লাগলো। অবশ্য পেছনে তার আব্বার সাহায্যও আছে। ও গুলশানে খুব সুবিধায় একটা জমি পেলো। তাই চট করে বাড়িও শুরু করলো। ইমামের আজকাল আসতে বেশ রাত হয়ে যায়। শেফা অনুযোগ করে তারও শরীর ভালো না। ইমাম অবশ্য ঠাণ্ডা মেজাজেই শেফাকে বোঝায় তার কাজ কতো বেড়েছে।
শেফা এক পুত্রসন্তানের মা হলো। বাড়িতে সেকি আনন্দ উৎসব। বড় ভাশুরের দুই মেয়ে তাই এ উত্সব আরও জাকজমকপূর্ণ। খুব তাড়াতাড়িই আকিকার ব্যবস্থা হলো। তিন-চারশ লোক দাওয়াত করলেন শ্বশুর। নাম রাখলেন আরমান। শেফা কিন্তু মনে মনে ওকে আরেক নামে ডাকে আর সোচ্চারে বলে যোগী, কেউ জানে না এ নামের পরিচয়। শুধু শেফা এ নামটা তার হৃদয়ে রক্ত দিয়ে লিখে রেখেছে। শ্বাপদশঙ্কুল অরণ্যে শেফা সেদিন একজন দেবদূত প্রত্যক্ষ করেছিল তার নাম যোগীন্দর সিং, যে তার পবিত্র শিরস্ত্রাণ খুলে শেফার অপবিত্র দেহটাকে সযতে ঢেকে দিয়েছিল আর কয়েকবার তাকে মাতসম্বোধন করেছিল। তাই তো শেফা মনে মনে যোগীন্দকে তার প্রথম সন্তান ভাবে। চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল কিন্তু তার মুখখানা শেফার স্মৃতিতে অম্লান। তাই তো আরমানকে যোগী ডেকে তাকে চুমুতে ভরে দেয়। মনে মনে বলে আল্লাহ্ যেন তেমনিই সারা জীবন মায়ের সম্মানের হেফাজত করে। শরতের নীল আকাশে শাদা পেঁজাতুলোর মতো হাল্কা ছন্দে ভেসে চলে শেফা, জীবনের এতো সুখ আছে তা কি কখনও সে ভাবতে পেরেছিল। আব্বা-আম্মা প্রায়ই আসেন। ইমাম সোনালির একটা বিয়ে ঠিক করেছে। ওর পরিচিত এক ব্যবসায়ীর ছেলে। ছেলেটা লেখাপড়ায় খুব ভালো। নিউক্লিয়ার ফিজিকস্ এ গবেষণার জন্য কমনওয়েলথ স্কলারশীপ পেয়েছে। সোনালিকেও নিয়ে যাবে, তাই আগামী মাসেই বিয়েটা হবে। তবে এবার আব্বা মেয়ে বিয়ে দেবেন তার নিজের জায়গায়। সামনে থাকবে বড় জামাই, সবাই দেখবে তার সৌভাগ্য। যারা একদিন টিটকারী দিয়েছিল, অজি তারা সালাম দেবে। রথের চাকা তো এমনি করেই একবার শূন্যে ওঠে একবার মাটি ছুঁয়ে। সত্যিই যাবার আগে বাবা জীবনে একটা পূর্ণতার স্বাদ পেয়ে গেলেন। ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ও বেরিয়ে এলে তার আর কোনও দায় দায়িত্ব থাকবে না।
বিয়ে হয়ে গেল! যতোটা আনন্দ সবাই প্রত্যাশা করেছিল সত্যিকার আনন্দ তাকে ছাড়িয়ে গেল! ইমামের বাবা মা ও ভাইয়েরা গিয়েছিল। আব্বা সবার জন্য হোটেল বুক করে রেখেছিলেন। তাই কারও কোনও কষ্ট হয় নি। তবে শেফা তার যোগীকে নিয়ে নিজের সেই পুরোনো শেফার ঘরেই রইল। এক সময় মেয়ে জামাই চলে গেল। ওরাও সবাই চলে এলো। সেই মেলা শেষের ভাঙা বাঁশি আর কলাপাতার মতো রইলেন শুধু আব্বা আর আম্মা। তারা যেন জীবনে পূর্ণতার স্বাদ পেয়েছেন।
হঠাৎ কি হলো বিনা মেঘে বজ্রপাত। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। ইমামের পরিবার ঐ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গবন্ধুকে তারা মহামানব মনে করে। ওর বাবা একেবারে ভেঙে পড়লেন। শেফার ভয় হলো আরও কিছু হবে নাকি। ইমাম একদিন অফিস খেকে ফোন করলো পুলিশ তাকে নিয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো শ্বশুর বেরুলেন। সন্ধ্যা নাগাদ ছেলেকে জামিনে বের করে আনলেন। অভিযোগ রাজনৈতিক নয় ব্যবসায়ে অসাধুতা। এর চেয়ে বেশি শেফা জানে না, জানতে চায়ও না। সে যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। রাজনৈতিক কারণে ওর জেল হলেও শেফার দুঃখ ছিল না। কারণ আব্বাকে বেশ কয়েকবার বছর দু’বছরের জন্য জেলে থাকতে