بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد الله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد المرسلين، والعاقبة للمتقين، اما بعد!
কোরআ’ন অবতীর্ণের পূর্বে আরবের সামাজিক অবস্থা, সামাজিকতা, চারিত্রিক, রাজনৈতিক, সর্বদিক থেকে অন্ধকার এবং বর্বরতার অতলতলে নিমজ্জিত ছিল। সর্বত্র শিরক, মূর্তিপুজার সয়লাভ ছিল, মানুষ একে অপরের রক্ত পিপাসু এবং একে অপরের সম্পদ ও সম্মান লুণ্ঠনে ব্যস্ত ছিল, প্রতিশোধের বদলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ চলত, কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত প্রথিতকরণ সাধারণ বিষয় ছিল। অসংখ্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করাকে গৌরবের বিষয় মনে করা হত। মদপান, জুয়া, ব্যভিচার তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। উলঙ্গপনার অবস্থা ছিল এই যে, নারী ও পুরুষরা উলঙ্গ হয়ে বাইতুল্লাহ (কাবা ঘরের) ত্বাওয়াফ করাকে সওয়াবের কাজ বলে মনে করত। গরীব, মিসকীন, বিধবা, ইয়াতীমদের দেখার মত কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় যখন কোরআ’ন অবতীর্ণ হল তখন মাত্র কয়েক বছরের অল্প সময়ে কোরআ’নের শিক্ষা আশ্চর্যজনক ভাবে আরবদের এদৃশ্য পট পরিবর্তন করে দিল, মাওলানা আলতাফ হোসাইন হালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
ঐটা কি বিজলীর গর্জন না মহান পথ প্রদর্শকের আওয়াজ ছিল
যা আরব ভূমিকে পরিপূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
যে সমস্ত লোকেরা নিজের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রথিতকরণকে সাধারণ কিছু বলে মনে করত, স্বয়ং তারা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাদের অপরাধ স্বীকার করে তাদের কৃতকর্মের জন্য নয়নাশ্রু ঝরাচ্ছিল, এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে আবেদন করল হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার এক মেয়ে ছিল যে আমার নিকট অত্যন্ত আদরের ছিল, আমি তাকে ডাকলে সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমার নিকট আসত, একদিন আমি তাকে ডাকলাম এবং সাথে নিয়ে চললাম, পথিমধ্যে একটি কুয়া পেয়ে আমি তাকে সেখানে নিক্ষেপ করলাম, তার সর্বশেষ আওয়াজ আমার কানে আসছিল আর সে বলতে ছিল ‘ও আব্বা ও আব্বা’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) নয়নাশ্রু ঝরাতে লাগলেন, লোকেরা ঐ ব্যক্তিকে কথা বলতে নিষেধ করতে চাইল, তিনি বললেন: তাকে বাধা দিওনা, যে বিষয় সম্পর্কে তার জানার যথেষ্ট অনুভুতি আছে, তাকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে দাও। ঘটনা শোনার পর তিনি বললেন: জাহেলিয়াতের যুগে যা কিছু হয়েছে ইসলাম গ্রহণ করার ফলে আল্লাহ্ তা ক্ষমা করে দিয়েছেন, এখন নুতন করে জীবন যাপন শুরু কর। (দারেমী)।
ঐ ব্যক্তি যে ধন-সম্পদের জন্য ডাকাতি করত, লুটপাট করত, কোরআ’নের শিক্ষা তাকে পৃথিবীর ধন-সম্পদের লোভ থেকে এত অনাগ্রহী করেছে যে, ধন-সম্পদের চেয়ে তুচ্ছ আর কোনকিছু তার কাছে ছিল না! একদা ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার ঘরে আসল, চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ছিল, স্ত্রী এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে বলল: আমার নিকট কিছু সম্পদ জমা হয়ে গেছে এজন্য আমি চিন্তা করছি, স্ত্রী বলল: তাতে চিন্তিত হওয়ার কি আছে? স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে লোকদেরকে ডেকে আনল এবং ত্বালহা তার জমাকৃত সম্পদ চার লক্ষ দিরহাম লোকদের মাঝে বণ্টন করে দিল। (ত্বাবারানী)।
