বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

রাণুর প্রথম ভাগ

দাদা ওদিকে ধর্ম্ম সম্বন্ধে খুব লিবারেল মতের লোক ছিলেন, অর্থাৎ হিন্দুধর্ম্ম সম্বন্ধে অজ্ঞতাটা যেমন গভীর করিয়া রাখিয়াছিলেন, খ্রীষ্ট এবং কবেকার জরাজীর্ণ জুরুয়াস্থিয়ানবাদ সম্বন্ধে জ্ঞানটা সেইরূপ উচ্চ ছিল। দরকার হইলে বাইবেল হইতে সুদীর্ঘ কোটেশন তুলিয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়া দিতে পারিতেন এবং দরকার না হইলেও যখন একধার হইতে সমস্ত ধর্ম্মমত সম্বন্ধে সুতীব্র সমালোচনা করিয়া ধর্ম্মমতমাত্রেরই অসারতা সম্বন্ধে অধার্ম্মিক ভাষায় ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়া যাইতেন, তখন ভক্তদের বলিতে হইত, হ্যাঁ, এখানে খাতির চলবে বাবা, এ যার নাম শশাঙ্ক মুখুজ্জে।

দাদা বলিতেন, না, গোঁড়ামিকে আমি প্রশ্রয় দিতে মোটেই রাজি নই।

প্রায় সব ধর্ম্মবাদকেই তিনি ‘গোড়ামি’ নামে অভিহিত করিতে এবং গালাগাল না দেওয়াকে কহিতেন ‘প্রশ্রয় দেওয়া’।

সেই দাদা এখন একেবারে অন্য মানুষ। ত্রিসন্ধ্যা না করিয়া জল খান না এবং জলের অতিরিক্ত যে বেশি কিছু খান বলিয়াই বোধ হয় না। পূজা পাঠ হোম লইয়াই আছেন এবং বাক ও কর্মে শুচিতা সম্বন্ধে এমন একটা ‘গেল গেল’ ভাব যে, আমাদের তো প্রাণ ‘যায় যায়’ হইয়া উঠিয়াছে।

ভক্তেরা বলে, ও রকম হবে, এ তো জানা কথাই, এই হচ্ছে স্বাভাবিক বিবর্ত্তন; এ একেবারে খাঁটি জিনিস দাঁড়িয়েছে।

সকলের চেয়ে চিন্তার বিষয় হইয়াছে যে, এই অসহায় লাঞ্ছিত হিন্দুধৰ্ম্মের জন্য একটা বড় রকম ত্যাগ স্বীকার করিবার নিমিত্ত দাদা নিরতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন এবং হাতের কাছে আর তেমন কিছু আপাতত না পাওয়ায় ঝোঁকটা গিয়া পড়িয়াছে ছোট কন্যাটির উপর।

একদিন বলিলেন, ওহে শৈলেন, একটা কথা ভাবছি, — ভাবছি বলি কেন, এক রকম স্থিরই করে ফেলেছি।

মুখে গম্ভীর তেজস্বিতার ভাব দেখিয়া সভয়ে প্রশ্ন করিলাম, কি দাদা?

গৌরীদান করব স্থির করেছি, তোমার রাণুর কত বয়স হ’ল?

বয়স না বলিয়া বিস্মিতভাবে বলিলাম, সে কি দাদা! এ যুগে —

দাদা সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন, যুগের ‘এ’ আর ‘সে’ নেই শৈলেন, ওইখানেই তোমরা ভুল কর। কাল এক অনন্তব্যাপী অখণ্ড সত্তা এবং যে শুদ্ধ সনাতনধর্ম্ম সেই কালকে —

একটু অস্থির হইয়া বলিলাম, কিন্তু দাদা, ও যে এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু।

দাদা বলিলেন, এবং শিশুই থাকবে ও, যতদিন তোমরা বিবাহবন্ধনের দ্বারা ওর আত্মার সংস্কার ও পূর্ণ বিকাশের অবসর করে না দিচ্ছ। এটা তোমায় বোঝতে হলে আগে আমাদের শাস্ত্রকাররা —

অসহিষ্ণুভাবে বলিলাম, সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওর তো এই সবে আট বছর পেরুল দাদা, ওর শরীরই বা কতটুকু আর তার মধ্যে ওর আত্মাই বা কোথায়, তা তো বুঝতে পারি না। আমার কথা হচ্ছে —

দাদা সেদিকে মন না দিয়া নিরাশভাবে বলিলেন, আট বৎসর পেরিয়ে গেছে। তা হলে আর কই হ’ল শৈলেন? মনু বলেছেন, ‘অষ্টবর্ষা ভবেদ্‌গৌরী নববর্ষেতুরোহিণী’ — জানি, অতবড় পুণ্যকর্ম্ম কি আমার হাত দিয়ে সমাধান হবে! ছোটটার বয়স কত হ’ল?

