বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর প্রথম ভাগ

অকাল-বোধন

যেদিন যাওয়ার কথা ছিল, তাহার আগের দিন পঙ্কজের ননদ অসুখ করিয়া বসিল, সুতরাং যাত্রা স্থগিত হইয়া গেল। স্বামী চটিয়া বলিল, কেবল অনাচারে এটি হয়েছে, এর জন্যে কে দায়ী জান?

পঙ্কজ হাসিয়া বলিল, জানি বইকি। কিন্তু সে শেষ করিবার পূর্ব্বেই তাহার উত্তরটি কি হইবে আন্দাজ করিয়া তাহার স্বামী তাড়াতাড়ি বলিল, ঠাট্টা রাখ, তোমাদের জন্যেই হয়েছে এটি; রাত দুপুর পর্য্যন্ত হুডুদ্দুম করে ঘুমের ব্যাঘাত জন্মানো। আমি তখনই পইপই করে বারণ করতুম; তা গরিবের কথা বাসী না হলে তো আর —

পঙ্কজ একটু সঙ্কুচিতভাবে বলিল, হ্যাঁ, এ বয়েসে রাত জাগলে নাকি আবার অসুখ করে? — বলিয়া সলজ্জ কুটিল হাসির এমনই একটি সঙ্কেত করিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিল যে, তাহার আচারশুদ্ধ মনেও বহু পুরাতন স্মৃতির একটি অসংযত সৌরভ ক্ষণিকের জন্য জাগিয়া উঠিল; — সেই তাহারা দুইটিতে যখন অনর্থক উদ্দেশ্যহীন আলাপে কত বিনিদ্র রজনী অক্লান্তভাবে কাটাইয়া দিত, যখন গ্রীষ্মের রাত্রি উত্তাপ হারাইয়া আর শীতের রাত্রি শৈত্য হারাইয়া কোথা দিয়া যে চলিয়া যাইত — সেই সব দিনের কথা। মনে পড়ে, এক শ্রাবণের রাতে পঙ্কজ অভিমানভরে পাশ ফিরিয়া শুইয়া ছিল, হাজার মিনতিতেও কথা কয় না, ফিরে না; তারপর হঠাৎ একটা মেঘের ডাকে মুহূর্ত্তে ফিরিয়া সে তাহার বুকে ভয়ে মিশিয়া গিয়াছিল। স্বামী বধূকে বলিয়াছিল, তোমার চেয়ে বাজও কোমল, সে আমার কাতরানি শুনলে।

স্বামী কয়েক মুহূর্ত্তের জন্য নিষ্ঠা, সংযম প্রভৃতি দশবিধ সোপানের কথা ভুলিয়া অনেক দিন পরে স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া যৌবনের সেই বিহ্বল হাসি একটু হাসিল, এবং এই ভাবের আমেজে আর একটা কি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ করিবার জন্য মুখটা বাড়াইয়া হঠাৎ নিজেকে সামলাইয়া লইল ও হাসিয়া বলিল, দিন দিন ব’য়ে যাচ্ছ তুমি।

স্ত্রীও শুধু একটু হাসিল, তাহার পর বলিল, ঠাকুরঝিকে তো আর কয়েক দিন পাঠানো যাবে না, কিন্তু ঠাকুরজামাই আর থাকতে চান না যে!

ও বোধ হয় ভাবছে, শ্বশুরবাড়িতে আর কত দিন কাটাব, তা আমি বুঝিয়ে বলব ’খন। কাছেপিঠে নয় তো যে, আবার দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবে।

প্রতিদিনই উপশম হইবার আশা দিয়া অসুখটা দশ-বারো দিন পর্য্যন্ত বিস্তার করিল এবং তাহার পর রোগিণীটিকে এমনই নিস্তেজ করিয়া দিয়া গেল যে, তাহার আর উঠিয়া চলাফেরা করিবার সামর্থ্য রহিল না। দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, যেন প্রাণটি নেহাত নিরাশভাবেই এই শুষ্ক দেহের অবলম্বন ধরিয়া দুলিতেছে।

