মূলত কোর’আন মাজীদ কোরাইশদের তেলওয়াত পদ্ধতি (তাদের ভাষায়) অবতীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন বংশের বিভিন্ন রকমের স্থানীয় ভাষা এবং উচ্চারণ পদ্ধতির কারণে উম্মুতে মোহাম্মাদীকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ৭টি স্থানীয় ভাষায় কোর’আন তেলওয়াতের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। জিবরীল (আ.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ নির্দেশ পৌঁছাল যে, আপনি আপনার উম্মতকে একটি স্থানীয় ভাষায় কোর’আন শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরীল (আ.) দ্বিতীয় বার আসল এবং বলল, আল্লাহ্ তা’লা আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় দু’টি ভাষায় কোর’আন শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরীল (আ.) তৃতীয় বার আসল এবং বলল, আল্লাহ্ তা’লা আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় ৩টি ভাষায় কোর’আন শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরীল (আ.) চতুর্থ বার আসল এবং বলল, আল্লাহ্ তা’লা আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় ৭টি ভাষায় কোর’আন শিক্ষা দিন, এ সাতটি স্থানীয় ভাষার মধ্যে মানুষ যে ভাষায় কোর’আন তেলওয়াত করবে তা সঠিক হবে।[১]

উল্লেখ্য, ৭টি ভাষার উদ্দেশ্য হল কোথাও উচ্চারণের পার্থক্য, যে এক কেরাতে (পদ্ধতিতে) পড়া হয় মূসা অন্য ক্বেরাতে মূসায়ু, আবার কোথাও যের যবর পেশের পার্থক্য যেমন— এক কেরাতে যুল আরসিল মাজীদু (দালের উপর পেশ দিয়ে) আবার অন্য কেরাতে যুল আরসিল মাজীদি (দালের নিচে যের দিয়ে)। আবার কোথাও এ পার্থক্য হয় এক বচন, দ্বিবচন এবং বহুবচনে, বা পুং লিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের পার্থক্য। যেমন এক ক্বেরাতে তাম্মাতু কালিমাতু রাব্বিক আবার অন্য ক্বেরাতে তাম্মাত কালিমাত রাব্বুক। আবার কোথাও এ পার্থক্য হয়ে থাকে ক্রিয়ার মধ্যে, যেমন এক ক্বেরাতে ওমান তাত্বাওয়া খাইরান, আবার অন্য কেরাতে মান ইয়ত্বাওয়া খাইরান। কিন্তু একথা পরিষ্কার যে, এ সাত কেরাতের তেলওয়াতের মাধ্যমে অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য হয় না। এটা এধরণের পার্থক্য যেমন মিশরের অধিবাসীরা আরবী ‘জ্বিম’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘গ’ এর ন্যায় উচ্চারণ করে, যেমন ‘জানাযা’ শব্দটিকে তারা ‘গানাযা’ উচ্চারণ করে থাকে, ইরানের অধিবাসীরা আরবী ‘কাফ’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘চ’-এর ন্যায় উচ্চারণ করে থাকে, যেমন ‘আল্লাহু আকবার’কে তারা ‘আল্লাহু আচ্চার’ উচ্চারণ করে। ভারতের হায়দারাবাদ এলাকার লোকেরা আরবী ‘কাফ’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘খ’-এর ন্যায় উচ্চারণ করে, যেমন ‘সন্দুক’কে তারা ‘সন্দুখ’ উচ্চারণ করে থাকে। কিন্তু এ ভিন্নতার কারণে কোথাও অর্থের মধ্যে কোন পরিবর্তন করে না। ঠিক এমনিভাবে কোর’আন মাজীদের ভিন্ন ভিন্ন সাত ক্বেরাতের বিষয়টিও অনুরূপই।

ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু)-র কোর’আন মাজীদকে এক ক়েরাতে (তেলওয়াত পদ্ধতিতে) একত্রিতকরণ এবং সূরা সমূহের বিন্যাস:

ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে (২৫-০৩৫) হি. জিহাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমনকারী সাহাবাগণ বিজিত অঞ্চলসমূহে নিজ নিজ শিক্ষা অনুযায়ী কোর’আন মাজীদ তেলওয়াত করত, যতদিন পর্যন্ত মানুষ ৭ ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতি) সম্পর্কে অবগত ছিল ততদিন কোন প্রকার প্রশ্ন দেখা দেয়নি, কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ইসলাম দূর দূরান্তের অঞ্চলসমূহে পৌঁছার পর ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতি) সম্পর্কে মানুষের ধারণা কমতে লাগল, ফলে ভিন্ন জন ভিন্ন পদ্ধতিতে তেলওয়াত করার কারণে মানুষের মাঝে একজন আরেক জনের তেলওয়াতকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করতে লাগল, হুযাইফা বিন ইয়ামেন (রযিয়াল্লাহু আনহু) আরমেনিয়া এবং আজারবাইজানের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ওসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আমীরুল মুমেনীন এ উম্মত আল্লাহ্‌র কিতাব নিয়ে মতভেদে লিপ্ত হওয়ার আগে তার একটা সুরাহা করুন। ওমসান (রযিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন যে, কি হয়েছে? হুযাইফা (রযিয়াল্লাহু আনহু) বলল, যুদ্ধ চলাকালে দেখলাম যে সিরিয়ার লোকেরা উবাই বিন কা’ব (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর তেলওয়াত পদ্ধতিতে কোর’আন তেলওয়াত করছে, যা ইরাক বাসীরা শোনেনি, আর ইরাকবাসীরা আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর তেলওয়াত পদ্ধতিতে কোর’আন তেলওয়াত করছে যা সিরিয়াবাসীরা শোনেনি, ফলে একে অপরকে কাফের ফতোয়া দিচ্ছে। ইতিপূর্বে ওসমান (রযিয়ল্লাহু আনহু)-এর নিকট এ ধরনের অভিযোগ এসেছিল, তাই তিনি সম্মানিত সাহাবাগণকে একত্রিত করে বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করলেন যে, এ বিষয়ে আপনাদের কি পরামর্শ? সাহাবাগণ ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করল, আপনি এ ব্যাপারে কি চিন্তা করেন? ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু) বলল, আমার পরামর্শ হল এই, যে সমস্ত মুসলমানদেরকে এক ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতির) উপর একমত করে দেই, যাতে কোন মতভেদ না থাকে। সাহাবাগণ ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু)-র এ পরামর্শকে পছন্দ করল এবং এটাকে তারা সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করল। এ সম্মিলিত সিদ্ধান্তের উপর কাজ করার জন্য ওসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) চারজন সাহাবার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন, এ কমিটির মধ্যে ছিল যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন যোবাইর (রযিয়াল্লাহু আনহু), সা’ঈদ বিন আস (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুর রহমান বিন হারেস (রযিয়াল্লাহু আনহু)। এ কমিটিকে সহযোগীতা করার জন্য পরে আরো অন্যান্য সাহাবীগণ তাদের সাথে শামীল হয়ে ছিলেন। এ কমিটিকে এ দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল যে, তারা আবুবকর এবং ওমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমার) একত্রিতকৃত