» » মরা মানিক আর জ্যান্ত মানিক

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

মরা মানিক আর জ্যান্ত মানিক

বাবর তখন কাবুলের সিংহাসনে। তিনি দিল্লির সিংহাসন আক্রমণ করবার জন্যে তোড়জোড় করছিলেন।

হাজারা হচ্ছে আফগানিস্তানের একটি ছোট রাজ্য। হাজারার সরদারের ছোট ভাইয়ের নাম মুকারাব খাঁ।

বসন্তকালের একটি দিন। মুকারাব খাঁ দূরদেশ থেকে ফিরে আসছেন—সঙ্গে তাঁর ছয়জন অনুচর।

হাজারার কেল্লা-প্রাসাদের সামনে এসে মুকারাব সবিস্ময়ে অনুভব করলেন, চারিদিকে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক, থমথমে মৃত্যুস্তব্ধতা।

আরও দুই-চার পা এগিয়ে তাঁর বিস্ময় পরিণত হল আতঙ্কে। যেদিকে তাকানো যায়, চোখে পড়ে খালি ভীষণ দৃশ্য! শত্রুর দেখা নেই, কিন্তু কোথাও পড়ে আছে ভাঙা বাক্স-প্যাঁটরা, কোথাও বইছে রক্তের ঢেউ, কোথাও নর-নারীর ভূতলশায়ী নিশ্চেষ্ট মৃতদেহ।

ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে মুকারাব নগ্ন তরবারি হাতে করে প্রহরীহীন প্রাসাদ-দ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।

উপরে উঠে একটি ঘরে ঢুকে তিনি স্তম্ভিত চোখে দেখলেন, মেঝের উপরে মৃত প্রহরীদের মাঝখানে পড়ে আছে তাঁর দাদার স্ত্রী ও শিশু-পুত্রের দেহ!

মুকারাব হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘এ বীভৎস দুঃস্বপ্নের অর্থ কী?’

ঘরের কোণে মৃতদেহের স্তূপের ভিতর থেকে টলতে টলতে কাঁপতে কাঁপতে এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। মুকারাব চিনলেন, তিনি হচ্ছেন তাঁদের পরিবারের বিশেষ বন্ধু—বিশ্বস্ত এক মোল্লা বা পুরোহিত। তাঁরও সর্বাঙ্গ, রক্তাক্ত, ডান হাতের তিনটি আঙুল উড়ে গেছে, দেহের এক পাশেও গভীর ক্ষত—দেখলেই বোঝা যায়, তাঁর মৃত্যু আসন্ন।

বৃদ্ধ ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘বাছা, তোমার দাদা কেল্লার সমস্ত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে বেরিয়ে সদলবলে মারা পড়েছেন। সেই অবকাশে কুখ্যাত দস্যু-দলপতি মনসুর এসে কেল্লায় ঢুকে আমাদের এই সর্বনাশ করে গেছে। কিন্তু ভগবানকে ধন্যবাদ, যে লোভে দুরাত্মা এখানে এসেছিল তার সে লোভ ব্যর্থ হয়েছে! হাজারার পদ্মরাগমণি সে নিয়ে যেতে পারেনি—এই নাও, তোমার হাতে আমি তা সমর্পণ করছি!’ কোমরবন্ধের ভিতর থেকে মণি বার করে দিয়েই বৃদ্ধ আবার মাটির উপরে লুটিয়ে পড়লেন—সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রাণ বেরিয়ে গেল।

হাজারার মহামূল্যবান পদ্মরাগমণি—এর নাম ফেরে লোকের মুখে মুখে! সাত রাজার ধন মানিক বলতে যা বুঝায়, এ হচ্ছে তাই। সকলেরই লোভী দৃষ্টি পাগল হয়ে ওঠে তাকে লাভ করবার জন্যে।

মণিখানি হাতে নিয়ে মুকারাব মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, তাঁর ছয় সঙ্গীর মধ্যে একজন হয়েছে অদৃশ্য।

জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় গেল সে?’

একজন বললেন, ‘সে হঠাৎ নীচে নেমে ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ের দিকে চলে গেল!’

সচকিত কণ্ঠে মুকারাব বললেন, ‘পাহাড়ের দিকে চলে গেল! এটা তো ভালো কথা নয়! সবাই হুঁশিয়ার থাক—নিশ্চয় সে বিশ্বাসঘাতক!’

