রাণুর প্রথম ভাগ
৩
অপরাহ্ণকাল। ‘নবদ্বীপ আশ্রম’-এর একটি ক্ষুদ্র কক্ষে রামতনু গালে হাত দিয়া গাঢ় চিন্তায় আচ্ছন্ন।
আকাশে মেঘ থমথম করিতেছে। অপরাহ্ণের তাবৎ চিহ্নগুলাই লোপ পাইয়াছে। রামতনুর মনটা বড় বিষন্ন। আজ সকালে এক পসলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল বলিয়া প্রিয়ার উদ্দেশে যাওয়া হয় নাই; আর এখনও এই দশা। কাজটাও এমন ধরনের নয় যে, একটা গাড়ি ভাড়া করিয়া যাওয়া চলে। যাক, যখন উপায় নাই, তখন আর কি হইবে?
পশ্চিমে হাওয়ায় মেঘগুলা পূর্ব্বপ্রান্তে জড় হইতেছিল। রামতনু শখ করিয়া ভাবিতেছিল, তাহার মানসপ্রতিমাও ওইদিকটাই আলো করিয়া আছে। পুরাকালে এই মেঘ বিরহী যক্ষের সংবাদ যেমন তাহার প্রেয়সীর নিকট বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল, আজও যেন সেইরূপ রামতনুর মনোব্যথা বহন করিয়াই পূর্ব্বদিকে ১৪ নম্বর বিপ্রদাস লেনে তাহার প্রিয়ার পদতলে ঢলিয়া পড়িতেছে। আহা, তাহার বিরহেও এত সুখ!
রামতনুর কিন্তু মনে পড়িল, তাহার সহিত যখন একবারও দেখা হয় নাই, তখন এই মনগড়া বিরহ নিষ্ফল। প্রথমে কিরূপে দেখাসাক্ষাৎ করা উচিত, সেইটিই ভাবিবার কথা। বাস্তবিক, আমি অমুকের দেওর — বলিয়া উঠিলে চলিবে না তো। না হয় পাঁচ মিনিট ধরিয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া পরিচয়ই দিল। তাহার পর যদি জিজ্ঞাসা করে, কি কাজ বাপু এখানে?
সাত-পাঁচ ভাবিয়া রামতনু স্থির কলি, পরিচয়টা যেন হঠাৎ হইয়া গেল — এইরূপ হইলেই ঠিক।
মিনিট কয়েক চিন্তার পর রামতনুর মাথায় একটা জমকালো মতলবের উদয় হইল! সেটা সংক্ষেপত এই —
সে এই বাহির হইয়া বিপ্রদাস লেনটা চিনিয়া লইবে। তাহার পর যতক্ষণ না বৃষ্টি নামে, এদিক ওদিক একটু পায়চারি করিবে; এবং বৃষ্টি নামিবামাত্রই গলিতে ঢুকিয়া পড়িবে ও চৌদ্দ নম্বর বাড়ির নিকট গিয়া আর যেন পারিল না, এই ভাবে তাহার বারান্দায় উঠিয়া পড়িবে। ইহাতে চাই কি শ্রীমুখে একটু ‘আহা’ এবং শ্রীহস্ত প্রদত্ত একটি শুষ্ক বস্ত্রেরও আশা করা যাইতে পারে। তাহা ছাড়া পরিচয়াদির সময়ও পাইবে অনেক।
তাহা হইলে আর দেরি করা চলে না। রামতনু তাড়াতাড়ি জুতা জামা পরিয়া বাহির হইয়া পড়িল। চারিদিকে মেঘের আড়ম্বর দেখিয়া একবার মনে হইল, ছাতাটা লইয়া যায়; কিন্তু ভাবিল, তাহা হইলে ভাল জমিবে না।
ছোট বড় কতকগুলা গলি অতিক্রম করিয়া রামতনু কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীটে, আসিয়া পড়িল। রাস্তার দুই দিকে বিপ্রদাস লেন খুঁজিতে খুঁজিতে সে উত্তর দিকে চলিল। মাঝে মাঝে আকাশের পানে চাহিয়া তাহার মনটা বড় দমিয়া যাইতেছিল। বৃষ্টি আরম্ভ হইল বলিয়া — আর দেরি নাই। তাহা হইলেই তো সর্ব্বনাশ। আশঙ্কা-দুর্ব্বল মনে রামতনুর একটা সংশয় উদয় হইল, বউদিদি যদি ভুল বলিয়া থাকেন। কিংবা তাহার পোড়া বরাতে যাহা বেশি সম্ভব — ইঁহারা যদি বাসা বদলাইয়া ফেলিয়া থাকেন। কিংবা যদি —
বিপন্নভাবে রামতনু এক বৃদ্ধ দোকানীকে বলিল, ওগো কর্ত্তা, আমি বিপ্রদাস লেনে যাব।
বৃদ্ধ কি একটা নেশার ঝোঁকে ঝিমাইতেছিল। মাথা না তুলিয়াই ঘাড়টা একটু হেলাইয়া বলিল, স্বচ্ছন্দে।
বৃষ্টি নামিল। এখানে আর বৃথা কালক্ষেপ করা যায় না। দোকানীকে বিড়বিড় করিয়া কি একটা গালি দিয়া রামতনু এক রকম ছুটিতেই আরম্ভ করিল। বৃষ্টির জলে তাহার উৎসাহ স্যাঁতস্যাঁতে হইয়া আসিতেছিল। স্থির করিল, আর এক জনকে জিজ্ঞাসা করিবে; যদি সন্ধান না পায় তো আজ এই পর্য্যন্ত।