ঐ সমস্ত লোক যারা দিন-রাত মদ, পানির মত ব্যবহার করত তারা মদ হারাম হওয়ার বিধান অবতীর্ণ হলে (সূরা মায়েদা-৯০) এমনভাবে মদ পরিহার করল যেন মদের ব্যাপারে তাদের কোন ধারণাই ছিল না।
বুরাইদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর পিতা বলেন: “আমরা একটি টিলার উপর বসে মদ পান করছিলাম, ওখান থেকে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হলাম, তখন মদ হারাম হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হল, আমি দ্রুত ফিরে এসে আমার সাথীদেরকে আয়াতটি শোনালাম, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মদ পান করা শেষ করেছিল আবার কেউ পেয়ালা মুখে লাগিয়ে মদ পান করছিল, কেউ হাতে পেয়ালা ধরে ছিল, আমার আওয়াজ শোনামাত্র সবাই মদের পেয়ালা মাটিতে ঢেলে দিল, আর যখন আমি আয়াতের শেষ অংশ অর্থাৎ—
অর্থ: “তোমরা কি মদ পান করা থেকে বিরত থাকবে?” সবাই সমস্বরে বলে উঠল:
অর্থ: হে আমাদের রব আমরা বিরত থাকলাম। (ইবনু কাসীর)
ঐ সমাজ যেখানে উলঙ্গপনা এবং বেহায়াপনার সয়লাভ চলছিল, একজন নারীকে দশ দশজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখা বৈধ বিয়ের মর্যাদা ছিল, সেখানে কোরআ’নের শিক্ষা নারীদের মধ্যে এত লজ্জাবোধের অনুভুতি সৃষ্টি করতে পেরেছিল যে, যখন কোরআ’নে পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হল তখন যে সমস্ত নারীদের কাছে পর্দা করার মত কাপড় ছিল না তারা তাদের পরিধানের কাপড় ছিড়ে উড়না বানিয়েছিল।
আয়শা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেন ঐ সমস্ত নারীদের প্রতি যারা—
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ
অর্থ: “এবং তারা যেন তাদের মাথার উড়না তাদের বক্ষদেশে ফেলে রাখে।” (সূরা নূর-৩১)—
এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়া মাত্রই তারা তাদের পরিধানের বস্ত্র ছিড়ে তা দিয়ে উড়না বানিয়েছিল। (বোখারী)
কোরআ’ন মাজীদ বান্দাদেরকে তাদের রবের সাথে এত গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে তুলেছে যে, তার সামনে পৃথিবীর বড় বড় নে’মতসমূহও সাধারণ এবং মূল্যহীন মনে হয়েছে।
আবু ত্বলহা নিজের আঙ্গুর এবং খেজুরের সুন্দর সাজানো ঘন সবুজ বাগানে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিল, নামাযরত অবস্থায় মন আল্লাহর দিক থেকে ফিরে বাগানের দিকে চলে আসল এবং সে ভুলে গেল যে কত রাকাত নামায আদায় করেছে, আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতটুকু বাধা হওয়ার রাগে নামায শেষ করেই রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) নিকট আসল এবং আবেদন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ এ বাগান আমাকে নামাযের সময় আল্লাহর দিক থেকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছে, তাই আমি তা দান করে দিলাম তা আপনি যেখানে খুশী সেখানে ব্যবহার করুন।
