রাণুর প্রথম ভাগ
অকাল-বোধন
১
বিবাহের পরে ননদ প্রথম বার শ্বশুরবাড়ি যাইবে, নন্দাই লইতে আসিয়াছে; পঙ্কজিনীকে তাহার নিজের ঘরটি কিছুদিনের জন্য এই নবদম্পতিকে ছাড়িয়া দিতে হইল, কারণ বাড়িতে ঘরের অভাব। কর্ত্তার বন্দোবস্ত হইল সদর-ঘরে। ছোট যে ভাঁড়ারঘরটি ছিল, তাহারই জিনিসপত্র সরাইয়া পঙ্কজিনী নিজের, পুত্রকন্যাদের এবং দেবরটির সংস্থান করিয়া লইল।
কোলের ছেলেটি এই পরিবর্ত্তনের কারণ বুঝিতে না পারিয়া মার গলা জড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাদেল ঘলে ছুলে না কেন মা?
তোর পিসী তাড়িয়ে দিয়েছে।
বাবাকেও তালিয়ে দিয়েতে?
হ্যাঁ, দিয়েছে বইকি।
কেন?
আড়ি পাতিবার সময় উতরাইয়া যাইতেছিল। ছেলের কানের উপর ঘুমপাড়ানির লঘু আঘাত করিয়া জননী বলিল, নে, ঘুমো দিকিন তুই এখন, বকর-বকর করতে হবে না, — ওই, আয় তো রে হুমো —
সমস্ত দিনের দৌরাত্ম্য-ক্লান্ত শিশু অমন পিসীমার স্বভাবের এই আকস্মিক পরিবর্ত্তনের কথা, হুমোর অলৌকিক চেহারা এবং কীর্ত্তিকলাপের কথা এবং দিবসের হাসিকান্নার দুই-একটা আধবিস্মৃত কথা ভাবিতে ভাবিতে মায়ের কোলে নিদ্রায় এলাইয়া পড়িল। একটু পরেই পাড়ার কয়েকজন যুবতীর চুড়ির ঠুনঠুন, কাপড়ের খসখসানি এবং চাপা গলার ফিসফিসানিতে ঘরের পাশের হাওয়াটা কৌতুকচঞ্চলতায় জীবন্ত হইয়া উঠিল। পঙ্কজিনী কোলের ছেলেটিকে আরও দুই-একটা নরম আঘাত দিয়া শোয়াইয়া দিল; ঘরের অন্যান্য ঘুমন্ত মুখগুলির উপর চক্ষু বুলাইয়া লইল; তাহার পর চাপা স্বরে অনিচ্ছার আভাস মিশাইয়া বলিল, জুটেছিস পোড়রমুখীরা? বলিহারি শখ তোদের, কোথায় একটু চোখ বুজব, না — । বলিতে বলিতে খিড়কির দরজাটার অর্গল খুলিয়া দিল।
একজন ভিতরে আসিতে আসিতে নথের ঝাঁকি দিয়া বলিল, নাঃ, শখে আর কাজ কি? তোমার কত্তার কাছে গিয়ে ভাগবতে দীক্ষা নিগে যাই। বলি, হ্যাঁ, তাকে বাড়ির বাইরে করেছ তো? নইলে আমাদের মতলব টের পেলে এই রাত-দুপুরে ডাকাত-পড়া কাণ্ড করে তুলবেন ’খন।
এই সম্মিলনীটিতে বয়সে বোধ হয় পঙ্কজিনীই সবচেয়ে বড়, তাই সে সলজ্জ গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, দেখিস, বেশি বাড়াবাড়ি করিস নি কিন্তু সব। এই দেড় দিন গাড়িতে এসে হাক্লান্ত হয়ে আছে বেচারা, একটু ঘুমুনো দরকার।
এই সহানুভূতিতে একটি তরুণী নবম পর্দ্দাতেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল, অপরের গা ঠেলিয়া বলিল, দিদি ভুলে গেছে সব; ঘুমের জন্যেই ওদের মাথা-ব্যথা বটে। ইহাতে দলটির একপাশে কয়েকজনার মধ্যে একটু টেপা হাসি, অর্থপূর্ণ চাহনি এবং দুই-একটা অন্যবিধ বয়সসুলভ ইশারার বিনিময় হইয়া গেল। যাহারা এই চপলতাটুকুর মূল কোথায় বুঝিল না, তাহারা কপট বিরক্তির সহিত মত দিল, এসব ছ্যাবলাদের সঙ্গে কোথাও যাইতে নাই।
অমনই ছ্যাবলাদের দলের একজন হঠাৎ ভারিক্কি হইয়া বলিল, তাই না তাই, দু চক্ষের বালাই সব —
এই ছলাটুকুতে সকলে হাসিয়া উঠিল। পঙ্কজ ঠোঁটে হাসির একটু রেশ নিয়া রাখিয়া বলিল, পোড়ার মু — খ, রঙ্গ নিয়েই আছেন।
ইহারা যতই আনন্দমুখর হইয়া উঠিতেছিল, পঙ্কজিনীর উৎসাহটা যেন ততই শিথিল হইয়া আসিতেছিল। ইহারা সকলে মিলিয়া হঠাৎ ঘরটার মধ্যে পূর্ণযৌবনের এমন একটা রসহিল্লোল তুলিল যে, যৌবনসীমাগতা এই নারীর ইহাদের মধ্যে নিজেকে নিতান্ত খাপছাড়া বলিয়া বোধ হইল। যদি চিন্তার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে ফুটমান কলিটির পাশে যে ফুলটি ফোটা শেষ করিয়া দুই-একটি দল হারাইয়া বৃন্তসংলগ্ন রহিয়াছে, সেও বোধ করি এক রকমই ভাবিত। একেবারে তাহার সমবয়সীগোছের কেহই ছিল না সেখানে, তাহার পাতানো ‘গোলাপ’ পর্য্যন্ত নয়। কেন যে ছিল না, পঙ্কজ তাহার কারণ নিজের মনকে নিজেই দিল — তাহারা সব নিজেদের সাত আট দশ বৎসরের পুত্রকন্যা লইয়াই ব্যস্ত, এই সব লঘুতার কি আর অবসর আছে? একজনকে প্রশ্ন করিল, কই, গোলাপ এল না রে ছোট বউ? উত্তর পাইল, তাঁর শরীরটা তেমন ভাল নয়।
সেই মুখরা মেয়েটা একটু পিছনে সরিয়া গিয়া একজনের ঘাড়ে মুখ গুঁজিয়া বলিল, মোটে দুদিনের ছুটিতে গোলাপের ‘ভোমরা’ বাড়ি এসেছে।
কে তাহার গাল দুইটা টিপিয়া ধরিল, বলিল, মুয়ে আগুন, রস যে ধরে না আর! তোমার ভোমরারও শিগগির আসা দরকার হয়ে পড়েছে।
পঙ্কজিনী হঠাৎ বলিল, তা সব দাঁড়িয়ে রইলি যে? যা করতে এসেছিস কর্গে।
একজন বলিল, বাঃ, আর তুমি?
নাঃ, আমি আর না; তোদের সব দোর খুলে দিতে উঠেছিলুম।
সে গেলই না। বিছানায় গিয়া শুইল এবং উঠানের ওপার হইতে যখন মাঝে মাঝে ত্রস্ত মলের শিঞ্জিনী এবং রুদ্ধ হাসির তরল ঝঙ্কার ভাসিয়া আসিতে লাগিল, সে খোকার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কি ভাবিয়া শরমে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিতে লাগিল।