বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

রাণুর প্রথম ভাগ

আমার ভাইঝি রাণুর প্রথম ভাগের গণ্ডি পার হওয়া আর হইয়া উঠিল না।

তাহার সহস্রবিধ অন্তরায়ের মধ্যে দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এক, তাহার প্রকৃতিগত অকালপক্ক গিন্নীপনা, আর অন্যটি, তাহার আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তাহার দৈনিক জীবনপ্রণালী লক্ষ্য করিলে মনে হয়, বিধাতা যদি তাহাকে একেবারে তাহার ঠাকুরমার মত প্রবীণ গৃহিণী এবং কাকার মত এম. এ., বি. এল. করিয়া পাঠাইতেন, তাহা হইলে তাহাকে মানাইতও ভাল এবং সেও সন্তুষ্ট থাকিত। তাহার ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পরবর্ত্তী ভাবী নারীত্ব হঠাৎ কেমন করিয়া যেন ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে আসিয়া পড়িয়া তাহার ক্ষুদ্র শরীর-মনটিতে আর আঁটিয়া উঠিতেছে না — রাণুর কার্য্যকলাপ দেখিলে এই রকমই একটা ধারণা মনে উপস্থিত হয়। প্রথমত, শিশুসুলভ সমস্ত ব্যাপারেই তাহার ক্ষুদ্র নাসিকাটি তাচ্ছিল্যে কুঞ্চিত হইয়া উঠে — খেলাঘর সে মোটেই বরদাস্ত করিতে পারে না, ফ্রক জামাও না, এমন কি নোলক পরাও নয়। মুখটা গম্ভীর করিয়া বলে, আমার কি আর ও সবের বয়েস আছে মেজকা?

বলিতে হয়, না মা, আর কি — তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল।

রাণু চতুর্থ কালের কাল্পনিক দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় মুখটা অন্ধকার করিয়া বসিয়া থাকে।

আর দ্বিতীয়ত — কতকটা বোধ হয় শৈশবের সহিত সম্পর্কিত বলিয়াই — তাহার ঘোরতর বিতৃষ্ণা প্রথম ভাগে। দ্বিতীয় ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার কাকার আইন-পুস্তক পর্য্যন্ত আর সবগুলির সহিতই তাহার বেশ সৌহার্দ্দ্য আছে, এবং তাহাদের সহিতই তাহার দৈনিক জীবনের অর্দ্ধেকটা সময় কাটিয়া যায় বটে, কিন্তু প্রথম ভাগের নামেই সমস্ত উৎসাহ একেবারে শিথিল হইয়া আসে। বেচারীর মলিন মুখখানি ভাবিয়া আমি মাঝে মাঝে এলাকাড়ি দিই — মনে করি, যাকগে বাপু, মেয়ে — নাই বা এখন থেকে বই স্লেট নিয়ে মুখ গুঁজড়ে রইল, ছেলে হওয়ার পাপটা তো করে নি; নেহাতই দরকার বোধ করা যায়, আর একটু বড় হোক, তখন দেখা যাবে ’খন।

এই রকমে দিনগুলা রাণুর বেশ যায়; তাহার গিন্নীপনা সতেজে চলিতে থাকে এবং পড়াশুনারও বিষম ধুম পড়িয়া যায়। বাড়ির নানা স্থানের অনেক-সব বই হঠাৎ স্থানভ্রষ্ট হইয়া কোথায় যে অদৃশ্য হয়, তাহার খোঁজ দুরূহ হইয়া উঠে এবং উপরের ঘর নীচের ঘর হইতে সময়-অসময়ে রাণুর উচুঁ গলায় পড়ার আওয়াজ আসিতে থাকে — ঐ ক-য়ে য-ফলা ঐক্য, ম-য়ে আকার ণ-য়ে হস্বই ক-য়ে য-ফলা মাণিক্য, বা পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল, অথবা তাহার রাঙা কাকার আইন মুখস্থ করার ঢঙে — হোয়ার অ্যাজ ইট ইজ, ইত্যাদি।