রাণুর ছোট রেখা পাঁচ বৎসরের। দাদা বয়স শুনিয়া মুখটা কুঞ্চিত করিয়া একটু মৌন রহিলেন। পাঁচ বৎসরের কন্যাদানের জন্য কোন একটা পুণ্যফলের ব্যবস্থা না করিয়া যাওয়ার জন্য মনুর উপরই চটিলেন, কিংবা অত পিছাইয়া জন্ম লওয়ার জন্য রেখার উপরই বিরক্ত হইলেন, বুঝিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে স্থান ত্যাগ করিলেন। আমিও আমার রুদ্ধশ্বাসটা মোচন করিলাম। মনে মনে কহিলাম, যাক, মেয়েটার একটা ফাঁড়া গেল।

দুই দিন পরে দাদা ডাকিয়া পাঠাইলেন। উপস্থিত হইলে বলিলেন, আমি ও সমস্যাটুকুর এক রকম সমাধান করে ফেলেছি শৈলেন। অর্থাৎ তোমার রাণুর বিবাহের কথাটা আর কি। ভেবে দেখলাম, যুগধর্ম্মটা একটু বজায় রেখে চলাই ভাল বইকি —

আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম, হর্ষের সহিত বলিলাম, নিশ্চয়, শিক্ষিত সমাজে কোথায় ষোল-সতরো বছরে বিবাহ চলছে দাদা, এ সময় একটা কচি মেয়েকে — যার ন বছরও পুরো হয় নি — তা ভিন্ন খাটো গড়ন বলে —

ঝাঁটা মার তোমার শিক্ষিত সমাজকে। আমি সে কথা বলছি না। বলছিলাম যে, যদি এই সময়ই রাণুর বিয়ে দিয়ে দিই, তা মন্দ কি? বেশ তত যুগধর্ম্মটাও বজায় রইল, অথচ ওদিকে গৌরীদানেরও খুব কাছাকাছি রইল। ক্ষতি কি? এটা হবে, যাকে বলতে পারা যায়, মডিফায়েড গৌরীদান আর কি।

আমি একেবারে থ হইয়া গেলাম। কি করিয়া যে দাদাকে বুঝাইব, কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

দাদা বলিলেন, পণ্ডিত মশায়েরও মত আছে। তিনি অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখে বললেন, কলিতে এইটিই গৌরীদানের সমফলপ্রসূ হবে।

আমি দুঃখ ও রাগ মিটাইবার একটা আধার পাইয়া একটু উষ্মার সহিত বলিলাম, পণ্ডিত মশায় তা হলে একটা নীচ মিথ্যা কথা আপনাকে বলেছেন দাদা, আপনি সন্তুষ্ট হলে উনি এ কথাও বোধ হয় শাস্ত্র ঘেঁটেই বলে দেবেন যে, মেয়েকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলেও আজকাল গৌরীদানের ফল হবার কথা। কলিযুগটা তো ওঁদের কল্পবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যখন যে বিধানটি চাইবেন, পাকা ফলের মত টুপ করে হাতে এসে পড়বে।

দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। আমিই কথা কহিলাম, যাক, ওঁরা বিধান দেন, দিন বিয়ে। আমি এখন আসি, একটু কাজ আছে।

আসিবার সময় ঘুরিয়া বলিলাম, হ্যাঁ, শরীরটা খারাপ বলে ভাবছি, মাস চারেক একটু পশ্চিমে গিয়ে কাটাব; হপ্তাখানেকের মধ্যে বোধ হয় বেরিয়ে পড়তে পারব। — বলিয়া চলিয়া আসিলাম।

Leave a Reply