১. শিরকী দিক—

 ফোরকানুল হকের প্রতিটি সূরার শুরু নিম্নোক্ত বাক্যের দ্বারা শুরু হয়েছে। (অর্থ) আমি শুরু করছি বাপের নামে, কালিমার নামে এবং রুহুল কুদুসের নামে যে শুধু একমাত্র ইলাহ। এটাই তত্ত্ববাদের আক্বীদা (বিশ্বাস) যা এত অস্পষ্ট এবং বুঝার অনুপযুক্ত যে, আজও কোন বড় খৃষ্টান আলেমও এর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে নাই।

২. আল্লাহ্‌র অবমাননা—

 ফোরকানুল হকের বিভিন্ন স্থানে কোর‘আন মাজীদ এবং বিধি-বিধানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’লাকে মারাক্তকভাবে অবমাননা করা হয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ এক স্থানে লেখা আছে — (অর্থ) ‘এবং যখন শয়তান বলল, (নাউযুবিল্লাহ্) হে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি তোমাকে আমার রিসালাত এবং ওহীর জন্য সমস্ত লোকদের মধ্য থেকে বাছাই করেছি, অতএব, আমি তোমাকে যা দিচ্ছি সে অনুযায়ী আমল কর, আর আমার নে’মতসমূহকে স্মরণ কর এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ কর। (সূরা আল গারানিক-৯)। উল্লেখ্য সূরা আ’রাফের ১৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা মূসা (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন— قَالَ يَٰمُوسَىٰٓ إِنِّي ٱصۡطَفَيۡتُكَ عَلَى ٱلنَّاسِ بِرِسَٰلَٰتِي وَبِكَلَٰمِي فَخُذۡ مَآ ءَاتَيۡتُكَ وَكُن مِّنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ١٤٤ — অর্থ, ‘আমি তোমাকেই আমার রিসালাত ও আমার সাথে বাক্যালাপের জন্য লোকদের মধ্যে হতে মনোনীত করেছি, অতএব, এখন আমি তোমাকে যা কিছু দেই তা তুমি গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।’

৩. নবীগণের অপমান—

 নবীগণের সাথে ঠাট্টা বিদ্রুপ, তাদেরকে অবমাননা, তাদেরকে হত্যা করা ইহুদীদের এমন এক অপরাধ যার কথা কোরআন মাজীদে বারবার বর্ণনা করা হয়েছে, আর এর একটি জীবন্ত উদাহরণ ফোরকানুল হক। যার একটি আয়াত এই— ‘আর যখন মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানের সাথে একাকী হল, তখন বলল, আমি তোমার সাথে আছি, অতএব মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে পরিত্যাগ করে শয়তানকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করল।’ (সূরা আল গারানিক-৮)। অন্য এক স্থানে লেখা হয়েছে—‘এক নিরক্ষর কাফের ব্যক্তি (নাউজুবিল্লাহ্) নিরক্ষরদেরকে শিক্ষা দিয়েছে ফলে তাদের অজ্ঞতা এবং মূর্খতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।’ (সূরা আশশাহাদাত-৪)।

৪. জিবরীল (আ.) এর অবমাননা—

কোরআন অবতীর্ণের সময়কাল থেকেই আহলে কিতাব (ইহুদী-নাসারারা) জিবরীল (আ.)-এর দুশমন ছিল। তাদের দাবী হল জিবরীল (আ.) ইসহাকের বংশ ছেড়ে ইসমাঈলের বংশে কেন গেল? তাই তারা ফোরকানুল হকে নিজেদের হিংসা ও বিদ্বেষের কথা এভাবে প্রকাশ করেছে। — ‘মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট মিথ্যা ও চক্রান্তমূলক ওহী করা হয়েছে যা শয়তান তার নিকট নিয়ে এসেছে।’ (সূরাতুল গারানিক-১৫)। এ শয়তানী আয়াতে জিবরীল (আ.)-কে শয়তান (নাউযু বিল্লাহ্) এবং কোরআনুল কারীমকে মিথ্যা এবং চক্রান্ত বলে আক্ষ্যায়িত করা হয়েছে (নাউযু বিল্লাহ্)।

৫. জিহাদ হারাম—

 নিঃসন্দেহে জিহাদ শব্দটি আজ সমগ্র বিশ্বে কাফেরদের জন্য জীবন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, জিহাদ কাফেরদের ঘুমকে হারাম করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ফোরকানুল হক লেখার মূল উদ্দেশ্যই হল মুসলমানদেরকে জিহাদ থেকে নিরুৎসাহিত করা।

