রাণুর প্রথম ভাগ
৪
পরদিবস বেলা আন্দাজ চারিটার সময় রামতনু বিছানার উপর অলসভাবে শুইয়া জানালার মধ্য দিয়া আকাশ পানে চাহিয়া ছিল। মেঘ ছিল না বলিলেও মিথ্যা বলা হয় না, তবুও ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘে ডরায়, সেইরূপ যা দুই-এক খণ্ড মেঘ এদিক ওদিক করিয়া বেড়াইতেছিল, তাহা দেখিয়া রামতনুর যথেষ্ট আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছিল এবং আশু বিবাহের আশা দিয়াও তাহাকে শ্যামবাজারে পাঠাইতে পারা যাইত না। সে ভাবিতেছিল, মেঘের নামগন্ধ না মুছিয়া গেলে সে আর পাদমপি নড়িতেছে না। এমন পয়সাও নাই যে, গাড়ি করিয়া যাইবে। আর যাইলেও যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া মস্ত বড় একটা ভিড় দাঁড়াইয়া যাইবে না, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? বেটা উজবুক চাকরটা সব কাঁচাইয়া দিল।
মেসে একটা লোক খবরের কাগজ দিত, সে দেখা দিল। তাহাকে নিজের ঘরে ডাকিয়া রামতনু কাগজটা লইল। হাতে কোন কাজ নাই, একটা কাগজের দামও বেশি নয়, রামতনু জিজ্ঞাসা করিল, কোনও বাংলা কাগজ রাখিস?
লোকটা সোৎসাহে একখানা ‘নায়ক’ বাহির করিয়া বলিল, এই নিন বাবু, এ রকম গালাগাল পাঁচকড়িবাবু অনেক দিন দেন নি; প্রাণ খুলে লাট সাহেবকে নিয়েছেন একচোট।
রামতনু হাসিয়া কাগজখানা লইল, তাহাকে দাম চুকাইয়া দিল এবং বুকে বালিশটা চাপিয়া কাগজটা বিছানায় মেলিয়া পড়িতে লাগিল।
পড়িবে কি? প্রথমেই বড় বড় অক্ষরে ছাপা হেডিংগুলায় নজর পড়ায় তাহার আক্কেল গুম হইয়া গেল — “দিনে ডাকাতি! মাঝ, শহরে ভীষণ কাণ্ড!!” নিম্নবর্ত্তী দুইটি অনতিক্ষুদ্র প্যারাগ্রাফে লেখা আছে — “গতকল্য বেলা আন্দাজ ৪৷৷০ ঘটিকার সময় ১৪নং বিপ্রদাস লেনে শ্রীযুক্ত বাবু সারদাপ্রসাদ দত্তের ভবনে একটি লোমহর্ষণ ডাকাতির উপক্রম হইয়া গিয়াছে। মুষলধারায় অশ্রান্ত বৃষ্টি হইতেছিল বলিয়া গলিতে লোকচলাচল বন্ধ ছিল এবং আশপাশের বাড়িগুলিরও দুয়ার-জানালা প্রায় সব রুদ্ধ ছিল। সারদাবাবু সপরিবারে ৺কালীঘাটে দেবীদর্শনে গিয়াছিলেন। বাড়িতে ছিল মাত্র একটি পশ্চিমা চাকর। এই সময় সুযোগ বুঝিয়া একটি ভদ্রবেশধারী যুবা ভিজিতে ভিজিতে আসিয়া বারান্দায় উঠে এবং প্রথমে সোজা কথায় একখানি শুষ্ক বস্তু চাহিয়া আলাপ জমাইবার চেষ্টা করে এবং তাহাতেও কৃতকার্য্য না হইয়া একখানি কার্ড হাতে দিয়া বলে যে, সে তাহার প্রভুর আত্মীয়। চাকরটা ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া কার্ডটা ছিঁড়িয়া ফেলে এবং তাহাকে অর্দ্ধচন্দ্রদানে নিষ্ক্রান্ত করিবার প্রয়াস করে। ইহাতে দুর্বৃত্ত জামার মধ্য হইতে একখানা ভোজালি বাহির করিয়া তাহাকে আক্রমণ করে। তখন ভৃত্যটা রাস্তায় পড়িয়া চীৎকার করিয়া লোক জড় করে। ইত্যবসরে ভদ্রবেশধারী গুণ্ডাটি চম্পট দেয়; এবং ঠিক এই সময় গলির বাহিরে সদর-রাস্তা দিয়া একটি মোটরকে উর্দ্ধশ্বাসে বৃষ্টির মধ্য দিয়া ছুটিয়া যাইতে দেখা যায়। পুলিসের তদন্ত চলিতেছে।
