রাণুর প্রথম ভাগ
২
বাড়িটা কয়েক দিন ধরিয়া পাড়ার কৌতুক-রহস্যের কেন্দ্র হইয়া রহিল। রাত্রে যুবতীদের রঙ্গরস, সকালে ছোট মেয়েদের দৌরাত্ম্য, এবং মধ্যাহ্নে গুলের-কোটা-হাতে ঠানদিদিদের তামাক-গুঁড়ার মতই ঝাঁঝালো রসিকতা — এসবের মধ্যে পঙ্কজিনীকে সহায়িকা হইয়া থাকিতে হইত। ফলে, প্রথম প্রথম তাহার এই নবদম্পতির উপর যে স্বাভাবিক করুণার ভাবটি ছিল, তাহাও তিরোহিত হইয়া ইহাদিগকে বিদ্রুপলাঞ্ছিত করিবার ইচ্ছাটা প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। তাই সকালবেলা স্বামীর পূজার জন্য চন্দন ঘষিবার সময় সে দুষ্টামির হাসি হাসিতে হাসিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উপদ্রবের নব নব প্রণালীতে তালিম দিতে লাগিল; রাত্রে আড়ি পাতিবার সুবিধার জন্য দুয়ার জানালা যাহাতে বাহির হইতে খোলা যায়, তাহার উপায় করিয়া রাখিতে লাগিল; এবং মধ্যাহ্নে প্রবীণরা যখন নূতন বরটিকে ঘিরিয়া আসর জমাইয়া বসিত, তখন সেও পাশ হইতে ফোড়ন দিতে লাগিল, ঠাকুর-জামাইয়ের আজকাল ওই রকমই গোলমাল হচ্ছে। নিজে পান খান না, অথচ সকালে ঠোঁটের ওপর রাঙা ছোপ লেগে থাকে; আর বিছানা থেকে উঠলে মুখে নয় একটু সিঁদুরের দাগ, নয় কোনখানে সোনার আঁচড়, সে তো রয়েছেই —
ইহার উপর কেহ বোধ হয় তাহাকেই খোঁচা দিয়া বলিত, মর্, তোর কথার ভাবে বোধ হয়, সারা সকালটা নাতজামাইয়ের চাঁদমুখটির দিকেই হাঁ করে চেয়ে বসে থাকিস।
সে উত্তর দিত, তা একটু থাকি বইকি। জানি, দুপুরবেলা দশটি রাহুতে মুখটি নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগাবে যে।
এই রকমই হইতে লাগল। মোট কথা, শান পড়িলে অস্ত্রখানিকে লইয়া কেবল যেমন চোপ বসাইতে ইচ্ছা করে, ক্রমাগত চর্চার ফলে পঙ্কজের রহস্য-বিদ্রুপের প্রয়োগ সম্বন্ধে সেই রকম একটা প্রবল ইচ্ছা দাঁড়াইয়া গেল। মাঝে পড়িয়া নাকাল হইতে লাগিল এই লাজুক বরটি।
মনটা পঙ্কজের তারল্যে ছলছল করিতে লাগিল। সে, নেহাত কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ-করা বলিয়া ননদের সহিত ঠাট্টা করিত না, কিন্তু আজকাল তাহার বিদ্রুপের দুই-একটা ঝাপটা সে বেচারীকেও বিব্রত করিতে লাগিল।
হঠাৎ যেন নিজের বয়সের ভার ছাড়িয়া পঙ্কজিনী খানিকটা হাল্কা হইয়া পড়িল।
কিন্তু স্বামী তাহার মাঝে মাঝে রসভঙ্গ করিয়া দিত। জমাট মজলিসের মধ্য হইতে তাহাকে ডাকিয়া লইয়া কথনও বলিত, নাও নাও, ঢের হয়েছে, আমার ‘বেদান্তদর্পণে’র পাতাটা যে খুঁজতে বলেছিলুম, মনে আছে?
পাতাটা চার মাস যাবৎ নিরুদ্দেশ। পঙ্কজিনী বোধ হয় বলিয়া ফেলিত, কথাটা ঠিকই মনে আছে, কিন্তু পাতাটা বাড়িতে নেই।
স্বামী গম্ভীরভাবে বলিত, আমি জানি, এই বাড়িতেই আছে; তার হাত-পা গজায় নি যে —
কিন্তু হাত-পা আছে এমন ছেলেপিলে তো ফেলে দিয়ে আসতে পারে?
যেখানে মেয়েমানুষ এমন লঘুচিত্ত, সে বাড়িতে ছেলেপিলেরা সবই করতে পারে। আমি বলি, রঙ্গরস ছেড়ে একটু খুঁজলে ভাল করতে যত সব —
একদিন মধ্যাহ্ন-বৈঠক হইতে পঙ্কজের জরুরি তলব হইল। ব্যাপার কি? — বলিয়া সে একটু বিরক্তভাবেই স্বামীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এবং বলিল, তোমার কি একটু আক্কেল নেই? ওপাড়ার ঠাকরুণদিদি কি বললেন জান?