এ সম্পর্কে কিছু ইবলীসী অনর্থক কথাবার্তা দেখুন—‘তারা আমাদের দিকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে যে আমি মুমেনদের কাছ থেকে জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জীবন ক্রয় করে নিয়েছি, আর আমার পথে যুদ্ধ করবে, ইঞ্জিলের আলোকে এ অঙ্গিকার পূর্ণ করা আমার দায়িত্ব, সাবধান হও, এ ধরনের অপবাদ দাতারা মিথ্যুক।’ পরে আরো বলা হয়েছে— ‘আমি পাপিষ্ঠদের জীবন ক্রয় করি না, পাপিষ্ঠদের জীবন মারদুদ শয়তান ক্রয় করে।’

আরো একটি উদাহরণ— ‘তোমরা কি ধারণা করছ যে, আমি বলেছি, আল্লাহ্‌র পথে যুদ্ধ কর আর মুমেনদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত কর[১], অথচ আমার পথে কোন যুদ্ধ নেই, আর না আমি মুমেনদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছি। বরং পাপিষ্ঠদেরকে মারদুদ শয়তান যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছে। (নাউযুবিল্লাহ্) (সূরা আল-মাওয়েজা-২)।

অন্য এক স্থানে লিখেছে— ‘আর বিজয়ী হয়ে গেছে (আহলে কিতাবদের জান্নাত) মুসলমানদের ঐ জান্নাতের উপর যার অঙ্গীকার তাদের সাথে করা হয়েছে এবং যার জন্য তারা আনন্দ এবং সুস্বাদ অনুভব করে, ঐ পথে জীবন দেয়, মূলত সেটা ব্যভিচারী এবং পাপিষ্ঠদের জান্নাত। (সূরা রূহ-৩)।

৬. গণীমতের মালের নিন্দা—

জেহাদের মাধ্যমে অর্জিত গণিমতের মালের বিষয়টিও কাফেরদের জন্য বেদনাদায়ক, এটাকে তারা কোথাও ডাকাতি, কোথাও চুরি, কোথাও লুট, কোথাও জুলম বলে আখ্যায়িত করেছে। শুধু একটি উদাহরণ দেখুন— ‘আর তোমাদেরকে বলা হয়েছে যারা আল্লাহ্ প্রতি ঈমান রাখে না তাদের সাথে যুদ্ধ কর, আর গণিমতের মাল হিসেবে যা পাও তা ভক্ষণ কর, তা হালাল এবং পবিত্র, এটা জালেমদের কথা।’ (নাউজুবিল্লাহ্) (সূরা আল- আতা-৭)।

৭. কোরআন মাজীদের অবমাননা—

ইহুদী নাসারারা মৌখিক এবং লিখিত কোন পন্থা অবলম্বন করতে কোন প্রকার ত্রুটি করে নি, ফোরকানুল হকের ইবলিসী কথা বার্তা তার মুখ দিয়ে বের হয়েছে বলে এক স্থানে প্রমাণিত হয়েছে, তাই সে একস্থানে লিখেছে— ‘হে লোকেরা! তোমাদের নিকট শয়তানের পথভ্রষ্টমূলক আয়াত পড়ে শোনানো হচ্ছে, যাতে করে সে তোমাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যেতে পারে, অতএব, তোমরা শয়তানের নিদের্শ অনুসরণ করবে না এবং তাকে তোমাদের নিকৃষ্ট দুশমন হিসেবে জান।’ (সূরা আল-আতা-১৫)

৮. কোরআন মাজীদে পরিবর্তন—

আহলে কিতাবদের মধ্যে আসমানী কিতাবসমূহে পরিবর্তনের একটি স্বাভাবিক অপরাধ পরায়ণতা আছে। তাওরাত এবং ইঞ্জিলের পর কোরআন মাজীদে তারা নিকৃষ্টতম পরিবর্তনের অপরাধে লিপ্ত হয়েছে, শাব্দিক পরিবর্তনে উদাহরণ তো পাঠ করা ইতিপূর্বে দেখেছেন, আর বিধি-বিধানে পরিবর্তনের একটি উদাহরণ আমরা এখানে পেশ করলাম— ‘তোমরা আমার প্রতি মিথ্যারোপ করেছ যে, আমি নিষিদ্ধ মাসসমূহে যুদ্ধ হারাম করেছি, আমি যা হারাম করেছিলাম তা আমি রহিত করে দিয়েছি, অতএব, এখন আমি হারাম মাসসমূহে বড় যুদ্ধ করা হালাল করে দিয়েছি।’ (সূরা আস্‌সালাম-১১)

