কোর’আন মাজীদ সম্পর্কে কাফেরদের দাবী ছিল এই যে, এটা আল্লাহ্‌র নাযিলকৃত কিতাব নয়, বরং মোহাম্মদের নিজস্ব আবিষ্কার। আল্লাহ্ তা’লা কোরআন মাজীদে এর উত্তর দিয়েছেন যে, যদি কোর’আন মাজীদ মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিজস্ব আবিষ্কার হয় তাহলে তার অনুরূপ একটি সূরা বা একটি কথা তোমরাও আবিষ্কার করে দেখাও। আল্লাহ্‌র বাণী—

أَمۡ يَقُولُونَ ٱفۡتَرَىٰهُۖ قُلۡ فَأۡتُواْ بِعَشۡرِ سُوَرٖ مِّثۡلِهِۦ مُفۡتَرَيَٰتٖ وَٱدۡعُواْ مَنِ ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٣

অর্থ: ‘তবে কি তারা বলে যে, ওটা সে নিজেই রচনা করেছে? তুমি বলে দাও, তাহলে তোমরাও ওর অনুরূপ রচিত দশটি সূরা আনয়ন কর, আর যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে (তোমাদের সাহায্যার্থে) আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে ডাকতে পার তাদেরকে ডেকে আন।’ (সূরা হুদ-১৩)।

দশটি সূরার পর আল্লাহ্ একটি সূরারও চেলেঞ্জ দিয়েছেন, আল্লাহ্ বাণী—

وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣

অর্থ: ‘এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তোমরা তাতে সন্দিহান হও তবে তার অনুরূপ একটি সূরা আনয়ন কর এবং আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্য বাদী হও।’ (সূরা বাকারা-২৩)।

একটি সূরার পর আল্লাহ্ একটি আয়াতের চেলেঞ্জও দিয়েছেন, যে একটি সূরা তো অনেক দূরের কথা তোমরা এর অনুরূপ একটি আয়াতও তৈরী করতে পারবে না। আল্লাহ্‌র বাণী—

أَمۡ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُۥۚ بَل لَّا يُؤۡمِنُونَ ٣٣ فَلۡيَأۡتُواْ بِحَدِيثٖ مِّثۡلِهِۦٓ إِن كَانُواْ صَٰدِقِينَ ٣٤

 অর্থ: ‘তারা কি বলে, এ কোর’আন তাঁর নিজের রচনা? বরং তারা অবিশ্বাসী। তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এর অনুরূপ কোন রচনা উপস্থিত করুক না।’ (সূরা তূর-৩৩, ৩৪)

সূরা বানী ইসরাইলে আল্লাহ্ এত কঠোর চেলেঞ্জ করেছেন যা অন্য আর কোথাও করেন নি। আল্লাহ্‌র বাণী—

قُل لَّئِنِ ٱجۡتَمَعَتِ ٱلۡإِنسُ وَٱلۡجِنُّ عَلَىٰٓ أَن يَأۡتُواْ بِمِثۡلِ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ لَا يَأۡتُونَ بِمِثۡلِهِۦ وَلَوۡ كَانَ بَعۡضُهُمۡ لِبَعۡضٖ ظَهِيرٗا ٨٨

অর্থ: ‘হে মোহাম্মদ! তুমি বলে দাও যদি এই কোর’আনের অনুরূপ কোর’আন আনয়নের জন্য মানুষ ও জ্বিন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এর অনুরূপ কোর’আন আনয়ন করতে পারবে না।’ (সূরা বনী ইসরাইল-৮৮)

প্রশ্ন হল এই যে, গত ১৪ শত বছর থেকে আরব এবং অনারবে বিদ্ধমান কোর’আন মাজীদের ঘোর-দুশমনদের কেউ এ চেলেঞ্জ গ্রহণ করেনি।

বাস্তবতা হল এই যে, কিছু উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে। ইসলামের শত্রুদের কেউ কেউ কোর’আনের সাথে মিল রেখে সূরা তৈরীর চেষ্টা করেছে। যেমন—