ডাকাতদের নায়ক মনসুর—বিরাট তার দেহ, বিকট তার চেহারা! সে যখন চলাফেরা করে, মনে হয় মস্ত এক বনমানুষ বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

যেমন তার আকৃতি, তেমনি প্রকৃতি। দয়া-মায়ার স্বপ্নও সে দেখেনি কোনও দিন। মানুষের প্রাণ তার কাছে মাটির খেলনার মতন তুচ্ছ। প্রকাণ্ড দল নিয়ে সে যখন মানুষ শিকারে বেরোয়, দেশ জুড়ে ওঠে তখন হাহাকার!

পাহাড়ের বুকের ভিতর মনসুরের সুরক্ষিত আস্তানা। সেখানে গিয়ে কেউ তাকে আক্রমণ করতে পারে না।

হাজারার কেল্লা লুঠে ফিরে এসে মনসুর বিশ্রাম করছিল।

হঠাৎ দেখা গেল, কে একটা অচেনা লোক দ্রুতপদে আসছে তাদের আস্তানার দিকে।

সিংহ-বিবরের মুখে কে এই নির্বোধ হতভাগ্য? মনসুরের বিস্মিত সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে হাতে বিদ্যুৎ দুলিয়ে নেচে উঠল তরবারির পর তরবারি!

আগন্তুক ত্রস্তভাবে দুহাত তুলে বললে, ‘আমি শত্রু নই, আমি বন্ধু।’

ডাকাতরা বললে, ‘তোমাকে আমরা চিনি না। কে তুমি?’

—‘আমি হাজারার এক সৈনিক, তোমাদের সরদারের কাছে এসেছি।’

মনসুর চলন্ত মাংস-হাড়ের পাহাড়ের মতো এগিয়ে এসে বাজখাঁই গলায় বললে, ‘আমার কাছে কী চাও তুমি?’

—‘হাজারার পদ্মরাগ মণির সন্ধান আমি জানি। আপনি যদি সেখানা আমাকে পাইয়ে দিতে পারেন, আমি তাহলে অনেক টাকা পুরস্কার দিতে রাজি আছি।’

মনসুর ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘পুরস্কার টুরস্কার নয়—আমি সেই মণিখানাই চাই। তার সন্ধান দিলে তুমি পাবে হাজার মোহর বকশিশ!’

সৈনিক বুঝলে সে যমের মুখে এসে পড়েছে, এখন ছাড়ান পাওয়া যাবে না! হাতে যা আছে, তাই নিয়েই প্রাণে প্রাণে সরে পড়াই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।

সে বললে, ‘মণিখানা আছে আমার প্রভু মুকারাব খাঁয়ের কাছে। তিনি এখন আত্মীয়দের গোর দিতে ব্যস্ত। তাঁর সঙ্গে পাঁচজনের বেশি সৈনিক নেই।’

মনসুর বললে, ‘সুখবর বটে। এই নাও তোমার বখশিশ।’

সৈনিক সাগ্রহে মোহরগুলো গুনতে বসে গেল।

মনসুর রহস্যময় হাসি হেসে বললে, ‘সুখবর এনেছ বলে প্রাপ্য পুরস্কার তুমি পেলে। এইবারে তোমার বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার নাও’—মনসুরের তরবারি শূন্যে উঠল ও নীচে নামল। পরমুহূর্তে দেখা গেল, বিশ্বাসঘাতক সৈনিকের ছিন্ন মুণ্ড ধুলার উপরে গড়িয়ে যাচ্ছে।

উচ্চ পর্বতের উপরে সমুজ্জ্বল আকাশপটে আচম্বিতে কে যেন এঁকে দিলে সারি সারি অশ্বারোহীর জীবন্ত ছবি!

শোকে কাতর হলেও মুকারাব খাঁয়ের চোখের তীক্ষ্ণতা ভোঁতা হয়ে যায়নি। ক্ষণে ক্ষণে তিনি এদেরই দেখা পাবার আশা করছিলেন! গুণে দেখা গেল, সংখ্যায় তারা তিরিশজন।

এক লাফে তিনি ঘোড়ার উপরে উঠে পড়ে সঙ্গের পাঁচজন সৈনিককে ডেকে বললেন, ‘তিরিশজনের বিরুদ্ধে আমরা ছ’জনে অস্ত্র ধরে কিছুই করতে পারব না। দক্ষিণ দিকে—কাবুলের দিকে ঘোড়া ছোটাও!’