“দ্বিখণ্ডিত কার্ডের অর্দ্ধেকটা মাত্র পাওয়া গিয়াছে; সেটার লেখাটুকুও নাকি জল পড়িয়া এমনই অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, কিছুই নিরূপিত হয় না। আমাদের লালপাগড়ী ভায়ারা বোধ করি ভাবিতেছেন, লেখাটা পড়া গেলে ব্যাপারটার একটা কিনারা হয়। এমন না হইলে আর বুদ্ধি! আমরা বলি, অত মাথা না ঘামাইয়া, বিজ্ঞাপন দিয়া ঠিকানাটা ডাকাতের নিকট হইতে আনাইয়াই লওয়া হউক না।”
রামতনুর সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল। কি সর্ব্বনাশ! সে একজন ফেরারী আসামী! তাহাকে লইয়া শহরময় হৈ-চৈ পড়িয়া গিয়াছে। ঘামে তাহার বুকের বালিশ ভিজিয়া গেল এবং তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন মাথার মধ্যে একটা গুবরে-পোকা ঢুকিয়া ভোঁ-ভোঁ করিয়া চক্র দিতেছে। ক্রমে পারিপার্শ্বিক জিনিসগুলার ধারণা যেন তাহার এলোমেলো হইয়া আসিতে লাগিল।
মিনিট পাঁচেক পরে সে অতিকষ্টে নিজেকে একটু সামলাইয়া লইল; বাহিরে গিয়া বেশ করিয়া মাথাটা ধুইয়া ফেলিল। লোকটা সাধারণত দেবদেবী মানিত না, কিন্তু হঠাৎ তাহার তেত্রিশ কোটির উপরই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়া গেল, এবং যাঁহারা বিশিষ্ট, তাঁহাদের মধ্যে যিনি যাহা পছন্দ করেন, তাঁহার জন্য সেই দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে মানত করিয়া বসিল। আবার ভিতরে আসিয়া কাগজটা আর একবার পড়িয়া তাড়াতাড়ি ভাঁজ করিয়া ফেলিল। তাহাতেও তাহার মন যেন মানিল না। খবরটা শহরের অনেকে পড়িয়াছে এবং পড়িতেছে, কিন্তু তাহার ভীতি এই কাগজখানিতে এমন সংবদ্ধ হইয়া পড়িল যে, সে যেন ইহা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখিলেই বাঁচে। তাহার ঘরে এই খবরটা তাহার কেনা এই কাগজে কেহ পড়িলে যেন তাহার গ্রেপ্তার না হইয়াই যায় না।
রামতনু এদিক ওদিক দেখিয়া ভাঁজ-করা কাগজখানা বিছানার নীচে একেবারে মাঝখানে গুঁজিয়া দিল। জানালা দিয়া কাগজখানা রাস্তায় ফেলিয়া দেওয়াও তাহার নিরাপদ বোধ হইল না।
তাহার পর মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল, এখন পুলিসের হাত হইতে বাঁচিবার উপায় কি? মাতৃবাক্য ঠেলিয়া একেবারে অশ্লেষা-মঘা মাথায় করিয়া আসিয়া কি অঘটনটাই না ঘটিল! যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া আসা, তাহার মুখ তো এখনও দেখা গেল না; যদি ভবিষ্যতে দেখা হয় তো পুলিসপরিবৃত হইয়া — কল্পনাতেও প্রেমের নেশা ছুটিয়া গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে। সে মুখ দেখাইবার বদলে এখন ভগবান যদি তাহার নিজের মুখ লুকাইবার একটু সুযোগ করিয়া দেন তো সে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে। ধর, শেষ পর্য্যন্ত জেলে না হয় নাই যাইতে হইল, কিন্তু এই কুটুম্ব-সাক্ষাৎ লইয়া কি কেলেঙ্কারিই না হইবে! শেষে বাড়ি পর্য্যন্ত টান ধরিবে, তাহার প্রবঞ্চনা করিয়া চলিয়া আসার কথাও জাহির হইয়া পড়িবে এবং সে আসার উদ্দেশ্য ও কাহারও অবিদিত থাকিবে না। হা ঈশ্বর, স্বপ্নে দেখাইয়াছিলে মধুর মিলন, আর বাস্তবে দাঁড় করাইলে কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ডাকাতির দায়ের এজাহার! তবে আর ভক্তবৎসল তোমায় বলে কেন মিছামিছি?
