রাণুর প্রথম ভাগ
৩
রসিকের শ্বশুর রায় সাহেব পান্নালাল রায় চৌধুরী জমিদার, এবং কোটপ্যাণ্টধারা বাদ দিয়া আর সবার কাছেই প্রবলপ্রতাপান্বিত। রাজসম্মানের ফসল তুলিয়া আবার জমিতে সার দিতেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের শ্যালক সম্প্রতি ভারতে পদার্পণ করিয়াছে, তাহার একটা হিল্লে করিয়া দেওয়ার দায়িত্ব লাভ করিয়া একটু চিন্তান্বিত আছেন। সাহেব বলিয়াছেন, লোকটি বরফের উপর স্কেটিং করিতে ইংলণ্ডে অদ্বিতীয়। আর কোন গুণ আছে কি না, সাহেব নিজেও বলেন নাই এবং রায় সাহেবেরও প্রশ্ন করিবার সাহস হয় নাই। স্ত্রী পুত্র, আমলা গোমস্তা, দাস দাসী সকলের উপরই তিরিক্ষি হইয়া ক্রমাগতই ভাবিতেছেন, বরফের ওপর স্কেটিং করে, এমন লোককে কোথায় বসানো যায়! ইতিমধ্যে বেহাইয়ের পত্র আসিল, তিনি রাজি, রায় সাহেব তাঁহার জামাইকে যে রকম ভাবেই না কেন শিক্ষা দান করেন — বিলাতে পাঠাইয়াই হউক কিংবা বাড়িতে রাখিয়াই হউক।
রায় সাহেবের বিলাতে পাঠানোই ইচ্ছা ছিল। জামাই সেখান হইতে একটা কেষ্টবিষ্ট হইয়া আসিলে মেয়েদের জিদে কুলের খাতিরে অপদার্থ জামাই করার অপবাদ তো তাঁহার মিটিবেই, চাই কি ঈশ্বর মুখ তুলিয়া চাহিলে ওই বিলাত-ফেরত জামাইয়ের জোরেই শেষ বয়সে একটা শাঁসালো গোছের খেতাব লইয়া মরিতে পারিবেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে গিয়া বলিলেন, হুজুর, আপাতত তো আমার হাতে কোন কাজ নেই, যা মিস্টার আইড্লের বহুমুখী প্রতিভার উপযোগী হতে পারে। তবে ভাবছি, জামাইটিকে আপনাদের ‘হোমে’ পাঠাব। মিঃ আইডল যদি অনুগ্রহ করে তাকে একটু একটু ইংরেজী শিক্ষা দেন এবং ভারতবর্ষীয় অসভ্যতা ছাড়িয়ে আদব-কায়দায় একটু তালিম দেন তো মস্ত একটা উপকার হয়। আপনারা রাজার জাত, আমি আর কি প্রতিদান দিতে পারি? তাকে আমার বাগানবাড়িটা ছেড়ে দেব; পান তো খান না — সিগারেট খাবার জন্যে মাসে শ-তিনেক করে দেব। একটা মোটর-গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা তার অধীনে থাকবে; আর — আর চণ্ডীমণ্ডপটা পরিষ্কার করে রাখব, শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো আছে, ইচ্ছে হলে স্কেটিং খেলবেন। হতভাগা বাংলা দেশে বরফ জমে না — এসে পর্য্যন্ত তার স্কেটিঙের কত অসুবিধেই না হচ্ছে। উচ্ছন্ন যাক এমন দেশ।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলিলেন যে, রায় সাহেবের বন্ধুত্বই তাঁহার পরম মূল্যবান সামগ্রী — তিনি তাঁহার কোন প্রস্তাবেই আপত্তি করিতে পারেন না, এবং আশা করেন, তাঁহার শ্যালক মিঃ আইড্লও তাঁহার খাতিরে সম্মত হইবেন। তবে যেমন সিগারেট খাইবার জন্য রায় সাহেব তিন শত দিবেন বলিয়াছেন, সেই সঙ্গে খানা প্রভৃতির জন্যও যদি আরও শ খানেক ধরিয়া দেন তো মিঃ আইড্লকে রাজি করা সহজ হইয়া পড়িবে!