  1. মুসাইলাম কাজ্জাব রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগেই নবুয়তের দাবী করেছিল এবং বলেছিল যে আমার উপর ওহী অবতীর্ণ হয়েছে, প্রমাণ হিসেবে নিম্নের সূরাটি পেশ করেছিল। যার অর্থ, হে ঘেনর ঘেনরকারী ব্যাঙ তুমি যতই ঘেনর ঘেনর কর তুমি কাউকে পানি পান করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না, আর না পানিকে নোংরা করতে পারবে।
  2. মুসাইলামা কাজ্জাবের দাবী কৃত আরেকটি সূরার অর্থ— হাতী, হাতী কি? তুমি কি জান হাতী কি? তার লেজটি ছোট আর শুঁড়টি বড়।
  3. শিয়াদের একটি দলের দাবী সূরা ‘বেলায়েত’ কোর’আন মাজীদের অন্তর্ভুক্ত— অর্থ, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম, হে লোকেরা যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তোমরা ঈমান আন নবী এবং তাঁর ওলী প্রতি, যাকে আমি প্রেরণ করেছি, তারা উভয়ে তোমাদেরকে সঠিক পথের প্রতি আহ্বান করে। নবী এবং ওলী (নবীর বন্ধু) একে অপরের পরিপূরক, আর আমি সবকিছু জানি এবং সবকিছু সম্পর্কে অবগত। নিশ্চয় যারা আল্লাহ্‌র অঙ্গিকার পূর্ণ করে, তাদের জন্য রয়েছে নে’মত ভরপূর জান্নাত, আর যারা মিথ্যায় প্রতিপন্ন করে আমার আয়াতসমূহকে যখন তা তাদের নিকট তেলওয়াত করা হয়, নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামে বেদনাদায়ক স্থান। যখন কিয়ামতের দিন তাদেরকে ডাকা হবে যে কোথায় জালেম এবং রাসূলগণকে মিথ্যায় প্রতিপন্নকারীরা, তিনি রাসূলদেরকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদেরকে বিজয়ী করবেন। আর স্বীয় রবের তাসবীহ পাঠ কর তাঁর প্রশংসা সহ, আর আলী সাক্ষী দাতাদের অন্তর্ভুক্ত।[১]
  4. ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দে ফিলিস্তিনের একজন ইহুদী ড. আনীস সুরস নিন্মোক্ত চারটি সূরা তৈরী করে ছিল। (১) সূরা আল মুসলিমুন, (১১ আয়াত বিশিষ্ট) (২) সূরা আত্ তাজাস্‌সুদ (১৫ আয়াত বিশিষ্ট) (৩) সূরা আল ঈমান (১০ আয়াত বিশিষ্ট) (৪) সূরাতুল ওসায়া (১৬ আয়াত বিশিষ্ট) এবং সে এ দাবী করেছিল যে আমি কোর’আন মাজীদের চেলেঞ্জ গ্রহণ করে এ সূরাগুলো তৈরী করেছি।[২] এর মধ্যে সূরা মুসলিমুনের কিছু আয়াত নিচে উল্লেখ করা হল— অর্থাৎ, ‘আলিফ, লাম, সোয়াদ, মীম। বল, হে মুসলমান নিশ্চয় তোমরা পথভ্রষ্টতার মাঝে পতিত আছ, নিশ্চয় যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর মাসীহ (ঈসা আ.)কে অস্বীকার করে তাদের জন্য পরকালে রয়েছে জাহান্নামের আগুন এবং বেদনাদায়ক শাস্তি, ঐ দিন কিছু কিছু চেহারা লাঞ্ছিত এবং কালো হবে, আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা চাও, কিন্তু আল্লাহ্ যা চান তিনি তাই করেন।
  5. ২০০৫ সালের শুরুতে ইহুদী এবং খৃষ্টানরা মিলে অ্যামেরিকায় “ফোরকানুল হক” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল, যেখানে কোর’আন মাজীদের অনুকরণে ৭৭টি সূরা লিখেছিল। ঐ সূরাসমূহের কিছু কিছু আয়াত এ গ্রন্থের উপযুক্ত আলোচনায় পাঠকরা পেয়ে যাবেন।