নীচে ঠাকুরের সঙ্গে যেন একটি ভদ্রলোকের কথাবার্ত্তার আওয়াজ শোনা গেল; তাহার পর সিঁড়িতে পায়ের শব্দ — রামতনু উৎকর্ণ হইয়া রহিল। শব্দটা যেন তাহারই ঘরের দিকে আসিতেছে; বিবশাঙ্গ রামতনু দরজার দিকে অপলক নেত্রে চাহিয়া রহিল।
ভদ্রলোকটি দরজার সামনে আসিয়া রামতনুকে নমস্কার করিলেন, তাহার পর ভিতরে প্রবেশ করিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে চেয়ারখানায় বসিয়া বলিলেন, মশায় —
রামতনু ঠিক এতক্ষণে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, মশায় —
দুইজনের কথা একসঙ্গে বাহির হওয়ায় দুইজনেই একটু থতমত খাইয়া গেল। সামলাইয়া রামতনু কি বলিতে যাইতেছিল, তাহার আগেই ভদ্রলোকটি বলিলেন, এখানে রাম — এই রাম — অর্থাৎ রামতারণ বলে কেউ থাকেন?
রামতনু বুঝিল, এ সাক্ষাৎ ডিটেক্টিভ, আর রক্ষা নাই। ঢোক গিলিয়া জড়িত স্বরে বলিল, আজ্ঞে, কই, না।
থাকেন না? তাই তো — আচ্ছা, ধরুন, রামের সঙ্গে কিছু যোগ করে — যেমন ধরুন — রাম — রাম —
রামতনুর বক্ষে সজোরে ঢিপঢিপ করিয়া আওয়াজ হইতেছিল। ব্যস্তভাবে বলিল, না না মশায়, ও রকম ধরনের নাম — রামায়ণ থেকে কোন নামই এ বাড়িতে নেই। আপনি বোধ হয় ভুল ঠিকানায় এসেছেন।
লোকটি রামতনুর দিকে একটু অপ্রতিভভাবে চাহিলেন ও বলিলেন, মশায়, মাফ করবেন, আপনাকে বোধ হয় বিরক্ত করছি। আপনি অসুস্থও বোধ হচ্ছে, কিন্তু একটু হাঙ্গামায় পড়া গেছে। — বলিয়া পকেটে হাত দিলেন এবং কোণাকোণি ছিন্ন একটা কার্ড বাহির করিয়া পড়িয়া বলিলেন, আজ্ঞে না, ঠিকানা ঠিক এই, এই দেখুন না।
রামতনু কার্ড দেখিবে কি, সব আঁধার দেখিতেছিল। তাহারই কার্ড-রামটহলের হাতে ছেঁড়া। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত কার্ডটার দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার আর বাক্যস্ফুর্ত্তি হইল না। এ সেই হঠাৎ লোকটি বলিলেন, আচ্ছা, আপনি এখানে আছেন কদিন? সবাইকে চেনেন?
