» » মুসলমানের জহরব্রত

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

মুসলমানের জহরব্রত

হিন্দুর রক্তে মুসলমানের এবং মুসলমানের রক্তে হিন্দুর হাত আজ রাঙা হয়ে উঠেছে। এ দৃশ্য নতুন নয়। এমনই সব রক্তাক্ত ঘটনার দ্বারা আজ হাজার বৎসর ধরে ভারতের ইতিহাস আরক্ত হয়ে আছে। রক্তস্রোত কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে, কিন্তু একেবারে থামেনি কখনও।

তবু ওরই মাঝে মাঝে এক-একটি সমুজ্জ্বল ছবি জেগে ওঠে অত্যন্ত অভাবিত ভাবে, কাজলকালো মেঘের কোলে রুপালি বিদ্যুৎলতার মতো! আজ তোমাদের হাতে উপহার দেব এমনি একখানি ছবি। বড় করুণ, কিন্তু বড় মিষ্টি ছবি।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি তখন দিল্লির সিংহাসনে। তাঁর সাম্রাজ্য দিনে দিনে বিস্তৃততর হয়ে উঠেছে, হিন্দু রাজাদের মাথা থেকে খসে পড়ছে মুকুটের পর মুকুট।

রণসম্বর দুর্গের রাজপুত রানা হামির দেব কিন্তু আলাউদ্দিনের সামনে মাথা নত করতে রাজি নন। আপন স্বাধীনতার জন্যে অস্ত্রধারণ করতে প্রস্তুত তিনি সর্বদাই। এখানে বলে রাখা ভালো, চিতোরের উদ্ধারকর্তা হামির ও রণসম্বরের হামির একই ব্যক্তি নন।

সেনাপতি মির মহম্মদ সা একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে তিনি করেছিলেন বিদ্রোহ ঘোষণা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে তাঁকে দেশত্যাগী হতে হল। পলাতক মহম্মদ রানা হামিরের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। রানা সম্মতি দিলেন।

দিল্লি থেকে এল সুলতানের কড়া হুকুম—‘ফিরিয়ে দাও বিদ্রোহী মহম্মদকে!’

হামির দেব জবাব দিলেন, ‘অসম্ভব! আশ্রিতকে জাতিধর্মনির্বিশেষে রক্ষা করাই হচ্ছে হিন্দুর কর্তব্য। মহম্মদ সাকে ফিরিয়ে দেব না।’

ক্রুদ্ধ দিল্লিশ্বর বললেন, ‘বটে? তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’

হামির দেব নির্ভয়ে বললেন, ‘আমি অপ্রস্তুত নই।’

পঙ্গপালের মতো মুসলমান সৈন্য নিয়ে বিখ্যাত সেনাপতি নসরত খাঁ ধেয়ে এলেন রাজপুতনার দিকে। রাজপুতদের একটা দুর্গের পতন হল। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দের কথা।

হামির দেব আশ্রয় গ্রহণ করলেন রণসম্বর দুর্গের মধ্যে। এই প্রসিদ্ধ ও দুর্ভেদ্য দুর্গ বহু শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করেছে বারংবার। দিল্লির সৈন্যরা দুর্গ অবরোধ করলে বটে, কিন্তু অধিকার করতে পারলে না।

রণসম্বরের মধ্যে অস্ত্র নিক্ষেপ করবার জন্যে দিল্লির সৈন্যরা একটা মোরচ বা উপদুর্গ নির্মাণ করছিল। তা পরিদর্শন করতে এলেন সেনাপতি নসরত খাঁ।

আচম্বিতে দুর্গের ভিতর থেকে নিক্ষিপ্ত হল প্রকাণ্ড একখণ্ড প্রস্তর। প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মাটির উপরে লুটিয়ে পড়লেন নসরত খাঁ। দুদিন পরে তাঁর মৃত্যু হল। দিল্লির সেনাদলের মধ্যে জাগল হাহাকার।

এ সুযোগ ত্যাগ করলেন না রানা হামির দেব। সদলবলে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এসে তিনি মুসলমান সৈন্যদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হিংস্র শার্দূলের মতো দুর্দান্ত বিক্রমে। রাজপুত যোদ্ধাদের কণ্ঠে কণ্ঠে জাগ্রত হল আকাশভেদী জয়ধ্বনি—‘হর হর মহাদেব! হর হর মহাদেব!’

আরম্ভ হল রক্তরাঙা তরবারির তাণ্ডব নৃত্য, দিকে দিকে ছুটতে লাগল বল্লমগুলো উল্কাবেগে, শূন্যে যেন বিপুল জাল বিস্তার করে অধোমুখে নেমে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে শাণিত তির!