কোরআন মাজীদের অনুকরণে আয়াত এবং সূরা তৈরী করার এ সমস্ত উদাহরণ থেকে পরিষ্কারভাবে একথা প্রমাণিত হয় যে, কোরআন মাজীদ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হওয়ার দাবী (নাউজু বিল্লাহ্) একটি বাতেল দাবী।

বাস্তবতা হল এই যে, কোরআন মাজীদে যে বিষয়টিকে চেলেঞ্জ করা হয়েছে তা এরকম নয় যে, কোন ব্যক্তি আরবী ভাষার শব্দ বা অক্ষর ব্যবহার করে এ ধরণের কিছু লাইন কখনো তৈরী করতে পারবে না, যেমন কোরআন মাজীদে আছে। চিন্তা করুন! যে সমাজে বিশুদ্ধ সাহিত্যিকতা পূর্ণ আরবী ভাষার স্বনামধন্য সাহিত্যিকরা ছিল, এমনকি ইমরুল কায়েসের মত বাকপটু কবি বিদ্ধমান ছিল, তাদের জন্য আরবী ভাষায় কয়েকটি  লাইন তৈরী করা কি এমন কঠিন কাজ ছিল? মূলত কোরআন মাজীদ যে বিষয়ের চেলেঞ্জ করেছিল তা ছিল এই যে, কিয়ামত পর্যন্ত কোন মানুষ একটি সূরা তো দূরের কথা এমনকি একটি আয়াতও তৈরী করতে পারবে না, যা বিশুদ্ধতা, সাহিত্যিকতা, শ্রুতিমধুরতা, আকৃষ্টিতা, মানুষের নিকট গ্রহণ যোগ্যতা ইত্যাদি দিক থেকে কোরআন মাজীদের আয়াতের ন্যায় সমমানের হবে। এ চেলেঞ্জের সামনে সমগ্র আরব বিশ্ব অপারগ হয়ে লাজওয়াব হয়ে গিয়েছিল এবং অকপটে স্বীকার করে নিয়ে ছিল যে, এ কোর’আন কোন মানুষের কথা নয়। নিচে এর কিছু উদাহরণ পেশ করা হল—