আমার লাগে ভাল, কিন্তু রাণুর স্বাভাবিক স্ফূর্ত্তির এই রকম দিনগুলা বেশিদিন স্থায়ী হইতে পারে না। ভাল লাগে বলিয়াই আমার মতির হঠাৎ পরিবর্ত্তন হইয়া যায় এবং কর্ত্তব্যজ্ঞানটা সমস্ত লঘুতাকে ভ্রূভঙ্গী করিয়া প্রবীণ গুরুমহাশয়ের বেশে আমার মধ্যে জাঁকিয়া আসিয়া বসে। সনাতন যুক্তির সাহায্যে হৃদয়ের সমস্ত দুর্ব্বলতা নিরাকরণ করিয়া গুরুগম্ভীর স্বরে ডাক দিই, রাণু!

রাণু এ স্বরটি বিলক্ষণ চেনে; উত্তর দেয় না। মুখটি কাঁদ-কাঁদ করিয়া নিতান্ত অসহায় ভালমানুষের মত ধীরে ধীরে আসিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়ায়, আমার আওয়াজটা তাহার গলায় যেন একটা ফাঁস পরাইয়া টানিয়া আনিয়াছে। আমি কর্ত্তব্যবোধে আরও কড়া হইয়া উঠি, সংক্ষেপে বলি, প্রথম ভাগ। যাও।

ইহার পরে প্রতি বারই যদি নির্ব্বিবাদে প্রথম ভাগটি আসিয়া পড়িত এবং যেন তেন প্রকারেণ দুইটা শব্দও গিলাইয়া দেওয়া যাইত তো হাতেখড়ি হওয়া ইস্তক এই যে আড়াইটা বৎসর গেল, ইহার মধ্যে মেয়েটাও যে প্রথম ভাগের ও-কয়টা পাতা শেষ করিতে পারিত না, এমন নয়। কিন্তু আমার হুকুমটা ঠিকমত তামিল না হইয়া কতক গুলা জটিল ব্যাপারের সৃষ্টি করে মাত্র — যেমন, এরূপ ক্ষেত্রে কোন কোন বার দুই-তিন দিন পর্য্যন্ত রাণুর টিকিটি আর দেখা যায় না। সে যে কোথায় গেল, কখন আহার করিল, কোথায় শয়ন করিল, তাহার একটা সঠিক খবর পাওয়া যায় না। দুই-তিন দিন পরে হঠাৎ যখন নজরে পড়িল, তখন হয়তো সে তাহার ঠাকুরদাদার সঙ্গে চায়ের আয়োজনে মাতিয়া গিয়াছে, কিংবা তাহার সামনে প্রথম ভাগটাই খুলিয়া রাখিয়া তাহার কাকাদের পড়ার খরচ পাঠানো কিংবা আহার্য্য দ্রব্যের বর্ত্তমান দুর্ম্মূল্যতা প্রভৃতি সংসারের কোন একটা দুরূহ বিষয় লইয়া প্রবল বেগে জ্যাঠামি করিয়া যাইতেছে, অথবা তাঁহার বাগানের যোগাড়যন্ত্রের দক্ষিণহস্তস্বরূপ হইয়া সব বিষয়ে নিজের মন্তব্য দিতে দিতে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমার দিকে হয়তো একটু আড়চোখে চাহিল, বিশেষ কোন ভয় উদ্বেগ নাই — জানে, এমন দুর্ভেদ্য দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে, যেখানে সে কিছুকাল সম্পূর্ণ নির্ব্বিঘ্ন।

আমি হয়তো বলিলাম, কই রাণু, তোমায় না তিন দিন হ’ল বই আনতে বলা হয়েছিল?

সে আমার দিকে না চাহিয়া বাবার দিকে চায়, এবং তিনিই উত্তর দেন, ওহে, সে এক মহা মুশকিল ব্যাপার হয়েছে, ও বইটা যে কোথায় ফেলেছে —

রাণু চাপা স্বরে শুধরাইয়া দেয়, ফেলি নি — বল, কে যে চুরি ক’রে নিয়েছে —

হ্যাঁ, কে যে চুরি করে নিয়েছে, বেচারী অনেকক্ষণ খুঁজেও —

রাণু যোগাইয়া দেয়, তিন দিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েও —

হ্যাঁ, তোমার গিয়ে, তিন দিন হয়রান হয়ে ও — শেষে না পেয়ে হাল ছেড়ে —

রাণু ফিসফিস করিয়া বলিয়া দেয়, হাল ছাড়ি নি এখনও।

হ্যাঁ, ওর নাম কি হাল না ছেড়ে ক্রমাগত খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যা হোক, একখানা বই আজ এনে দিও, কতই বা দাম!

