হেমেন্দ্রকুমার রায়
ঐতিহাসিক সমগ্র
তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : বিষবৃক্ষের বীজ
দিগবিজয়ী তৈমুর লং এদিকে-ওদিকে-সেদিকে লুব্ধ দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও একজন মাত্রও যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে পেলেন না।
—গর্বিত শ্বেতাঙ্গদের দেশ ইউরোপেও নয়। তাঁর হাতে রুশিয়ার ভয়াবহ দুরবস্থা দেখে শ্বেতাঙ্গদের প্রাণ ভীষণ ভয়ে থরহরি কম্পমান।
তখনকার ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নরপতি ছিলেন স্পেনের অধিপতি। তিনি তো ভেট পাঠিয়ে মোসাহেবি করতে চান।
তৈমুর লং স্পেনকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,—আচ্ছা, আচ্ছা, তুমি নির্ভয় হও। সমুদ্রে বড় মাছের সঙ্গে ছোট মাছরাও বাস করতে পারে।
আচম্বিতে তাঁর দৃষ্টি আবিষ্কার করলে টিকিধারী চিনাদের মুল্লুক। কেবল ওকেই জয় করতে বাকি আছে। তৎক্ষণাৎ ঘোর রবে হতে লাগল ঘন ঘন তূর্যধ্বনি—বাজতে লাগল ডিমিডিমি রণডঙ্কা—ধেয়ে এল মেদিনী থরথরিয়ে পঙ্গপালের মতো সৈন্যদলের পর সৈন্যদল।
তৈমুর লং খাপ থেকে তরোয়াল খুলে পদভারে মাটি কাঁপিয়ে সদম্ভে অগ্রসর হলেন। বার্ধক্যে তিনি তখন প্রায় অন্ধ।
তারপর—
তারপর বেশ খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে সর্বজয়ী মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন—পথের উপরে তাঁর অসাড় হাত থেকে খসে পড়ল দিগবিজয়ীর রক্তস্নাত তরবারি। ধনেপ্রাণে বেঁচে গেল চিনদেশ। সেখানে আর হাজার-হাজার নরমুণ্ড সাজিয়ে পিরামিড গড়া হল না।
দেশের পর দেশ রক্তপ্লাবনে ডুবিয়ে, নরমুণ্ডের পিরামিডের পর পিরামিড সাজিয়ে তৈমুর লং যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছিলেন এইবারে ক্রমে ক্রমে তার ফলফসল ফলতে আরম্ভ করলে।
তাঁর বংশধররা সিংহাসন নিয়ে সাংঘাতিক বিবাদ করতে লাগল—সহোদর আর সহোদরকে মানলে না। পৃথিবীর নানা দেশের রাজপরিবারে বিভিন্ন সময়ে এমন ব্যাপার দেখা গেছে বটে, কিন্তু আর কোনও বংশেই ব্যাপারটা এমন ধারাবাহিকভাবে অবশ্যপালনীয় ঐতিহ্যের মতো হয়ে ওঠেনি।
তৈমুরের বংশে পুরুষানুক্রমে বারংবার দেখা গিয়েছে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি—এমনকী সে বংশে পিতাপুত্রের সম্পর্কও প্রায়ই অহি-নকুল সম্পর্কের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলে তৈমুরের মৃত্যুর পরেই তাঁর বিপুল সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড ও ছারখার হয়ে যায়।
তাঁর এক উত্তরপুরুষ রাজপুত্র বাবর স্বদেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে গিয়ে রাজ্য স্থাপন করলেন এবং পরে তিনিই হলেন ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
তাঁর পুত্র হুমায়ুনের কোনও ভাই ছিল না। তাই বোধ করি সিংহাসন নিয়ে কোনও মারামারি কাটাকাটি হয়নি।
তাঁর পুত্র আকবরও পিতার একমাত্র সন্তান। সুতরাং ভ্রাতৃবিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তিনি সন্তান-সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। তাঁর পুত্র সেলিম (পরে জাহাঙ্গির নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন) বিদ্রোহী হয়েছিলেন।
তারপর থেকেই কাকে রেখে কাকে বাদ দেব? পিতৃদ্রোহ ও ভ্রাতৃবিরোধ মোগল রাজবংশে যেন একটা বাঁধাধরা রীতি হয়ে ওঠে—প্রজাদের সঙ্গে বেমালুম মিশে যায় রাজরক্ত এবং এসব কথা এতবার অসংখ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে যে, এখানে তা নিয়ে বাক্যব্যয় করা বাহুল্যমাত্র।
যে সাজাহানের শেষ জীবনের ট্র্যাজেডি আমাদের চক্ষু অশ্রুজলে পূর্ণ করে তোলে, তিনিও যৌবনে পিতার আজ্ঞাবহ পুত্রের মতো জীবনযাপন করেননি। বিদ্রোহী হয়ে পিতা জাহাঙ্গির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন, পরে যুদ্ধে হেরে ভালোমানুষ সাজতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং তিনি ভ্রাতৃহত্যাতেও হস্ত কলঙ্কিত করতে ছাড়েননি।
তাঁরই যোগ্য পুত্র ঔরঙ্গজিব। বৃদ্ধ ও অক্ষম পিতাকে শেষজীবনের কয়েকটা বৎসরের জন্যে কারাগারে নিক্ষেপ করে তিনি রক্তের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। দুই সহোদরকে হত্যা ও আর এক সহোদরকে চিরদিনের মতো ভারত থেকে বিতাড়িত করে তবে ক্ষান্ত হয়েছিলেন।
যথার্থ পক্ষে ধরতে গেলে মোগল রাজবংশের শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট হচ্ছেন বাহাদুর শাহ। সিংহাসন পাওয়ার পর তাঁর রাজত্বকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বটে, কিন্তু ঔরঙ্গজিবের পুত্র হয়ে সিংহাসন অধিকার করার সময়ে তিনিও বংশগত ধারা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে তিনি প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ভ্রাতৃবিরোধে ও খুনখারাবিতে যোগদান না করে পারেননি।
তারপরেও মোগল রাজপরিবারে ভ্রাতৃবিরোধ ও খুনোখুনি একটা অবশ্যম্ভাবী কাণ্ড হয়ে ওঠে এবং যে-কারণে তৈমুরের সাম্রাজ্য ছারখার হয়ে যায়, তৈমুরের বংশধরদের নির্বুদ্ধিতার জন্যে মোগল সাম্রাজ্যেরও অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় ঠিক সেই কারণেই।