ঐ সমাজ যেখানে মানুষের মধ্যে পরকালের জওয়াবদিহিতা এবং আল্লাহর ভয় থেকে পরিপূর্ণরূপে গাফেল করে দিয়েছিল, তাদেরকে সর্বপ্রকার পাপকাজে নিমজ্জিত করে দিয়েছিল, কোরআ’নের শিক্ষা তাদের অন্তরে পরকালের এতটা ভয় সৃষ্টি করেছিল যে, তারা প্রতি মুহূর্তে পরকালকেই অগ্রাধিকার দিত। মায়েয বিন মালেক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজে স্বীকার করল যে, সে পাপে লিপ্ত হয়েছে এবং তাকে ঐ পাপ থেকে মুক্ত করা হোক। তিনি মায়েয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তার পাপের কথা স্বীকার করা সত্বেও কিছু প্রশ্ন করে তাকে তার অবস্থান থেকে হটাতে চাইলেন, কিন্তু মায়েয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নাছোড়বান্দার ন্যায় বলতে লাগল যে, আমাকে এ পাপ থেকে মুক্ত করুন। তাই তিনি রায় দিলেন এবং মায়েয (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে পাথর মেরে হত্যার মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করা হল। (মুসলিম)।
যে সমাজে নিকট আত্মীয়দের মৃত্যুতে মৃতদের জন্য মাতাম করা, চেহারা ক্ষত করা, উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা, বছর কি বছর ধরে শোক পালন করা, গৌরবের বিষয় মনে করা হত, ঐ সমাজের এক একজন ব্যক্তি এমন ধৈর্য এবং নিয়মানুবর্তীতায় অভ্যস্ত হল যে, পুরুষ তো বটেই এমনকি নারীরাও ধৈর্যের দৃষ্টান্ত হয়ে গেল।
উম্মে আতীয়া বাসরায় স্বীয় ছেলের অসুস্থতার কথা মদীনায় বসে জানতে পারলেন, তাই তিনি বাসরা সফর করার দৃঢ় সংকল্প করলেন, বাসরা পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন যে, দুদিন পূর্বে তার ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে, উম্মে আতীয়া দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয় হলেন বটে, কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু বলছিলেন ‘ইন্না লিল্লাহ্ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’, এটা ব্যতীত তার মুখ দিয়ে অন্য আর কোন শব্দ বের হয় নাই।
এরপর চতুর্থ দিন আতর তলব করে তা ব্যবহার করলেন এবং বললেন: রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বামী ব্যতীত অন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক পালন করতে নিষেধ করেছেন।
যে সমাজে নারীর মর্যাদা বা সম্রমের কোন লেশমাত্রও ছিল না, কোরআনের শিক্ষা পুরুষদের অন্তরে এমন পরিবর্তন এনে দিয়েছিল যে, তারা নিজেরাই নারীর সম্মান এবং সম্ভ্রমের রক্ষক হয়ে গেল, এক মহিলা মসজিদ থেকে বের হচ্ছিল, আবু হুরাইরা অনুভব করল যে, সে সুগন্ধি ব্যবহার করেছে, আবু হুরাইরা মহিলাকে ওখানে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল— হে আল্লাহর বান্দী তুমি কি মসজিদে যাচ্ছ? সে বলল: হাঁ। আবু হুরাইরা বলল: আমি আমার প্রিয় নবী আবুল কাসেম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: যে নারী মসজিদে সুগন্ধি ব্যবহার করে আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামায কবুল হবে না যতক্ষণ না সে তার ঘরে ফিরে গিয়ে গোসল করে আসে। (আহমদ)
ঐ লোকেরা যারা সর্বদা একে অপরের রক্ত পিপাসু ছিল, যাদের নিকট মানবাত্মার কোন মূল্য ছিল না, কিতাব ও সুন্নাতের শিক্ষা তাদেরকে শুধু নিজেদেরই নয় বরং অন্যদের জীবন রক্ষক বানিয়ে দিয়েছে।
