হেমেন্দ্রকুমার রায়
ঐতিহাসিক সমগ্র
ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ : পূর্বাভাষ
ছত্রপতি কে? যিনি সম্রাট, বা রাজ চক্রবর্তী, বা মহারাজাধিরাজ।
সম্রাট হর্ষবর্ধন যে নিজেকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে মনে করতেন, তার প্রমাণস্বরূপ তাঁর স্বাক্ষর অদ্যাবধি বর্তমান আছে।
ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, তবু নিধিরাম নিজেকে ‘সর্দার’ মনে করত বলে একটা ঠাট্টার কথা শুনি। ওই নিধিরামের মতো একালের কোনও কোনও খেতাবি ধনীও নিজেকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে প্রচার করতে লজ্জিত হন না। অভিধানকেও ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চান।
ভারতের প্রথম ছত্রপতি কে?
প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার জন্যে কেউ যেন রামায়ণ বা মহাভারতের দিকে দৃষ্টিপাত না করেন। রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্য হলেও ইতিহাস নয়। তাদের মধ্যে ইতিহাসের মাল-মশলা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলির সাহায্যে প্রামাণিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হতে পারে না।
সাল ও তারিখ না পেলে এবং সত্য ও প্রামাণিক তথ্যের দ্বারা বিশেষজ্ঞরা বিচার না করলে ইতিহাস রচিত হয় না। প্রাচীন হিন্দুরা সাল-তারিখ নিয়ে মাথা ঘামায়নি আদৌ। নিরঙ্কুশ কবির কল্পনাও তাদের কাছে ইতিহাস বলে স্বীকৃত হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীকেই সাধারণত ঐতিহাসিক যুগের আরম্ভ বলে ধরা হয়। ওই সময়ের অল্পস্বল্প যা জানা গেছে তার উপর নির্ভর করে বলা চলে যে, ষোলোটি রাজ্য নিয়ে আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতবর্ষ গঠিত হয়েছিল।
দাক্ষিণাত্যে নয়, আর্যাবর্তে যিনি প্রধান হতে পারতেন, তাঁকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বা সম্রাট বা ছত্রপতি বলে স্বীকার করা হত। দাক্ষিণাত্য ও আর্যাবর্তকে আলাদা করে রেখেছিল প্রধানত বিন্ধ্য শৈলশ্রেণি।
কিন্তু তখনও ভারতে কেউ ছত্রপতি বা সম্রাট বলে পরিচিত হননি।
বুদ্ধদেবের জীবনচরিতে বা বৌদ্ধ জাতকে আর্যাবর্তের একাধিক শক্তিশালী নরপতির সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের কেউ ‘ছত্রপতি’ বলে মানত না। প্রাদেশিক রাজার দল পরস্পরের সঙ্গে মারামারি কাটাকাটি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন, ছত্রপতি হওয়ার শক্তি বা অবসর তাঁদের ছিল না।
সত্যিকথা বলতে কী, তখনও ভারতে যথার্থ ঐতিহাসিক যুগ আসেনি।
গ্রিক দিগবিজয়ী আলোকজান্ডার দি গ্রেট-এর ভারত আক্রমণের ফলেই খুলে যায় এখানে ইতিহাসের বদ্ধ দ্বার। এ হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর কথা। পঞ্চনদের সৈন্যরা রণক্ষেত্রে পরাজিত হল বটে, কিন্তু আর একদিক দিয়ে ভারতের হল পরম লাভ। সে নিজেকে খুঁজে পেলে ইতিহাসের আলোকে।
ভারতের প্রত্যন্ত দেশে আলেকজান্ডারের শিবিরে যখন যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে, সেই সময়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এক পঁচিশ বৎসর বয়স্ক তরুণ ভারতীয় যুবক—তিনি গ্রিক নরপতির সঙ্গে দেখা করতে চান।
যথাসময়ে দেখা হল। আলেকজান্ডার শুধোলেন, ‘কে তুমি?’
উত্তর হল, ‘আমি মৌর্যবংশীয় এক রাজপুত্র, নাম চন্দ্রগুপ্ত।’
‘আমার কাছে কী দরকার?’
‘আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’
‘কীরকম সাহায্য?’
‘ভারতের প্রধান নরপতি হচ্ছেন মগধের অধীশ্বর মহাপদ্ম নন্দ। তাঁকে জয় করতে না পারলে ভারত জয় করা অসম্ভব। তিনি ভীষণ অত্যাচারী, তাঁরই জন্যে আমি আজ নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছি। প্রজারাও তাঁকে ঘৃণা করে, তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চায়। আমি, সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে, তাঁকে আক্রমণ করবার সমস্ত অন্ধিসন্ধি বলে দিতে এসেছি।’
বুদ্ধিমান আলেকজান্ডার বুঝলেন, এই সুচতুর যুবক তাঁর সাহায্যে মগধ রাজ্য জয় করতে চায়। তিনি বললেন, ‘আপনার সাহায্য আমার দরকার হবে না। আমি নিজেই মগধ রাজ্য জয় করতে পারব।’
হতাশ হয়ে চন্দ্রগুপ্ত ফিরে এলেন বটে, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি গ্রিক ফৌজের অনেক বিশেষত্ব আবিষ্কার করতে ভুললে না।