‘হর হর মহাদেব! হর হর মহাদেব!’ নীরব হয়ে পড়ল ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি। রক্তপিছল রণক্ষেত্রের উপরে অগণ্য শবদেহের স্তূপের পর স্তূপ রচনা করতে করতে দিল্লির পলাতক সৈন্যবাহিনীর পিছনে পিছনে ধাবমান হল রাজপুত বীরের দল।

শত্রুহীন যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্ত মুখে তরবারি কোশবদ্ধ করলেন স্বদেশভক্ত মহাবীর হামির দেব। আজ দিল্লি হতগর্ব, রাজস্থানের রাজলক্ষ্মী রাহুমুক্ত। পৃথ্বীরাজের পর এক শতাব্দীর মধ্যে আর কোনও হিন্দু বীরই মুসলমানদের এমনভাবে পরাজিত করতে পারেননি। এবং হামিরও হচ্ছেন পৃথ্বীরাজেরই যোগ্য বংশধর।

টলে উঠল দিল্লির সিংহাসন! আলাউদ্দিন তাড়াতাড়ি আরও অনেক সৈন্য সংগ্রহ করে নিজের পলাতক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে ছুটে এলেন। রণসম্বর আবার হল অবরুদ্ধ। মুসলমান সৈন্যের সংখ্যাধিক্য দেখে হামির দেব বুদ্ধিমানের মতো প্রকাশ্য রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শত্রুর শক্তিপরীক্ষা করতে অগ্রসর হলেন না।

হামির দেব জানতেন রণসম্বরের পতন অসম্ভব। দাসবংশীয় সুলতান বলবন এই দুর্গ অধিকার করতে পারেননি। খিলজিবংশীয় প্রথম সুলতান ফিরুজও সসৈন্যে দুর্গ অধিকার করতে এসে দুর্ভেদ্যতা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। আলাউদ্দিনকেও কিছুকাল পরে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়তে হবে, এ সম্বন্ধে হামির ছিলেন একরকম নিশ্চিন্ত।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়, কিন্তু আলাউদ্দিন নিজের গোঁ ছাড়তে নারাজ। যেমন অটল রণসম্বর কেল্লা, তেমনই অটল দিল্লির সৈন্যরা। তারা কেল্লা দখল করতে পারলে না বটে, কিন্তু এমনভাবে চারিদিকের পথঘাট আগলে রইল যে অবরুদ্ধ রাজপুতেরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়তে লাগল।

হিন্দুস্থানে কোনওদিনই দেশভক্তের অভাব হয়নি। আবার এখানে দেশদ্রোহীর সংখ্যাও গুণে ওঠা যায় না। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম যে দেশদ্রোহী যবন গ্রিকদের সাহায্য করেছিল, তার নাম হচ্ছে শশীগুপ্ত। তারপর স্বদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে কত যে বিশ্বাসঘাতক, এখানে সকলকার নাম করবার জায়গা হবে না।

রণসম্বর অবরোধেও বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অভিনয় করবার মতো লোকের অভাব হল না। হামির দেবের মন্ত্রী রণমল আরও কয়েকজন বিশ্বাসহন্তা হিন্দুর সঙ্গে দুর্গ থেকে বেরিয়ে অবলম্বন করলে শত্রুপক্ষ। দুর্গের কোথায় কী রকম দুর্বলতা আছে তা জানবার জন্যে আলাউদ্দিন তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন।

দুর্গের মধ্যে হামির দেবের আশ্রিত মুসলমানও ছিল অনেক। তারা কিন্তু খাঁটি মানুষ, নিমকের মর্যাদা নষ্ট করেনি একজনও। রাজপুতদের সঙ্গে সমানভাবে দাঁড়িয়ে তারাও প্রাণপণে বাধা দিয়েছিল আলাউদ্দিনের সৈন্যদের এবং তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মোগল সেনাপতি মির মহম্মদ সা। তাহলেই দেখা যাচ্ছে, এই ভারতবর্ষে বহু শতাব্দী পূর্বেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সত্যিকারের মিলন কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।

কেটে গেল পুরো একটি বৎসর। অবশেষে আলাউদ্দিন কেল্লা দখলের এক নতুন উপায় আবিষ্কার করলেন। বালিভরা থলের উপরে থলে সাজিয়ে দুর্গ-প্রাকারের সমান উঁচু করা হল।

তারপরে সেই থলেগুলোর উপর দিয়ে উঠে প্রাকারের শীর্ষদেশে গিয়ে দাঁড়াল কাতারে কাতারে মুসলমান সৈন্যগণ।

দুর্গের মধ্যে দুই পক্ষের হাতাহাতি যুদ্ধ বাধল বটে, কিন্তু আর দুর্গ রক্ষা করা সম্ভব নয়, রণসম্বর আর নিজের অজেয় নাম রক্ষা করতে পারবে না।

হতাশ হয়ে হামির দেব বললেন, ‘ওই পাহাড়ের উপরে জ্বালাও এক প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড! বীরের মৃত্যুকে যারা ভয় করে না, এগিয়ে আসুক তারা! আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় যেসব মাতা-ভগ্নী-জায়া আর শিশু সন্তানগণ, বিধর্মীদের অপবিত্র কবল থেকে রক্ষা করবার জন্যে নিক্ষেপ করো তাদের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায়! আজ আমাদের উদযাপন করতে হবে জহরব্রত। তারপর শুরু হবে আমাদের বিচিত্র মরণ-খেলা—আমরা মারব আর মরব, মারব আর মরব, মারব আর মরব! শত্রু রক্তে সর্বাঙ্গ রঞ্জিত করে মরণবিজয়ীর দল আমরা মরতে মরতে হাসব, মরতে মরতে হাসব, মরতে মরতে হাসব! হা হা হা হা হা হা! আলাউদ্দিন রণসম্বর জয় করতে পারে, আমাদের জয় করতে পারবে না! হর হর মহাদেব!’