রামতনুর নেশার মত ভাবটা ছাঁত করিয়া কাটিয়া গেল; সে মুখ তুলিয়া পাগলের মত ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।
লোকটিও ব্যাপারটা আন্দাজ করিতে পারিলেন না। নিজেকে সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, না, আপনি রেস্ট নিন, আপনাকে জ্বালাতন করে বড় অন্যায় করছি। আমি বোধ হয় ভুল ঘরেই ঢুকেছি; কিন্তু অন্য ঘরগুলোও বন্ধ। তা আমি এই বইটা নিয়ে বসি। অন্যান্য ভদ্রলোকেরা এলে খোঁজ নেব। তাহার পর তিনি চিন্তিতভাবে নিজের মনে মনেই বলিলেন, কিংবা হতেও পারে, নিজেই বোধ হয় ভুল বুঝেছি। — বলিয়া বইখানার পাতা উল্টাইতে লাগিলেন।
বলে কি? বসিয়া থাকিবে! রামতনুর মাথায় বাজ পড়িল। বিপদে বুদ্ধিবৃত্তিকে একটু গুছাইয়া লইয়া বলিল, আজ্ঞে, বসে থেকে তো কোন ফল নেই; আমি এ মেসের সব্বাইকেই জানি। আজ চার বছর একটানা এখানে রয়েছি। আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন।
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না, শুধু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বইয়ের এক জায়গায় কি যেন পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার পর সন্দিগ্ধভাবে রামতনুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, তা থাকুন মশায়, চার বছর, কিন্তু দু মিনিটে আমি যা টের পেয়েছি, আপনি চার বছরে কেন টের পান নি, তা জানি না। অর্থাৎ রামতনু ব’লে এখানে কেউ আছেন, সম্ভবত এই মেসেই থাকেন, আর সম্ভবত আমার সামনেই ব’সে আছেন। দেখুন তো, এই বইখানা বোধ হয় আপনার। — বলিয়া রামতনুর যেখানে নামটা লেখা ছিল, সেইখানটা টিপিয়া ধরিয়া তাহার সম্মুখে বইটা বাড়াইয়া ধরিলেন।
রামতনুর মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হইয়া গেল। লোকটির হাতটা চাপিয়া ধরিয়া নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, মশায়, বাঁচান, কিছু দোষ নেই আমার, জেল থেকে —
কিছু দোষ নেই, নিতান্ত বলা যায় না; কারণ মিছিমিছি আত্মগোপন করতে গিয়ে আমায় যা ভাবিয়েছেন, তাতে একটু দোষ হয়েছে বইকি। তবে তার জন্যে জেলে যেতে হবে না, এ গ্যারাণ্টি আমি দিতে পারি। তারপরে, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো।
রামতনু ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল না বটে, তবে কিছু কিছু বলিল; অর্থাৎ সারদাবাবুর সহিত তাহাদের কুটুম্বিতা কি প্রকারের আর সেই কুটুম্বিতাসূত্রে আলাপ করিবার প্রয়াসে ব্যাপারটা কিরূপ অহেতুকভাবে ঘোরালো হইয়া দাঁড়াইয়াছে — ইত্যাদি, ইত্যাদি। বেশির ভাগ গোপনই করিল — যেমন আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য কি, আসিল কত বাধা-বিপত্তির মাঝে, আরও অনেক কথা।
ভদ্রলোকটির নাম অমিয়বাবু। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, আমিও অনেকটা এই ধরনের কিছু একটা হবে তা আন্দাজ করেছিলাম। চাকরটা যখন একটা কার্ডের টুকরো দেখিয়ে বললে, আবার আমায় কার্ড দিয়ে ভোলাতে এসেছিল, তখনই আমার মনে একটু খটকা লাগে; ভাবলুম, বাংলা দেশে ডাকাতির যুগটা এখনও সম্পূর্ণ যায় নি বটে, তবে চিঠিপত্র দিয়ে ডাকাতির যুগটা আর নেই। লুট করতে এসে ঠিকানা রেখে যাবে, এমন ডাকাতকে অতি-সাহসী অথবা অতি-বোকা বলতে হবে, তা এই সভ্যযুগে এই দু রকমের কোনটাই থাকা সম্ভব নয়।
