রাণুর প্রথম ভাগ
২
যাহা হউক, কোর্টশিপ করিবার উদ্দেশ্যে সুটকেস, বিছানা, স্টীল ট্রাক, টিফিন-কেরিয়ার ইত্যাদি গাদাখানেক লটবহর সমেত রামতনু কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিল। হাওড়ায় পঁহুছিল সন্ধ্যার ঘণ্টা দেড়েক পূৰ্ব্বে। মনটা তাহার উৎসাহে পূর্ণ হইয়া উঠিল। এইবার তবে সে সেই বাঞ্ছিতার নিকট পঁহুছিল, যাহাকে আজ তিন দিন ধরিয়া কল্পনা ও স্বপ্নের মাঝে পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। পুলটি পার হইলেই তাহার ওই তীর্থস্বরূপা নগরী। ওঃ, কাল এতক্ষণ! — ভাবিতেও অসহ্য সুখ!
অন্যমনস্কভাবে মালকোঁচা আঁটিয়া ভারনিপীড়িত কুলীটাকে একটা ধমক দিল; এবং নিজেই বিছানার পুটলিটা হাতে ঝুলাইয়া লইল। নিকটে একটা ছোঁড়া একটা ফিটনের দ্বার খুলিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ভারটা নেহাত অসহ্য বোধ হওয়ায় রামতনু কিছু না বলিয়া সেটা দ্বারপথে সেই ফিটনের মধ্যে চালাইয়া দিয়া অগ্রগামী দূরবর্ত্তী কুলীটাকে ডাক দিল, ওরে বেটা, এদিকে — এখানে।
ছোঁড়াটা ব্যাপার দেখিয়া হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল। এক্ষণে আবার কুলীটাকে গাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া অগ্নিশর্ম্মা হইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, এটা মালগাড়ি আছে নাকি বাবু — যেতো পারছো চাপাচ্ছো? আমার আয়েশী বিলিতী ঘোড়া; বাজে মাল টানতে পারবে না। তাহার পর রামতনুর সহিত অন্য লোক নাই দেখিয়া বলিল, আলবৎ, আদমি যেতো পারবে এসো, তাতে না বোলবার ছেলে নয়। — বলিয়া ঘোড়াটার চর্ম্মসার জঙ্ঘায় একটা চাপড় দিয়া বলিল, কি রে বেটা, না?
রামতনু কথাটার প্রমাণের জন্য একবার ‘আয়েশী, বিলিতী’ ঘোড়াটার পানে চাহিল, দেখিল, সে বেচারীও দীন নয়নে মোটগুলার দিকে চাহিয়া আছে। তাহার সুস্পষ্ট মোটা মোটা পঞ্জরের বেড়ার মধ্যে শিরাবহুল স্থূল পেটটি দেখিলেই বোধ হয়, সে তাহারই ভারে এত কাহিল যে, অন্য ভার বহিবার আর তাহার সামর্থ্য নাই। ‘তবে বেঁধে মার, সয় ভাল’ — ভাবটা যেন অনেকটা এই রকম গোছের।
কিন্তু অনুকম্পার এ অবসর নহে; বরং দুই পয়সা ভাড়া বেশি দেওয়া যাইতে পারে, তাই সেই বালকের কথায় অনাদর দশাইয়া রামতনু বোঝাগুলি কুলীর মাথা হইতে নামাইতেছিল, এমন সময় এক সাহেব-আরোহীর সহিত গাড়োয়ান স্বয়ং আসিয়া দেখা দিল। সুখের বিষয়, কোনও বচসা হইল না; কারণ এই নবৈশ্বর্য্যগর্ব্বিত গাড়োয়ানটার সহিত আর বাক্যবৃদ্ধি নিরাপদ নহে জানিয়া রামতনু স্বহস্তেই বোঝাটি গাড়ি হইতে নামাইয়া লইল।
ফিটন চলিয়া গেল। চালকের পাশে আসিয়া সেই উদ্ধত ছোঁড়াটা একবার রামতনুর পানে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে গাড়োয়ানটাকে কি একটা বলিল। কথাটা শুনিতে না পাইলেও রামতনু অপমানের আঘাতে বড় নিরুৎসাহ হইয়া পড়িল। তাহার বাঞ্ছিতার ছবিটি মনে এতই সজীব হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার মনে হইল, যেন তাহার সম্মুখেই তাহাকে এই লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইতেছে।
কিন্তু নিরুৎসাহ হইলে কাজ চলে না। এদিকে সব গাড়িই প্রায় ভৰ্ত্তি হইয়া আসিতেছে। রামতনু কুলীটাকে বলিল, নে, ওঠা। বেটা আজ বড় বেঁচে গেল আমার হাত থেকে।
কুলীটা খপ করিয়া একটু নীচু হইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, না বাবু, আমায় চুকিয়ে দিন; আপনি বোড়ো ফ্যাসাদে লোক আছেন।
গাড়োয়ানটার মত কুলীটারও অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন ছিল বলিতে হইবে। তাই অদূরে কয়েকজন ব্যর্থমনোরথ গাড়োয়ানকে সেই অভিমুখে হুড়াহুড়ি করিয়া আসিতে দেখা গেল, এবং তাহাদের মধ্যে একজন বিশেষ ক্ষিপ্রতার সহিত আগুয়ান হইয়া মালগুলিতে হাত রাখিয়া সঙ্গীগণকে শাসাইয়া দিল, বাস করো, মেরা সওয়ারি হ্যাঁয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার সহকারী বালককে ডাক দিল, এ ইসমাইল, আরে চল্ শা–।
তাহাকে লইয়াই এত কাড়াকাড়ি পড়িয়া গিয়াছে দেখিয়া রামতনু আবার বেশ সপ্রতিভ হইয়া উঠিল এবং গাড়ি আসিলে গদিতে একটা চাপ দিয়া বসিয়া বলিল, হাঁকাও।
ঘোড়ার পিঠে চাবুক কশিয়া গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যেতে হোবে বাবু?
