বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

পৃথ্বীরাজ

পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান আর পিণ্ডারী-দস্যুদলের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ বাধিয়া গিয়াছে। পিণ্ডারীদের দুই-তিনজন আহত হইয়া ধরাশয্যা লইয়াছে, তবু দুর্দ্ধর্ষ দলটা হটিতে চাহে না। টিপু সুলতানের কানের কাছ দিয়া একটি আঁকাবাঁকা আমের ডাল বোঁ করিয়া বাহির হইয়া গেল; সেটা কুড়াইয়া লইয়া দস্যুদের আক্রমণ করিতে যাইবে, এমন সময় পৃথ্বীরাজের করচ্যুত একটা মাটির চাংড়া পিণ্ডারী-সর্দ্দারের নাকের উপর পড়িয়া তাহার নাকের নীচেটা রক্তে এবং মুখের বাকিটা ধূলায় ধূসরিত করিয়া দিল।

এই সময় স্কুলের টিফিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়িল। টিপু সুলতান এবং অক্ষত পিণ্ডারী কয়জন ছুটিয়া গিয়া ক্লাসে বসিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত যে যাহার পড়া শুরু করিয়া দিল। তিনটি পিণ্ডারী আহত হইয়াছিল, তাহারা নিজের নিজের জখমে হাত দিয়া মন্থরগতিতে স্কুলের দিকে আসিতে লাগিল। রণক্ষেত্রে রহিল মাত্র পৃথ্বীরাজ এবং পিণ্ডারী-সর্দ্দার। বিজেতা গিয়া আহত শত্রুকে সমবেদনার কোমল স্বরে প্রশ্ন করিল, বড় লেগে গেছে, না ভাই?

পিণ্ডারী বলিল, বেশি নয়। ইস, তোর পাটা —

ও কিছু নয়; দাঁড়া, কাপড়ের খুঁটটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে আসি। — বলিয়া পৃথ্বীরাজ একটু খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে জলের ঘরের দিকে ছুটিল। জল আনিয়া নাকটা মুছাইয়া দিতেছিল, পিণ্ডারী বলিল, এর পরেই নবীন মাস্টারের ক্লাস, আজ আবার নতুন বেত কেড়েছে।

এমন সময় স্কুলের বারান্দা হইতে টিপু সুলতান হাঁক দিল, তোমরা সব এস শিগগির, স্যার ডাকছেন; খেলা যে তোমাদের শেষ হতে চায় না!

পিণ্ডারী বলিল, নিশ্চয় সব বলে দিয়েছে।

পৃথ্বীরাজ বলিল, তা’লে আজ এসপার কি ওসপার যা হয় একটা করব, ওকে আস্ত রাখব না।

বারান্দা হইতে তাগাদা আসিল, চলে এস, স্যার কতক্ষণ বসে থাকবেন?

দুইজনে উগ্রভাবে চাহিয়া দেখিল; পৃথ্বীরাজের চেহারাটা অত্যন্ত কালো এবং চোখ দুইটা অত্যন্ত সাদা বলিয়া করুণার চক্ষে চাহিলেও উগ্র দেখায়। আহত পিণ্ডারী-দস্যু কয়টি থামের আড়ালে ইহাদের অপেক্ষায় ছিল; সকলে একসঙ্গে প্রবেশ করিল। টিপু নিজের আসনে বসিয়া একটা বই খুলিয়া বলিল, স্যার, আমরা ততক্ষণ সময় নষ্ট না করে পুরনো পড়া করি। — বলিয়া একবার অপরাধীদের পানে চাহিল।

নবীন মাস্টার প্রশ্ন করিলেন, রস্‌কে, পৃথ্বীরাজের তারিখ কত?

রসিক অর্থাৎ বর্ত্তমান ঘটনার পৃথ্বীরাজ চুপ করিয়া রহিল।

নবীন মাস্টার আবার প্রশ্ন করিলেন, মাখনা, টিপু সুলতান কোন্ সালে জন্মেছিল?

মাখনলাল অর্থাৎ এই আখ্যায়িকার পিণ্ডারী-সর্দ্দার যেন তারিখটা ‘পেটে আসছে মুখে আসছে না’ ভাব দেখাইয়া কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া রহিল।

নবীন মাষ্টার বলিলেন, হুঁ। আর আপনারা দয়া করে বলতে পারেন, পিণ্ডারীর আকবরের কে হত?