পুলিস কার্ডের খানিকটা পেয়ে বাকিটা খুঁজতে লাগল। দৈবক্রমে সেটা জলকাদা মাখা হয়ে আমার জুতোর পাশেই পড়ে ছিল; আমি জুতোর তলায় সেটা চেপে ধরলাম, এবং সুবিধেমত উঠিয়ে পকেটে পুরলাম। কার্ডের এই আধখানা নিয়ে আমি দুটো সিদ্ধান্ত খাড়া করলাম — প্রথমত, যদি খারাপ মতলবে কেউ এসে থাকে তো এটার কোন মূল্যই নেই; সে প্রকৃতপক্ষেই চাকরটার কাছে নিজের আত্মীয়তা প্রমাণ করতে গিয়েছিল একটা যা-তা ঠিকানা দিয়ে। আর যদি কোন জানিত লোক দেখা করতে এসে থাকে, তবে এটার যথেষ্টই দাম আছে। আমার নিজের আন্দাজ কাউকেও আর জানালাম না, ভাবলাম, একবার চুপিচুপি দেখা যাবে।
ঠিকানাটা বুঝতে ততটা বেগ পেতে হয় নি; তবে নামটা সমস্ত পাওয়া গেল না। এই দেখুন না, আন্দাজে ‘রাম’-গোছের একটা কথা দাঁড় করানো যায়, বাস্, তার পরে ছেঁড়া। পুলিসের হাতে যেটুকু আছে, তাতে নামের যেটুকু ছিল — একেবারে জলকাদায় মুছে গেছে, নীচে খালি ‘লেন’ আর তার নীচে ‘ক্যালকাটা’ পড়া যায়।
কিন্তু পুরো নামের অভাবটুকুই ব্যাপারটাকে খানিকটা রহস্য দিয়ে। একটু জমাট ক’রে তোলে, আর আমার একটু ডিটেক্টিভি করার লোভটা বাড়িয়ে দেয়। এটুকু না থাকলে তো ব্যাপারটা এক রকম বৈচিত্র্যহীনই বলতে হয়।
যা হোক, শেষে কিন্তু আপনি বড় দমিয়ে দিয়েছিলেন। আর আপনার এই বইখানি আমায় সাহায্য না করলে আমায় বড় অপ্রস্তুত হয়ে বাসায় ফিরতে হত। আচ্ছা, আপনি কিন্তু এতটা বেগ দিলেন কেন? সত্যিই ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন নাকি? তা হলে গেরস্থের কাছে ঠিকানা দিয়ে আসতে পারলেন, আর আমার কাছে আত্মপরিচয় দেবার সময় সব সাহস লোপ পেল?
ভদ্রলোকটি চেয়ারে হেলান দিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন; রামতনু ক্ষীণভাবে তাহাতে একটু যোগ দিল। তাহার পর বিছানার ভিতর হইতে ‘নায়ক’খানা বাহির করিয়া বলিল, পড়ুন এইখানটা, তা হলেই শ্রাদ্ধ কতদূর গড়িয়েছে বুঝতে পারবেন। মশায়, মানুষ সাধু কি অসাধু, তা আর আজকাল তার নিজের কাজের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে এই সব খবরের কাগজগুলোর মতামতের ওপর।
অমিয়বাবু উচ্চহাস্যে মধ্যে মধ্যে বিবরণটুকু পড়িয়া কাগজটা রাখিয়া দিলেন, বলিলেন, বাহাদুরি তবে আমারই বেশি, একটা মস্তবড় ব্যাপারে কিনারা করে ফেলেছি। কিন্তু আসল কথাটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে। নিন জামা-টামা পরে, ব্যাপারটা না জুড়তে পরিচয় হলেই ভাল, তাদের একেবারে অভিভূত ক’রে ফেলা যাবে। নিন, আমি ততক্ষণ একটা সিগারেট ধরাই।