৯. মুসলমানদের সাথে শত্রুতা—

ফোরকানুল হকে মুসলমানদেরকে কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে পথভ্রষ্ট লোকেরা’ (সূরা আস্সালাম-১); আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে কাফেররা’ (সূরা তাওহীদ)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে মুনাফেকরা’ (সূরা মাসীহ্-১)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে মোশরেকরা’ (সূরা সালুস-১)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে অপরাধীরা’ (সূরা আল মাওয়েজা-১)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে মিথ্যা আরোপকারীরা’ (সূরা আল ইফক-১৭)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে অজ্ঞ লোকেরা’ (সূরা আল খাতাম-১)। আবার কোথাও বলা হয়েছে— ‘হে পরিবর্তনকারীরা’ (সূরা আল আসাতীর-১)।

আর আহলে কিতাবদেরকে সর্বত্র — ‘হে ঈমানদাররা।’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, কোরআ’ন মাজীদে যেভাবে বানী ইসরাঈলদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এমনিভাবে ফোরকানুল হকে মুসলমানদের উপর অসংখ্য অপবাদ দেয়া হয়েছে, আর যে, বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি বড় করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা হল এই যে, মুসলমানরা হত্যাকারী, ডাকাত, চোর, সন্ত্রাসী এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী। কিছু উদাহরণ নিচে পেশ করা হল—

ক) ‘তোমরা গীর্জা এবং উপসানালয়সমূহ বিনষ্ট করেছ, যেখানে আমার নাম স্মরণ করা হত, আর তোমরা আমাদের ঐ মোমেন বান্দাদের উপসানালয়সমূহ বিনষ্ট করেছ যারা তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, তোমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করেছে, তোমাদেরকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে, তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করেছ, অতএব, তোমরা যুলুমকারী।’ (সূরা আল আসাত্বীর-৪)।

খ) ‘তোমরা বলেছ, দ্বীনের মধ্যে জবরদস্তি নেই, কিন্তু আমার মুমেন বান্দাদের উপর কুফরী চাপিয়ে দেয়ার জন্য জবরদস্তি করছ, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে সে নিরাপত্তা লাভ করেছে, আর যে ব্যক্তি সত্য দ্বীনের উপর অটল ছিল তাকে পাপিষ্ঠদের ন্যায় হত্যা করা হয়েছে।’ (সূরাতুল মূলুক-১)

গ) ‘তোমাদের কর্ম পদ্ধতি, কুফরী করা, শিরক করা, ব্যভিচার করা, যুদ্ধ করা, হত্যা করা, লুটপাট করা, নারীদেরকে বন্দী করা, অজ্ঞতা এবং নাফরমানী করা।’ (সূরা আল কাবায়ের- ৩, পৃ. ২৪৯)।

উল্লেখিত ইবলিসী কথাবার্তাসমূহে যেভাবে মুসলমানদের প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করা হয়েছে ফোরকানুল হকের অধিকাংশ অংশে এ ধরনের ইবলিসী কথাবার্তায় ভরপুর।

১০) সত্য গোপন করা—

আহলে কিতাবদের অপরাধসমূহের মধ্যে একটি অপরাধ হল সত্য গোপন করা, ফোরকানুল হকেও এ উদাহরণ বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। একটি উদাহরণ —

সূরা নিসার মধ্যে আল্লাহ্ তা’লা এরশাদ করেছেন—

 وَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تُقۡسِطُواْ فِي ٱلۡيَتَٰمَىٰ فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تَعۡدِلُواْ فَوَٰحِدَةً أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَلَّا تَعُولُواْ ٣

 অর্থ— ‘তবে নারীদের মধ্যে তোমাদের পছন্দমত দু’টি, তিনটি ও চারটি বিয়ে করো। কিন্তু যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে ন্যায় বিচার করতে পারবে না তবে মাত্র একটি অথবা তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যার অধিকারী (ক্রীতদাসীকে বিয়ে করো) এটা অবিচার না করার নিকটবর্তী।’ (সূরা নিসা-৩)।