খোবাইব আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তার বংশের লোকেরা ধোঁকায় ফেলে গ্রেপ্তার করে মক্কার মোশরেকদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছিল, মোশরেকরা তার কাছ থেকে বদরের যুদ্ধে নিহতদের বদলা নিতে চাচ্ছিল, সেটা ছিল যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ মাস, তাই তারা তাকে হত্যা করার সময় পিছিয়ে দিল, আর খোবাইব আনসারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বেড়ি পরিধান করে এক ঘরে বন্দী করে রাখল, নিষিদ্ধ মাস শেষ হয়ে গেলে মক্কার কোরাইশরা খোবাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যার তারিখ নির্ধারণ করল। খোবাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নিহত হওয়ার আগে পবিত্র হওয়ার জন্য বন্দীশলার কর্তার নিকট ক্ষুর চাইল, কর্তা তার কম বয়সী বাচ্চার মাধ্যমে ক্ষুর দিয়ে পাঠাল। কিন্তু পরে সে চিন্তায় পড়ে গেল যে, আমি কি বোকামী করলাম, হত্যার আসামীর নিকট নিজের সন্তানের হাতে ক্ষুর দিয়ে পাঠালাম। কর্তা পেরেশান অবস্থায় দৌঁড়ে আসল এবং দেখল খোবাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ক্ষুর হাতে নিয়ে বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করছে, হে ছেলে তোমার মা তোমার হাতে ক্ষুর পাঠানোর সময় আমাকে ভয় করে নাই? কর্তা সাথে সাথে ঐ পেরেশান অবস্থায় বলে উঠল, হে খোবাইব আমি এ বাচ্চা তোমার নিকটে আল্লাহ্র নিরাপত্তায় পাঠিয়েছি, খোবাইব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বাচ্চার মায়ের চিন্তা দূর করার জন্য বলল: চিন্তা করবে না, আমি এ নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করব না, আমাদের ধর্মে অত্যাচার, ওয়াদা ভঙ্গ করা জায়েজ নয়। যে ব্যক্তিকে আগামী দিন অন্যায়ভাবে নিহত হতে হবে, সে নিজেই কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা ঠিক মনে করে নাই। ঐ সমস্ত লোক যারা জাহেলিয়াতের যুগে হালাল ও হারামের মধ্যে কোন পার্থক্য করত না, কোরআ’নের শিক্ষা তাদেরকে আমানতদারী এবং ধার্মিকতার এমন স্তরে নিয়ে এসেছে যে, কারো কাছ থেকে একটি পয়সা হারাম ভাবে নেওয়া তারা মোটেও পছন্দ করত না। সা’দ বিন ওবাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বংশের কাছ থেকে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দিলেন এবং সাথে সাথে এ উপদেশ দিলেন যে, দেখ! কিয়ামতের দিন যেন এমন না হয় যে, তোমার কাঁধে বা পিঠে যাকাতের উঠ চিল্লাতে থাকে। সা’দ বিন উবাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ্ আমি এধরণের দায়িত্ব থেকে অবসর চাচ্ছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার স্থলে অন্য একজনকে দায়িত্ব দিলেন। (ত্বাবরানী)।
যে সমাজে ব্যক্তি স্বার্থ, নির্দয় আচরণ, লুটপাট সাধারণ বিষয় ছিল, কিতাব ও সুন্নাতের শিক্ষা তাদেরকে অল্প কয়েক বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে সমবেদনা পরায়ণ, একে অপরের কল্যাণকামী, আত্মত্যাগী করে তুলেছিল।
ইয়ারমুকের যুদ্ধে কতিপয় সাহাবা প্রচণ্ড গরমের তাপে আহত অবস্থায় পিপাসায় কাতরছিল, ইতিমধ্যে একজন মুসলমান পানি নিয়ে আসল এবং আহতদেরকে তা পান করাতে চাইল, তাদের প্রথম ব্যক্তি বলল, দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পানি পান করাও। যখন দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পানি পান করাতে গেল তখন সে বলল, তৃতীয় জনকে পানি পান করাও। পানি পরিবেশনকারী তখনও তৃতীয় জনের নিকট পৌঁছে নাই, এতিমধ্যেই প্রথম ব্যক্তি শহিদ হয়ে গেছেন, তখন সে দ্বিতীয় জনের নিকট আসল, ততক্ষণে সেও তার মালিকের ডাকে সাড়া যুগিয়েছে, আর যখন তৃতীয় জনের নিকট পৌঁছল, তখন সেও পানি পান না করে শাহাদাতবরণ করেছে। (ইবনু কাসীর)