রায় সায়েব এটা তাঁহার পরম সৌভাগ্য মানিয়া লইলেন। আসিবার সময় শেকহাণ্ডের পর গোটা দুই-তিন আভূমি দীর্ঘ সেলাম ঠুকিয়া বলিয়া আসিলেন, হুজুর, গোলাম বার্থ-ডে অনার্স-লিস্টে এবার একেবারেই বাদ পড়ে গেল। সামনে নতুন বছরে খেতাব-বিতরণ আসছে — আপনারই হাতে সব।
রসিকের তালিম শুরু হইল। শ্বশুর বলিলেন, বাবাজী, একটু তাড়াতাড়ি সাহেবের কাছে কিছু ইংরেজী লেখাপড়া আদায় করে নাও। যত শিগগির নিজের কাজ গুছিয়ে নিজেকে বিলেত যাবার যুগ্যি করে নিতে পার, ততই ভাল। অন্য মাস্টার রাখলেও চলত, একটা খাতিরে পড়ে মাস গেলে এই পাঁচশো টাকার ধাক্কায় পড়ে গেছি।
রসিকের বিশেষ তাড়াতাড়ি ছিল না। সমস্ত রাত নববধূর সঙ্গে কাব্যচর্চা করে, সমস্ত দিন ধরিয়া বধূটি ঘুমাইয়া কাটায় আর বরটি শিক্ষকের কাছে বসিয়া ঢোলে। শিক্ষক বিলাতের নূতন উৎসাহ লইয়া দিনকতক খুব চেষ্টা করিল। ছাত্রকে ইংরেজী শিক্ষা দিবার সুবিধার জন্য নিজে খানিকটা বাংলাও শিখিয়া ফেলিল। কিছুই ফল হইল না। তখন সে আরামকেদারায় পা তুলিয়া দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে সিগারেট টানিতে শুরু করিয়া দিল। মনে হইল, যেন তিনশো টাকার শেষ আধলাটি পর্য্যন্ত ধুয়ায় পরিণত করিয়া উড়াইয়া দিবে।
কথাটা যখন জানাজানি হইয়া গেল, রসিক-দম্পতিকে বিভক্ত করিয়া আলাদা আলাদা দুই ঘরে জায়গা করিয়া দেওয়া হইল। বধূটির বড় লজ্জা ও একটু দুঃখ হইল, এবং রসিকের হইল রাগ। কয়েকদিন পরে যখন ওর লজ্জার জড়তা এবং এর রাগের বেগ অনেকটা কাটিয়া গেল, তখন গোপনে পত্রাচার আরম্ভ হইল। তাহাতে আমাদের ঘরোয়া আটপৌরে প্রেমের হা-হুতাশ বড় থাকিত না, — এদিক হইতে থাকিত বই-থেকে-তোলা পৃথ্বীরাজের বীরোচ্ছ্বাস, আর ও-তরফে ক্ষত্রিয়কুমারী সংযুক্তার অগ্নিময়ী বাণী।
এও একদিন অন্তঃপুরের গোয়েন্দাদের হাতে পড়িয়া গেল। শ্বশুর ভাবিলেন, এ তো ভ্যালা বিপদে পড়া গেল। রসিককে ডাকিয়া বলিলেন, বাবাজী, আমি বলছিলাম, তুমি গিয়ে না হয় বাগানবাড়ির এক ধারে সাহেবের সঙ্গে থেকে বিদ্যা অর্জ্জন কর — এইটিই আমাদের সেই ঋষিমুনিদের আমলের সনাতন প্রথা কিনা।
রসিক মুখ গোঁজ করিয়া বাগানবাড়িতে উঠিল এবং সেই দিনই তাহার নিজের সনাতন প্রথায় প্রথমে সাহেবের খানসামা ও পরে খোদ সাহেবের সহিত বিবাদ করিয়া একটা রীতিমত ফ্যাসাদ বাধাইয়া অন্তর্দ্ধান হইল। তাহার মানে, সেখানে অন্তর্দ্ধান হইয়া স্বগৃহে আসিয়া আবির্ভূত হইল।
পিতা আগুন হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, এক্ষুনি বেরুক ও বাড়ি থেকে, কার হুকুমে আবার বাড়িতে এসে ঢুকেছে?