লাজুক বরটি বড় মুশকিলে পড়িয়া গেল। শ্বশুরবাড়িতে আর অধিক দিন থাকাও যায় না, অথচ নূতন বালিকা-বধূটির জন্যও প্রাণটি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িল। বাড়িতে গিয়া পাঁচ-সাত দিন অন্তর শ্যালকের এক-আধখানা চিঠির উপর ভরসা করিয়া সে যে কি করিয়া থাকিবে, তাহা ভাবিয়া পাইল না। এই তো এইখানেই দিনের মধ্যে কতবার করিয়া খবর পাইতেছে এবং কাছে বসিবার সুযোগও বউদিদি যথেষ্ট করিয়া দিতেছেন, কিন্তু তাহাতেও তো উৎকণ্ঠার অন্ত নাই, চোখের আড়াল হইলে আর প্রাণে সোয়াস্তি নাই।

এ অবস্থায় যখন শ্যালক আসিয়া হিন্দুদের বৈবাহিক আচার-ব্যবহার, স্ত্রী-পুরুষের শাস্ত্রসঙ্গত প্রকৃত সম্বন্ধ, এবং অন্যান্যের প্রতি শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট কর্ত্তব্য প্রভৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করিয়া একটি সারবান উপদেশ দিয়া বলিল, তাহার থাকাটা একান্ত প্রয়োজন, এবং পাড়ার প্রবীণদের দ্বারাও যখন সেই কথাই বলাইল, এবং তাহার উপর আবার যাইবার কথা তুলিতে শ্যালকজায়া যখন তাচ্ছিল্যভরে হাসিয়া জানিতে চাহিল, বউয়ের অসুখে মাথা-খারাপ হইয়া গিয়াছে কি না, তখন বেচারা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। ইহার পরে যাহা সামান্য একটু দ্বিধা ছিল, তাহা নিঃশেষ হইয়া গেল বধূটি যখন বড়ই অভিমান ভরে ঠোঁট দুইটি কাঁপাইয়া বলিল, তা যাবে বইকি। আমি আর তোমার কে?

এ কথার পরেও কে চলিয়া যাইতে পারে, জানি না। কিন্তু সে থাকিয়া গেল। বাড়িতে লিখিয়া দিল, তাহার নিজের শরীর খারাপ, কিছুদিন যাওয়া চলিবে না, তবে ভাবিবার কিছুই নাই। নববধূটির মায়ায় আটকাইয়া রহিল। সত্য কথাটুকু লিখিতে যেন কেমন কেমন বোধ হইতেছিল। এখানে বউদিদিকে বলিয়া দিল, বাড়িতে আর চিঠি দেওয়ার দরকার নেই, আমি সব কথা লিখে দিয়েছি। এবং বধূকে বলিল, সেখানে গিয়ে যেন সব কথা ফাঁস করে দিও না, বড় লজ্জায় পড়তে হবে তা হলে।

বধূটি ছোট্ট মাথাটি দুলাইয়া বলিল, তা বলে তোমার অসুখ করেছিল, এমন অলুক্ষুণে মিছে কথা বলতে পারব না।

ইহাতে নবপরিণীত যুবকটি একটা অপরিসীম তৃপ্তি অনুভব করিল এবং বধূর মুখের কাছে মুখটি লইয়া গিয়া আবেগভরে কহিল, মিছে কথা আর কি? মনের অসুখ কি অসুখ নয় শৈল? আমি যে কি অসুখে রয়েছি, কি বুঝবে তুমি? এর চেয়ে তুচ্ছ শরীরের অসুখ যে — ইত্যাদি অনেক কথা, যাহা না লিখিলেও স্ত্রী-পুরুষ সকলেই আন্দাজ করিয়া লইতে পারেন।

মোদ্দা কথাটা হইতেছে, সে মাসখানেক থাকিয়া গেল। কলেজের পার্সেণ্টেজের কথা হিসাব করিল বটে, কিন্তু পার্সেণ্টেজের জন্য যেমন এ পর্য্যন্ত কোন ছাত্রেরই জীবনের প্রিয়তম কাজটিতে বাধা পড়ে নাই, সেইরূপ তাহারও পড়িল না। সে মনে মনে এই সুদীর্ঘ মানবজীবনের যৌবনের অচিরস্থায়ী দিনগুলার পার্সেণ্টেজ এবং তাহারও মধ্যে আবার পরিণয়ের এই স্বপ্নবিষ্ট দিনগুলার পার্সেণ্টেজ কষিয়া ফেলিল। ফলে যতদিন পর্য্যন্ত না বধূটি আরোগ্যলাভ করিয়া সক্ষম হইয়া উঠিল, সে আর তাহার কাছ-ছাড়া হইল না।

যখন বন্ধুকে নিজের মুখে কহিতে শুনিল যে, আর তার বিশেষ কোন কষ্ট নাই, তখন শ্যালকজায়ার নিকট আরক্তি পেশ করিল, বউদি, এবার যেতে হচ্ছে — একটা দিন-টিন —

পঙ্কজ গাল দুইটি ভার করিয়া বলিল, তা কি দিয়ে আর কে রাখব ভাই? রোকবার যা, তা তো সঙ্গে চলল। কিন্তু এখনও বড্ড কাহিল নয়?

না, আর তেমন কাহিল কি? শরীর তো বেশ সেরে উঠেছে।

পঙ্কজ চাপা হাসির সহিত হঠাং ঘাড়টা কাত করিয়া গালে তর্জ্জনীটা টিপিয়া বলিল, ওমা, তাও তো বটে, আজকাল ঠাকুরঝির শরীরের কথা আর আমরা কি জানব?

বেচারা বরটি লজ্জিত হইয়া পড়িল। হাসিয়া বলিল, এইজন্যেই আপনার কাছে বলতে সাহস হয় না বউদি; কিন্তু ঠাট্টা রেখে দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে একটা দিন-টিন দেখুন। আর তাও বলি, দাদার শরীরটা বাইরে পড়ে থেকে থেকে খারাপ হয়ে গেছে; ওটা তো আর ঠাকুরঝির শরীর নয় যে, পরেই ভাল তদারক করবে।

যে বিদ্রুপ অন্তরের কথাটির সহিত মিলিয়া যায়, তাহার আর ভাল জবাব যোগায় না। সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত পঙ্কজ শুধু বলিল, এই যে মুখ ফুটেছে! — বলিয়া সে তাড়াতাড়ি সে স্থান পরিত্যাগ করিতে যাইতেছিল, এমন সময় ‘বেদান্তদর্পণে’র সে পাতাটা পাওয়া গিয়াছে কি না — প্রশ্ন করিয়া স্বামীটি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

দশ বৎসরের বালকের মা পঙ্কজ নিজেকে সামলাইয়া লইতে পারিল না। নন্দাইয়ের এই ঠাট্টাটুকুর পরেই স্বামীকে সামনে পাইয়া নূতন বধূটির মতই শরমে রাঙা হইয়া ত্বরিতপদে ঘরের ভিতর আশ্রয় লইল।

ননদটি আজ চলিয়া গিয়াছে।

পঙ্কজের মনটা সমস্ত দিন বড় ছোট হইয়া আছে। ছোট কন্যার এত মানুষ-করা ছেলেমানুষ ননদটি বুকের মাঝখানটায় এমন খানিকটা শূন্যতা সৃজন করিয়া গিয়াছে যে, সেটা আর কিছু দিয়াই পূর্ণ করা যায় না। কেবলই মনে হইতেছে, আহা, এটি ও বড় ভালবাসিত আহা, বড় ছেলেমানুষ; আহা, কিছু শেখে নাই সে।

বাড়িটিও দুইদিন হাস্যকলরবে অধিকতর পূর্ণ হইয়া হঠাৎ যেন নির্বাণশিখা প্রদীপটির মত মলিন হইয়া গিয়াছে। নূতন-পরিচিত যুবকটি — যে কৌতুক-আলাপের মধ্য দিয়া ছোট ননদিনীর পার্শ্বে তাহার হৃদয়ে একটি স্থান অধিকার করিয়া লইয়াছে, তাহার কথাও বড় বেশি মনে হইতে লাগিল। তাহাকে লইয়া কখন কি অত্যাচারটি করা হইত, প্রবহমান দিনটির প্রহরে প্রহরে মনে পড়িয়া মনটাকে আকুল করিতে লাগিল। বিকালবেলায় সে আর বাড়ি থাকিতে পারিল না। প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়া বিগত কুড়ি-পঁচিশ দিনের খুঁটিনাটি সব আলোচনা করিয়া ভারী মনে কাটাইয়া দিল।

স্বামী বাড়ি ছিল না, নূতন রাস্তা, তাহাতে আবার রেলে কয়েকটি বদলি আছে, সে ভগ্নীপতিকে খানিকটা আগাইয়া দিতে গিয়াছে। কাল সন্ধ্যার পূর্ব্বে ফিরিবে না। চাকরটা পর্য্যন্ত সঙ্গে গিয়াছে।