সে দেখেছে। সেটা সম্মানের, কিন্তু এটা? ইমাম বোঝালো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকবার জন্যই এই নাজেহাল হওয়া! তার আব্বা আছেন। শেফার আব্বাও কম যান না। নিজের বাবার নাম এ ক্ষেত্রে উচ্চারিত হওয়াটা শেফা ঠিক সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলো না। তবে ইমামের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে সে চুপ করেই রইল। কয়েক দিন ইমাম ঘর থেকেই বেরুলো না। শেষ পর্যন্ত শ্বশুর ছেলেকে সঙ্গে করেই অফিসে নিয়ে গেলেন। বড়ভাই কেমন আলগা হয়ে দূরে সরে গেলেন। শ্বশুর দুঃখ পেলেও কিছু বলতে পারলেন না, কারণ বছরখানেক আগে ভাইয়ের ব্যবসার রীতিনীতি সম্পর্কে বাবার কাছে কিছু অনুযোগ করেছিলেন। কিন্তু শ্বশুর তা কানে তোলেন নি। আজ শেফার মনে হলো ভাশুর অপেক্ষাকৃত সৎ, তা না হলে তিনিও তো ওই একই পিতার সন্তান। রাজনৈতিক কারণ হলে দু’জনকেই তারা ধরতো। দুর্বল মুহূর্তে শেফার মনে একটা ছোট্ট পিপড়ার কামড়ের মতো সন্দেহের কাটা বিধলো। সত্যিই তো, রাতারাতি ব্যবসায়ে এমন কি জোয়ার এলো যে অতো বড় আলিসান বাড়ি ইমাম করে ফেললো। না শেফা আর ভাবতে পারে না। যোগীকে নিয়েই তার দিন আর অর্ধেক রাত কেটে যায়। ইমাম আরও দেরি করে ফিরতে শুরু করলো! বলে পার্টিকে এন্টারটেইন করতে হয়। বাচ্চা নিয়ে কষ্ট হবে বলে আগের মতো বাড়িতে আর পার্টি দেয় না, হোটেলেই সারে। কিন্তু মাস ছয়েক কাটবার পর সে আবার বাড়িতে পার্টি দিতে শুরু করলো। শেফার সেজেগুজে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। রিসিভ করতে হয়। খাওয়া দাওয়ার তদ্বির করতে হয়। যদিও তার মনটা পড়ে থাকে যোগীর বেবী কটের কাছে, সেখানে আজ তার জায়গায় আয় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটুকু না করলে ইমামের মনটা ছোট হয়ে যায়। তাছাড়া আজকাল ওর কিছু কিছু ব্যবহার শেফার ভালো লাগে না। কিন্তু এ নিয়ে আপত্তি করতে তার মন চায় না। একেক সময় নিজের মনেই ভাবে, তার অনেক ত্রুটি ইমাম নিঃশব্দে গ্রহণ করেছে। সুতরাং তার দোষত্রুটি, সামান্য ব্যবহার নিয়ে নাই-বা অশান্তি করলো সে। এতো কিছু পেয়েও আজকাল নিজেকে মাঝে মাঝে বড় শূন্য মনে হয়। কেন এমন হয় জানে না। সে কি অতি লোভী? এতো কিছু পেয়েও তার ভোগ তৃষ্ণা মিটলো না? কে জানে কোথায় কি গরমিল যেন হয়ে গেছে। হয়তবা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু তার ও তার পিতৃপরিবারে একটা প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে।
ইমামের অর্থের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ে কোনো চাপ সৃষ্টি হয় নি। তাই খুব তাড়াতাড়ি ওরা সামলে উঠে আবার খাওয়া দাওয়া গান বাজনায় মেতে উঠেছে। আমানের গান বাজনার সখ। মাঝে মাঝে বাড়িতে জলসা বসায়। তখন শেফার খুব ভালো লাগে। তবে ইদানিং দু’ভাইরই খাদ্যের থেকে পানীয়ের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। বাড়িতে বেশ একটি বড়ো সড়ো বার কর্ণার করে ফেলেছে। প্রথম প্রথম দু’একবার শেফা আপত্তি করেছে। ইমাম বলে, তুমি তো উকিলের মেয়ে। ব্যবসায়ীদের এসব প্রয়োজন হয় পার্টির কাছ থেকে কাজ পাবার জন্য। ইদানিং বেশ কিছু আর্মি অফিসার আসে তাদের বাড়িতে। ওরাও নাকি ব্যবসা করে। চাকুরিতে থেকে মিলিটারী অফিসাররা কেমন করে ব্যবসা করে শেফা ভেবে পায় না। নিশ্চয়ই অসভাবে অর্থোপার্জন করে। ইমামদের সুবিধা করে দেয়, নিজেরা কমিশন পায়।
