বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

রাণুর প্রথম ভাগ

বই হারানো, কি ছেঁড়া, পেট-কামড়ানো, মাথা-ব্যথা, খোকাকে ধরা প্রভৃতি ব্যাপারগুলা যখন অনেকদিন তাহাকে বাঁচাইবার পর নিতান্ত একঘেয়ে এবং শক্তিহীন হইয়া পড়ে, তখন দুই-এক দিনের জন্য নেহাত বাধ্য হইয়াই রাণু বই স্লেট লইয়া হাজির হয়। অবশ্য পড়াশুনা কিছুই হয় না। প্রথমে গল্প জমাইবার চেষ্টা করে। সংসারের উপর কোনকিছুর জন্য মনটা খিঁচড়াইয়া থাকায় কিংবা অন্য কোন কারণে যদি সকলের নিজ নিজ কর্ত্তব্য সম্বন্ধে আমার মনটা বেশি রকম সজাগ থাকে তো ধমক খাইয়া বই খোলে; তাহার পর পড়া আরম্ভ হয়। সেটা রাণুর পাঠাভ্যাস, কি আমার ধৈর্য্য, বাৎসল্য, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদ্‌গুণের পরীক্ষা, তাহা স্থির করিয়া বলা কঠিন। আড়াইটি বৎসর গিয়াছে, ইহার মধ্যে রাণু ‘অজ’ ‘আম’-র পাতা শেষ করিয়া ‘অচল’ ‘অধম’-র পাতায় আসিয়া অচল হইয়া বসিয়া আছে। বই খুলিয়া আমার দিকে চায় — অর্থাৎ বলিয়া দিতে হইবে। আমি প্রায়ই পড়াশুনার অত্যাবশ্যকতা সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র উপদেশ দিয়া আরম্ভ করি, আচ্ছা রাণু, যদি পড়াশুনা না কর তো বিয়ে হলেই যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, মেজকাকা কি রকম আছে, তাকে কেউ সকালবেলা চা দিয়ে যায় কি না, নাইবার সময় তেল কাপড় গামছা দিয়ে যায় কি না, অসুখ হলে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কি না — এসব কি করে খোঁজ নেবে?

রাণু তাহার মেজকাকার ভাবী দুর্দ্দশার কথা কল্পনা করিয়া একটু মৌন থাকে, কিন্তু বোধ হয় প্রথমভাগ-পারাবার পার হইবার কোন সম্ভাবনাই না দেখিয়া বলে, আচ্ছা মেজকা, একেবারে দ্বিতীয় ভাগ পড়লে হয় না? আমায় একটুও বলে দিতে হবে না। এই শোন না — ঐ ক-য়ে য-ফলা —

রাগিয়া বলি, ওই ডেঁপোমি ছাড় দিকিন, ওইজন্যেই তোমার কিছু হয় না। নাও, পড়। সেদিন কত দূর হয়েছিল? ‘অচল’ ‘অধম’ শেষ করেছিলে?

রাণু নিষ্প্রভভাবে ঘাড় নাড়িয়া জানায়, হাঁ।

বলি, পড় তা হলে একবার।

‘অচল’ কথাটার উপর কচি আঙুলটি দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। আমার মাথার রক্ত গরম হইয়া উঠিতে থাকে এবং স্নেহ করুণা প্রভৃতি স্নিগ্ধ চিত্তবৃত্তিগুলা বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাইবার উপক্রম হয়। মেজাজেরই বা আর দোষ দিই কি করিয়া? আজ এক বৎসর ধরিয়া এই ‘অচল’ ‘অধম’ লইয়া কসরৎ চলিতেছে; এখনও রোজই এই অবস্থা।

তবুও ক্রোধ দমন করিয়া গম্ভীরভাবে বলি, ছাই হয়েছে। ‘আচ্ছা বল — অ — চ — আর ল — অচল।

রাণ অ-র উপর হইতে আঙুলটা না সরাইয়াই তিনটা অক্ষর পড়িয়া যায়। ‘অধম’-ও ওই ভাবেই শেষ হয়; অথচ ঝাড়া দেড়টি বৎসর শুধু অক্ষর চেনায় গিয়াছিল।

তখন জিজ্ঞাসা করিতে হয়, কোনটা অ?

রাণু ভীতভাবে আমার দিকে চাহিয়া আঙুলটি সরাইয়া ল-এর উপর রাখে।

ধৈর্য্যের সূত্রট। তখনও ধরিয়া থাকি, বলি, হুঁ, কোণ্টা ল হ’ল তা হ‘লে?

আঙুলটা সট করিয়া চ-এর উপর সরিয়া যায়। ধৈর্য্যসাধনা তখনও চলিতে থাকে; শান্তকণ্ঠে বলি, চমৎকার! আর চ?

