পূবের হাওয়া
‘পূবের হাওয়া’ প্রকাশের কালক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের সপ্তম কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশকাল আশ্বিন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ (অক্টোবর ১৯২৫)। প্রকাশক মজিবল হক, বি,কম্, ভোলা বরিশাল। মুদ্রাকর মজিবল হক, বি,কম্। ওরিয়েণ্টাল প্রিণ্টার্স লিমিটেড, ২৬/৯/১এ, হ্যারিসন রোড, কলিকাতা। পৃষ্ঠা: ২+৫০। দাম পাঁচ সিকা। প্রকাশক ‘একটি কথা’য় বলেন—
‘পূবের হাওয়া’য় পঞ্চাশটি কবিতা যাওয়ার কথা। এবার সাঁইত্রিশটি গেল; পর বারে সব কটি দেওয়া যাবে।
প্রথম সংস্করণের মোট ৩৭টি কবিতা ও গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ২৬টি কবিতা ও গান ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থে পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। নিম্নে সেগুলোর তালিকা প্রদান করা হল এবং বন্ধনীর ভিতরে ‘ছায়ানট’ কাব্যে প্রকাশিত শিরোনাম দেওয়া হল—
শিরোনাম
‘ছায়ানট’ কাব্যে প্রকাশিত উল্লিখিত ২৬টি কবিতা ও গানের যেগুলো হুবহু ‘পূর্বের হাওয়া’ কাব্যে সঙ্কলিত হয়েছে সেগুলো ‘পূর্বের হাওয়া’র বর্তমান সংস্করণে বর্জন করা হয়েছে। তবে ‘ছায়ানট’ ও ‘পূবের হাওয়া’ সংস্করণে যে সকল কবিতা ও গানে পাঠভেদ আছে সেইগুলো বর্তমান সংস্করণে রাখা হয়েছে।
‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘মুক্তি-বার’ কবিতাটির শেষস্তবকের প্রথম পঙ্ক্তি ‘তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি …’ ‘পূবের হাওয়া’য় হয়েছে এরূপ—
যখন তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি …’
‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘পরশ-পূজা’ কবিতাটির ষষ্ঠ পঙ্ক্তি ‘পূবের হাওয়া’য় হয়েছে এরূপ—
আহা পরশ তোমার জাগ্ছে যে গো এই সে, দেহে মম,
কম সরস হরষ-সম॥
নবম পঙ্ক্তি হয়েছে এরূপ—
তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁওয়ার আকুল কাঁপন আছে—
মদির অধীর পূলক নাচে॥
এবং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ পঙ্ক্তিদ্বয় হয়েছে এরূপ—
আমি চুমোয় চুমোয় ডুবাবো এই সকল দেহ মম—
ওগো শ্রাবণ-প্লাবণ সম॥
‘দূরের পথিক’ কবিতাটির প্রারম্ভ ‘পূবের হাওয়া’য় এরূপ—
আজ অমন কর গো বারে-বারে জল-ছলছল চোখে চেয়ো চেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।
‘পুলক’ কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবক ‘পূবের হাওয়া’য় এরূপ—
তার অবুঝ বনের সবুজ সুরে
মাঠের নাটে পুলক পুরে,
ঐ গহন বনের পথটি ঘুরে বাজিয়ে বাঁশী আসছে দূরে
কচি পাতা দূত ওরি॥
‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘শেষের গান’ অনেক শব্দ পরিবর্তন করে ‘শেষের ডাক’ শিরোনামে ‘পূবের হাওয়া’য় মুদ্রিত হয়েছে; তাই গানটি পূবের হাওয়ার বর্তমান সংস্করণে রাখা হয়েছে।
‘ছায়ানটের’ ‘মুক্তিবার’ কবিতার নাম ‘পূবের হাওয়া’য় ‘অবসর’। ‘অবসর’ কবিতার দ্বাদশ চরণের পরে আছে—
অভিমানিনীরে মোর।
‘মুক্তিবারে’ এ চরণটি নেই।
ছায়ানটের ‘নিরুদ্দেশের যাত্রী’ কবিতার একবিংশ ও দ্বাবিংশ চরণ দুটি এরূপ—
থামল বাদল-রাতের কাঁদা
হাসলো আবার টুটলো ধাঁধা।
পূবের হাওয়ায় ‘নিরুদ্দেশের যাত্রী’ কবিতায় চরণ দুটি এরূপ—
থামল বাদল রাতের কাঁদা
ভোরের তারা কনক-গাঁদা।
ছায়ানটের ‘চিরশিশু’ কবিতার শেষ তিন চরণ—
ওরে ও কে কণ্ঠ রুখে
উঠছে কেন মন ভারায়ে।
অস্ত হতে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে॥
পূবের হাওয়ায় ‘পথিক শিশু’ কবিতার শেষ দুটি চরণ এরূপ—
ওরে ও কে কণ্ঠ রুখে? পাঁচ ফাগুনের যুঁই-চারা এ
আজ মন-পাখি ধায় মধুরতম নাম আশীষের শেষ ছাড়ায়ে।
ছায়ানটের ‘দহনমালা’ কবিতার দ্বিতীয় চরণের ‘বদল দিয়ে’ এবং ষষ্ঠ চরণের ‘দু’হাতে পূরে’ পূবের হাওয়ার ‘দহনমালা’ কবিতায় যথাক্রমে ‘বদল করে’ ও ‘দু’ হাত ভরে’ হয়েছে।
ছায়ানটের ‘বিধুরা পথিক-প্রিয়া’ ও পূবের হাওয়ার ‘পথিক-বধূ’ কবিতার প্রথম একাদশ চরণের পাঠ অভিন্ন। তারপরে ‘পথিক-বধূ’ কবিতায় পাই—
পরদেশী কোন শ্যামল বঁধূর শুনতো বাঁশি সারাক্ষণ গো?