শেফার ভয় করে তার যোগী পবিত্র থাকবে তো? সেও কি পৈত্রিক ব্যবসায় নেমে এমনিই উশৃঙ্খল হয়ে যাবে? কাঞ্চন মূল্যে পৃথিবীকে বিচার করবে? ইমাম মাঝে মাঝে শেফাকে অনুযোগ করে সে এমন ঠাণ্ডা হয়ে গেল কেমন করে, মনে হয় তার কিছুই ভালো লাগে না। শেফা বলেছিল, তুমি ঠিক ধরেছো। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করে, ভালো লাগে না। ইমাম হঠাৎ কেন জানি না রেগে গেল। সাধারণত সে শান্ত স্বভাবের। বললাে, তুমি সব সময় আমার আর্মির পার্টনারদের নিয়ে নানা কথা বলাে। এ তােমার কেমন স্বভাব। কোন দিন পাক আর্মি তােমার সঙ্গে কি ব্যবহার করেছিল তুমি সব সময় ওটাই মনে করবে। এরা বাঙালি, এদেশের ছেলে, বােঝ না কেন? শেফা উত্তর দেয় না। শুধু বলতে ইচ্ছে করে, যে ধর্মের যে জাতের হােক না কেন খাকি কাপড় গায়ে তুললেই মানুষের মনুষ্যত্ব বােধ কমে যায়। কারণ এদের ভেতর সবাই কিন্তু ভালাে মানুষ নয়। সে একজন যুবতী মহিলা। পুরুষের দৃষ্টির ভাষা সে পড়তে পারে। ওর ননদ আজকাল এলে সকালের দিকে আসে। বলে, তােমাদের বাড়ির সন্ধ্যার আড্ডা আমার ভালাে লাগে না ভাবি। দিন গড়ায়, শেফার কোলে একটি মেয়ে এসেছে । শেফা নাম রেখেছে, কুন্দ। অবশ্য আকিকায় একটা লম্বা চওড়া নাম রেখেছেন শ্বশুর। যােগীর এখন ছ’বছর, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যায়। শেফা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে, যােগী তাের নামের মর্যাদাটা রাখিস বাবা। আমার জন্মের ঋণ যেন শােধ হয়।
ছােটভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা ফার্মে যােগ দিয়েছে। বিদেশে যাবার চেষ্টায় আছে। সােনালির স্বামী দায়িত্ব নিয়েছে। হয়েও যাবে, সময়ের অপেক্ষা। ও মাঝে মাঝে আসে। যােগীকে নিয়ে খুনসুটি করে। কুন্দকে নাচায়, গল্প সল্প করে খাওয়া দাওয়া করে চলে যায়। বাবা মার নিঃসঙ্গতার জন্য দু’জনেই দুঃখ করে। কিন্তু কিবা করতে পারে তারা। সেদিন কথা প্রসঙ্গে খুব সংকোচের সঙ্গে বললাে, আপা দুলাভাইকে তুই কিছু বলিস না? এতাে বেশি ড্রিঙ্ক করে যে লােকে নানা কথা বলে । তার চেয়েও বেশি স্ক্যান্ডাল আর্মির সঙ্গে এতাে দহরম মহরম কেন? এই আর্মিই আমাদের জীবনটা শেষ করতে বসেছিল । শেফা গম্ভীর হয়ে বললাে, সেন্টু যার যাতে ভালাে লাগে তাই ভালাে। সে যদি আর্মি নিয়ে নেচে সুখ পায় পাক। তবে এ নিয়ে আমি একদিন মৃদু আপত্তি করেছিলাম, বেশ ক্ষুন্ন হলাে। আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার কেন জানি না কিছু ভালাে লাগে না। মনে হয় কিছু একটা অঘটন ঘটবে। অঘটনের বাকি আছে কি? ১৯/২০টা কু্য হয়ে গেছে। কোন দিন সব শেষ হয়ে যাবে। তখন হয়ত একটা চরম অরাজকতা আসবে । দুলাভাই কি এসব বােঝে না? বুঝবে কেন? অর্থের মােহে অন্ধ হয়ে গেছে। তার টাকা চাই, আরও টাকা। বলে, শেফা মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, ছেলে মানুষ করতে হবে, সােজা হয়ে হাঁটতে শিখলেই আমেরিকা পাঠাতে হবে। বলিস কি তুই? তার এতাে খরচ। ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে হেসে ফেলে শেফা। কালচারাল বৈষম্য বড় সাংঘাতিক জিনিস ভাই ‘ এর সঙ্গে আপােস করা কঠিন, সত্যিই কঠিন।