কাবুলের পথে পড়ে যে গিরিসঙ্কট, মুকারাব খাঁ সঙ্গীদের সঙ্গে তার ভিতরে এসে পড়লেন—পিছনে নিয়ে তিরিশজন শত্রু।

ডাকাত সরদার মনসুরের বাহন ছিল তারই মতন বিপুলবপু, ভারী ও বলবান এক তুর্কি ঘোড়া।

মুকারাবের আরবি ঘোড়া—আকারে ছিপছিপে, তার পায়ে পায়ে বিদ্যুৎগতির ইঙ্গিত।

অন্যান্য ডাকাত ও মুকারাবের পাঁচ সঙ্গীর ঘোড়াগুলো ছিল সাধারণ!

খানিক পথ পেরিয়েই মুকারাব বুঝলেন, সঙ্গীদের থাকলে তাঁকেও ধরা পড়তে হবে। তাঁর আরবি ঘোড়া সতেজে সবেগে এগিয়ে যেতে চায়, কিন্তু সঙ্গীরা তাঁর নাগাল পাবে না বলে তাঁকে রাশ টেনে ধরে থাকতে হচ্ছে। ফলে, পিছনের ডাকাতেরা খুব কাছে এসে পড়েছে।

একটা তেমাথার কাছে গিয়ে মুকারাব সৈনিকদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা আর আমার সঙ্গে এস না। তোমরা যাও বাঁ-দিকে, আমি যাব ডানদিকে।’

তিনি ঘোড়ার রাশ ছেড়ে দিলেন—উড়ে চলল সে পক্ষিরাজের মতো!

এতক্ষণ পরে মনের সাধে ছুটতে পেরে তার খুশি আর ধরে না! দেখতে দেখতে সে শত্রুদের চোখের আড়ালে চলে যায় আর কি!

ওদিকে অন্যান্য ডাকাতদের ছোট ছোট ঘোড়াগুলো পাল্লা দিতে না পেরে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু মনসুরের বলবান ঘোড়া সামনে এগিয়ে চলল সামনে।

পাহাড়ের পথ কখনও উপরে ওঠে, কখনও নীচে নামে—তারপর পাহাড় পড়ে থাকে পিছনে। তারপর পায়ের তলায় এসে পড়ে রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তর, দুপাশ দিয়ে ছুটে চলে যায় চলচ্চিত্রের মতন ঝোপ, গাছ, বন, এবং হু-হু করে বন্য গীতি গেয়ে যায় উচ্ছ্বসিত বাতাস।

এখন দেখা যাচ্ছে কেবল দুই অশ্বারোহীকে। অন্যান্য ঘোড়সওয়াররা কোথায় কতদূর হারিয়ে গেছে, তার কোনও ঠিকানাই নেই!

মনসুরের ঘোড়া বলবান, মুকারাবের ঘোড়া বেগবান। কেউ কারুর কাছে হারতে রাজি নয়—শক্তি আর গতি।

সূর্য যখন ডুবু ডুবু—তখন গতি বুঝি শক্তিকে ফাঁকি দেয় দেয়!

মনসুরের ঘোড়ার দেহ ভারী, মনসুরের দেহ ভারি, উপরন্তু তাকে আরও ভারী করে তুলেছে তার নিজের দেহের লোহার বর্ম! মুকারাব-এর হালকা দেহ নিয়ে তাঁর ছিপছিপে ঘোড়া ক্রমেই বেশি তফাতে চলে যাচ্ছে।

মনসুর খুলে ফেলে দিলে শিরস্ত্রাণ আর বর্ম, খানিক হালকা হবার জন্যে।

মুকারাব হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেন, কাছে আছে মাত্র একজন শত্রু।

এতক্ষণ বাধ্য হয়ে তাঁকে পালাতে হচ্ছিল, এইবার জেগে উঠল তাঁর আহত বীর্য ও পৌরুষ। ঘোড়া থামিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে চোখের নিমেষে তিনি ধনুকে জুড়লেন তীক্ষ্ণ তির!