মেয়েরা সব রসিককে ঘিরিয়া কাঁদিতে লাগিল। ঠাকুরমা রসিককে বুকে চাপিয়া চক্ষের জলে স্নান করাইয়া বলিলেন, ষাট, বাছা আমার! জেলার মাচিষ্টকের শালাকে একটু চটিয়ে ফেলেছে; যদি বুদ্ধি করে ঘরে না পালিয়ে আসত তো এতক্ষণ যে হাজতে গিয়ে উঠত, — আমার সে কথা ভাবতেও যে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আজ তিনি বেচে থাকলে কি তোর এমন কথা বলতে পারতিস?
দরদীদের দলের মধ্যে পড়িয়া রসিকেরও চক্ষু ডবডব করিয়া উঠিয়াছিল; ঠাকুরদার উল্লেখে চাপা আবেগে অরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ঠাকুদ্দা বেঁচে থাকলে? ঠাকুদ্দা বেঁচে থাকলে আজ শ্বশুর বেটার সঙ্গেও একটা এসপার কি ওসপার করে আসতাম — হ্যাঁ।
অবশ্য ‘এসপার কি ওসপার’ কিছু একটা হয় নাই বলিয়া বসিকের নিরাশ হইবার কোন কারণ ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে হুলস্থূল এবং ক্রমে সারা জেলাতেই একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গেল। জেলার চুনোপুঁটি হইতে আরম্ভ করিয়া জজ ম্যাজিস্ট্রেট পর্য্যন্ত যত সাহেব ছিল, সকলের নিকট দরবার করিয়া রায় সাহেবের পায়ের সুতা ছিঁড়িল। শেষকালে আইড্ল সাহেবকে চার হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বিরাগ এবং খেতাবের উপর ফাঁড়াটা কাটাইয়া দিলেন। টাকাটা গনিয়া দিয়া বাড়িতে আসিয়া বলিলেন, আজ থেকে অমলি বিধবা হল। কেউ যেন আমার সামনে জামাইয়ের নাম পর্য্যন্ত না মুখে আনে।
দিন দুই-তিন পরে কুটুম্বিতা বজায় রাখিবার জন্য রসিকের পিতা পুত্রের আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া একখানি পত্র লোক মারফ পাঠাইয়া দিলেন। লোকটা উত্তম-মধ্যম কয়েক ঘা খাইয়া গালি দিতে দিতে ফিরিয়া আসিল, বলিল, বললে — আমার মেয়েও নেই, জামাইও নেই — নিকালো হিঁয়াসে — নিকালো। ওঃ, সে কি গর্জ্জন। তারপরেই এই চোরের মার কর্ত্তামশায়।
সকলে ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হইয়া পড়িল। শুধু ঠাকুরমা ‘তিনি বাঁচিয়া থাকিলে’ এ অবস্থায় কি করিতেন নির্ণয় করিয়া সমস্যাটা সমাধান করিয়া দিলেন, কহিলেন, মিন্সের নাকের ওপরে ছেলের বিয়ে দাও; কুলীনের ছেলের আবার বিয়ের ভাবনা কি গা? কি দাদা, বিয়ে করবি তো?