কপি থেকে এমন একটি কপি প্রস্তুত করবে যা শুধু একটি ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতিতে) হবে, আর যদি কোন শব্দ বা আয়াতের ব্যাপারে মত ভেদ হয় যে, এটা কিভাবে লিখা হবে তখন তা কোরাইশদের তেলওয়াত অনুযায়ী লিখতে হবে, কেননা কোর’আন কারীম তাদের ভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সাহাবাগণের একমিটি ‘উম্ম’কে সামনে রেখে যে গুরুত্বপূর্ণ কজে আঞ্জাম দিয়ে ছিল তা ছিল নিম্নরূপ:

  1. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে সাহাবাগণের নিকট যতগুলো সহীফা ছিল তা আবার তলব করা হল এবং এগুলোকে নুতন করে ‘উম্ম’-এর সাথে মেলানো হল, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি আয়াত নুতন মোসহাফে (কোর’আনে) অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই যতক্ষণ না সাহাবাগণের ভিন্ন ভিন্ন সহিফার সাথে মেলানো হয়েছে।
  2. আয়াতসমূহকে যের যবর পেশহীনভাবে এমনভাবে লিখা হল যেন সমস্ত ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতি) এক হয়ে যায়, যেমন: কিয়ামতের দিনের মালিক ও কিয়ামতের দিনের বাদশাহ। এ দু’টি পদ্ধতিকে নুতন মোসহাফে (কোর’আনে) এমন ভাবে লিখা হল, এতে উভয় ক্বেরাত (তেলওয়াত পদ্ধতি) লিখার মধ্যে এসে গেছে, কিন্তু এর অর্থের মধ্যে কোন রূপ পরিবর্তন হয় নাই।
  3. ‘উম্ম’-এর মধ্যে সমস্ত সূরাসমূহ পৃথক পৃথক সহিফায় (পুস্তকে) অগোছালোভাবে বিদ্ধমান ছিল, এ কমিটি চিন্তাভাবনা করে সমস্ত সূরাগুলোকে ধারাবহিকভাবে সাজিয়ে একত্রিক করে দিল।
  4. ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু) সকলের ঐক্যমতে প্রস্তুতকৃত কোর’আনের এ কপি বিভিন্ন স্থানে পাঠলেন, তার মধ্যে একটি কপি মক্কায়, একটি সিরিয়ায়, একটি ইয়ামেন, একটি বাসরায়, একটি কুফায় পাঠালেন আর একটি কপি মদীনায় সংরক্ষণ করলেন।
  5. কোর’আন মাজীদের এ কপি বিভিন্ন ইসলামী কেন্দ্রগুলোতে পাঠানোর সাথে সাথে ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু) একজন বিশেষজ্ঞ এবং কারীও ঐ সমস্ত ইসলামী কেন্দ্রগুলোতে পাঠিয়েছেন, যারা লোকদেরকে সকলের ঐক্যমতে প্রস্তুতকৃত কোর’আনের তেলওয়াত পদ্ধতি মোতাবেক যথাযথভাবে লোকদেরকে কোর’আন শিক্ষা দিত। তাদের মধ্যে যায়েদ (রযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন মদীনায়, আর আবদুল্লাহ্ বিন সায়েব (রযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন মক্কায়।

এসমস্ত কর্মগুলো শেষ করার পর ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু) সাহাবাগণের নিকট বিদ্ধমান ভিন্ন ভিন্ন তেলওয়াত পদ্ধতি সম্বলিত কপিগুলো আগুন দিয়ে পুরিয়ে দিলেন। আর ‘উম্ম’ হাফসা (রাযিয়াল্লাহু আনহার) নিকট ফেরত দিলেন, যা হাফসা (রাযিয়াল্লাহু আনহার) মৃত্যুর পর মারওয়ান আগুন দিয়ে পুরিয়ে দিয়েছিল।