  1. জিমাদ আজদী (রযিয়াল্লাহু আনহু) যখন সর্ব প্রথম কোর’আন মাজীদের তেলওয়াত শুনল তখন সাথে সাথে বলে উঠল, আমি এধরণের কথা কখনো শুনিনি, আমি গণকদের কথা শুনেছি, কবিদের কথা শুনেছি, যাদুকরদের কথা শুনেছি, কিন্তু এ বাণী সমুদ্রের অতল তলে পৌঁছে যাবে।
  2. ওমার (রযিয়াল্লাহু আনহু) সূরা ত্বা-হার আয়াতসমূহ শ্রবণে তার সমস্ত রাগ নিমিষে নিঃশেষ হয়ে গেল আর বলতে লাগল ‘কত উন্নত এবং উত্তম একথা’।
  3. বানী আবদুল আসহাল বংশের সর্দার উসাইদ বিন হুজাইর (রযিয়ল্লাহু আনহু) যখন মোসআব বিন ওমাইর (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মুখে কোর’আন মাজীদ শুনতে পেল তখন বলতে লাগল, ‘আহ! কত উত্তম এবং উন্নত বাণী’।
  4. হজ্বের সময়ে কোরাইশ সর্দারদের একটি পরামর্শ বৈঠক দারুন নাদওয়ায় অনুষ্ঠিত হল, যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে তাঁকে যাদুকর বা পাগল বা কবি বা গণক বলে আখ্যায়িত করে হাজীদেরকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। লোকদের বিভিন্ন পরামর্শের আলোকে সভায় ইসলামের নিকৃষ্ট দুশমন ওলীদ বিন মুগীরা এ সিদ্ধান্ত দিল যে, মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গণক, পাগল, কবি, জাদুকর নয়, আল্লাহ্‌র কসম! তাঁর কথা অত্যন্ত সুন্দর, তাঁর মূল অত্যন্ত সুদৃঢ়, আর ডাল পালা ফলবান, তার ব্যাপারে খুব বেশি বললে যে কথা বলা যায় তাহল, এই যে, সে জাদুকর, তাঁর কথা শুনে বাপ-ছেলে, ভাই-ভাই, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং একথার উপর সবাইকে একমত করতে হবে।
  5. কোরাইশ সর্দার ওতবা বিন রাবীয়া রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মুখে সূরা হা-মীম সাজদার আয়াত শুনে এসে কোরাইশ নেতাদেরকে বলল, আল্লাহ্‌র কসম! আমি এমন এক বাণী শুনেছি যা ইতিপূর্বে আর কখনো শুনিনি। এ বাণী না কোন কবির বাণী না কোন জাদুকরের বাণী। আমার পরামর্শ এই যে, তাঁকে তার অবস্থা মত থাকতে দাও, আল্লাহ্‌র কসম! এ বাণীর মাধ্যমে বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হবে, যদি সে আরবদের উপর বিজয়ী হয় তাহলে সরকার তোমাদের সরকার হবে, তাঁর সম্মান তোমাদের সম্মান হবে, আর আরবরা যদি তাঁকে হত্যা করে তাহলে বিনা বদনামীতে তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।
  6. আল্লাহ্‌র দুশমন আবুজাহাল এবং তারা অপর দুই সাথী আবু সুফিয়ান এবং আখনাস বিন শারীক, এ তিন জন রাতের আঁধারে পৃথক পৃথক ভাবে মক্কার হারামে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখে কোর’আন মাজীদ শুনতে গেল। দ্বিতীয় দিনও শুনল এরপর তৃতীয় দিনও শুনল। তৃতীয় দিন আখনাস বিন শারীক আবু সুফিয়ানের ঘরে গেল এবং জিজ্ঞেস করল যে, বল মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তেলওয়াতকৃত বাণী সম্পর্কে তোমার কি অভিমত? আবু সুফিয়ান নির্দ্বিধায় বলে ফেলল এটা কোন মানুষের মুখের বাণী হতে পারে না। আখনাস বলল, আমারও একই অভিমত, এরপর আখনাস আবু জাহালের নিকট গেল এবং জিজ্ঞেস করল মোহাম্মদের তেলওয়াতকৃত বাণী কেমন? আবুজাহাল বলল, আমাদের বংশ এবং বনী আবদে মানাফের সাথে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিযোগীতা চলছে, নেতৃত্ব এবং উদারতায় আমরা উভয়ে সমান, এখন তারা দাবী করছে যে, আমাদের বংশে নবী জন্মগ্রহণ করেছে। এর প্রতিরোধ আমরা কিভাবে করব? তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা কখনো তার প্রতি ঈমান আনব না।
  7. হাবশায় হিযরত করার সময় আবু বকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু)ও হিজরত করার ইচ্ছা পোষণ করে বের হয়েছিলেন, কিন্তু ইবনে দাগীনা তাকে মক্কায় ফিরিয়ে আনল এবং মক্কার হারামে এসে আবু বকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নিরাপত্তা দেওয়ার ঘোষণা দিল। কোরাইশ সর্দাররা বলল, ‘ইবনে দাগিনা! আমরা তোমার নিরাপত্তা দেওয়াকে ভঙ্গ করছি না, কিন্তু তুমি আবু বকরকে বলে দাও যে, সে যেন ঘরের ভিতরে থেকে নামায আদায় করে এবং কোর’আন তেলওয়াত করে। সে যদি উঁচু কণ্ঠে নামায আদায় করে এবং কোর’আন তেলওয়াত করে তাহলে আমাদের বাচ্চারা এবং মহিলারা ফেতনায় পড়ে যাবে। আবু বকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু) কিছু দিন নিচু আওয়াজে কোর’আন মাজীদ তেলওয়াত করলেন, এরপর আবার উঁচু আওয়াজে কোর’আন তেলওয়াত করতে শুরু করলেন। যখন তিনি উঁচু আওয়াজে কোরআন তেলওয়াত করতেন তখন মোশরেকদের বাচ্চা, বৃদ্ধবনিতা কোর’আন শোনার জন্য একত্রিত হয়ে যেত, এতে মক্কার মোশরেকরা পেরেশান হয়ে গেল। ইবনে দাগিনাকে ডেকে তার নিকট অভিযোগ করল। ইবনে দাগিনা আবুবকর (রযিয়াল্লাহু আনহু)-কে উঁচু আওয়াজে কোর’আন তেলওয়াত করতে নিষেধ করল। তখন আবুবকর (রযিয়াল্লাহু আনহু) ইবনে দাগিনাকে তার দেওয়া নিরাপত্তা ফেরত দিল এবং বলল, আমি তোমার দেওয়া নিরাপত্তা তোমাকে ফেরত দিলাম এবং আল্লাহ্ দেওয়া নিরাপত্তায় আমি সন্তুষ্ট। (বোখারী)
  8. নবুয়তের পঞ্চম বছরের ঘটনা। একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হারামে বসে উচ্চ স্বরে সূরা নজম তেলওয়াত করছিলেন, শ্রবণকারীদের মধ্যে মুসলমান কাফের উভয়েই উপস্থিত ছিল। কোরআন মাজীদের প্রতিক্রিয়ার এ অবস্থা ছিল যে, সমস্ত শ্রোতারা পিনপতন নিরব হয়ে কোরআন মাজীদ শুনছিল; সূরা তেলওয়াত শেষ করে যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেজদা করছিলেন তখন সমস্ত শ্রোতারা নিজেদের অজান্তেই সিজদা করে ফেলেছিল, কাফেরদের একথা স্মরণই ছিল না যে, তারা কি করছে। সেজদা করার পর কাফেররা তাদের এ কর্মের জন্য লজ্জিত হল। কোরআন মাজীদ তেলওয়াতের এ অলৌকিক প্রতিক্রিয়া তো ছিল আরবীভাষীদের উপর, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ার আরো আশ্চর্যজনক দিক হল যে এ কোর’আন আরবদের উপর যেমন প্রভাব ফেলে এমনিভাবে অনারবদের মন মস্তিষ্কের উপরও যথেষ্ট প্রভাব ফেলার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে।