রাগ ধরে, তুই বুঝি এই কাটারি হাতে করে বাগানে বাগানে বই খুঁজে বেড়াচ্ছিস? লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে।

কাতরভাবে বাবা বলেন, আহা, ওকে আর এ সামান্য ব্যাপারের জন্যে গালমন্দ করা কেন? এবার থেকে ঠিক করে রাখবে তো গিন্নী?

রাণু খুব ঝুঁকাইয়া ঘাড় নাড়ে। আমি ফিরিয়া আসিতে আসিতে শুনিতে পাই, তোমায় অত করে শেখাই, তবু একটুও মনে থাকে না দাদু। কি যেন হচ্ছ দিন দিন!

কখনও কখনও হুকুম করিবার খানিক পরেই বইটার আধখান আনিয়া হাজির করিয়া সে খোকার উপর প্রবল তম্বি আরম্ভ করিয় দেয়। তম্বিটা আসলে আরম্ভ হয় আমাকেই ঠেস দিয়া, তোমার আদুরে ভাইপোর কাজ দেখ মেজকা। লোকে আর পড়াশুনা করবে কোথা থেকে?

আমি বুঝি, কাহার কাজ। কটমট করিয়া চাহিয়া থাকি।

দুষ্টু ছুটিয়া গিয়া বামালসুদ্ধ খোকাকে হাজির করে — সে বোধ হয় তখন একখানা পাতা মুখে পুরিয়াছে এবং বাকিগুলার কি করিলে সবচেয়ে সদ্গতি হয়, সেই সম্বন্ধে গবেষণা করিতেছে। তাহাকে আমার সামনে ধপ করিয়া বসাইয়া রাণু রাগ দেখাইয়া বলে, পেত্যয় না যাও, দেখ। আচ্ছা, এ ছেলের কখনও বিদ্যে হবে মেজকা?

আমি তখন হয়তো বলি, ওর কাজ, না তুমি নিজে ছিঁড়েছ রাণু? ঠিক আগেকার পাঁচখানি পাতা ছেঁড়া — যত বলি, তোমায় কিছু বলব না — খান তিরিশেক বই তো শেষ হল!

ধরা পড়িয়া লজ্জা, ভয়, অপমানে নিশ্চল নির্বাক হইয়া এমন ভাবে দাঁড়াইয়া থাকে যে, নেহাত নৃশংস না হইলে ইহার উপর আর কিছু তাহাকে বলা যায় না। তখনকার মত শাস্তির কথা ভুলিয়া তাহার মনের গ্লানিটুকু মুছাইয়া দিবার জন্য আমায় বলিতেই হয়, হারে দুষ্টু, দিদির বই ছিড়ে দিয়েছিস? আর তুমিও তো ওকে একটু-আধটু শাসন করবে না রাণু। ওর আর কতটুকু বুদ্ধি, বল?

চাঁদমুখখানি হইতে মেঘটা সরিয়া গিয়া হাসি ফোটে। তখন আমাদের দুইজনের মধ্য হইতে প্রথম ভাগের ব্যবধানটা একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং রাণু দিব্য সহজভাবে তাহার গিন্নীপনার ভূমিকা আরম্ভ করিয়া দেয়। এই সময়টা সে হঠাৎ এত বড় হইয়া যায় যে, ছোট ভাইটি হইতে আরম্ভ করিয়া বাপ, খুড়া, ঠাকুরমা, এমন কি ঠাকুরদাদা পর্য্যন্ত সবাই তাহার কাছে নিতান্ত ক্ষুদ্র এবং স্নেহ ও করুণার পাত্র হইয়া পড়ে। এই রকম একটি প্রথম ভাগ ছেঁড়ার দিনে কথাটা এই ভাবে আরম্ভ হইল — কি করে শাসন করব বল মেজকা? আমার কি নিশ্বেস ফেলবার সময় আছে, খালি কাজ — কাজ — আর কাজ।

হাসি পাইলেও গম্ভীর হইয়া বলিলাম, তা বটে, কত দিক আর দেখবে?