এ সাত কোরাতকে (তেলওয়াত পদ্ধতিকে) একটি পদ্ধতি একটি মোসহাফে (কোর’আনে) সমবেত করার মধ্যে ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু) কোর’আন মাজীদের ঐ বিরাট খেদমতে আঞ্জাম দিলেন যার ফলে আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানেরা ঐ পদ্ধতিতেই কোর’আন মাজীদ তেলওয়াত করছে, যে তেলওয়াত পদ্ধতিতে কোর’আন মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। সাহাবা কেরামগণের এ কষ্টের পর আল্লাহ্‌র দয়া ও অনুগ্রহে কোর’আন মাজীদের এক একটি অক্ষর, এক একটি শব্দ, এক একটি আয়াত কিভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত করে রেখেছেন তার কিছু উদাহরণ নিচে পেশ করা হল:

  1. কোর’আন মাজীদে ইবরাহীম শব্দটি ৬৯ বার এসেছে এর মাধ্যে সূরা বাক্বারার সর্বত্র এ শব্দটি ‘ইয়া’ ব্যতীত লিখা হয়েছে। যেমন, إِبْرَٰهِـۧمَ; আবার অন্যান্য সূরাসমূহে ইবরাহীম শব্দটি ‘ইয়া’ অক্ষরসহ লিখা হয়েছে। যেমন, إِبْرَاهِيمُ। কোর’আন মাজীদ লিখার ক্ষেত্রে এ পার্থক্য কোর’আন মাজীদের প্রতিটি কপিতে ১৪শত বছর থেকে চলে আসছে যা আজ পর্যন্ত কোন মুসলমান বা অমুসলিম প্রকাশক তা পরিবর্তন করতে পারে নাই, না কিয়ামত পর্যন্ত তা করতে পারবে।
  2. সামূদ শব্দটি কোর’আন মাজীদে দুইভাবে লিখা হয়েছে, যেমন, প্রথম আরবী ‘দাল’ অক্ষরটিতে যবর দিয়ে ثَمُودَ — সূরা হুদ ৬১ নং আয়াত, আবার কোর’আন মাজীদের চারস্থানে এই শব্দটি আলিফ যোগে এভাবে লিখা হয়েছে, ثَمُودَاْ সূরা হুদ ৬৮ নং আয়াত। ১৪শত বছর থেকে কোর’আন মাজীদের চারটি স্থানে সামূদ শব্দটি আলিফ যোগে লিখিত আছে, যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে লিখা হয়েছিল, আজও পৃথিবীর সমস্ত মোসহাফে (কোরআনে) এভাবেই লিখিত আছে, কোন প্রকাশকই সামূদ শব্দ অতিরিক্ত আলিফ অক্ষরটি উঠিয়ে দিতে পারে নাই এবং কিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না।
  3. ‘কাওয়ারীর’ শব্দটিও কোরআনে দু’ভাবে লিখিত হয়েছে— একস্থানে আরবী ‘রা’ অক্ষরটির উপর যবর দিয়ে— যেমন, সূরা নামলের ৪৪ নং আয়াতে قَوَارِيرَ; আবার অন্য এক স্থানে সূরা ইনসানের ১৫ নং আয়াতে “রা” অক্ষরের পরে আলিফ যোগে লিখা হয়েছে, قَوَارِيرَا۠ — কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে যেখানে ‘কাওয়ারিরা’ শব্দটি ‘আলিফ’ অক্ষর ব্যতীত লিখা হয়েছিল আজও প্রতিটি মোসহাফে (কোরআনে) আলিফ ব্যতীতই লিখা হচ্ছে, আর যেখানে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে ‘আলিফ’ যোগে লিখা হয়েছিল ওখানে আজও ‘আলিফ’ অক্ষর যোগেই লিখা হচ্ছে। অবশ্য তেলওয়াত কারীদের সুবিধার্থে ‘আলিফ’ অক্ষরের উপর একটি গোল ( ۟ ) চিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। আর শিক্ষকগণ তাদের ছাত্রদেরকে শিখিয়ে দেন যে এ ‘আলিফ’টি অতিরিক্ত যা পড়ার সময় উচ্চারণ হবে না।
  4. কোর’আন মাজীদে لِشَىْءٍ শব্দটি উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে দুই শ’য়ের অধিক স্থানে লিখিত হয়েছে শুধু একস্থানে এ শব্দটির সাথে ‘আলিফ’ অক্ষর যোগে সূরা কাহাফের ২৩ নং আয়াতে لِشَاْيۡءٍ এভাবে লিখিত হয়েছে, যা আরবী লিখন পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক নয়, কিন্তু সমস্ত মোসহাফে (কোরআনে) আজও এভাবেই বিদ্ধমান আছে, যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে লিখা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত কোন প্রকাশক তা সংশোধন করার মত সাহস দেখাতে পারে নাই।
