বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

বিয়ের ফুল

রামতনু সাত-সাত জায়গায় মেয়ে দেখিয়া ফিরিল; কিন্তু পছন্দ আর হইল না। সব গুলিই জবুথবু হইয়া সামনে আসিয়া বসে; হাজার চেষ্টা করিলেও ভাল করিয়া দেখা হয় না, সেইজন্য হাজার সুন্দর হইলেও মনে কেমন একটু খুঁত থাকিয়া যায়। সন্দেহ হয়, আচ্ছা, এ যে চোখটা কোনমতেই বড় করিয়া চাহিল না, নিশ্চয়ই কোনও দোষ আছে; ওঁর যে খোঁপার এত ধুম, ওইখানেই গলদ নাই তো? ইত্যাদি।

নাহক এই সাত ঘাটের জল খাইয়া রামতনু বুঝিল, কন্যামননের এ প্রশস্ত উপায় নহে। একটা প্রশস্ত উপায় মনে মনে ঠাওরাইবার চেষ্টা করিতেছিল, এমন সময় বউদিদির মুখে একদিন শুনিল, তাঁহার সম্পর্কে এক পিসীর কন্যা সম্প্রতি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাস দিয়া জলপানি পাইয়াছে। রামতনু বেচারা এতদিন বেশির ভাগ পাড়াগেঁয়ে ‘পুঁটী-খেঁদী’দেরই সন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল, সুতরাং এখন খবর পাইয়া এই সুশিক্ষিত যুবতীরত্নটির জন্য তাহার হৃদয় একেবারে পিপাসিত হইয়া উঠিল।

‘দেখা নাই, বুঝ নাই, এইরূপ হইল কি করিয়া’–ইত্যাকার সন্দেহ যদি কাহারও মনে উদয় হয় তো কৈফিয়ৎ এই মাত্র দেওয়া যায় যে, প্রেম সব সময় চোখে দেখার তোয়াক্কা রাখে না–‘হৃদয়-মরুভূমে’ আপনার খেয়ালমতই গজাইয়া উঠে। তাই, বউদি সংবাদটি দিতে, একটু অশোভন হইলেও রামতনু প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, কত বয়স তাঁর, দেখতে কেমন?

বউদিদি ইহাতে তাচ্ছিল্যের সহিত মুখটা ঘুরাইয়া বলিলেন, পোড়া কপাল, তোমার বুঝি অমনই নোলায় জল এল? পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পাস করে, সে মেয়ের আবার বিয়ে! গলায় দড়ি জোটে না? কোন্ দিন বা কাছা-কোঁচা এঁটে পুরুষের সঙ্গে আপিসে বেরুবে!

রামতনু বেজায় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। বুঝিল, কথাগুলা বড় অসাময়িক হইয়া পড়িয়াছে। বয়স এবং চেহারার সহিত পাস দিবার বিশেষ সম্বন্ধ সে নিজেই তেমন খুঁজিয়া পাইল না। কথাগুলা তাহার মনের আকস্মিক উন্মাদনার খবরই বাহিরে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে। সামলাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, না গো না, সে কথা নয়; কত বয়সে পাস দিয়েছে — তোমার গিয়ে, ষোল বছরের কমে — অর্থাৎ কিনা —

বউদিদি হাসিয়া ফেলিলেন।

রামতনু মুখ-চোখ রাঙা করিয়া আরও দুই-তিন বার ‘অর্থাৎ কিনা’ ‘অর্থাৎ কিনা’ করিয়া, তখনও বউদিদিকে হাসিতে দেখিয়া হঠাৎ চটিয় উঠিল; বলিল, না বউদি, সব সময় ইয়ারকি ভাল লাগে না।

পূর্ব্বের মতই সুতীক্ষ্ণ হাস্যসহকারে বউদিদি উত্তর করিলেন, বিশেষ ক’রে মনের অবস্থা যে সময় খারাপ, না? আহা, শুধু পাস-করা শুনেই বেচারীর এই দশা, যখন শুনবে চোদ্দ বছর বয়স, দেখতে পটের ছবিটির মতন, তার ওপর আবার পদ্য লিখতে পারে, তখন বোধ হয় মুচ্ছে যাবে।

মূর্চ্ছা যাইবার লক্ষণ রামতনুর তখনই প্রকাশ পাইতেছিল — রাগের চোটে; কোন রকমে আত্মসংবরণ করিয়া ঘর হইতে সক্রোধে বাহির হইয়া গেল।

এই ঘটনাটির পর ছোকরা হঠাৎ বড় নির্জ্জনতাপ্রিয় হইয়া উঠিল। বৈকালে দেখা গেল, সে মাঠে একলা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং সন্ধ্যা সময় তাহাকে বড় একটা দেখাই গেল না। রাত্রে ডালের সহিত দুধ মাখিয়া এবং মাঝে মাঝে আলুর শাঁস বাদ দিয়া খোসা খাইয়া সে আহার শেষ করিল এবং তাহার পর বিছানার আশ্রয় লইল। একটার সময়ও সে জাগিয়া মশারির চালে কল্পনার রঙিন ছবি আঁকিতেছে।