চুমচো কারে? ও নয় তোমার পথিক-বঁধূর
চপল হাসির হা-হা
তরুণ ঝাউএর কচি পাতায় করুণ অরুণ কিরণ
ও যে আ-হা
দূরের পথিক ফিরে নাক আর (আহা আ-হা)
ও সে সবুজ দেশের অবুঝ পাখি
কখন্ এসে যাচবে বাঁধন, চল পাখি ঘরকে চল!
ওকি? চোখে নাম্লো কেন মেঘের ছায়া ঢল ছল॥
ছায়ানটের ‘ছলকুমারী’র প্রথম স্তবকের শেষ দুই চরণ এবং দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম চরণে পাঠভেদ পাওয়া যায় পূবের হাওয়ার ‘প্রণয়-ছল’ কবিতায়। সেখানে—
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে
অনামিকায় গড়িয়ে আঁচল গাল দুটিকে ঘামায়॥
সবাই যখন ঘুমে মগন দুরু দুরু বুকে তখন
আমায় চুপে চুপে
রূপান্তরিত হয়েছে—
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে
গাল দুটিকে ঘামায়॥
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল
দুরু দুরু বুকে
সবাই যখন ঘুমে মগন তখন আমায় চুপে চুপে।
এই কবিতায় আরও কিছু পরিবর্তন লক্ষযোগ্য। যেমন— ‘ছলকুমারীর’র ‘সইরা হাসে দেখে তাহার’ ‘প্রণয়-ছলে’ ‘সইরা হাসে দেখে ছুঁড়ির’ এবং প্রথমোক্ত কবিতার—
কি যে কথা সেই তা জানে
ছলকুমারী নানান ছলে আমারে সে জানায়
দ্বিতীয়োক্ত কবিতায়
চলতে চাদর পরশ হানে
আমারো কি নিতুই পথে তারি বুকের জামায়।
ছায়ানটের ‘বাদল-দিনে’ কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম স্তবক এবং ষষ্ঠ স্তবকের প্রথম চরণদুটি পূবের হাওয়ার ‘বরষা’ কবিতায় নেই।
এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত নতুন ১২টি কবিতা ও গান এবং সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল—
‘স্মরণে’ ১৩২৭ শ্রাবণে (জুলাই-আগষ্ট ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) ৩য় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’য় ‘গান’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। শিরোনামের নীচে লেখা ছিল— “সুর—হিন্দুস্থানী—কাজরী”। তাতে দ্বিতীয় স্তবকের পঞ্চম পঙ্ক্তি ছিল নিম্নরূপ—
তাই পরাণ আমার বেড়ায় মেগে
সে কা’র যতনে।
‘বাদল-প্রাতের শরাব’ আষাঢ় ১৩২৭ বঙ্গাব্দ, মুতাবিক জুন-জুলাই ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনামের নীচে বন্ধনীতে লেখা ছিল—‘হাফিজ-এর ছন্দ ও ভাব অবলম্বনে’। ‘পূবের হাওয়ায় কবিতাটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘নিকটে’। এই কবিতাটি সম্বন্ধে ১৩২৭ বঙ্গাব্দ ভাদ্রের ‘মোসলেম ভারতে’ শ্রীমোহিতলাল মজুমদার বলেন—
‘বাদল-প্রাতের শরাব’ শীর্ষক কবিতায় ইরানের পুষ্পসার ও দ্রাক্ষাসার ভরপুর হইয়া উঠিয়াছে। এ কবিতাটিতেও কবির ‘মস্ত’ হইবার ও ‘মস্ত’ করিবার ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে। বাঙ্গালি মাত্রেই ইহার উচ্ছল রসাবেশ অন্তরে অনুভব করিবে। কবির লেখনী জয়যুক্ত হউক।
‘মানিনী’ ১৩২৭ বৈশাখের ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’য় ‘মানিনী বধূর প্রতি’ শিরোনামে বের হয়েছিল।
‘আশা’ ১৩২৭ পৌষের ‘সওগাতে’ ‘কলঙ্কী প্রিয়’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। বন্ধনীতে লেখা ছিল— ‘গান—বাউলের সুর’।
‘শরাবান্ তহুরা’ [‘নার্গিস বাগ্ মেঁ বাহার কি আগ্ মেঁ’] গানটি ১৯৩০ সালে রচিত বলে শ্রদ্বেয় মুজফ্ফর আহমদ ১৯৬৬ সালের ২রা আগস্ট তারিখে লেখা তাঁর একপত্রে (১৩৮১ সালের নজরুল একাডেমী পত্রিকায় প্রকাশিত] উল্লেখ করেছেন।
‘বিরহ-বিধুরা’ ১৩২৭ মাঘের ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপা হয়েছিল। পাদটীকায় লেখা ছিল— “কাবুলী-কবি ‘খোশহাল’-এর হিন্দুস্থানে নির্বাসন-কালীন তাঁহার সহধর্মিনীর লিখিত একটি কবিতার ভাব অবলম্বনে’।