ইমাম সেদিন ফিরলাে প্রায় সাড়ে বারােটায়। সেন্টুর কথাগুলাে এমনিতেই শেফাকে কিছুটা বিচলিত করেছে। মনে হল ছােট ভাই যেন কিছুটা অসম্মান করে গেল। রাতে মনে হলো ইমাম টলছে। শেফা বললো, বাড়িতে আব্বা-আম্মা আছেন আরেকটু সংযত হলে ভালো হয় না? নেশাগ্রস্তর মনে হয় জ্ঞান থাকে না। পরিবেশ থেকে অনেক নিচে নেমে যায়। শেফার মুখের কাছে এসে ইমাম বললো, সংযম দেখাচ্ছো। হ্যাঁ এ শিক্ষা তোমারই দেওয়া মানায়। সহস্র পুরুষকে দেই দান করে আমার চরিত্র সংশোধন করতে চাইছো? বাঃ বেশ বলে একটা হাততালি দিলো। শেফা ভয়ে দুঃখে যন্ত্রণায় পাশের ঘরে ঢুকলো। বেশ কিছু দিন হলো সে ছেলে মেয়ের সঙ্গে শোয়। তবে ইমাম এলে ওকে সেবা যত্ন করে খাইয়ে দাইয়ে ও শুতে যায়। আজকাল এর অতিরিক্ত কোনও চাহিদা ইমামের নেই। শেফা অবাক হলেও স্বস্তি বোধ করে। ভালোবাসাহীন দৈহিক মিলনে তার বড় ঘৃণা। তাই ইমামের অবহেলা বা ঔদাসীন্য তাকে বাঁচিয়ে দেয়।
কুন্দকে বুকে নিয়ে সে তার আনন্দের ভালোবাসার পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। কি কথা আজ তাকে বললো ইমাম? জবরদস্তি অত্যাচারকে কি দেহদান করা বলে? এই দীর্ঘ ৭৮ বছরে ইমাম কোনওদিন অতীতের ওই সর্বনাশা দিনগুলোর কথা মুহূর্তের জন্যও উচ্চারণ করেন। এর মনটা ছিল মায়া মমতায় ভরা, বাপের মতোই প্রগতিশীল উদার। কিন্তু সে এমন নিচে নেমে গেল কি করে?
পরদিন সকালে ইমামের চা নিয়ে সে গেল না তার বিছানায়। ডাকাডাকি করে ঘুমও ভাঙালো না। যোগীকে স্কুলে পাঠিয়ে কুন্দকে শাশুড়ির ঘরে আয়ার কাছে রেখে একটু বড় ভাশুরের কাছে গেল। ওঁরা দুজনেই একটু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গম্ভীর, কিন্তু স্নেহপ্রবণ। কোনও বুদ্ধি পরামর্শের প্রয়োজন হলেই সে বড় ভাইয়ের কাছে যায়। তারাও ওকে সাদরে গ্রহণ করেন। তাছাড়া এই যাতায়াতটাও ওর শ্বশুর শাশুড়ি খুব পছন্দ করেন। কারণ ইমাম আর আমান দুজনেই একে অন্যের-থেকে বেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কারণ তিনি এসব ফটকা বাজারি ব্যবসা পছন্দ করেন না। ওরা ধানমস্তীতে থাকে। শ্বশুরের কাছ থেকে গাড়ি চেয়ে নিয়ে এলো। তিনি আজ সকালের দিকে বেরুলেন না। এই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তার মুখের দিকে চেয়ে কিছু যেন পড়তে চেষ্টা করলেন, গোলমাল কিছু একটা হয়েছে, বাবার থেকে মা তো বেশি বোঝেন, তাই দুঃখী মেয়েটার কষ্ট তাকে বিপর্যস্ত করে। শ্বশুর অতো চিন্তিত নন কারণ এ বয়সে সবাই একটু উজ্জ্বল হয়, তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। তিনিও বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে কম বদমায়েসী করেন নি। আবার সময় মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। নইলে আজ পথই সম্বল হতো। তবে জিনিসটা অতো সহজ নয় এ কথা তিনি বোঝেন। কারণ তিনি আর যাই করুন অসৎ ব্যবসায়ী ছিলেন না। কালো টাকাকে তিনি বরাবর ঘৃণা করেছেন। ভাওতাবাজির ধার কখনো পারেন নি। সত্যি তো, বৌমাতো ঠিকই বলে, বাড়িতে এতো সামরিক অফিসারের আজ্ঞা কিসের? আজ এদের জন্যেই তো কপালে তাদের এত দুঃখ! কি জানি শেষ বয়সে কপালে কি আছে।
নেহায়েৎ প্রয়োজন ছাড়া ইমাম ও শেফার কথাবার্তা বিশেষ হয় না। অফিসে যাবার আগে শেফা আসে, জামা কাপড় গুছিয়ে দিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় কথা থাকলে দুজনেই সেরে নেয়। ইমামকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয় শেফার। ওর দিকে চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত। বাড়িতে খাওয়া এক রকম ছেড়েই দিয়েছে। মা একদিন বলেছিলেন, উত্তরে ইমাম বলে, একা খেতে ভালো লাগে না। তার থেকে হোটেলে সঙ্গী সাথী থাকে মা বলেন, বৌমাকে ডাকলেই পারিস। সন্ধের পর বাচ্চাদের দেখতে হয়। ওদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো… মাকে কথা শেষ করতে দেয় না ইমাম। মা না, ওকে বিরক্ত করে লাভ কি? আমারও দেরি হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি না। দুজনেই বুকে শ্বাস চেপে রেখে আলাদা হয়ে যান।