তাহার পরদিন কিন্তু মেঘ কাটিয়া গেল এবং রামতনুকে বেশ প্রফুল্ল দেখা গেল। স্পষ্টই বুঝিতে পারা গেল যে, সে রাতারাতি একটা মতলব আঁটিয়া ফেলিয়াছে। সে স্থির করিল, প্রজাপতির সহিত এ পর্য্যন্ত সাত-সাতটা বাজি হারিলেও আর এক হাত খেলিয়া দেখিবে। এবার আর পরের কথায় নাচিয়া চট করিয়া কন্যা দেখিতে ছুটিয়া তিক্ত মুখে ফিরিয়া আসা নয়। পূর্ব্বরাগের পালাটা দস্তুরমত শেষ করিয়া অন্য কথা। তবে দেরি আর কোনমতেই করা চলে না। সে মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইল, এই বিদুষী তরুণীটির জন্য যুবকমহলে একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গিয়াছে; এবং স্বয়ম্বর-সভার প্রত্যেক প্রার্থীর মতন যদিও সে নিজেকেই সর্ব্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয় মনে করিল, তথাপি ভাবিল, না, দেরি করাটা নিরাপদ নয়। অভাবের মাথায় চাই কি এক অবাঞ্ছনীয়ের গলায়ই বরমাল্য পড়িয়া যাইতে পারে।

সকালবেলা একটু এদিক ওদিক করিয়া কাটাইল; তারপর হঠাৎ বউদিদির নিকট একটা পুরানো টেলিগ্রাম লইয়া গিয়া বিরক্তভাবে বলিল, এই নাও, যা মনে করেছিলুম তাই; আমায় আর থাকতে দিলে না।

টেলিগ্রাম দেখিয়া বউদিদির মুখটা শুকাইয়া গিয়াছিল। তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিয়া রহিলেন।

রামতনু বলিল, ভয় পাবার কিছুই নেই; তবে আমায় কালই যেতে হবে।

কাল? এই বললে, বারো দিন দেরি আছে!

আমি বললেই তো আর হচ্ছে না, বিশ্বাস না হয় টেলিগ্রামটা পড়িয়ে নাও কাউকে দিয়ে। — বলিয়া, পাছে সত্যই কাহাকেও নিয়া পড়াইয়া লওয়া হয়, এই ভয়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে পকেটে পুরিল এবং হঠাৎ অধিকতর বিরক্তভাবে সেটাকে বাহির করিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিড়িয়া বলিল, আরে রামঃ, এমন কলেজেও মানুষে পড়ে।

এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ বউদিদি সান্ত্বনা দিয়া বলিলেন, তা ভাই, কি করবে বল; কামাই করাটা কি ভাল হবে? তোমার দাদা শুনে আবার চটবেন। কিন্তু এমন কেন হ’ল বল তো?

রামতনু পূর্ব্বের মতই রাগতভাবে বলিল, কে জানে? শুনেছিলাম, লাটসাহেব নাকি কলেজ দেখতে আসবে, তাই হবে বা।

বউদিদি রাগিয়া বলিলেন, মুয়ে আগুন লাটসাহেবের, সে আর মরবার সময় পেলে না! ঘরের ছেলে দুদিন ঘরে এসে বসবে, তাতেও সোয়াস্তি নেই!

যেন অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল — এই ভাবে রামতনু বলিল, চুলোয় যাক; হ্যাঁ, তোমার কোনও কাজ-টাজ আছে নাকি? তা হলে বল। তাই বলে আমি কিন্তু তোমার সেই পিসের বাড়িতে যেতে পারব না, সে আগে থাকতেই বলে রাখছি।

এই সরলহৃদয় রমণী ভাবিলেন, কালকের ঠাট্টায় দেবর তাহার রাগ করিয়াছে। সেইজন্য সেইখানেই যাওয়াইবার জন্য বেশি জিদ করিয়া বসিলেন। ঠিকানা দিলেন, মাথার দিব্য দিলেন, এবং যাহাতে হাঁটিয়া যাইতে না হয় তাহার জন্য ভাড়াও কবুল করিলেন। রামতনুর ঠিকানাটা লওয়াই উদ্দেশ্য ছিল; সেটি মনে মনে মুখস্থ করিয়া লইল। বাহিরে কিন্তু খুব মাথা নাড়িয়া বউদিদিকে বলিল, সে হতেই পারে না, আমি সেখানে যেতেই পারব না; তুমি আমায় তা হলে চেন নি।

পরদিবসই যাওয়া ঠিক হইল। দাদা তাহার বাড়িতে ছিলেন না; রামতনু ভাবিল, স্ত্রীর মুখে তিনি যখন এই উদ্ভট কথাটা শুনিবেন, তখন নিশ্চয়ই ভাবিবেন, রামতনু ভ্রাতৃজায়ার সহিত খুব একচোট ঠাট্টা করিয়া গিয়াছে; ততদিনে সে একটা সুসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া বাহির করিয়া ফেলিবে।

মা বধূমাতার মুখে শুনিলেন। অঞ্চলে চোখ মুছিয়া বলিলেন, রামুর আমার পড়াশোনার ঝোঁকটা চিরকালই এই রকম। আহা, ও কি বাঁচবে আমাদের পোড়া অদৃষ্টে? সবই ভাল বাছার, তবে ওই কেমন বিয়ের ফুল আর ফুটছে না!