মনসুর মনে মনে গুনলে মহাপ্রমাদ! বর্ম আর শিরস্ত্রাণ হেলায় হারিয়ে অনুতাপ করতে করতে ঘোড়ার পিঠে গা মিলিয়ে সে উপুড় হয়ে পড়ল, বাণ এড়াবার জন্যে।

সে বাণ এড়ালে বটে, কিন্তু তার ঘোড়া এড়াতে পারলে না। আহত ঘোড়া হল ‘পপাত ধরণীতলে’। মনসুরের বিপুল দেহও মাটির উপরে পড়ে একেবারে নিশ্চেষ্ট।

মুকারাব টপ করে ঘোড়া থেকে নেমে শত্রুকে মৃত ভেবে পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কিন্তু মনসুর হচ্ছে মস্ত ধড়িবাজ, শত্রুর চোখে ধুলো দেবার জন্যেই মড়ার মতন স্থির হয়ে পড়েছিল। মুকারাবকে কাছে পেয়ে সে খপ করে হাত বাড়িয়ে তাঁর কোমরবন্ধ চেপে ধরলে এবং তারপর বিষম ঝাঁকানি দিতে আরম্ভ করলে।

অতিকায় মনসুরের হাতে পড়ে মুকারাবের হাল হল বিড়াল কবলগত ইঁদুরের মতন। গায়ের জোরে তাকে বাধা দেবার সাধ্য তাঁর নেই। তিনি চটপট ছোরা বার করে তাকে আঘাত করলেন এবং মনসুরও আত্মরক্ষার জন্যে তাড়াতাড়ি তাঁকে ছেড়ে খাপ থেকে খুলে ফেললে তরবারি।

তখন সূর্যহারা আকাশের তলায়, শেষবেলার আলতা-আলো গায়ে মেখে দুই বীরের নগ্ন তরবারি ধরলে মৃত্যু-সঙ্গীতের উদ্দাম ছন্দ!

এ যুদ্ধে মনসুরের চেয়ে মুকারাবেরই সুবিধা বেশি। গুরুভার মনসুর প্রতিপক্ষের আক্রমণের ক্ষিপ্রতা এড়াতে এড়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে ডানদিকে ফেরবার উপক্রম করতে-না-করতেই মুকারাব সাঁৎ করে তার বাঁদিকে সরে গিয়ে মেরে দেন তরোয়ালের খোঁচা!

এইভাবে খানিকক্ষণ লড়তে পারলেই মুকারাবের শত্রু রক্তপাতের ও পরিশ্রমের জন্যে দুর্বল হয়ে হার মানতে বাধ্য হত। কিন্তু তাঁর অপেক্ষা করবার সময় নেই, কারণ যে-কোনও মুহূর্তেই পিছিয়ে পড়া ডাকাতদের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা!

বারবার তরবারির খোঁচা খেয়ে মনসুর রাগে অজ্ঞান হয়ে হঠাৎ সামনের দিকে বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ে নিজের তরবারি তুলে প্রচণ্ড এক কোপ বসিয়ে দিলে,—মুকারাবের তরবারি সে আঘাত সদর্পে গ্রহণ করলে এবং পরমুহূর্তে দস্যুর অসি ঝনঝন শব্দে ভেঙে দুখানা হয়ে গেল।

মুকারাব সেই প্রবল আক্রমণ ভালো করে সামলাবার আগেই মনসুর ভগ্ন অসি ফেলে প্রকাণ্ড এক যুদ্ধ-কুঠার নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে আবার তেড়ে এল—তার দুই তীব্র চক্ষু তখন জ্বলে উঠেছে হিংস্র পশুর মতো!

মুকারাব পাঁয়তারা কষে একপাশে সরে গেলেন—শত্রুর কুঠার শূন্যে খুঁজে পেলে কেবল শূন্যতাকেই! তারপর চোখের পলক পড়বার আগেই মুকারাবের তরবারি আমূল প্রবেশ করলে মনসুরের দেহের মধ্যে।

মনসুর মাটিতে আছড়ে পড়ল, আর উঠল না। তার লোভী মন পদ্মরাগমণি লাভ করলে না বটে, কিন্তু তার ক্ষত-বিক্ষত দেহের উপরে ফুটে উঠল পদ্মরাগের রক্তরাগ!

কিন্তু মুকারাব তবু আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলেন না—দিকচক্রবাল রেখায় দেখা যাচ্ছে যেন কতকগুলি ঘোড়সওয়ারের মূর্তি!