রামতনু একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। তাই তো, কোথায় যাইতে হইবে? সৰ্ব্বনাশ! এ কথাটা যে রামতনু নিজেই জানে না। কলেজের হস্টেলে যে তালা-আঁটা — এ কথা তো সে একবারও ভাবে নাই। কি বিভ্রাট! এখন উপায়? এদিকে সন্ধ্যা আগত প্রায়, আর সঙ্গে এই এত গুলা অতিকায় মোট। এই তিন দিন পড়াশুনা ছাড়িয়া এত যে ছাইভস্ম চিন্তা করিল, তাহার মধ্যে এই এত বড় চিন্তাটা কি মনে একবারও স্থান দিতে নাই?
কবিরা বলেন, প্রেম অন্ধ; তা যখন হইয়াছিল, তখন তো অন্ধ করিয়াইছিল, কিন্তু এখন সে নেশা কাটিয়া গেলেও রামতনু চক্ষে কিছু দেখিতে পাইল না। শরীর তাহার এলাইয়া পড়িল। গদিতে ঠেস দিয়া সে আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিল; কিন্তু আকাশ-পাতালের মাঝখানে যে আপাতত কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না।
১৪ নম্বর বিপ্রদাস লেনের কথা একবার মনে হইল। কিন্তু সেখানে তো এ অবস্থায় গিয়া খোঁটা গাড়া চলে না। চলে না তো, কিন্তু উপায়? কলেজ খুলিবার তো এখনও পুরা দশ দিন বাকি; এই দশ দিন কি গাড়িতে ঘুরিয়া বেড়াইবে? তাহাতেও সে নয় রাজি; কিন্তু গাড়ির মালিক যে নামিয়া আসিয়া এখনই একটা মীমাংসা করিয়া লইবার জন্য উৎকট রকম পীড়াপীড়ি লাগাইয়া দিবে; দশ মিনিটও যাইতে দিবে না।
গাড়িটা স্টেশন ছাড়াইয়া বাহিরে আসিল। ইহার মধ্যে গাড়োয়ান আরও দুই-তিন বার মাথা ঝুঁকাইয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কোথায় যেতে হোবে? কিন্তু কোন উত্তর না পাওয়ায় গাড়ি থামাইয়া নামিয়া আসিয়া রুক্ষভাবে জিজ্ঞাসা করিল, এ বাবু, আপনিও একটা মাল আছেন নাকি? কোথা বোলেন না যে? না, আমরা জ্যোৎখী আছি যে, বাড়ি চিনে লোবো?
ঘর্ম্মাক্তকলেবর রামতনু সোজা হইয়া বসিয়া ধীরভাবে বলিল, দাঁড়া বাবা, ততক্ষণ তুই চল্ না সামনে, বলছি।
একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় ভীত হইয়া গাড়োয়ান বলিল, কি মোজার কোথা আছে! আপনি লামুন, আমি এ রোকোম সওয়ারি চাহে না। পরে ইসমাইলকে বলিল, উতার রে — লা বক্মা।
বিপদ যখন এতই আসন্ন হইয়া পড়িল, রামতনুর চট করিয়া একট। হোটেলের কথা মনে পড়িয়া গেল। সে বলিল, আঃ, চল না রে ২৫৭ নম্বর মেছোবাজারে; আমার এই নম্বরটাই মনে পড়ছিল না।