  5. সূরা নামলের ২১ নং আয়াতে أَوۡ لَيَأۡتِيَنِّي শব্দটি এভাবে লিখা হয়েছে যার অর্থ হয়, কিংবা আমি তাকে হত্যা করব। এ শব্দটিতে ‘জালে’র পূর্বে ‘আলিফ’ অক্ষরটি অতিরিক্ত যা শুধু লিখার নিয়ম অনুযায়ীই অশুদ্ধ নয়, বরং অনুবাদ করার ক্ষেত্রেও মারাক্তক ভুলের কারণ হতে পারে যদি ঐ ‘আলিফ’ অক্ষরটি তেলওয়াতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে তার অর্থ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যাবে আর তাহবে এই যে, কিংবা আমি তাকে হত্যা করব না। আশ্চর্য বিষয় হল যখন কোর’আন মাজীদে যের, যবর, পেশ ছিল না, নক্তা (ফোটা) ছিল না তখন আয়াতের এ অংশটি অতিরিক্ত (আলিফ) সহ অপরিবর্তিত অর্থ নিয়ে ইসলামের শত্রুদের হাতে কিভাবে নিরাপদ ছিল? অথচ সর্বকালেই কাফেরার কোর’আন মাজীদে পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালিয়ে ছিল।
  6. এ বাক্যটি কোর’আন মাজীদে দু’বার এসেছে, প্রথম সূরা আনকাবুতে দ্বিতীয় সূরা যুমারে। সূরা আনকাবুতে শব্দটি ‘ইয়া’ অক্ষরসহ লিখিত হয়েছে, যেমন— يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ أَرۡضِي وَٰسِعَةٞ فَإِيَّٰيَ فَٱعۡبُدُونِ ٥٦ — আয়াত নং-৫৬। আবার সূরা যুমারে এ বাক্যটি ‘ইয়া’ অক্ষর ব্যতীত এভাবে লিখিত হয়েছে, قُلۡ يَٰعِبَادِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمۡۚ لِلَّذِينَ أَحۡسَنُواْ فِي هَٰذِهِ ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٞۗ  وَأَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٌۗ إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠  — আয়াত নং-১০। উভয় পদ্ধতির অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, লিখার এ পার্থক্য ১৪শত বছর থেকে কোর’আন মাজীদের প্রতিটি কপিতে এভাবেই বিদ্ধমান আছে। ‘ইয়া’ অক্ষরের এ সাধারণ পার্থক্যটি আজ পর্যন্ত কোন মুসলমান বা অমুসলিম কোন প্রকাশক পরিবর্তন করতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্ত বদলাতেও পারবে না।
  7. কোর’আন মাজীদে ‘লাইল’ শব্দটি ৭৪টি স্থানে উল্ল্যেখ হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী ‘লাইল’ শব্দটিকে তার পূর্ববর্তী শব্দের সাথে মিলাতে হলে আরেকটি ‘লাম’ অক্ষর যোগ করতে হয়, যেমন— … যেমন কোর’আন মাজীদের অন্যান্য শব্দগুলো ‘লাম’ অক্ষর যোগ করা হয়েছে, যেমন— قَالُوٓاْ أَجِئۡتَنَا بِٱلۡحَقِّ أَمۡ أَنتَ مِنَ ٱللَّٰعِبِينَ٥٥ — সূরা আম্বীয়া-৫৫ বা لَّا ظَلِيلٖ وَلَا يُغۡنِي مِنَ ٱللَّهَبِ ٣١ — সূরা মুরসালাত-৩১। কিন্তু ‘লাইল’ শব্দটি সমস্ত কোর’আনে একটি ‘লাম’ যোগে ব্যবহার হয়েছে। যা লিখার পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক নয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি কোর’আন মাজীদে ‘লাইল’ শব্দটিতে আরেকটি ‘লাম’ যোগ করতে পারেনি।
  8. কোর’আন মাজীদের সূরাসমূহের শুরুতে بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ দ্বারা শুরু করা হয়েছে, কিন্তু সূরা তাওবার শুরুতে بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ উল্লেখ নেই, তার কারণ হল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সূরা লিখানোর সময় তার শুরুতে بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ লিখাননি। তাই ১৪শত বছর থেকে পৃথিবীর সমস্ত মোসহাফ (কোর’আন)-এ সূরাটি بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ব্যতীতই লিখিত হয়ে আসছে, কোন বন্ধু বা শত্রুর সাহস হয়নি যে, তারা সূরা তাওবার শুরুতে بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ লিখবে।