প্রভুভক্ত আরবি ঘোড়া অদূরে অপেক্ষা করছিল, প্রভুর ডাক শুনে কাছে ছুটে এল! মুকারাব তার লাগাম ধরে পাশের জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করলেন।

অন্ধকারের অন্তপুরে ঢুকে আলোর দৃষ্টিও তখন অন্ধ হয়ে আসছে।

পরদিনের ভোরবেলা। গাছের পাতায় পাতায় সূর্যকরে সোনালি রূপ, গাছের ডালে ডালে পাখিদের খুশির সুর।

আফগানিস্তানের ঘালমান উপত্যকা—যেন সৌন্দর্যের নাচঘর! নদীর মুখে ফোটে আনন্দের বন্দনা, বুকে দোলে হিরার লহর! দিকে দিকে ছায়ার আশ্রয় রচনা করে পুলক-রোমাঞ্চে মর্মর-ছন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে খুবানি, আখরোট, ঝাউ, পিচ, তুঁত ও চেরি প্রভৃতি গাছের দল।

অদূরে দেখা যাচ্ছে সরদার দোস্ত মহম্মদের দুর্গ-প্রাসাদ।

সরদারের মেয়ে জুলেখা। বাগানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ তাঁর শাখ হল, একবার বনের ভিতরটা দেখে আসবার জন্যে।

সহচরীরা সভয়ে জানালে, তিনি পর্দানসিন, সরর্দারের কানে একথা উঠলে তিনি ভারি রাগ করবেন।

জুলেখা বললেন, ‘বনে এত ভোরে কেউ থাকে না। কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।’

সহচরীরা খিড়কির ফটক খুলে দিলে। জুলেখা বাইরে পা বাড়িয়েই দেখলেন এক অভাবিত অপূর্ব দৃশ্য!

গাছের তলায় ঘাস বিছানায় দুই চোখ মুদে শুয়ে আছেন এক সুকুমার দেবকুমার।

জুলেখার দেবকুমার হচ্ছেন আমাদের মুকারাব। হঠাৎ চোখ খুলে তিনিও হলেন চমৎকৃত! একি পরিস্থানের স্বপ্ন? এমন অপরূপ জীবন্ত রূপের ডালি কবে কে দেখেছে দুনিয়ায়?

মুকারাব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। মুখে গুণ্ঠন টেনে জুলেখা অদৃশ্য হয়ে গেলেন শরীরিনী বিদ্যুল্লতার মতো।

মুকারাব চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলেন। তারপর মনে মনে হেসে জামার ভিতর থেকে বার করলেন হাজারার বিশ্ববিখ্যাত পদ্মরাগমণি! সূর্যকরে সে জ্বলে উঠল আরক্ত অগ্নিশিখার মতো।

মুকারাব বললেন, ‘তুচ্ছ এই সাতরাজারধন মরা মানিক! এর বিনিময়ে আমি এক জ্যান্ত মানিক আনতে চললুম!’

এরপর আর বলবার কথা বেশি নেই।

সরদার দোস্ত মহম্মদ যখন মুকারাবের পরিচয় পেলেন ও তাঁর সকল কথা শুনলেন, তখন তাঁকে আদর-যত্ন করতে কোনওই ত্রুটি করলেন না। বললেন, ‘বৎস, এত বিপদ এড়িয়ে তুমি যে হাজারার আশ্চর্য পদ্মরাগমণি উদ্ধার করতে পেরেছ, এরচেয়ে সৌভাগ্য আর হতে পারে না।’

—‘কিন্তু সে মণি আপনার হাতেই সমর্পণ করতে এসেছি।’

দোস্ত মহম্মদ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। বিপুল বিস্ময়ে বললেন, ‘আমার হাতে সমর্পণ করতে এসেছ?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বিনিময়ে এর চেয়েও মূল্যবান রত্ন পাব বলে।’

—‘এর চেয়ে মূল্যবান রত্ন পৃথিবীতে নেই।’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে বইকি! আপনার কন্যা জুলেখাকে চোখে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।’

তখন দোস্ত মহম্মদ সব বুঝলেন।

মুকারাবের মতো সম্ভ্রান্ত, সুদর্শন ও বীর্যবান জামাই পাওয়াই সৌভাগ্যের কথা, তার উপরে প্রাপ্য হবে হাজারার অতুলনীয় পদ্মরাগমণি!

সুতরাং বিয়ের বাজনা বাজতে দেরি লাগল না এবং জুলেখাকে আবার মুকারাবের সুমুখে এসে মুখের ঘোমটা খুলে দাঁড়াতে হল!

কিছুদিন পরে বাবরের সঙ্গে মুকারাব যাত্রা করলেন পানিপথ যুদ্ধক্ষেত্রে।