বড় ছেলে একদিন এলো। বাবার সঙ্গে গম্ভীর মুখে কি সব আলাপ আলোচনা করলো। জানিয়ে গেল আগামী মাসের দু’তারিখে আরমান কার্সিয়া যাচ্ছে। ও ওখানে ভর্তি হয়েছে। বড় চাচাই সব ব্যবস্থা করেছে। তার বক্তব্য, বংশের একটা মাত্র ছেলে তার মানুষ হওয়া দরকার। এ বাড়ির এ পরিবেশে তাকে মানুষ করা কঠিন। তিনি বুঝলেন, এ জন্যই শেফা ভাসুরের কাছে গিয়েছিল। মনে মনে মেয়েটার প্রশংসা করলেন।
মাস খানেক পর একদিন ইমাম অফিসে বেরুচ্ছে এমন সময় আরমান বললো, আব্বা আমি কাল চলে যাচ্ছি। কোথায়? বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ইমাম। কেন তুমি জানো না আমি কার্সিয়া যাচ্ছি পড়তে। বোবা হয়ে যায় ইমাম। সে আজ পরিবার থেকে কতো দূরে চলে গেছে। ছেলে চলে যাচ্ছে পড়তে দেশের বাইরে আর সে খবর সে জানে না। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের জল চেপে রেখে অনেক দিন পর বাবার ঘরে এলো। আব্বা যেন হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন। তেমনি সস্নেহ কণ্ঠে বললো, না, না তেমন কোনও কথা নয়। আরমান বললো ও নাকি কার্সিয়া পড়তে যাচ্ছে, সত্যি? হ্যাঁ, কেন তুমি জানো না? বিস্ময়ের সঙ্গে জবাব দিলন আব্বা, তারপর নিজ থেকেই বললেন, অবশ্য জানবেই-বা কি করে? তুমি তোমার উপার্জন আর নিজের ভোগ বিলাস ছাড়া আর কিছুই আজকাল জানো না। হ্যাঁ ওকে এ পরিবার থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বড় খোকাকে বলেছিলাম। সেইসব ব্যবস্থা করেছে। কাল সকালের ফ্লাইটে ওরা যাবে। পারলে এয়ারপোর্টে যেয়ো। শিশুর মনে পিতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা থাকা উচিত। ইমাম অস্ফুটে বললো, থাকবো। শেফা কিছু বলে নি, প্রশ্ন করলো ইমাম। বৌমা, ওকে তুই আজও চিনলি না এটাই আমার দুঃখ। আমার কথার উপর কথা বলবে সে আসলে তার তাগিদেই ওকে পাঠানো। ভালোই হলো। কোনদিন আমি খাকি না থাকি তার ঠিক আছে। গার্জিয়ান ছাড়া ছেলে মানুষ করা যায় না। এখন আমি নিশ্চিন্ত। আমি না থাকলেও বড় খোকা ওকে মানুষ করতে পারবে, তোমার চিন্তার কিছু থাকবে না। মাথা নিচু করে ইমাম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অফিসে গেল না ইমাম, ঘরে ফিরে এলো। কিন্তু ভেতরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালো, শেফা ঘর গোছাচ্ছে। ওকে দেখেই চলে যাচ্ছিল, ইমাম ডাকলো, শেফা। শেফা ঘুরে দাঁড়ালো। ইমামের মনে হলো শেফা যেন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। মুখটা কেমন যেন রক্তশূন্য। চোয়াল দু’টো মনে হয় শৃক্ত। চোখ নামিয়ে নিলো ইমাম। শেফা স্বাভাবিক গলায় বললো, কিছু বলবে? অফিসে গেলে না? শরীর খারাপ নাকি? তার কণ্ঠস্বরে এতটুকু জড়তা নেই। অবাক হয়ে ইমাম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। একেই বলে ধরিত্রীর মতো সহনশীল। তার মনে পড়ে না শেফা কোনও দিন রাগ করে বা উঁচু গলায় তার সঙ্গে কথা বলেছে। অথচ শুনেছে সে সাংঘাতিক একরোখা জিদ্দি ছিল। তাহলে সে কি তাকে শুধু কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছে, অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারেনি? হঠাৎ কানে এলো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ভালো না লাগলে জামা কাপড় বদলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। এক কাপ চা এনে দেবো? বিস্মিত ইমাম অস্ফুটে বললো, দাও। তারপর সত্যি সত্যি কাপড় জামা বদলে শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর শেফা সেই পরিচিত ভঙ্গীতে চা এনে ইমামের বেডসাইড টেবিল রাখলো। ইমাম চেষ্টা করে ভেবে দেখলো প্রায় দু’বছর পর শেফা তাকে চা দিলো। কি ব্যাপার? সে কি রিপ ভ্যানউইলকিলের মতো দু’বছর ঘুমিয়ে ছিল। ক্লান্তু স্বরে বললো, আমার কাছে একটু বসবে শেফা? শেফা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বললো, বসবো। এখন সকাল দশটা বাজে। আমার যে অনেক কাজ। জানো বোধ হয় যোগী কাল কার্সিয়াও চলে যাচ্ছে। শুনেছি, কিন্তু তোমরা তো কেউ আমাকে কিছু বলেনি শেফা? আমি ওর বাবা নই? শেফা হেসে বলে, সে কথা কি কেউ তোমাকে বলেছে? তোমার সময় কোথায়, এ সব ছোট খাটো কথা শোনার বলো? যে কাজের চাপ। আমরা তো চাপের নিচে অনেক দূরে তলিয়ে গেছি। বুঝলাম সব, কিন্তু কোনও দিন কি আমাকে এ সব কথা মনে করিয়ে দিয়েছো বলো, বলো শেফা। উত্তেজনায় ও শেফার হাত চেপে ধরে। শেফা এতোক্ষণে স্পষ্ট উচ্চারণ করলো, হাত ছাড় ইমাম। এ হাত অপবিত্র, ধরলে তোমার গুনাহ হবে। যা বলবার তুমি আমাকে বলেছো। এবার চুপ করে শুয়ে থাকো। আমার অনেক কাজ। যোগীর জিনিসপত্র ঠিক করবে। বাবার যাবার আয়োজন আছে। তাছাড়া উনি যোগীর জন্য বাচ্চাদের মতো খুব কাতর হয়ে পড়েছেন। আমার জন্য না হয় নাই হলো আব্বার কথা ভেবেও তো ওকে এখানে রাখতে পারতে, মনতির স্বরে বললো ইমাম। তুমি তো কিছুই জানো না, ওর যাবার সব ব্যবস্থা আব্বাই করিয়েছেন। আমার কোনও মতামত আছে কিনা জানতে চেয়েছেন অনেক পরে, সব ঠিক করে। তাহলে তখন বারণ করোনি কেন শেফা? ইমাম বলে উঠলো। পাগল, আব্বার চেয়ে আপনজন যোগীর আর কে আছে। তুমি তো তবুও ওকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আমার তো কোনও ক্ষমতাই নেই। তাছাড়া আব্বার ওপর আমার যেমন অগাধ বিশ্বাস, তেমনি অনন্ত নির্ভরতা। আচ্ছা, তুমি বিশ্রাম করো আমি কাজগুলো সেরে আসি। এসো কিন্তু শেফা, করুণ কান্নার মতো শোনালো ওর কণ্ঠস্বর। দ্রুতপায়ে শেফা বেরিয়ে গেল। তার গলায় কান্না জমে আছে। তরল হলে বিপদ। আল্লাহর এ দুনিয়ায় কি সবই সম্ভব? ইমাম আর কখনও তার কাছে আসবে সে ভাবে নি। আজ দু’বছর তার নিষ্ঠাবতী বিধবার জীবন চলছে। শ্বশুর-শাশুড়ি সবই বুঝতে পারেন কিন্তু এ নিয়ে দু’জনে ছেলেকে একটি কথাও কোনও দিন বলেন নি। শুধু শ্বশুর একদিন শাশুড়িকে বলেছিলেন, ছিঃ ছেলের কাছে মাথা নিচু করবে? কখনও না! ওকে চলতে দাও, হোঁচট খেলেই হুমড়ি খেয়ে এসে পড়বে। নিজের সম্মান নিজের কাছে রেখো, সে আমি থাকি আর নাই থাকি। শেফা দূর থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেছে। এতোবড় মানুষটার বুকের ভেতর এতো গভীর বেদনা অথচ কতো সংযমী।
মনে হয় মুরুব্বিদের কথা মিথ্যা হয় না। ইমাম কোথাও হোঁচট খেয়েছে। বাড়িতে তো পার্টি ডিনার সব বন্ধ। কোথায় কি করে কি জানে? আজ হঠাৎ ছেলের চলে যাবার কথায় এমনভাবে ভেঙে পড়বে শেফার তা মনে হয় না। ব্যবসায় কোথাও কোনও গলদ বাধিয়েছে। শেফা এসব নিয়ে ভাবতে চায় না কিন্তু এখন না ভেবেও পারছে না। প্রতিপক্ষ সবল হলে তার সঙ্গে লড়াই করা যায়, কিন্তু দুর্বল হয়ে নতি স্বীকার করলে তো নিজের থেকেই পরাজয় মেনে নিতে হয়। অবশ্য এ সব টালবাহানা করে যোগীকে পাঠানো বন্ধ করতে শেফা দেবে না। তার ভবিষ্যতের পথ স্পষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া সামনে আছেন বড় ভাই, ধীর স্থির কর্তব্যপরায়ণ। অপুত্রক এ মানুষটি যোগীকে পুত্ৰতুল্য ভালোবাসেন।
