রাখাল ছেলে

সূর্য যখন লাল টুকটুকে হয়ে দেখা দেয় ভোরবেলায়, রাখাল ছেলে তখন গরু নিয়ে যায় মাঠে। আর সাঁঝের বেলায় যখন সূর্য ডুবে যায় বনের পিছনে, তখন তাকে দেখ যায় ফেরার পথে। একই পথে তার নিত্য যাওয়া-আসা। বনের পথ দিয়ে সে যায় নদীর ধারের সবুজ মাঠে। গরুগুলো সেখানেই চ’রে বেড়ায়। আর সে বসে থাকে গাছের ছায়ায় বাঁশিটি হাতে নিয়ে, চুপ করে চেয়ে থাকে নদীর দিকে, আপন মনে ঢেউ গুনতে গুনতে কখন যে বাঁশিটি তুলে নিয়ে তাতে ফুঁ দেয়। আর সেই সুর শুনে নদীর ঢেউ নাচতে থাকে, গাছের পাতা দুলতে থাকে আর পাখিরা কিচির-মিচির করে তাদের আনন্দ জানায়!

একদিন দোয়েল পাখি তাকে ডেকে বলে:

গান

ও ভাই, রাখাল ছেলে!

এমন সুরের সোনা বলো কোথায় পেলে।

আমি যে রোজ সাঁঝ-সকালে,

বসে থাকি গাছের ডালে,

তোমার বাঁশির সুরেতে প্রাণ দিই ঢেলে॥

তোমার বাঁশির সুর যেন গো নির্ঝরিণী

তাই শোনে রোজ পিছন হতে বনহরিণী।

চুপি চুপি আড়াল থেকে

সে যায় গো তোমায় দেখে

অবাক হয়ে দেখে তোমায় নয়ন মেলে॥

রাখাল ছেলে অবাক হয়ে দেখে সত্যিই এক দুষ্ট হরিণী লতাগুল্মের আড়াল থেকে মুখ বার করে অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। সে তাকে বললে:

ওগো বনের হরিণী!

তুমি রইলে কেন দূরে দূরে,

বিভোর হয়ে বাঁশির সুরে,

আমি তো কাছে এসে বসতে তোমায়

নিষেধ করি নি।

হরিণীর ভয় ভেঙে গেল, সে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এল রাখাল ছেলের কাছে। সে তার পাশটিতে এসে চোখে চোখ মিলিয়ে শুনতে লাগল তার বাঁশি। অবোধ বনের পশু মুগ্ধ হল বাঁশির তানে। তারপর প্রতিদিন সে এসে বাঁশি শুনত, যতক্ষণ না তার রেশটুকু মিলিয়ে যেত বনান্তরে।

হরিণীর মা-র কিন্তু পছন্দ হল না তার মেয়ের এই বাঁশি-শোনা। তাই সে মেয়েকে বলল :

ও আমার দুষ্টু মেয়ে,

রোজ সকালে নদীর ধারে যাস কেন ধেয়ে।

ভুল ক’রে আর যাস্‌নেরে তুই শুনতে বাঁশি

ওরা সব দুষ্টু মানুষ মন ভুলাবে মিষ্টি হাসি

বুঝি বা ফাঁদ পেতেছে ওরা তোকে একলা পেয়ে॥

তখন হরিণী তার মা-কে বুঝোয় :

না গো মা, ভয় ক’রো না

সে তো মানুষ নয়।

সে যে গো রাখাল ছেলে,

আমি তার কাছে গেলে

বড্ড খুশি হয়॥

এমনি করে সুরের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে হরিণী। রাখাল ছেলে হরিণীকে শোনায় বাঁশি, আর হরিণে রাখাল ছেলেকে শোনায় গান:

তোমার বাঁশির সুর যেন গো

নদীর জলের ঢেউয়ের ধ্বনি,

পাতায় পাতায় কাঁপন জাগায়

মাতায় বনের দিনরজনী।

সকাল হলে যখন হেথায় আস

বাঁশির সুরে সুরে আমায় গভীর ভালবাস—

মনের পাখায় উড়ে আমি

স্বপনপুরে যাই তখনি॥

কিন্তু হরিণীর নিত্যি স্বপনপুরে যাওয়া আর হল না। একদিন এক শিকারী এল সেই বনে। দূর থেকে সে অবাক হয়ে দেখল একটু রাখাল ছেলে বিহ্বল হয়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে আর একটি বন্য হরিণী তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। কিন্তু শিকারীর মন ভিজল না সেই স্বর্গীয় দৃশ্যে, সে এই সুযোগের অপব্যয় না করে বধ করল হরিণীকে। মৃত্যুপথযাত্রী হরিণী তখন রাখাল ছেলেকে বললে—বাঁশিতে মুগ্ধ হয়ে তোমাদের আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সেই তুমি, বোধহয় মানুষ বলেই, আমার মৃত্যুর কারণ হলে। তবু তোমায় মিনতি করছি :

বাঁশি তোমার বাজাও বন্ধু

অমার মরণকালে,

মরণ আমার আসুক আজি

বাঁশির তালে তালে।

যতক্ষণ মোর রয়েছে প্রাণ

শোনাও তোমার বাঁশরির তান

বাঁশির তরে মরণ আমার

ছিল মন্দ-ভালে।

বনের হরিণ আমি যে গো

কারুর সাড়া পেলে,

নিমেষে উধাও হতাম

সকল বাধা ঠেলে।

সেই আমি বাঁশরির তানে

কিছুই শুনিনি কানে

তাই তো আমি জড়ালেম এই

কঠিন মরণ-জালে॥

বাঁশি শুনতে শুনতে ধীরে ধীরে হরিণীর মৃত্যু হল। সাথীকে হারিয়ে রাখাল ছেলে অসীম দুঃখ পেল। সে তখন কেঁদে বললে :

বিদায় দাও গো বনের পাখি!

বিদায় নদীর ধার,

সাথীকে হারিয়ে আমার

বাঁচা হল ভার।

আর কখনো হেথায় আসি

বাজাব না এমন বাঁশি

আবার আমার বাঁশি শুনে

মরণ হবে কার।

বনের পাখি, নদীর ধার সবাই তাকে মিনতি করলে—তুমি যেও না।

যেও না গো রাখাল ছেলে

আমাদেরকে ছেড়ে,

তুমি গেলে বনের হাসি

মরণ নেবে কেড়ে,

হরিণীর মরণের তরে

কে কোথা আর বিলাপ করে

ক্ষণিকের এই ব্যথা তোমার

আপনি যাবে সরে।

দূর থেকে শুধু রাখাল ছেলে বলে গেল :

ডেকো না গো তোমরা আমায়

চলে যাবার বেলা,

রাখাল ছেলে খেলবে না আর

মরণ-বাঁশির খেলা॥