পঙ্কজ সকাল সকাল ছেলেমেয়েদের আহার করাইয়া শুইয়া রহিল, সেদিন নিজের ঘরে গিয়া শুইতে ইচ্ছা হইল না। শুইয়া ননদ-নন্দাইয়ের চিন্তার পাশে অলক্ষিতে আর একজনের যে চিন্তাটা আসিয়া উদয় হইল, সেটা স্বামীর — বড় অগোছালো বেহিসাবী মানুষ, ঘর ছাড়িয়া খুব কমই বাহিরে যায়।

পরদিন নূতন করিয়া ঘরদোর গুছাইতে, পুরানো রাস্তায় চালাইবার পূৰ্ব্বে একবার সংসারটাকে দেখিয়া লইতে কাটিয়া গেল। সকলের মধ্যেই যেন পঙ্কজের মনে হইতে লাগিল, স্বামীর জন্য এতদিন যথেষ্ট করা হয় নাই। আজ যে হঠাৎ এত দরদ কোথা হইতে উদয় হইল, সে বুঝিতে পারিল না, বুঝিবার চেষ্টাও করিল না। শুধু যেখানে যেখানে পারিল, স্বামীর জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করিয়া নূতন বন্দোবস্তটা যতদূর পারিল নিবন্ধ, করিয়া দাঁড় করাইল, এমন কি ঘরদুয়ার গুছাইতে গুছাইতে ননদ-নন্দাইয়ের কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার ইহাও মনে হইতে লাগিল, আহা, এই তালে যদি ওর সেই বইয়ের পাতা পেয়ে যেতুম; কতবার যে বলছে, গা করা হয় নি!

কবে দুইটা রূঢ় কথা বলিয়াছে, কবে একটা আবেদন-অনুরোধ হেলায় অগ্রাহ্য করিয়াছে, নন্দাই থাকিবার সময় আমোদ-প্রমোদে বাধা পাইয়া কবে একটু অবহেলা বিরক্তি দশাইয়াছে, সমস্ত আজ তাহার মনের মেঘে এপার ওপার করিয়া এক-একটা বেদনার বিজলিরেখা টানিয়া দিতে লাগিল। সন্ধ্যার সময় স্বামী আসিবে; কত দিনের বিরহিণীর মত পঙ্কজ সূক্ষ্ম যত্নের সহিত অভ্যর্থনার আয়োজন করিয়া রাখিতে লাগিল। ঝকঝকে করিয়া মাজা গাডুটা টাটকা জলে পূর্ণ করিয়া পাট-করা গামছায় ঢাকা দিয়া পা-ধোয়ার জায়গায় রাখিয়া দিল। আলনায় আহ্নিক করিবার গরদের কাপড়টি এবং তাহার পর পরিবার খান-কাপড়টি মিহি করিয়া কোঁচাইয়া টাঙাইয়া রাখিল। যখন যেটি দরকার, হাতের কাছে করিয়া গুছাইয়া রাখিল। বহুদিনের অনাদৃত স্বামীর আদরের পাত্রী মেজো মেয়েটিকে পর্য্যন্ত ফিটফাট করিয়া ধুইয়া মুছিয়া সাজাইয়া রাখিল। সন্তানের মুখে বক্ষের স্তন্য উজাড় করিয়া দিয়াও প্রসূতির যেমন অতৃপ্তি থাকিয়া যায়, সেইরূপ তাহারও যেন হাজার করিয়াও আশ মিটিতেছিল না।

তাহার পর সে বিছানা রচনা করিবার জন্য খাটের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হঠাৎ শরীরে কিসের যে একটা প্রবাহ খেলিয়া গেল, পঙ্কজের সমস্ত শরীরটা রোমাঞ্চে শিহরিয়া উঠিল। নবদম্পতির সদ্যত্যক্ত গৃহে বিলাসের মোহ এখনও লিপ্ত হইয়া আছে। ফুলের ও এসেন্সের মশ্রিত মৃদু গন্ধে ঘরটি আমোদিত। শয্যার মাথার দিকের এক কোণে একটা গন্ধ তীব্র হইয়া উঠিতেছিল, কুতুহলী হইয়া চাদরের কোণটা উঠাইয়া সে দেখিল, একটি বকুলের মালা সন্তর্পণে কুণ্ডলী করিয়া রাখা। পঙ্কজ একটু হাসিয়া সেটা বাহির করিয়া লইল। তাহার পর অন্য দিকে চাহিয়া অন্যমনস্কভাবে মালাটা দুই হস্তের অঙ্গুলির মধ্যে জড়াইয়া খুলিয়া আংটির মত পরিয়া, আবার মণিবন্ধে বলয়ের মত পরিয়া খেলা করিতে লাগিল।