খানিকক্ষণ স্থিরভাবে বইয়ের দিকে চাহিয়া থাকে, তাহার পর বলে, চ? চ নেই মেজকা।

সংযত রাগটা অত্যন্ত উগ্রভাবেই বাহির হইয়া পড়ে, পিঠে একটা চাপড় কষাইয়া বলি, তা থাকবে কেন? তোমার ডেঁপোমি দেখে চস্পট দিয়েছে। হতভাগা মেয়ে — রাজ্যের কথার জাহাজ হয়েছেন, আর এদিকে আড়াই বৎসরে প্রথম ভাগের আড়াইটে কথা শেষ করতে পারলে না! কত বুড়ো বুড়ো গাধা ঠেঙিয়ে পাস করিয়ে দিলাম আর এই একরত্তি মেয়ের কাছে আমায় হার মানতে হ’ল! কাজ নেই তোর অক্ষর চিনে। সন্ধ্যে পর্য্যন্ত ব’সে ব’সে খালি অ — চ — আর ল — অচল; অ — ধ — আর ম — অধম — এই আওড়াবি। তোর সমস্ত দিন আজ খাওয়া বন্ধ।

বিরক্তভাবে একটা খবরের কাগজ কিংবা বই লইয়া বসিয়া যাই; রাণু ক্রন্দনের সহিত সুর মিশাইয়া পড়া বলিয়া যায়।

বলি বটে, সন্ধ্যা পর্য্যন্ত পড়িতে হইবে; কিন্তু চড়টা বসাইয়াই নিশ্চিন্ত হইয়া যাই যে, সেদিনকার পড়া ওই পর্য্যন্ত। রাণু এতক্ষণ চক্ষের জলের ভরসাতেই থাকে এবং অশ্রু নামিলেই সেটাকে খুব বিচক্ষণতার সহিত কাজে লাগায় কিছুক্ষণ পরে আর পড়ার আওয়াজ পাই না; বলি, কি হল?

রাণু ক্রন্দনের স্বরে উত্তর করে, নেই।

কি নেই? — বলিয়া ফিরিয়া দেখি, চক্ষের জল ‘অচল’ ‘অধম’-র উপর ফেলিয়া আঙুল দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া কথা দুইটা বিলকুল উড়াইয়া দিয়াছে — একেবারে নীচের দুই-তিনখানা পাতার খানিকটা পর্য্যন্ত।

কিংবা আঙুলের ডগায় চোখের ভিজা কাজল লইয়া কথা দুইটিকে চিরান্ধকারে ডুবাইয়া দিয়াছে; এইরূপ অবস্থাতে বলে, আর দেখতে পাচ্ছি না, মেজকা — এই রকম আরও সব কাণ্ড।

চড়টা মারা পর্য্যন্ত মনটা খারাপ হইয়া থাকে, তাহা ভিন্ন ওর ধূর্ত্তামি দেখিয়া হাসিও পায়। মেয়েদের পড়াশুনা সম্বন্ধে আমার থিওরিটা ফিরিয়া আসে; বলি, না, তোর আর পড়াশুনা হ’ল না রাণু; স্লেটটা নিয়ে আয় দিকিন — দেগে দিই, বুলো। পিঠটায় লেগেছে বেশি? দেখি।

রাণু বুঝিতে পারে, তাহার জয় আরম্ভ হইয়াছে, এখন তাহার সব কথাই চলিবে। আমার কাঁধটা জড়াইয়া আস্তে আস্তে ডাকে, মেজকা!

উত্তর দিই, কি?

আমি, মেজকা, বড় হই নি?

তা তো খুব হয়েছ, কিন্তু কই, বড়র মতন —

বাধা দিয়া বলে, তা হলে স্লেট ছেড়ে ছোটকাকার মত কাগজপেন্সিল নিয়ে আসব? চারটে উটপেন্সিল আছে আমার। স্লেটে খোকা বড় হয়ে লিখবে ’খন। হঠাৎ শিহরিয়া উঠিয়া বলে, ও মেজকা, তোমার দুটো পাকা চুল গো! সৰ্ব্বনাশ! বেছে দিই?

বলি, দাও। আচ্ছা রাণু, এই তো বুড়ো হতে চললাম, তুইও দুদিন পরে শ্বশুরবাড়ি চললি। লেখাপড়া শিখলি নি, মরলাম কি বাঁচলাম, কি করে খোঁজ নিবি? আমায় কেউ দেখে-শোনে কি না, রেঁধে-টেধে দেয় কি না —

রানু বলে, পড়তে তো জানি মেজকা, খালি পেরথোম ভাগটাই জানি না, বড় হয়েছি কিনা। বাড়ির আর কোন্ লোকটা পেরথোম ভাগ পড়ে মেজকা, দেখাও তো!

Leave a Reply