কি?
হ্যাঁ, তোমায় আমি সেই কথা বলিগে। আক্কেল খুইয়ে যখন তখন ডাকলে তো বলবেই।
আহা, বলই না, অন্তত আমার আক্কেল বজায় রাখবার জন্যেও তো বলা উচিত।
কথাটা পঙ্কজের মনটা আলোড়িত করিতেছিল; সে ঈষৎ হাসিয়া রাগতভাবে বলিল, কেন! বললে, বরের সঙ্গে যে বড় আটা হয়েছে দেখছি! কি ঘেন্নার কথা বল দিকিন! এই বয়েসে সবার সামনে —
স্বামী কপট গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, তা বলেছেন ঠিকই, এই বয়েসে বুড়ো বরকে ছেড়ে কোথায় অন্য —
চুপ কর বলছি, আস্পদ্দা! — বড় বড় চোখ দুইটা আরও বড় করিয়া পঙ্কজিনী স্বামীকে থামাইল; তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, নাও, কেন ডাকছ বল; দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদিকে।
একজন অবধূত পদার্পণ করেছেন; মস্ত বড় —
পঙ্কজের হাসি-হাসি মুখটা মুহূর্ত্তে অন্ধকার হইয়া গেল। সে বিরক্তভাবে বলিল, তা আসুন, আমার অত ঘি-ময়দা নেই। তা ছাড়া বাড়িতে একটা জামাইয়ের খরচ আছে।
সে সংসারের খবর আমিও খুব রাখি। তা বলে সাধু-ফকির একজন দয়া করে যখন এসেছেন —
কেতাত্ত করেছেন। বল, চলে গেলে বেশি দয়া করা হবে। — বলিয়া পঙ্কজ চলিয়া যাইতেছিল; স্বামী কহিল, আরে, শোন।
না ফিরিয়া পঙ্কজ উত্তর দিল, কি? আমি শুনতে চাই না।
রাত্রে ‘হরিকথা’ কইবেন, তারও উজ্জ্বগ-টুজ্জ্বগ —
ওসব কিছু হবে-টবে না, বলে দিলুম এক কথা। পঙ্কজ উঠান ছাড়িয়া রকে উঠিল।
আর একটা কথা, শুনছ?
পঙ্কজ আবার না ফিরিয়া উত্তর করিল, না, শোনবার দরকার নেই।
তোমার গিয়ে বিনোদকেও ডেকে দাও; বাজে ফষ্টি-নষ্টি ছেড়ে একটু সদালাপ শুনবে ’খন।
তুমি একলাই শোন গিয়ে, বিনোদের ভাগ বসাবার দরকার নেই।
তখন এই তত্ত্বান্বেষী পুরুষটি নিজেই দুই পা আগাইয়া ভগ্নীপতিকে ডাকিয়া যাহাতে তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতির সুবিধা হয়, সেইজন্য সন্ন্যাসীর নিকট আনিয়া বসাইল এবং সেদিনকার মত সেই অনাধ্যাত্মিক সভাটিও উঠিয়া গেল।
মাত্র দুই-একটা উদাহরণ দেওয়া গেল, কিন্তু এই রকম রসভঙ্গ প্রায়ই ঘটিত। পঙ্কজিনী বর্ষীয়সীদের বিদ্রুপবাণে জর্জ্জরিত হইয়া স্বামীর উপর ঝাল ঝাড়িত, আচ্ছা, কেন তোমার এমন ধরন বল দিকিন? দু দণ্ড ব’সে একটি আমোদ-আহ্লাদ করে, তাতে তোমার গায়ে ফোসকা পড়ে?
স্বামী তখন একটি লেক্চার জুড়িয়া দিত, বলিত, ওই — ওইখানেই তোমাদের সঙ্গে মেলে না আমার। এখন দেখতে হবে, তোমরা যে অসার বাক্যালাপকে আমোদ বলছ, সেটা ঠিক আমোদ কি না, সেটা নির্ণয় করতে হলে আগে বুঝতে হবে, শুদ্ধ আমোদর স্বরূপটা কি? তা হলে দেখা যাক, শঙ্করাচার্য্য এ সম্পর্কে —
যাঁহারা পঙ্কজিনীকে চিনিয়াছেন, তাঁহারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন, এ বক্তৃতা কখনও শেষ হইত না। শুধু স্ত্রীলোকেই পারে, এমনভাবে মুখখানা ঘুরাইয়া লইয়া পঙ্কজ হনহন করিয়া চলিয়া যাইত, বলিত, ক্ষ্যামা দাও, ঢের বক্তিমে হয়েছে, যত সব অসৈরণ —
স্বামী স্ত্রীর আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্বন্ধে হতাশ হইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিত; বলিত, ওই তো মুশকিল, মেয়েমানুষের মন ঠিক জায়গায় আসতে আসতে আবার কেমন বিগড়ে যায়।