যে দিকটা না দেখেছি, সেই দিকেই গোল — এই তো খোকার কাণ্ড চোখেই দেখলে। কেন রে বাপু, রাণু ছাড়া আর বাড়িতে কেউ নেই? খাবার বেলা তো অনেকগুলি মুখ; বল মেজকা! আচ্ছা, কাল তোমার ঝাল-তরকারিতে নুন ছিল?

বলিলাম, না, একেবারে মুখে দিতে পারি নি।

তার হেতু হচ্ছে, রাণু কাল রান্নাঘরে যেতে পারে নি। — ফুরসৎ ছিল না। এই তো সবার রান্নার ছিরি! আজ আর সে রকম কম হবে না, আমি নিজের হাতে দিয়ে এসেছি নুন।

আমার শখের ঝাল-তরকারি খাওয়া সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া মনের দুঃখ মনে চাপিয়া বলিলাম, তুমি যদি রোজ এক বার করে দেখ মা।

গাল দুইটি অভিমানে ভারী হইয়া উঠিল, হবার জো নেই মেজকা, রাণু হয়েছে বাড়ির আতঙ্ক। ‘ওরে, ওই বুঝি রাণু ভাড়ার-ঘরে ঢুকেছে — রাণু বুঝি মেয়েটাকে টেনে দুধ খাওয়াতে বসেছে, দেখ্ দেখ্ — তোকে কে এত গিন্নীত্ব করতে বললে বাপু?’ হ্যাঁ, মেজকা, এত বড়টা হলুম, দেখেছ কখনও আমায় গিন্নীত্ব করতে — কখনও — একরত্তিও?

বলিলাম, বলে দিলেই হ’ল একটা কথা, ওদের আর কি!

মুখটি বুজে শুনে যাই। একজন হয়তো বললেন, ‘ওই বুঝি রাণু রান্নাঘরে সেঁধোল!’ রাঙী বেড়ালটা বলে, আমি পদে আছি। কেউ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে, রাণু বুঝি ওর বাপের — ।’ আচ্ছা মেজকা, বাবার ফুলদানিটা আমি ভেঙেছি বলে তোমার একটুও বিশ্বাস হয়?

এ ঘটনাটি সবচেয়ে নূতন; গিন্নীপনা করিয়া জল বদলাইতে গিয়া রাণুই ফুলদানিটা চুরমার করিয়া দিয়াছে, ঘরে আর দ্বিতীয় কেহ ছিল না। আমি বলিলাম, কই, আমি তো মরে গেলেও এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না।

ঠোঁট ফুলাইয়া রাণু বলিল, যার ঘটে একটুও বুদ্ধি আছে, সে করবে না। আমার কি দরকার মেজকা, ফুলদানিতে হাত দেবার? কেন, আমার নিজের পেরথোম ভাগ কি ছিল না যে বাবার ফুলদানি ঘাঁটতে যাব?

প্রথম ভাগের উপর দরদ দেখিয়া ভয়ানক হাসি পাইল, চাপিয়া রাখিয়া বলিলাম, মিছিমিছি দোষ দেওয়া ওদের কেমন একটা রোগ হয়ে পড়েছে।

দুষ্টু একটু মুখ নীচু করিয়া চুপ করিয়া রহিল; তাহার পর সুবিধা পাইয়া তাহার সদ্য দোষটুকু সম্পূর্ণরূপে স্খলন করিয়া লইবার জন্য আমার কোলে মুখ গুঁজিয়া আরও অভিমানের সুরে আস্তে আস্তে বলিল, তোমারও এ রোগটা একটু একটু আছে মেজকা; — এক্ষুনি বলছিলে, আমি পেরথোম ভাগটা ছিঁড়ে এনেছি।

মেয়ের কাছে হারিয়া গিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার কেশের মধ্যে অঙ্গুলি-সঞ্চালন করিতে লাগিলাম।

Leave a Reply