কোর’আন মাজীদের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার রাষ্ট্র প্রধান খরোশিফের এ ঘটনাটি পাঠকদেরকে অভিভূত করবে যে, মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান জামাল আবদুন নাসের রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান খরোশীফের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গেল। আর সাথে করে মিশরের প্রখ্যাত ক্বারী আবদুল বাসেতকেও নিয়ে গেল। সাক্ষাতে জামাল আবদুন নাসের কারী আবদুল বাসেতকে পরিচয় করিয়ে দিল এবং তার মুখ থেকে কালামুল্লাহ্ (আল্লাহ্‌র বাণী) শোনার জন্য নিবেদন করল। খরোশীফ বলল, আমি তো আল্লাহকেই মানি না, তাহলে তাঁর বাণী কি করে শোনব? নাসেরের বারংবারের নিবেদনে খোরশীফ কোর’আন শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করল। কারী আবদুল বাসেত সূরা ত্বা-হার ঐ আয়াতসমূহ তেলওয়াত করতে লাগল যা শ্রবণে ওমার (রযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করে ছিলেন। সূরা ত্বা-হার তেলওয়াত শুনে খোরশীফের চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। তেলওয়াত শেষ হলে নাসের খোরশীফকে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো আল্লাহকে মানেন না তাহলে আপনার চোখ কেন অশ্রুসজল হল? খোরশীফ বলল, আমি সত্যিই আল্লাহকে মানি না কিন্তু এ বাণী শোনে অশ্রু নিয়ন্ত্রন করতে পারি নি, তার কারণ আমি বুঝতে পারছি না।[৩]