  9. সূরা ক়াহাফে সূসা (আ.) এবং খিজির (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, যে তাঁরা উভয়ে একটি এলাকাতে পৌঁছার পর সেখানকার লোকদের নিকট খাবার চাইল, কিন্তু তারা খাবার দিতে অস্বীকার করল। কুরআন মাজীদের ভাষায় … অর্থাৎ, ‘তারা অস্বীকার করল’।খলীফা ওলীদ বিন আবদুল মালেকের সময়ে যখন কোরআন মাজীদে নোক্তা (ফোটা) যোগ করা হল, তখন কেউ কেউ … এর পরিবর্তে … শব্দ লিখার পরামর্শ দিল, যার অর্থ হয়, তারা খাবার দিল। যাতে করে আপ্যায়ন করাতে অস্বীকার করার স্থলে আপ্যায়ন করাল, আর এলাকাবাসীরা তাদের বদনাম থেকে বেঁচে যাবে। তখন ওলীদ বিন আবদুল মালেক বললেন, ‘কোরআন মাজীদ তো অন্তর থেকে অন্তরে স্থানান্তিত হয়।’ (অর্থাৎ, যা হাফেজদের অন্তরে সংরক্ষিত থাকে এবং তারা তাদের ছাত্রদের অন্তরে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে স্থানান্তরিত করে। অতএব, কাগজের পরিবর্তনে কোন কাজ হবেনা।[২] তাই তা যেমন ছিল তেমনই থাকতে দাও। গত ১৪শত বছর থেকে কাফেরদের সর্বপ্রকার শত্রুতা এবং কুচক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও কোন কট্টরপন্থী কাফেরও কোরআন মাজীদের কোন একটি শব্দ বা অক্ষর বা কোন যের বা যবর এমনকি ফোটার কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি, আর কিয়ামত পর্যন্ত কোনদিন পারবেও না। আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন, إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ অর্থাৎ, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’ আর এই বাণীর কার্যকারিতা বিগত ১৪শত বছর থেকে চলে আসছে।

আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশীদের শাসনামলে কোরআন সংরক্ষণ সংক্রান্ত ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে পাঠকদের মনঃপুত হবে।

মামুনুর রশীদ তার শাসনামলে জ্ঞান চর্চার মূল্যায়ন করতেন, যেখানে সকলেরই প্রবেশাধিকার ছিল। একটি বৈঠকে একজন ইহুদী উপস্থিত ছিল, তার জ্ঞানগর্ব এংব সাহিত্যকতাপূর্ণ আলোচনায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে খলীফা মামুন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দাওয়াত দিলেন। কিন্তু ইহুদী তা প্রত্যাখ্যান করল। এক বছর পর ঐ ইহুদী আবার ঐ বৈঠকে উপস্থিত হল কিন্তু এই সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে মামুনুর রশীদ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমার হাতের লেখা সুন্দর, আমি বই লিখে বিক্রি করি, আমি পরীক্ষামূলকভাবে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করেছি, সেখানে বহুস্থানে আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে কম বেশি করেছি এবং এ কপি নিয়ে ইহুদীদের গীর্জায় গিয়েছি। ইহুদীরা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে তা ক্রয় করেছে। এরপর ইঞ্জিলের তিনটি কপি পরিবর্তন করে লিখে তা