ভয়টা যখন সম্পূর্ণ তিরোহিত হইল, রামতনুর মনে আবার পূর্ব্বের ভাবটা আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া লইল। অমিয়বাবু তাহাকে বিপন্মুক্ত করিয়াছেন বটে, কিন্তু বিশেষ করিয়া তিনি তাহার বাঞ্ছিতার আত্মীয় বলিয়া সে সহজেই তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িল এবং তাঁহার আতিথ্যের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। অমিয়বাবু যখন সিগারেট ধরাইতেছিলেন, রামতনু প্রচ্ছন্নভাবে একটা টাকা বাহির করিয়া নীচে নামিয়া গেল এবং ঠাকুরকে বাছা বাছা খাবার, এক বাক্স কাঁচিমার্কা সিগারেট ও পানের ফরমাশ দিয়া উপরে উঠিয়া আসিল। তাহার মনে হইতেছিল, হ্যাঁ, শেষ পর্য্যন্ত বিয়ের ফুলটা ফুটল তা হলে, ভগবান মুখ তুলে চাইলেন, — ওঃ, চাইতেই হবে, অধ্যবসায় বলে একটা জিনিস আছে তো। আর তিনিই শুধু আছেন, ওসব দেবতা-টেবতা কিছু নয়।
ঘরে আসিয়া প্রফুল্লভাবে অমিয়বাবুকে বলিল, তা নয় টাটকা-টাটকিই দেখাশোনা করা গেল; কিন্তু আগে থাকতে বাড়িতে কে কে আছেন জানা থাকলে পরিচয়ের বিশেষ সুবিধে হয়। অর্থাৎ নতুন পরিচয়ের আড়ষ্ট ভাবটা অনেকটা কেটে যায়। বিশেষ করে আপনাকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে আমি এ সুযোগটুকু ছাড়তে রাজি নই।
রামতনু পূর্ব্বে অবশ্য অনেকটা শুনিয়াছিল, কিন্তু যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া আসা, তাহার সম্বন্ধে আলোচনার জন্য তাহার তৃষিত মনটা বড়ই ব্যগ্র হইয়া উঠিল — বিশেষ করিয়া তাহারই এই আত্মীয়ের সহিত।
অমিয়বাবু বলিলেন, হ্যাঁ, সে কথা মন্দ কি! তবে মেলা লোকের মধ্যে গিয়ে আপনাকে হাঁপিয়ে পড়তে হবে না — বাড়িতে ওঁদের আছেন মাত্র কর্ত্তা স্বয়ং, আর এই গিয়ে একটি মেয়ে, মা আর একটি ছেলে, সে নেহাত ছেলেমানুষ — ইস্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ে।
নিজের অন্তর্নির্দ্দিষ্ট পথে আলোচনাটিকে লইয়া যাইবার জন্য রামতনু বলিল, হ্যাঁ, লেখাপড়ার কথায় মনে পড়ে গেল, সারদাবাবুর মেয়েটি তো খুব উচ্চশিক্ষিতা?
উচ্চশিক্ষিতা এখনও বলা যায় না, ম্যাট্রিকটা পাস করেছেন মাত্র। তবে হ্যাঁ, আরও পড়েন সবারই এই রকম ইচ্ছে। — কথাগুলা অমিয়বাবু ঘাড়টা একটু নামাইয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন।
রামতনু বলিল, যাই হোক, আমাদের মধ্যে এটুকুও বড় একটা পাওয়া যায় না, আলাপ ক’রে তৃপ্তি পাওয়া যাবে। তার ওপর আপনার সঙ্গে পরিচয়টা আগে থাকতেই হয়ে রইল। আপনার সঙ্গে ওঁদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ব’লে বোধ হচ্ছে যেন।
অমিয়বাবু পূৰ্ব্ববৎ হাসিয়া বলিলেন, সম্বন্ধ কিছুই ছিল না, তবে কয়েক দিন থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, আর সেটা একটু ঘনিষ্ঠও বলতে হবে বইকি।
রামতনু বিশেষ কিছু না বুঝিয়া, শুধু বাক্যের কৌশলটুকু লক্ষ্য করিয়া হাসিয়া বলিল, কি রকম?
অর্থাৎ — ওর নাম কি — ওঁর সেই মেয়ের সঙ্গে সম্প্রতি আমার বিবাহ হয়েছে। — বলিয়া পূর্ব্বের মত লজ্জিতভাবে হাসিতে হাসিতে অমিয়বাবু নির্বাপিত সিগারেটটা আবার ধরাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন; এবং ঠিক এই সময়ে দরজার আড়াল হইতে উড়ে ঠাকুরটা বিজ্ঞের মত মুচকি হাসিয়া ইশারা করিয়া জানাইল, আতিথ্যের আয়োজন সব হাজির।
…