এইরূপ মনস্থ করিয়া রামতনু একজন পথিককে প্রশ্ন করিল। সামনেই একটা গলি ছিল, তিনি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই গলি দিয়ে একটু বেরিয়ে যান, সামনেই বিপ্রদাস লেন।
রামতনু হাতে স্বর্গ পাইল, কিন্তু মাথার স্বর্গ তাহাকে তীক্ষ্ণ বারিধারায় বিব্রত করিয়া তুলিতেছিল, আর সেই তীক্ষ্ণতা অতিশয় অসহ্য হইয়া উঠিল, যখন রামতনু বিপ্রদাস লেনে প্রবেশ করিয়া দেখিল, ডাইনে বাড়ির নম্বর ১১১ এবং বামে ১১২।
তাহার মানে, এটা গলির শেষ দিক এবং গলিটাও মস্ত বড়। দুঃখ করিয়া আর কি হইবে? দক্ষিণ দিকের বাড়িগুলার উপর মাঝে মাঝে নজর ফেলিয়া মাথা নীচু করিয়া সে দৌড়াইতে লাগিল। তাই কি ছাই বাড়িগুলাই ছোট? যাহা হউক, এই বড় বড় বাড়িগুলার নম্বর ক্রমে ক্রমে কমিয়া আসিতে লাগিল, এবং রামতনুরও নষ্ট উৎসাহ ফিরিয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে একবার মাথা উঁচাইয়া রামতনু দেখিল — ২১।
তাহার পরে মুখে হাসি দেখা দিল, এবং সে আর মাথাও নীচু করিল না। চোখে জলের ঝাপটা লাগিতেছিল। আসন্ন সুখের কথা ভাবিয়া এ সামান্য অসুবিধাকে উপেক্ষা করিয়া বাড়ির নম্বরগুলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া রামতনু লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া শৌখিন চালে দৌড়াইতে লাগিল। মুখে একটু হাসিও টানিয়া আনিল — যেন ব্যাপারটা সে বড়ই উপভোগ করিতেছে।
ক্রমে ১৮, ১৭, ১৬ নম্বর বাড়ি পার হইয়া গেল। এইবার ১৫, তাহার পর এই ১৪। রামতনু টপ করিয়া উঠিয়া পড়িল। দিব্য বারান্দাওয়ালা বাড়ি।
গলা হইতে চাদরটা নামাইয়া নিংড়াইতে নিংড়াইতে রামতনু বলিল, কি বৃষ্টি! এবং একবার চারিদিকটা চাহিয়া দেখিল।
বারান্দার এক কোণে একটা পশ্চিমা চাকর গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল —
“কলকতিয়াকে লোগনিকে নহি পতিয়ইহ
সমর্হু সমর্হু সখি বাট ঘাট যেইহ।”
অর্থাৎ, হে সখি, কলিকাতার লোককে প্রত্যয় নাই, অতএব পথঘাট চলিবে খুব সামলাইয়া। সুতরাং এবংবিধ অবিশ্বাস্য একজন কলিকাতাবাসীকে পথঘাট ছাড়িয়া একেবারে তাহার প্রভুর গৃহে আসিয়া উঠিতে দেখিয়া রুক্ষভাবে সে বলিল, এ মাশা, কিনারে চলিয়ে দাঁড়ান; দালানকে মাঝখানে জল পরসে।
রামতনুর এতক্ষণ অন্য রকম অভ্যর্থনা পাইবার কথা। কিন্তু তাহার কোন চিহ্ন না পাইয়া সে দালানের মাঝখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। এক্ষণেই পরিচয়মাত্রে তাহার কদর দেখিয়া এ বেটার কিরূপ ভ্যাবাচাকা লাগিয়া যাইবে, তাহা ভাবিয়া রামতনু বেশ একটু কৌতুক অনুভব করিতেছিল। কিন্তু আর একটু দাঁড়াইয়া চঞ্চলভাবে ইতস্তত দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া দেখিল, দুয়ারে শিকল আঁটা। এতক্ষণ কাঁপিতেছিল, এইবার দাঁতে দাঁত লাগিতে শুরু হইল। কি কুগ্রহ, মিছামিছি সন্ধ্যার সময় এই বৃষ্টিস্নান! আরে, মার ঝাড়ু এই কোর্টশিপের মাথায়! ইহার চেয়ে চার ক্রোশ গরুর গাড়ি চড়িয়া মেয়ে দেখিতে যাওয়া শতগুণে শ্রেয়।
হঠাৎ-পরিচয়ের আশা ছাড়িয়া কাপড় নিংড়াইয়া মাথা মুছিতে মুছিতে রামতনু চাকরটাকে প্রশ্ন করিল, তোর মনিবরা কোথায়?