আজ যৌবনের সায়াহ্নে পঙ্কজের প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়িয়া গেল। এই সেই গৃহ — এই রকম গন্ধেরও রেশ মাথার মধ্যে যেন নাইয়া উঠিতেছে — তাহাদেরও ঘর আলো করিয়া নিশ্চয়ই এমনই ফোটা ফুলের মেলা তখন বসিত, আর তাহার পায়ের কাঁচা আলতাও কি এমনই করিয়া যেখান সেখান রাঙাইয়া দিত না? দিত নিশ্চয়, কিন্তু কই, তখন তো সে এত কথা বুঝে নাই! জীবনে তখন যে বসন্ত আসিয়াছিল, তাহার অভ্যর্থনার কলগীতি তো তেমন করিয়া গাওয়া হয় নাই! স্বামী কতটুকু কদর করিয়াছিল, কে জানে — এখন ভাল করিয়া মনে পড়ে না। আর এই তো ভোলানাথ স্বামী — এর কাছে নিজেই যখন নিজের যৌবন-সম্পদকে ভাল করিয়া পরিচিত করিয়া দিতে পারে নাই, তখন কি আর যথা প্রাপ্যটুকু পাওয়া গিয়াছিল!

আজিকার গৃহিণী পঙ্কজিনী সেদিনকার পনরো বৎসরের বধূ পঙ্কজিনীকে সখীর মত বক্ষের মধ্যে চাপিয়া ধরিল। অন্তর তাহার ব্যর্থতার বেদনায় মথিত হইয়া উঠিল। তাহার পর ধীরে ধীরে একটা কথা, যাহা এতক্ষণ বাষ্পাকারে মনের মধ্যে ভাসিয়া বেড়াইতেছিল, স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বাম হস্তে জড়ানো বকুলের মালাটা দক্ষিণ হস্তে আবেগভরে চাপিয়া ধরিয়া বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া পঙ্কজ ভাবিল, এখনও কি সে ভুল শোধরানো যায় না? একদিনের জন্যও নয় — এক মুহূর্ত্তের — ?

এবার একটু সামলাইয়া লইয়া ভাবিল, কেন হইল এমনটা? তাহার একটা সুস্পষ্ট উত্তর খুঁজিয়া পাইল না বটে; তবে বিগত সমস্ত মাসটা ব্যাপিয়া ননদ-নন্দাই, পাড়াপড়শী আর সখীবৃন্দ লইয়া যে হাস্যকলরবে কাটানো গিয়াছে, তাহারই স্মৃতি মনের মধ্যে স্বপ্নের আমেজে জাগিয়া উঠিল; আর তাহার পর এটা অন্তত বেশ বুঝিতে পারিল যে, মনটা পূর্ব্ব হইতেই শিথিল হইয়া পড়ুক আর নাই পড়ুক, আজ এই শূন্য গৃহের মধুময় স্মৃতি তাহাকে পূর্ণভাবেই অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে — আজ আর তাহার আকাঙ্ক্ষার উপর সংযম নাই, তা সে হাজারই বিসদৃশ হউক না কেন।

পঙ্কজিনী গিয়া আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইল। প্রথমটা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখিয়াই বালিকাটির মতই লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। তবে এ ভাবটা রহিল না। ক্রমে সে যত্ন করিয়া কবরী বাঁধিল; মুখটি ভাল করিয়া মুছিয়া কপালে একটি খয়েরের টিপ পরিল; তুলিয়া-রাখা কানের দুলজোড়া বাহির করিয়া কানে দুলাইয়া মাথার কাপড়ে ঢাকিয়া রাখিল; পায়ে আলতা দিল; অধরৌষ্ঠও রঞ্জিত করিতে যাইতেছিল, কিন্তু কি ভাবিয়া আর করিল না। আয়নায় নিজের ছায়াটিকে চোখ রাঙাইয়া বলিল, মরণ আর কি, বড় বাড় যে! — তাহার পর সীমন্তে মিহি করিয়া সিন্দূরের রেখা টানিয়া দিয়া সুন্দর মুখখানিকে হেলাইয়া দুলাইয়া আরশিতে নিজেকে একটু ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। একটা ভাল কাপড় পরিবার ইচ্ছাও হইল; কিন্তু পুত্রকন্যাদেবরের মধ্যে নিতান্ত বাধ-বাধ ঠেকিতে লাগিল। তবে একখানি ভাল কাপড় ট্রাঙ্ক হইতে বাহির করিয়া আলনায় স্বামীর পিরানের নীচে লুকাইয়া রাখিল — সময় বুঝিয়া পরিবে। তাহার পরে বহুদিনের ছাড়া শয্যাটি প্রাণের সমস্ত দরদ দিয়া রচনা করিয়া, তাহার এই সমস্ত আয়োজনের দেবতার জন্য অন্তরের কাতর প্রতীক্ষা লইয়া সংসারের কাজে আনমনা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