মোগল সেনাপতি মির মহম্মদ সা এগিয়ে এসে বললেন, ‘রাজা, আমিও জহরব্রত পালন করতে চাই।’

হামির দেব সবিস্ময়ে বললেন, ‘সে কী, আপনি যে মুসলমান!’

মহম্মদ হাসিমুখে বললেন, ‘হাঁ রাজা, আমি মুসলমান হলেও আপনার সঙ্গে আমার অদৃষ্ট যে একসূত্রে গাঁথা! আর আমার জন্যেই আজ তো আপনার এই বিপদ!’

হামির দেব বললেন, ‘ইচ্ছা করলে আপনি এখনও পলায়ন করতে পারেন। জহরব্রত পালন করার অর্থই হচ্ছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। আপনি পারবেন?’

মিষ্টি হাসি হেসে মহম্মদ বললেন, ‘হিন্দু পারে, মুসলমান কি পারে না? ভারতের হিন্দু-মুসলমান হচ্ছে এক বোঁটায় দুটি ফুল! ওদের একটি শুকোলে শুকিয়ে যাবে অন্যটিও।’

হামির দেব বললেন ‘উত্তম। এর উপরে আর কথা নেই।’

পাহাড়ের শিখরে দাউ দাউ জ্বলে উঠল বিশাল অগ্নিশয্যা। হামির দেবের সহধর্মিণী রানি রঙ্গদেবীর সঙ্গে দলে দলে রাজপুতকন্যা দৃঢ়পদে অগ্রসর হয়ে জ্বলন্ত শয্যায় শয়ন করলেন এমন প্রশান্ত মুখে যে, দর্শকদের মনে হল তা অগ্নিকুণ্ড নয়, চন্দনকুণ্ড!

সব শেষ।

হামির দেব অসি কোশমুক্ত করে বললেন, ‘এইবারে আমাদের পালা! হর হর মহাদেব!

মহম্মদ সা অসি কোশমুক্ত করে বললেন, ‘চলুন রাজা! আল্লা হো আকবর!’

হাজার হাজার রাজপুত বীর অস্ত্রচালনা করতে করতে ঝাঁপ দিলে শত্রু-সৈন্য-সাগরের মধ্যে। উচ্ছ্বসিত, আন্দোলিত হয়ে উঠল সৈন্যসাগরের তরঙ্গের পর তরঙ্গ, তার তলায় ডুবে গেল কে জানে কোথায় আত্মত্যাগী হিন্দু বীরদের রক্তলাঞ্ছিত ক্ষত-বিক্ষত পবিত্র দেহ।

হামির দেবও ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু তখনও নিকটস্থ নয়। অনেক কষ্টে উঠে বসলেন তিনি ধীরে ধীরে। পরাধীনতা যে মৃত্যুরও চেয়ে ভয়াবহ! প্রাণপণে দেহের সমস্ত শেষশক্তি সঞ্চয় করে নিজে তরবারি তুলে স্বহস্তে করলেন তিনি নিজের কণ্ঠদেশে প্রচণ্ড আঘাত! পৃথিবীর কোলে লুটিয়ে পড়ল মহাবীরের দেহহীন মুণ্ড এবং মুণ্ডহীন দেহ।

মির মহম্মদেরও সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু মৃত্যু তখনও তাঁর কাছে আসেনি।

স্বয়ং আলাউদ্দিন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মির মহম্মদ সা! এখন আমি যদি চিকিৎসা করিয়ে আবার তোমাকে বাঁচিয়ে তুলি, তাহলে তুমি কী করবে?’

মহম্মদ সগর্বে বললেন, ‘আমি যদি বাঁচি, তাহলে আগে তোমাকে হত্যা করে পরে রাজা হামির দেবের পুত্রকে বসাব তাঁর প্রাপ্য সিংহাসনে!’

বলা বাহুল্য মির মহম্মদকে বাঁচাবার চেষ্টা হল না!

তারপর হল আর একটি ছোট্ট দৃশ্যাভিনয়, সে কথাও বলা উচিত বোধ হয়।

বিশ্বাসঘাতক স্বদেশদ্রোহী রণমল সদলবলে এসে সুলতান আলাউদ্দিনকে সম্বোধন করে বললে, ‘আপনাকে সাহায্য করেছি, এইবারে আমাদের পুরস্কার দিন।’

আলাউদ্দিন বললেন, ‘নিশ্চয়! বিশ্বাসহন্তাদের যোগ্য পুরস্কারই দেব। জল্লাদ! এদের মুণ্ডচ্ছেদ কর!’

যা বললুম বানানো কথা নয়, ইতিহাসের সম্পূর্ণ সত্যকথা।