চাকরটা লোকটার চালচলন দেখিয়া সন্দিগ্ধ মনে ইতস্তত করিয়া বলিল, তাতে তোমার কি জরুরি আছে? এই পাঁচ মিনিটমে এসে পড়বে। — বলিয়া একবার আড়চোখে নির্জ্জন রাস্তা ও রুদ্ধ গৃহগুলার উপর নজর ফিরাইয়া লইল।
বেচারা মনিবের সত্বর প্রত্যাবর্ত্তনের সম্ভাবনা জানাইয়া এই অজ্ঞাতকুলশীল কলিকাতাবাসীটিকে তাড়াইবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু ইহাতে তাহাকে বরং প্রফুল্ল হইতে দেখিয়া বেজায় অস্বস্তি অনুভব করিল এবং রামতনুর উপর হইতে চোখ না সরাইয়া একটু রাস্তার দিকে সরিয়া বসিল।
রামতনু সেটা বিশেষ লক্ষ্য করিল না। নেহাত চুপ করিয়া না থাকিয়া একটু কথাবার্ত্তা কহিবার জন্য বলিল, তুই বুঝি বাবুর চাকর?
উত্তর হইল, হুঁ; লেকিন হামার বড় ভাই পুলিসে কাম করে। রামতনু বড় ভাইয়ের পরিচয়ের প্রয়োজন তেমন বুঝিতে পারিল না, ভাবিল, ওদের বুদ্ধিই এই রকম।
অনেকক্ষণ নীরবে কাটিল। রামতনু মুঠায় চাপিয়া চাপিয়া জল বাহির করিয়া বুকের মাঝেই ফেলিতে লাগিল। চাকরটা অসহিষ্ণুভাবে বলিয়া উঠিল, এ মাশা, কিনারে দাঁড়ান না, কিস মাফিক লোক আপনি?
রামতনু একটু চটিল; ভাবিল, আচ্ছা বেয়াদব তো! কিন্তু মনে হইল, আহা, চেনে না; ও বেচারার আর দোষ কি? তাই এই অজ্ঞানজনিত ঔদ্ধত্যকে ক্ষমা করিয়া বলিল, কই, মনিব যে তোর আসে না?
চাকরটা তাহার দিকে ফিরিল না, তাচ্ছিল্যের সহিত চুপ করিয়া রহিল। রামতনু ভিতরে ভিতরে জ্বলিয়া যাইতেছিল, কিন্তু ভাবিয়া দেখিল, চটিয়া ফল নাই। তাই কঠোর সংযমের সহিত বলিল, তা যদি দেরিই থাকে তো একটা শুকনো কাপড় নিয়ে আয় দিকিন।
চাকরটা বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়িয়া ব্যঙ্গস্বরে বলিল, আর গোরাম গোরাম এক পিয়ালা চা ভি আনিয়ে দি? বোড়ো ভিজিয়ে গেলেন —
রামতনু তখন আরও চটিয়া গেল, কিন্তু আরও নরম সুরে চিবাইয়া চিবাইয়া বলিল, দেখ, ঢের বাংলা বুলি হয়েছে, চালাকি রাখ। আমার চাকর হলে এতক্ষণ আস্ত থাকতিস নি। তোর মনিব এলে টের পাবি, আমি কে। তবে নেহাত দেরি হলে আমি যদি চ’লেই যাই তো, এই কার্ড রইল। নে, একখানা কাপড় নিয়ে আয় দিকিন লক্ষ্মীছেলের মতন।
রামতনু পূৰ্ব্ব হইতেই কার্ড সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল। ভিজা একখানা কার্ড বাহির করিয়া তাহার নাম ও ঠিকানা লিখিয়া চাকরটার হাতে দিয়া বলিল, নে, রাখ; আর এই ঠিকানায় আমার ভিজে কাপড়গুলোও কাল দিয়ে আসবি।
চাকরটা গম্ভীরভাবে কার্ডটা দুই খণ্ড করিয়া ফেলিয়া দিল এবং দাঁড়াইয়া উঠিয়া হুঁশিয়ারির সহিত গলা উঁচাইয়া বলিল, হামার নাম রামটহলবা আসে, হামায় ঠকিয়ে কাপড় লিতে আসে তুম?