মূল বিষয় হল এই যে, কোরআ’ন মাজীদ অত্যন্ত অল্প সময়ে একত্ববাদের বিশ্বাসের সাথে সাথে মানুষের চরিত্র এবং কর্মের দিক থেকে এমন এক উন্নতমানের মানুষ তৈরী করেছে, ইতিহাসে যার কোন তুলনা নেই, শুধু এতটুকু বুঝে নিন যে কোরআন মাজীদ ২৩ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে কয়লাকে স্বর্ণে পরিণত করেছে।
আল্লাহ্ তা’য়ালা কোরআ’ন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন—
الر ۚ كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ ١
অর্থ— “এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি আপনার প্রতি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের করে নিয়ে আসেন, পরাক্রান্ত প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তারই পথের দিকে। (সূরা ইবরাহীম-১) ।
সুরা ইবরাহীমের উল্লেখিত আয়াত থেকে নিন্মোক্ত দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়—
- কোরআনের শিক্ষাই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার ক্ষমতা রাখে, বা অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, মানুষকে অন্ধকারচ্ছন্ন চিন্তা চেতনা থেকে আলোকিত চিন্তা চেতনার পথে আনতে পারে।
- কোরআ’ন অবতীর্ণের আগে সমস্ত জাহেলী কর্মকাণ্ড যেমন— শির্ক, কুফর, মদ, জুয়া, ব্যভিচার, খারাপকাজ, উলঙ্গপনা, পর্দাহীনতা, বেহায়াপনা, গানবাজনা, রক্তপাত, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, চক্রান্ত, চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, মারামারি ইত্যাদিকে আল্লাহ্ অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ কোরআন অবতীর্ণের পরে উল্লেখিত পাপকাজসমূহ থেকে পাক পবিত্র হয়ে তাওহীদে (একত্ববাদে) বিশ্বাসী হয়ে নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব, আমানতদারী, ধর্মভীরুতা, সত্যবাদীতা, সহনশীলতা, কল্যাণকামিতা, আত্মত্যাগ, নেকী, আল্লাহভীতি, সততা, লজ্জাশীলতা, পর্দা ইত্যাদির ন্যায় উন্নত গুণাবলীকে আল্লাহ্ তা’য়ালা আলো বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অতএব আলো এবং আলোকিত চিন্তা চেতনা শুধু তাই যা আল্লাহ তা’য়ালা আলো বলে আখ্যায়িত করেছেন, যদি সমস্ত পৃথিবীও ঐ আলোকে অন্ধকার বলে আখ্যায়িত করতে থাকে, তবুও তা আলো হিসেবেই থাকবে, অন্ধকার বলে বিবেচিত হবে না; আর যাকে আল্লাহ্ অন্ধকার বলেছেন তা অন্ধকার হিসেবেই থাকবে, যদিও সমস্ত পৃথিবী তাকে আলো বলতে শুরু করে, অবশ্য আলোকে অন্ধকার বলে বিবেচনাকারী এবং অন্ধকারকে আলো বলে বিবেচনাকারীরা নিজেরাই নিষ্ফল হবে।
অতএব আমাদের এ দৃঢ় ঈমান আছে যে নারীকে পর্দা করে সমাজকে ফেতনা ফাসাদ থেকে রক্ষা করা, পুরুষকে নারীদের উপর কর্তৃত্বকারী হিসেবে মানা, পারিবারিক নিয়মকে আইনে পরিণত করা, ইসলামী দণ্ডবিধি আইন বাস্তবায়ন করা, সমাজকে মদ, ব্যভিচার, অন্যায়ের মত নিকৃষ্ট অপরাধ থেকে পাক পবিত্র করা, চোর এবং ডাকাত থেকে সমাজকে সংরক্ষণ করা, হত্যার বিনিময়ে হত্যার আইন বাস্তবায়ন করে, হত্যা এবং রক্তপাত দূর করা, একাধিক বিয়ে প্রথাকে মেনে নিয়ে সমাজকে গোপন প্রেম, বাড়ী থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, আদালতের বিয়ের ন্যায় বেহায়া এবং অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করে, মিথ্যা অপবাদের আইন বাস্তবায়ন করে নারীকে সম্মান এবং তার সম্ভ্রম রক্ষা করা, ইসলামের দুশমন কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা স্বয়ং আলোকিত চিন্তা চেতনা।