খোরশীফ সত্যিই দুর্ভাগ্যবান মানুষ ছিল, তার মন মস্তিষ্কে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাই সে তা বিবেচনা করার চিন্তাও করে নি, যে তার চোখে পানি আসার কারণ কি? কিন্তু এ ধরণের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যে, লোকেরা কুফরী অবস্থায়ও কোর’আন মাজীদের অর্থ না জেনেই শুধু তেলওয়াত শুনেই চোখে পানি এসে গেছে, তার অন্তরে ঢেউ সৃষ্টি হয়ে গেছে, মনমস্তিষ্ক জয় হয়ে গেছে, এরপর তখনই মস্তিষ্ক তৃপ্তি লাভ করেছে যখন ইসলাম গ্রহণ করেছে।

ঈমানদারদের বিষয়টি তো ভিন্ন যে, মক্কা এবং মদীনার হারামে রামযান মাসে কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদের নামাযে) কোন অতিরঞ্জন ছাড়াই বলা যায় যে, হাজার নয় বরং লক্ষ লক্ষ মুসলমান উপস্থিত থাকে যাদের মধ্যে কোরআন মাজীদের আয়াতের অর্থ বুঝার মত লোক কমই থাকে। কিন্তু ইমামগণের সুললিত কণ্ঠে যখন কোর’আন শুনে তখন চোখে অশ্রু ঝরতে থাকে, মনে দুনিয়ার সুখ সমৃদ্ধির কথা থাকে না, কান্না থামানো যায় না। আর যারা কোরআন মাজীদ বুঝে তেলওয়াত করে তাদের বিষয়টি তো আরো ভিন্ন, তেলওয়াত করার সময় তাদের মন এত নরম হয় যে শব্দের উচ্চারণ করতে অনেক সময় তাদের কষ্ট হয়। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়, অন্তর নরম হয়ে যায়, তেলওয়াত শোনার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়, মন-মানসিকতা এমন হয় যে, মানুষ দুনিয়ার চাওয়া পাওয়া থেকে একেবারেই বিমুখ হয়ে যায়। মক্কার হারামের ইমাম শেখ সউদ আশ-শুরাইমের (হাফিযাহুল্লাহ্) পেছনে নামায আদায়কারীরা জানে যে, নামাযে সূরা তেলওয়াত করার সময় তাঁর অবস্থা এই হয় যে, কোন কোন সময়ে তিনি সূরা ফাতেহার তেলওয়াত পূর্ণ করতে পারেন না, কণ্ঠ নিচু হয়ে যায়, নিজের অজান্তেই কান্নায় ভেংঙ্গে পড়েন। এটাই ঐ চেলেঞ্জ যা কোরআন মাজীদে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত জ্বিন ও ইনসানকে দেয়া হয়েছে, যদি তোমরা এটা বুঝ যে, কোরআন মাজীদ মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্বরচিত তাহলে তোমরাও এ ধরণের একটি সূরা বা কমপক্ষে একটি আয়াত রচনা করে দেখাও যা পাঠ করে মৃত অন্তর জাগ্রত হবে, যা শ্রবণে চোখ অশ্রুসজল হবে, শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাবে, অন্তর নরম হয়ে যাবে, যা মানুষের মন থেকে দুনিয়ার চাওয়া পাওয়ার চিন্তাকে দূর করে দিবে, যা বারবার তেলওয়াত করলে তেলওয়াত করার বা শ্রবণ করার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পাবে, মানুষের অন্তর তার অজান্তে বলে উঠবে যে এ বাণীতো শুধু আমার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে, এর অপেক্ষায়ই আমি ছিলাম, এটা ব্যতীত আমার জীবন বৃথা ছিল, এর প্রতি ঈমান এনে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য খোঁজে পেয়েছি।