চার্চে নিয়ে গেলাম এবং খৃষ্টানদের নিকট তা বিক্রি করলাম। এরপর কোরআন মাজীদের তিনটি কপি নিলাম এবং এখানেও ঐভাবে কম বেশি করে লিখলাম এবং মসজিদে নিয়ে গিয়ে তা মুসলমানদের নিকট বিক্রি করে দিলাম। কিন্তু এই তিনটি কপিই খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল এই বলে যে, এটাতে পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ, তাওরাত ও ইঞ্জিলের সমস্ত কপি গৃহিত হয়েছে এবং কোন কপিই ফেরত আসেনি। এ ঘটনার পর আমার বিশ্বাস জন্মাল যে, সত্যিই কোরআন মাজীদ সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ্ নিয়েছেন, তাই আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।[৩]

ওসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলের পর:

ওসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কোরআন মাজীদের যে কপিটি প্রস্তুত করিয়েছিলেন তা ছিল যের, যবর, পেশ ও নোক্তা বা ফোটা বিহীন। আরবী ভাষীদের জন্য এ ধরনের কোনআন তেলওয়াত করা ততটা কঠিন ছিল না, কিন্তু অনারবদের জন্য তা যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, সর্বপ্রথম বসরার গভর্ণর যিয়াদ বিন আবু সুফিয়ান একজন আলেম আবুল আসওয়াদ আদদুয়ালীকে এ বিষয়ে একটি সমাধান খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি অক্ষরগুলোতে নোক্তা বা ফোটা দেওয়ার পরামর্শ দিলেন এবং তাই করা হল। আবদুল মালেক বিন মারওয়ান (৬৫-৮৬ হি.) তার শাসনামলে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরআন তেলওয়াতকে আরও সহজতর করার জন্য ইয়াহইয়া বিন ইয়ামার, নাসার বিন আসেম লাইসী ও হাসান বাসরী (রাহিমাহুমুল্লাহ্)-এর পরামর্শ ক্রমে যের, যবর, পেশ সংযোগ করেছেন। আবার বলা হয়ে থাকে যে হাযমা এবং তাশদীদের আলামতসমূহ খালীল বিন আহমদ (রাহিমাহুল্লাহ্) স্থাপন করেছেন। এই বিষয়ে আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

সাহাবা এবং তাবেয়ীনগণের অভ্যাস ছিল যে, তারা সপ্তাহে একবার কোরআন মাজীদ খতম করতেন, এ উদ্দেশ্যে তারা পূর্ণ কোরআন মাজীদকে সাত ভাগে ভাগ করেছিলেন, যাকে হিযব বা মাঞ্জিল বলা হয়। মূলত এই হিযব বা মাঞ্জিলের ভাগ সাহাবা কেরামগণের যুগে হয়েছিল। অবশ্য কোরআন মাজীদকে ত্রিশ পারায় ভাগ করা, প্রত্যেক পারাকে চার ভাগে ভাগ করা, অর্থাৎ, চতুর্থাংশ, অর্ধেক, তৃতীয়াংশ, এমন কি রুকুর আলামত, আয়াত নাম্বার, ওয়াক্‌ফ (যতি চিহ্ন) যোগ করা ইত্যাদি মোসহাফ উসমানী (উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে একত্রিকৃত কোরআন)-এর পরে করা হয়েছে। যার সংযোজন একমাত্র কোরআন মাজীদের তেলওয়াত এবং মুখস্ত করাকে সহজ করার জন্য করা হয়েছে। কোরআন মাজীদ অবতীর্ণের সময়কালের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং শরীয়তের দৃষ্টিতেও এর কোন বিশেষ বিধান নেই। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. মুসলিম, কিতাব ফাযায়েল কোর’আন, বাব বায়ান আন্নাল কোর’আন নাযালা আলা সাবআতা আহরুফ।
  2. ড. শওকী আবু খলীল লিখিত কাসাসুল কোরআন, অনুবাদ মাক্তাবা দারুস্‌সালাম, পৃ. ৭৪৭।
  3. মাওলানা মুফতি মুহম্মদ শফি লিখিত মা’আরেফুল কোরআন, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭০।