রসিক, বউ যে কি বস্তু খানিকটা স্বাদ পাইয়াছিল, একটু হাসিয়া ঘাড়টা কাত করিয়া জানাইল, সে খুব রাজি। পেসাদী ঘটকিনীর দেমাকী চালে বাড়িটা আবার টলমল করিতে লাগিল।
রসিক কিন্তু নিজের অন্তরকে ভুল বুঝিয়াছিল। দুরন্ত হাঁদাগোবিন্দগোছের ছেলে, — কিই বা সে অন্তরের মত সূক্ষ্ম জিনিসের খোঁজ রাখে? যে ভাবটা যখন মনের উপর স্পষ্ট হইয়া উঠে, সেইটার উপর তাহার বলিষ্ঠ দেহের সমস্ত শক্তি উৎসর্গ করিয়া দেওয়াই তাহার ধম্ম। নূতন যখন বিরহ হইল, সে দেখিল, বউ নামক এক বিস্তর সুবিধাজনক পদার্থের অভাব ঘটিয়াছে। তাই ঘাড়টা বাঁকাইয়া একেবারে কাঁধের উপর ফেলিয়া জানাইল, হাঁ, বিবাহ করিবে বইকি। এবং তাহার দাম্পত্য-জীবনে নানান ঝঞ্ঝাট বাধাইত এমন সব অপ্রয়োজনীয় কি অল্প-প্রয়োজনীয় লোকদের লক্ষ্য করিয়া বলিল, কিন্তু দে ঠাকুমা, এ শ্বশুরবাড়িতে যেন মেলা কেউ না থাকে — এই শালী-শালাজ এরা সব।
কিন্তু কথা হইতেছে যে, দাম্পত্যের দেবতাটি ক্রমাগত মারপ্যাঁচের মধ্য দিয়াই নিজের অধিকারটি সাব্যস্ত করিয়া যান, সুতরাং তিনি যে রসিক এবং রসিকের পিতা মাতা ঠাকুরমা প্রভৃতির সুবিধার জন্য রসিকের মনে আগাগোড়া একটা ভাবই কায়েম করিয়া রাখিবেন, এমন আশা করা নিতান্তই ভুল। সেইজন্য, যখন বিবাহের কথাটা বেশ পাকা হইয়া আসিয়াছে, এমন সময়টিতে রসিকের মনে এই কথাটা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, বধূমাত্র হইলেই তাহার চলিবে না; তাহার অমলাকেই চাই, বিশেষ করিয়া নিতান্তই। এতদিন শুধু বধূর অভাব ছিল — একটা শূন্যতা মাত্র। আজ দেখিল, অভাবটা আসলে অমলার অভাব — শূন্যতাটাও বেদনায় ভরিয়া উঠিল, যাহা তাহার পক্ষে একেবারেই নূতন।
প্রথমে ভাল মানুষের মত একটু ওজর-আপত্তি করিল। লোকে বলিল, তবু ভাল। ঠাকুরমা বলিলেন, একটু লজ্জা হয়েছে আর কি, ওটা কেটে যাবে ’খন। এক কথাতেই রাজি হয়েছিল বলে ও কি আমার তেমনই বেহায়া গা!
গায়ে-হলুদের দিন রসিক একেবারেই বাঁকিয়া বসিল। যখন তাহাকে অত্যধিক প্ররোচনা এবং ভয় প্রদর্শনের দ্বারা সোজা করিবার চেষ্টা করা হইল, সে গায়ে-হলুদের সমস্ত সরঞ্জাম ফেলিয়া ছড়াইয়া ভাঙিয়া চুরিয়া বেগে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। কর্ত্তার গর্জ্জনের সঙ্গে মেয়েদের কান্না মিলিয়া উৎসবের বাড়িতে একটা বীভৎস কাণ্ড হইয়া দাঁড়াইল।
ঠাকুরমা নাতনী এবং নাতবউদের একত্র করিয়া আঁচলে চোখের জল মুছিতে মুছিতে বলিলেন, আমি ওর এতটুকু বয়স থেকেই বলে আসছি, ও ঠিক তোদের ঠাকুদ্দার মত হবে; তাঁর ছিল বটে ছ-ছটা বিয়ে — কি করবেন, কুলীনের ছেলে — কিন্তু এই পেরথোমটার ওপরই যে কি পোড়া টান ছিল!