ফোরকানুল হকের লেখক কোরআন মাজীদের এ আয়াতটিকে এভাবে লিখেছে— ‘তোমরা বিয়ে কর দু’টি, তিনটি, চারটি, অথবা ক্রীতদাসীদেরকে।’

‘যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে ন্যায় বিচার করতে পারবে না’— এই অংশটুকু বাদ দিয়েছে।

যেখানে একাধিক বিয়ের জন্য অপরিহার্য শর্ত ‘ন্যায় বিচার’ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ন্যায় বিচার ব্যতীত দুই বা তিন বা চার বিয়ের কথা উল্লেখ করে তারা বুঝাল যে, মুসলমানদের শরীয়ত একটি অবিচার মূলক শরীয়ত।

১১) ভালবাসা এবং নিরাপত্তার চক্রান্ত—

ফোরকানুল হকে ইহুদী নাসারাদেরকে ‘হে ঈমানদাররা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।[২] আর ফোরকানুল হকের দিকনির্দেশনাকে ‘সত্য দীন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[৩] এবং বিভিন্ন স্থানে এ দাবী করা হয়েছে যে, ইহুদী নাসারারা ভালবাসা, ন্যায় বিচার, শান্তি ও নিরাপত্তার ধারক ও বাহাক। যেমন— ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি ভালবাসা, দয়া, অনুগ্রহ, ন্যায়বিচার এবং নিরাপত্তার নির্দেশ দিয়ে থাকি।’ (সূরা আল কতল-৩)। অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে— ‘নিশ্চয় দ্বীনে হকই ভালবাসা, ভাতৃত্ব, দয়া ও শান্তির দ্বীন।’ (সূরা আল আজহা-৫)।

ভালবাসা, ভাতৃত্ব, দয়া ও শান্তিরধারকেরা আফগানিস্তান ও ইরাকে সাধারণ জনতার উপর যে ভালবাসা, ভাতৃত্ব, দয়া ও নিরাপত্তার সাথে যেমন আক্রমণ করেছে বা আফগানিস্তান ও ইরাকের জেলসমূহ এবং কিউবার বন্দীশলায় মুসলমান বন্দীদের সাথে যে ভালবাসা, ভাতৃত্ব ও নিরাপত্তামূলক আচরণ করা হচ্ছে তা সমগ্র বিশ্ব অবলোকন করছে।

১২. ফোরকানুল হকের সাম্প্রদায়িকতা

সমগ্র পৃথিবীর সামনে আজ আলোকিত চিন্তা, নিরপেক্ষতা এবং ক্ষমতার বড়াইকারী ‘উন্নত বিশ্ব’ ভিতরে ভিতরে কতটা দলীয় গোঁড়ামীর অন্ধত্ব এবং উন্মাদনায় মত্ত। তার অনুমান ফোরকানুল হকের এ দু’টি লাইন থেকে অনুমান করুন— এক. ‘সত্য ইঞ্জিল এবং সত্য ফোরকানুল হকই সত্য দ্বীন, আর যে ব্যক্তি এ দ্বীন ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন অন্বেষণ করবে তা তার কাছ থেকে কখনো গ্রহণ করা হবে না।’ (সূরা আল জুযিয়াহ-১৩)। দুই. ‘আমি সত্য দ্বীনের কথা স্মরণ করানোর জন্য ফোরকানুল হক অবতীর্ণ করেছি, যা সত্য ইঞ্জিলের সত্যায়নকারী, যাতে করে তাকে অন্যান্য সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারি, যদিও কাফেররা (মুসলমানরা) তা অপছন্দ করে।’ (সূরা আর আযহা-৬)।

দ্বিতীয় আয়াত থেকে শুধু এ কথাই প্রমাণিত হয় না যে, ইহুদী নাসারারা তাদের দলীয় ব্যাপারে কত গোঁড়ামী এবং উন্মাদনায় মত্ত আছে, বরং এ কথাও বুঝা যায় যে, তারা সর্বশক্তি প্রয়োগে ইসলামকে পরাজিত এবং ইহুদী ও নাসারাদেরক বিজয়ী করার দৃঢ় প্রত্যয়ী।

এখন ফোরকানুল হকের আলোকিত চিন্তাসম্পন্ন কিছু দিক নিদের্শনার উল্লেখ এখানে করতে চাই যাতে পাঠকরা বুঝতে পারে যে বর্তমান যুগের আলোকিত চিন্তার মূল উৎস কোথায়?