এদিকে তাহার দেবতাটি যখন বহুদূর পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়া ছোট ভগ্নীটিকে বিদায় দিল, তখন তাহার শান্ত সমাহিত চিত্তে মায়ার একটা তীব্র আঘাত লাগিল। ইহার আগে যে মুখ সে কখনও অশ্রুসিক্ত হইতে দেখে নাই, অশ্রুজলে-ভরা বিদায়কালীন সেই ছোট মুখটি তাহার মনে বিষাদের একটা মৌন ছবি আঁকিয়া দিল, যাহা সে শাস্ত্রের কোন বচন দিয়াই মুছিয়া ফেলিতে পারিল না। ইহাতে অন্য কোন অবোধ মানবকে বোধ হয় সংসারের আপন জনগুলির কাছে নিবিড়তর করিয়া টানিয়া আনিত; কিন্তু এই সতর্ক মুক্তিকামীকে আরও স্বতন্ত্র করিয়া আরও দূরে সরাইয়া দিল। সে ভাবিল, ইহা কিছুই নয়, ‘তাঁহার’ একটা পরীক্ষা মাত্র। যে ভববন্ধন হইতে ত্ৰাণ পাইতে চাহে, তাহাকে এই অগ্নিপরীক্ষায় উতরাইয়া যাইতেই হইবে, নহিলে সমস্ত সাধনাই পণ্ড।

সেইজন্য শাস্ত্রও যখন এই মিথ্যা অবিদ্যাজাত মায়ার নিকট পরাস্ত হইল, সে স্থির করিল, একেবারে বাড়ি না গিয়া রাস্তায় দুই-এক দিবস শুরুগৃহে থাকিয়া বিক্ষিপ্ত মনটা সুস্থির করিয়া লইবে। আর অনেক দিন গুরুদেবের চরণদর্শনও ঘটে নাই; যখন এতটা আসাই গিয়াছে, তখন এই সুবিধাটুকু ছাড়াও উচিত নয়। তাই ফিরিবার পথে সে আর বাড়ি পর্য্যন্ত নিজের টিকিট করিল না। শুধু চাকরটাকে পাঠাইয়া দিল, আর বলিয়া দিল, বলে দিস, যদি গুরুদেবের সঙ্গে আবার গঙ্গাস্নানটা সেরে আসবার ঝোঁক হয় তো চাই কি আরও দুই-এক দিন দেরি হয়ে যেতে পারে। আর দেখিস, মেয়েটাকে যেন না বেশি বকে-টকে।

পঙ্কজ সমস্ত আয়োজন নিখুঁত করিয়া শেষ করিল; সকাল সকাল সংসারের কাজকর্ম্ম সারিয়া লইল এবং আর সকলের আহারাদি পর্য্যন্ত মিটাইয়া, ছোট-সেই দুরন্ত ছেলেটিকে বুকে চাপিয়া আবেশ-শিথিল চরণে শয়নগৃহে প্রবেশ করিল।

এই সময় দেবর আসিয়া খবর দিল, দাদা আজ আর এলেন না বউদি, দুখীরাম একলা ফিরে এসেছে।

পঙ্কজ শূন্য দৃষ্টিতে দেবরের দিকে চাহিয়া রহিল, কোন কথাই কহিতে পারিল না! দুখীরাম নিজেই আসিয়া বলিল, হ্যাঁ, তেনার মনটা বড় খারাপ দেখলাম বউমা, বোধ হয় গুটঠাকুরের সঙ্গে তিত্থিটিত্থি সেরে আসবেন পাঁচ-সাত দিন পরে, গুটঠাকুরও বোধ হয় পায়েব ধুলো দেবেন একবার।

Leave a Reply