রামতনু আর নিজেকে সামলাইতে পারিল না, কারণ মানবের ধৈর্য্য এবং শীত সহ্য করিবার ক্ষমতা — উভয়েরই একটা সীমা আছে। একে তো শুষ্ক কাপড় পাইল না, তাহার উপর চক্ষের সম্মুখে তাহার কার্ডের এই লাঞ্ছনা হওয়াতে সে একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। ঘুষি বাগাইয়া সামনে আগাইয়া গেল এবং দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল, আমি ঠগ, জোচ্চোর? বেটা, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা?
হুঁশিয়ার হইলেই যে সাহসী হইতে হইবে — এমন কোন কথা শাস্ত্রে লেখে না। আবার সম্প্রতি শহরে কয়েকটা ডাকাতি হইয়া গিয়াছিল। রামতনুর উদ্যত ঘুষির নিম্ন হইতে তড়িতের ন্যায় সরিয়া গিয়া মাঝরাস্তায় বৃষ্টি মাথায় করিয়া রামটহলবা আর্ত্ত স্বরে ডাকিয়া উঠিল, খুন ভইল, দৌড় হো, ডাকু পড়ল বা —
রামতনু প্রমাদ গণিল। মুহূর্ত্তের মধ্যে নামিয়া পড়িয়া প্রেম ভুলিয়া প্রাণপণে ছুটিল। সামনেই একটা গলি দেখিতে পাইয়া তাহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং এ গলি সে গলি করিয়া একেবারে হেদোর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাঁপাইতে লাগিল, যেন বুকের পাঁজরা কয়টা ছিটকাইয়া বাহির হইয়া যাইবে।
কিন্তু তখনও তাহার স্বস্তি নাই। সামনে দিয়া মন্থর গতিতে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাইতেছিল। একবার চারিদিক চাহিয়া গাড়োয়ানকে সে জিজ্ঞাসা করিল, মেছোবাজার যাবি?
রামতনুর বস্ত্রের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া গাড়োয়ান বলিল, না বাবু, গদি ভিঙে যাবে।
আমি দাঁড়িয়ে যাব বাবা, গদি ভিজলে তুই দাম পাবি।
ডবল ভাড়া লিব বাবু, দেখছেন না, কি রকম বাদল আছে?
বাদল না হলে আর এইটুকুর জন্যে গাড়ি করি? তা ডবল ডবলই সই, কত হবে?
দেড় টাকা দিবেন বাবু; আপনি ভদ্রলোক কষ্টে পড়েছেন, কি আর বোলব?
নিরুপায়ভাবে গাড়িতে চড়িতে চড়িতে রামতনু বলিল, চার আনার ডবল কি দেড় টাকা হয় বাপু? তা চল, তোর ধর্ম্ম তোতেই আছে; একটু জোরে হাঁকাস।
গাড়ি চড়িবার মিনিট দুইয়েকের মধ্যে বৃষ্টিটা হঠাৎ ধরিয়া গেল। বিধিরও এই কঠোর বিদ্রুপ দেখিয়া রামতনুর মনে হইল, গাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকিয়া মরে।
নামিয়া একটা দোকান হইতে পাঁচ গ্রেন কুইনাইন কিনিয়া লইয়া হোটেলে ঢুকিল। তাহার পর ট্রাঙ্ক খুলিয়া গাড়োয়ানের জন্য দেড় টাকা বাহির করিয়া লইল। তখন কেবল একটি এক টাকার নোট ও বিকশিতদন্ত বিদ্রুপের মত একটি টাকা ট্রাঙ্কের মাঝখানে পড়িয়া রহিল।