ক) পর্দা নারীজাতির জন্য একটি লাঞ্ছনা এবং অবমাননা— ‘আল মাহদী’ ফোরকানুল হকে লিখেছে— ‘তোমরা তোমাদের নারীদের মাঝে এ বলে প্রচ্ছন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছ যে, যখন কেউ কোন প্রশ্ন করবে তখন পর্দার আড়াল থেকে প্রশ্ন করবে, আর এটা আমার সৃষ্টিকে লাঞ্ছনা এবং অবমাননা করা।’ (সূরা নিসা-১০)।

খ) নারীদেরকে ঘরে বসিয়ে রাখা অবিচার— ঐ সূরায় পরবর্তীতে লিখা হয়েছে— ‘তোমরা নারীদেরকে তোমাদের একথা দিয়ে বন্দী করে রেখেছ যে,“তোমরা তোমাদের ঘরে থাক” সতর্ক হও ঘরে বসে থাকার নিদের্শ নিকৃষ্ট নিদের্শ, যা জালেমরা দিয়েছে।’ (সূরা নিসা-১১)।

গ) পুরুষদেরকে শাসক নির্ধারণ করা জান্তব এবং হিংস্রতা— ‘তোমরা বল যে পুরুষ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল, আর যে সমস্ত নারীদের ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশঙ্কা করো তাদেরকে উপদেশ দাও, তাদেরকে বিছানা থেকে পৃথক করে দাও, তাদেরকে প্রহার কর, তাহলে মানুষ, বন্য পশু, হিংস্র প্রাণী এবং চতুষ্পদ জন্তুর মাঝে পার্থক্য কি থাকল?’ (সূরা নিসা-৪)।

ঘ) উত্তরাধিকারে নারীকে অর্ধেক সম্পদ দেয়া, দুইজন নারীর সাক্ষীকে একজন পুরুষের সাক্ষীর সমান নির্ধারণ করা সম্পর্কে— ‘তোমাদের শরীয়তে নারী পূরুষের অর্ধেক সম্পদ পায়, কেননা (কোরআনে বলা হয়েছে) পুরুষ নারীর দ্বিগুণ সম্পদ পাবে, তোমাদের শরীয়তে নারীর সাক্ষীও পুরুষের অর্ধেক, কেননা (কোরআনে বলা হয়েছে) যদি দু’জন পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায় তাহলে দু’জন নারী এবং একজন পুরুষ সাক্ষ্য দিবে, তাহলে নারীর উপর পুরুষের একগুণ মর্যাদা বেশি, আর এটা জালেমদের ন্যায় বিচার।’

ঙ) ত্বালাক হারাম— ‘আর আমি বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি ত্বালাক এবং ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হবে না।’ (সূরা আতুহুর-৯)।

চ) ত্বালাকপ্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করা ব্যভিচার এবং কুফর— ‘যে ব্যক্তি কোন তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে বিয়ে করল সে ব্যভিচার করল, আর তার এ কাজটি কুফরী এবং পাপ কাজ।’ (সূরা আত্বালাক-৩)।

ছ) একাধিক বিয়ে ব্যভিচার— ‘তোমরা বলেছ যে বিয়ে করো ঐ সমস্ত নারীদেরকে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয়, দুই, তিন, চারটি পর্যন্ত, অথবা ঐ সমস্ত কৃতদাসীদেরকে যারা তোমাদের অধীনস্ত। একথা বলে তোমরা বর্বরতার অভ্যাস ব্যভিচারের অবর্জনা এবং পাপের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছ, তাই তোমরা পবিত্র হতে পারবে না।’ (সূরা আল মিযান-৯)

জ) নারী পুরুষের পার্থক্য পূর্ণ অধিকারের দুর্নাম— ফোরকানুল হকের ইবলিসী কথাবার্তাসমূহে শুধু বিয়েকে গোলামী হিসেবেই দেখায়নি বরং নারী পুরুষের পার্থক্য পূর্ণ অধিকারকে সরাসরি যুলুম হিসেবেও পেশ করা হয়েছে, যেহেতু পুরুষরা চার জন স্ত্রী রাখতে পারবে তাহলে নারী কেন চার জন স্বামী রাখতে পারবে না।