কোরআন মাজীদের সাহিত্যিকতা ছাড়াও তার বিস্ময়কর আরো অনেক দিক রয়েছে[৪], আর এর প্রতিটিই চেলেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। এসমস্ত বিশ্বয়কর বিষয়সমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বয়কর বিষয় হল এই যে, অল্পবয়সী বাচ্চাদের পরিপূর্ণ কোরআ’ন এমনভাবে মুখস্ত করে নেয়া যে, কোথাও একটি যের, যবর, পেশের ত্রুটি থাকে না, এথচ এবাচ্চা স্পষ্ট আরবীতো দূরের কথা সাধারণ আরবী শব্দসমূহের অর্থ সম্পর্কেও অবগত নয়, ঐ বাচ্চাকে যদি তার মাতৃ ভাষার কোন বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা মুখস্ত করতে দেয়া হয়, তাহলে সেতা মুখস্ত করতে পারবে না, আর যদি মুখস্ত করেও তাহলে বেশি দিন পর্যন্ত তা মুখস্ত রাখতে পারবে না। অথচ কোরআন মাজীদ মুখস্তকারী হাফেজরা আজীবন তা পড়ে এবং পড়ায়, তা শুনে এবং শোনায়।[৫]

অল্প বয়সে, দশ বার বছর বয়সে কোরআন মাজীদ মুখস্ত করে নেওয়া তো সাধারণ বিষয়, কিন্তু এর চেয়েও কম বয়সে কোর’আন মাজীদ মুখস্ত করার উদাহরণও রয়েছে।[৬]

অল্প বয়স ছাড়াও বয়স্ক হয়ে কোরআন মাজীদ মুখস্ত করার উদাহরণও আছে, অথচ এ বয়সে মুখস্ত শক্তি লোপ পেতে থাকে।[৭] পরিশেষে কি কারণ আছে যে, আজ পৃথিবীতে তাওরাত, ইঞ্জিলের অনুসারীও যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু এদের মধ্যে তাওরাত বা ইঞ্জিলের হাফেজ একজনও নেই, অথচ কোরআন মাজীদের হাফেজ কোন অতিরঞ্জন ছাড়া বলা যেতে পারে যে, কোটি কোটি। মন ও মস্তিষ্কে এত সহজে রেখাপাতকারী এবং মুখস্ত হওয়ার উপযুক্ত আয়াত যদি কেউ তৈরী করতে পারে তাহলে তৈরী করে দেখাক। ইহুদী স্কলার ডক্টর আনীস যে, ‘ফোরকানুল হক’ লিখেছে তার প্রথম শব্দটিই এত অসমাঞ্জস্য এবং অস্পষ্ট যে, তা সহজে মুখে উচ্চারণ করা যায় না এবং মানবিক স্বভাবও তা গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়।[৮] মূলত কাফেরদের কোর’আনের সাথে দুশমনীর মূল কারণ, এ চেলেঞ্জটি যা ১৪ শত বছর থেকে তাদেরকে অপারগ এবং লা-জওয়াব করে রেখেছে। হিংসা ও বিদ্বেষের কারণে তারা সবসময় অস্থিরতায় ভোগছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না, যার বহিঃপ্রকাশ তাদের মৌখিক ঠাট্টা বিদ্রূপের মাধ্যমে হয়ে থাকে; আবার কখনো কখনো কোরআন মাজীদকে বাস্তবে অবমাননা এবং বেয়াদবীর মাধ্যমেও করে থাকে।