কোথা দিয়ে যে দিনটা কেটে গেল শেফার সে জানে না। বুকে পাষাণ বেঁধে সে যোগীর যার আয়োজন করেছে। মাত্র নয় বছরের ছেলে। কোনও অসুবিধা দুঃখ অভাব কিছুই তো তার ছিল না। কিন্তু না, ধনলিন্দু, লম্পট পিতার আদর্শ সে ছেলের সামনে ধরবে না। দুপুরে এবং রাতে দু’বেলাই ইমাম খাবার টেবিলে ছেলের পাশে বসে খেলো এবং আব্বা আম্মার সঙ্গেও কিছু অনাবশ্যক কথা বললো।
সকালে আব্বা-আম্মা জানালেন তারা এয়ারপোর্টে যাবেন না। ভাইয়া যেদিন গরমের ছুটিতে আসবে সেদিন তারা আনতে যাবেন। যোগী কিন্তু বেশ খুশি। শুধু দাদা দাদির কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ওদের চুমোয় চুমোয় ভরে দিলো। তারপর কিছু না বলে এক দৌড়ে বড় চাচার গাড়িতে গিয়ে বসলো। ইমাম আর শেফা আব্বা আম্মাকে বলে তাদের গাড়িতে উঠলো। মনে হলো শেফার, তার সমস্ত ধনরত্ন বাক্স বন্দি করে সে নিয়ে চলেছে অজানা অচেনা জায়গায়-ঢেলে দিতে। কুন্দ বাড়িতে, দাদা-দাদির কাছে! ওকে নিয়ে এলে ভালো হতো, কিছুটা অন্যমনস্ক থাকা যেতো। এয়ারপোর্টের কাজ কর্ম সারা হলো। বড়ভাই শেফাকে বললেন, কোনও চিন্তা করো না, শেফা। আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে দিন সাতেক হোটেলে থাকবো। ও সেটেল্ড হলে তারপর আসবো। ইমামের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা হয়েছিস, একটু সামলে চলিস। মেয়েটাকে বুকে করে রাখিস। পৃথিবীতে যতো মানবিক সম্পর্ক আছে, বাবা আর মেয়ের চেয়ে মধুর আর কিছু নেই। আচ্ছা চলি, খোদা হাফেজ। যোগী দিব্যি টা টা বাই বাই করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেল। ইমাম হাত বাড়িয়ে শেফার হাতটা ধরলো। ওর হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা এবং মৃদু মৃদু কাঁপছে। ইমাম বললো, শেফা চলো। ওখানে গিয়ে চা খাই। গলাটা আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, প্লেন না ছাড়লে যাবো না। শেফা বোবার মতো ওর সঙ্গে সঙ্গে চলল। চায়ে চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গে এ্যানাউন্সমেন্ট হলো। ওপরে জানালা থেকে দেখলে যোগী তার চাচার হাত ধরে বক বক করতে করতে প্লেনে উঠে গেল। উপরের দিকে হাত বাড়ালেন কারণ তিনি জানেন অন্তত এক জোড়া চোখ হৃদয়ের শেষ বিন্দু ভালোবাসা দিয়ে এ দিকে তাকিয়ে থাকবে। ওরা চলে গেল।
সারা পথ শেফা যেন মুক বধির একটা প্রাণীর মতো স্থানুবৎ বসে রইলো। ইমাম কি যেন বলছিল শেফার কানে গেল না। শুধু মনে হচ্ছে টেপরেকর্ডার যেন কানের কাছে বেজেই চলেছে যোগীর কণ্ঠস্বর নিয়ে, আম্মু আম্মু আম্মু। বাড়িতে এসে কুন্দকে বুকে নিয়ে উপুড় হয়ে পড়লো শেফা। তার সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। আম্মা এসে দাঁড়ালেন, মাথায় হাত রেখে বললেন, শেফা স্থির হও। ছেলেকে মানুষ করতে হবে। ছেলে মানুষ করতে পারা যেমন গৌরবের অমানুষ হলে তেমনি লজ্জা ও কলঙ্কের। পর্দার ওপাশে ইমাম দাঁড়িয়ে, মনে হয় যেন আম্মা ওকেই ধিক্কার দিচ্ছেন। আম্মা বসলেন শেফার পাশে। বললেন, শেফা ভেবে দেখো আমান যেদিন আমেরিকা গেল আমার কেমন লেগেছিল। তোমার যোগী তো ছমাস বাদেই আসবে তোমার