ঐতিহাসিক সমগ্র
সিরাজের বিজয় অভিযান : এক
এই অঞ্চলেই আগে ছিল প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ। তারপর তার নাম হয় মাকসুসাবাদ, তারপর মুর্শিদাবাদ।
মহানগরী মুর্শিদাবাদ।
স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী। বিস্ময়-বিমুগ্ধ ক্লাইভ যাকে দেখে লন্ডনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
আজ সেখানে গেলে দেখা যায়, ধুলায় ধূসর হয়েছে তার গর্বোদ্ধত শির। যে ধুলার বিছানায় পড়ে আছে কঙ্কালসার মুর্শিদাবাদের জরাজীর্ণ মৃতদেহ, সেই ধুলার সঙ্গে কিন্তু মিশে আছে সুদূর এবং নিকট অতীতের কত মানুষের স্মৃতি!
হিন্দুদের হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক, মহীপাল, রানি ভবানী ও মোহনলাল এবং মুসলমানদের হোসেন শা, মুরশিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, মিরমদন—
এবং সিরাজউদ্দৌলা।
মিরজাফর ও মিরকাসিম বাংলায় নকল নবাবির অভিনয় করেছিলেন মাত্র। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হচ্ছেন সিরাজউদ্দৌলা।
কয়দিনই বা তিনি সিংহাসনে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র আঠারো বৎসর বয়সে। কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর নাম করেছে অমরত্ব অর্জন। কারণ? তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-যজ্ঞের পুরোহিত।
বালক সিরাজের ছিল যথেষ্ট বালকতা, প্রচুর দুর্বলতা। সেজন্যে তাঁর নামে শোনা যায় অনেক কুৎসা। কিন্তু সেই নিন্দার খোলস থেকে মুক্ত করে নিলে আমরা যে সিরাজের দেখা পাই, তিনি হচ্ছেন সোনার বাংলার খাঁটি ছেলে। দেশমাতৃকার পায়ে পরাবার জন্যে যখন ফিরিঙ্গি দস্যুরা শৃঙ্খল প্রস্তুত করছিল এবং যখন সেই অপকর্মে তাদের সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে এসেছিল হিন্দু ও মুসলমান দেশদ্রোহীর দল, সিরাজ তখন তাদের বাধা দিয়েছিলেন প্রাণপণে। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি পণরক্ষা করতে পারলেন না, তাঁকে দিতে হল প্রাণ।
এই প্রাণদান, এই আত্মদানের জন্যেই সিরাজের নাম আজ মহনীয়, বরণীয় এবং স্মরণীয়। স্বদেশের জন্যে সিরাজ দিয়েছিলেন বুকের শেষ রক্তবিন্দু।
এই জন্যেই সিরাজের সব দোষ ভুলে লোকে আজও তাঁর জন্যে চোখের জল ফেলে পরমাত্মীয়ের মতো এবং এইজন্যেই সিরাজের মৃতদেহ আজও যেখানে ধুলার সঙ্গে ধুলা হয়ে মিশিয়ে আছে, একদিন আমি সেখানে ছুটে গিয়েছিলুম তীর্থযাত্রীর মতো।
সেখানে গিয়ে কানে শ্রবণ করলুম অতীতের গৌরববাহিনী বাণী, প্রাণে অনুভব করলুম স্মৃতির চিতাগ্নিজ্বালা, মানসচোখে দর্শন করলুম পলাশির রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন।
আগে সেই কথা বলব।