যে তিনটিকে আহত পিণ্ডারী-দস্যু বলিয়া পরিচিত করিয়াছি, তাহাদের দুইজনে, যেন ভয়ানক মুখস্থ আছে এই ভাবে মনে করিবার ভঙ্গিমায় দ্রুত ঠোঁট নাড়িতে লাগিল। তৃতীয়টি অত্যন্ত ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল। নবীন মাস্টারের রসিকতা ধরিতে না পারিয়া বৈরাম খাঁর সহিত গোলমাল করিয়া বলিয়া ফেলিল, আকবরের পিসেমশাই হত স্যার।

সপাৎ করিয়া বেত নামিল। — আকবরের পিসেমশায় হত; — ভিন্সেণ্ট স্মিথের ঠাকুরদাদা রায় দিলেন। অন্য পিঠগুলাতেও সপাসপ সপাসপ আওয়াজ হইতে লাগিল। নবীন মাস্টার গর্জ্জাইতে লাগিলেন, লক্ষ্মীছাড়া সব, পেটে বোমা মারলে হিস্ট্রির একটা অক্ষর বেরোয় না — পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান আর পিণ্ডারীদের একসঙ্গে লড়াই হচ্ছে। হিস্ট্রির পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে! এই রস্‌কে লক্ষ্মীছাড়া হচ্ছে হারামজাদার জড়!

আবার সপাৎ সপাৎ করিয়া বেতের ঘা পড়িতে লাগিল।

রসিকের কালো মুখ রাগে, অপমানের যন্ত্রণায় তামাটে হইয়া উঠিয়াছিল। উস উস করিয়া চোখ-মুখ কুঁচকাইয়া মার খাইল। শেষ হইলে প্রচণ্ডভাবে এক বার টিপুর দিকে চাহিয়া লইয়া দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল, আমরা একটুও মারামারি করি নি; কে বলেছে?

নবীন মাস্টার হঠাৎ বেত বন্ধ করিয়া দিলেন, ডাকিলেন, অন্তা!

অনন্তকুমার অর্থাৎ আজিকার টিপু সুলতান মাস্টারকে শুনাইয়া, আমায় এখানটা একটু বুঝিয়ে দাও তো ভাই। — বলিয়া সবে পাশের ছেলের নিকট জিওমেট্রির একটা পাতা মেলিয়া ধরিয়াছিল; আহ্বান-মাত্রেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া উত্তর দিল, আজ্ঞে স্যা — র।

এরা আজ মোটেই লড়াই করে নি?

করেছিল বইকি স্যার; আমি স্যার, কত করে বুঝিয়ে বললাম স্যার, টিপিন-পিরিয়ডটা কি ভাই হুড়োহুড়ি দাপাদাপি করবার জন্যে স্যার দিয়েছেন? তা আমার কথা স্যার —

আর শেষ করিতে হইল না, রসিক বাঘের মত একটা লাফ দিয়া অস্তার ঘাড়ে পড়িল এবং তাহার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টানিয়া লইয়া চাপা কান্নার একটা ‘গি-গি’ শব্দ করিতে করিতে কিল চড় আঁচড়ানি কামড়ানি যাহা সুবিধা পাইল, তাহাই দিয়া নিজের আশ মিটাইয়া মাথাটা ঝাঁকানি দিয়া পিছনে ঠেলিয়া দিল এবং পলকের মধ্যে নবীন মাস্টারের লাঠিটা টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া এক দৌড়ে সদর-রাস্তার উপর আসিয়া দাঁড়াইল। সেখানে দাঁড়াইয়া লাঠিট। খেলাইয়া চীৎকার করিতে লাগিল, আজ সমস্ত ইস্কুল এক ধারে, আর রসিক এক ধারে। একটা এসপার কি ওসপার যা হয় কিছু করব; চলে আয় অন্তা, মরদকা বাচ্চা হ’স তো।

সমস্ত স্কুলটা বারান্দায় আসিয়া জড় হইল। শিক্ষকেরা ‘ধরে আন ছোড়াকে, ধরে আন’ বলিয়া অনিশ্চিতভাবে হুকুম করিতে লাগিল। কিন্তু কেহই আর বারান্দা হইতে নামিতে সাহস করিল না। দারোয়ান রামভজ্জু, ‘হামি যাবে, হালমানজীকে কিরপাসে’ বলিয়া নামিয়া গটগট করিয়া কয়েক পা অগ্রসর হইল। রাস্তায় বিছাইবার জন্য এক জায়গায় পাথর-ভাঙা জড় করা ছিল। চলে আয়, এই তো মাংতা হ্যায়। — বলিয়া রসিক সেইখানে গিয়া দাঁড়াইল। রামভজ্জু পিছনে ফিরিয়া দেখিতে দেখিতে তাড়াতাড়ি বারান্দায় ফিরিয়া আসিল। বলিল, ডাকু আছে; ইস্কুলের গাছের আমগুলো কে ঢিল মেরে লুকসা করিয়েসে বাবু? ওহি তো।

Leave a Reply