কাছে। তুমি ইচ্ছে করলেই ওকে দেখতে যেতে পারবে। কিন্তু আমার আমান, ওতো হারিয়ে গেছে আমি জানি। হয়তো দু’পাঁচ বছর পর সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আসবে, আবার চলে যাবে। বিয়ে করেছে ওদেশী মেয়ে। আমাদের উপর তার তো আর টান থাকবার কথা নয়। ওঠো শেফা, আমাকে দেখো। সত্যিই শেফা উঠে বসলো। ধড়মড় করে বললো, আব্বার খাওয়া হয়েছে? না মা, তুমি বিছানা নিলে ও মানুষটা খায় কি করে! শেফা কুন্দকে শাশুড়ির কাছে দিয়ে একরকম দৌড়েই নিচে চলে গেল। একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর অনুপস্থিতিতে বাড়িঘর কেমন যেন নিস্তব্ধ শান্ত হয়ে গেছে। অবশ্য কুন্দ এখন সারাবাড়ি ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। দাদা-দাদিকে ডাকে।
মাসখানেকের ভেতর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। এবার ইমাম একেবারেই ঘরে বন্দি হলো। আশ্চর্য! ওর আব্বা ভালো মন্দ কিছুই ওকে বললেন না। গতবার সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। শেফা বলতেই বললেন, ওর কোনও অভিভাবকের দরকার নেই। ও এখন বড় হয়েছে। একাই চলতে পারবে। তবুও বড় ছেলেকে ডেকে ওর দিকে একটু চোখ রাখতে বলেছেন। একেই বলে বাপের মন, মানতে চায় না।
সেই প্রথম জীবনের মতো ইমাম বই নিয়ে বসে থাকে, কি বই শেফা জানে না। আগে পলিটিক্যাল বই পড়তো। এখন পড়ে খ্রিলার। কুন্দকে নিয়ে কখনও কখনও বাইরে যায় কিন্তু শেফাকে অনুরোধ করে না। একদিন গিয়েছিল সংসদ ভবনের কাছে লেকের পাড়ে। বেশিক্ষণ বসলো না শেফা। সংসদ ভবন দেখলে ওর ভাঙ্গে লাগে না। ওর মনে হয় ওটা অভিশপ্ত। ওখানে কোনও নির্বাচিত সংসদ বসলো না। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন কি, আর হলো কি। শেফার কষ্ট হয়। সবাই তো দিব্যি খেয়ে হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছে। ওই মানুষটার জন্য ওর বুকটা কেন এমন করে কাঁদে। সম্ভবত ওই মনটাও যে ওদের জন্য কেঁদেছিল। এ স্পর্শকাতরতা উভয়ের জন্যই বোধহয় সংক্রামকভাবে সংবেদনশীল।
দিন চলে যায়। শেফারও যায়। আমান বউকে তালাক দিয়ে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু ইমামের কাছ থেকে আগের মতো প্রশ্রয় না পাওয়ায় ভদ্র জীবন যাপন করছে। ফেরবার পথে লন্ডনে সোনালিদের কাছে এক সপ্তাহ ছিল। ওর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। এরা আর দেশে ফেরে নি। নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। দু’জনেই ভালো কাজ করছে। শুনে শেফার ভালো লাগলো। সেও চলে গেছে। গত বছর আব্বা আম্মা গিয়ে প্রায় ছ’মাস থেকে এসেছেন। শেফার এতে বড় তৃপ্তি, শেফা। বেঁচে আছে থাকবে। যাদের দুনিয়াতে এনেছে তাদের মানুষ করবার প্রতিশ্রুতি আছে নিজের অন্তরের কাছে। সে একজন মা এবং ব্যতিক্রমধর্মী মা, যে মেয়ের সব চেয়ে বড় পরিচয় সে বীরাঙ্গনা, শেফা দেশের জন্য তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীত্ব বিসর্জন দিয়েছে। সে তো কোনও শহীদের চেয়ে কম ভাগ্যবান ও পুণ্যবান নয়। তারা প্রাণ দিয়েছে একবার, শেফা মান দিয়েছে বার বার। আজও তার স্বামী থেকে শুরু করে অনেকেই তাকে বাঁকা চোখে দেখেন। শেফা ওদের করুণা করে, কৃপা করে, সে এমনি বিজয়িনীর বেশে সংসার থেকে বিদায় নেবে। সেইদিন তার সাধনা সার্থক হবে যে-দিন সে তার যোগী, তার কুন্দর কাছে তার মূল্য তুলে ধরতে পারবে, এই তার একমাত্র ও শেষ প্রার্থনা আল্লাহর কাছে।