অতএব, কোন মুসলমানের ‘ফোরকানুল হক’ বা অনুরূপ কোন লিখনী দেখে এ ভুলে পতিত হওয়া ঠিক হবে না যে, কোরআন মাজীদে দেয়া চেলেঞ্জ গ্রহণ করা হয়েছে, বা তার গুরুত্ব কমে গেছে, ঐ চেলেঞ্জ আজও আলহামদুলিল্লাহ্ ঐ ভাবেই বিদ্ধমান আছে যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে বিদ্ধমান ছিল এবং কিয়ামাত পর্যন্ত এভাবেই বিদ্ধমান থাকবে।

لَّا يَأۡتِيهِ ٱلۡبَٰطِلُ مِنۢ بَيۡنِ يَدَيۡهِ وَلَا مِنۡ خَلۡفِهِۦۖ تَنزِيلٞ مِّنۡ حَكِيمٍ حَمِيدٖ ٤٢

অর্থ, ‘কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না—অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়, এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসার্হ আল্লাহ্‌র নিকট হতে অবতীর্ণ। (সূরা হা-মীম সাজদাহ/ফুসসিলাত-৪২)।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বিস্তারিত দেখুন, ইরানী ইনকিলাব, ইমাম খোমেনী, মাওলানা মোহাম্মদ মানজুর নো’মানী লিখিত শিয়িয়ত। প্রকাশক— আল ফোরকান বুক ডিপো, লক্ষ্ণৌ পৃ. ২৭৮।
  2. http://dialspace.dial.pipex.com/park/geq96/origianal/muslimoon.htm
  3. উর্দূ ডাইজেষ্ট, মার্চ ২০০৬।
  4. কোরআন মাজীদের অন্যান্য বিস্ময়কর বিষয়সমূহের মধ্যে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত— (১) কোর’আন মাজীদে বর্ণিত ঐ সমস্ত কথাবার্তা যা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে; (২) অতীত জাতিদের অবস্থা যা আজও কেউ মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারে নি; (৩) বৈজ্ঞানিক দর্শন যা আজও কেউ মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে নি আর ভবিষ্যতেও পারবে না; (৪) গায়েবের খবর সমূহ যেমন— দাব্বাতুল আরয (মাটি থেকে প্রাণীর আগমন), ইয়াজুজ মাজুজের আগমন।
  5. আলহামদুলিল্লাহ্ লিখকের সম্মানিতা মা কোন উস্তাদ ব্যতীতই শৈশবে কোর’আন মাজীদ মুখস্ত করেছেন, আজীবন সন্তানদেরকে কোরআন মাজীদ শিক্ষা দিয়ে জীবনাতিক্রম করেছেন। আজ ৯০ বছর বয়সেও প্রতিদিন তিন পারা করে তেলওয়াত করার অভ্যাস চালু রেখেছেন।
  6. ইসলামাবাদের মাদরাসা ফারুকীয়ায় চীনের একজন শিশু পাঁচ বছর বয়সে কোরআন মাজীদ মুখস্ত করতে শুরু করেছে এবং সাত বছর বয়সে— আলহামদুলিল্লাহ্, পূর্ণ কোরআন মাজীদ মুখস্ত করে নিয়েছে। (তাকভীর ২০ নভেম্বর ২০০২ইং।)
  7. লেখকের সম্মানিত পিতা হাফেজ ইদরীস কীলানী (রাহিমাহুল্লাহ্) ৫৯ বছর বয়সে— আলহামদুলিল্লাহ্, দু’ বছরে কোরআন মাজীদ মুখস্ত করেছেন, বয়স্ক হয়ে কোরআন মাজীদ মুখস্ত করারও অনেক উদাহরণ রয়েছে।
  8. উল্লেখ্য ‘ফোরকানুল হকের’ প্রথম সূরা ফাতেহার শুরু নিন্মোক্ত বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে—(অর্থ) আমি শুরু করছি বাপের নামে, কালিমার নামে এবং রুহুল কুদুসের নামে যে শুধু একমাত্র ইলাহ।