‘তোমরা নারীদেরকে তোমাদের যৌনকামনা পূরণের মাধ্যম করে রেখেছ। তোমরা যেভাবে খুশি সেভাবে তাকে চাও, কিন্তু নারী তোমাদেরকে যেভাবে খুশী সেভাবে চাইতে পারে না। তোমরা নারীকে যখন খুশী তখন ত্বালাক দিতে পার, অথচ তারা তোমাদেরকে ত্বালাক দিতে পারে না। তোমরা তাদেরকে ভিন্ন করে রাখতে পার, কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভিন্ন করে রাখতে পারবে না। তোমরা তাদেরকে প্রহার করতে পার, কিন্তু তারা তোমাদেরকে মারতে পারবে না। তোমরা একজন নারীর সাথে দু’জন, তিন জন, চার জন বা একজন কৃতদাসী রাখতে পার, কিন্তু তারা দ্বিতীয় স্বামী রাখতে পারে না। তোমরা তাদের উপর কর্তৃত্বশীল, কিন্তু তারা তোমাদের উপর কর্তৃত্বশীল নয়, এমন কি তারা তাদের নিজেদের কোন বিষয়েও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।’ (সূরা নিসা ৮, ৯)।

ঝ) খুনের বদলা খুন একটি ধ্বংসাত্বক কাজ— কোরআন মাজীদে আল্লাহ্ তা’লা বলেছে—

وَلَكُمۡ فِي ٱلۡقِصَاصِ حَيَوٰةٞ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٧٩

অর্থ— ‘হে জ্ঞানবান লোকেরা! (কেসাসের মধ্যে) প্রতিশোধ গ্রহণে তোমাদের জন্য জীবন আছে।’ (সূরা আল বাকারা-১৭৯)।

এর অর্থ হল এই যে, হত্যাকারীকে হত্যার বিনিময়ে হত্যা করতে হবে, অথচ পাশ্চাত্যে কেসাসের (হত্যার বিনিময়ে হত্যাকারীকে হত্যা করা) বিধান না থাকায় আলোকিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে ফোরকানুল হকের লেখক লিখেছে— ‘আমি তোমাদেরকে কেসাসের (হত্যার বিনিময়ে হত্যা করার নিদের্শ) দেই নি, হে জ্ঞানী ব্যক্তিরা তোমাদের জন্য কেসাসে (হত্যার বিনিময়ে হত্যার মধ্যে) রয়েছে ধ্বংস ও বরবাদ।’ (সূরা আল মোহতাদীন -৭)।

ফোরকানুল হকের ইবলিসী কথাবর্তা পড়ার পর এ অনুমান করা দুষ্কর নয় যে, মূলত ইহুদী নাসারারাদের অন্তরে কোরআন মাজীদের বিরুদ্ধে সুপ্ত হিংসা বিদ্বেষ গ্রন্থাকারে বের হয়েছে।

সমস্ত ইবলিসী কথাবার্তা সম্পর্কে আমরা পাঠকদেরকে যেদিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই তা হলো এই যে, আল্লাহ্ তা’লাকে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিবরীল (আ.)-কে (নাউজুবিল্লাহ্ আবারও নাউজুবিল্লাহ্) বার বার শয়তান বলে আখ্যাকারী ইহুদী নাসারা কি মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে? (নাউজু বিল্লাহ্) কোরআন মাজীদেকে শয়তানের আয়াত হিসেবে উল্লেখকারী অভিশপ্ত ইহুদী নাসারারা কি মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে? ফোরকানুল হকের শয়তানী আয়াতসমূহ বিশ্বাসকারী ইহুদী নাসারা এবং কোরআন মাজীদে আল্লাহ্‌র অবতীর্ণ আয়াতসমূহের প্রতি বিশ্বাসকারী মুসলমানদের উদ্দেশ্য কি এক হতে পারে? সূর্য আলোহীন হতে পারে, চাঁদ টুকরা টুকরা হতে পারে, আকাশ বিদীর্ণ হতে পারে, পৃথিবী ফাটতে পারে কিন্তু মুসলমান এবং কাফেরদের মাঝে বন্ধুত্ব হতে পারে না।

উল্লেখ্য, ইহুদী নাসারাদের মুসলমানদের সাথে দুশমনির বিষয়টি প্রাকশিত এ কয়েকটি আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আরো বিস্তৃত।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. আর মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করো। (সূরা আনফালের ৬৫ নং আয়াতে এই কথা বর্ণিত হয়েছে।)
  2. সূরা আল ইঞ্জিল-৬।
  3. সূরা আল আযহা-৫।