কোরআ’ন মাজীদ অবর্তীর্ণের সূত্রপাত হয়েছিল লাইলাতুল কদর, ২১ রমযান, ১০ আগষ্ট ৬১০ খৃষ্টাব্দ, সোমবার।[১]

ঐ সময়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বয়স ছিল চন্দ্র বছর হিসেবে ৪০ বছর, ৬ মাস, ১২ দিন। আর সৌর বছর হিসেবে ৩৯ বছর তিন মাস ২২ দিন।[২]

অহী অবতীর্ণের প্রারাম্ভে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভয়ে থাকতেন যে নাজানি তিনি অহীর কথাগুলো ভুলে যান, জিবরীল (আ.)-এর সাথে সাথে অহীর কথগুলো বার বার দোহরাতেন, ফলে আল্লাহ্ এ নির্দেশ দিলেন যে,

لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ ١٦

অর্থ: “তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত অহী আবৃত্তি করবেন না।” (সূরা ক্বিয়ামা-১৬)

সাথে সাথে এ নিশ্চয়তাও দিলেন যে, এ অহী স্মরণ রাখা এবং পড়ানো আমার দায়িত্ব। আল্লাহ্‌র বাণী:

إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ ١٧ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ١٨

অর্থ: “এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব, অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি তখন আপনি ঐ পাঠের অনুসরণ করুন। (সূরা কিয়ামা-১৭,১৮)

আল্লাহ্‌র এবাণী থেকে একথা পরিষ্কার ভাবে স্পষ্ট হয় যে, কোরআন মাজীদের এক একটি আয়াত, এক একটি শব্দ স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্তরে সংরক্ষিত করে দিয়ে ছিলেন। আরো সতর্কতার জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি বছর রমযান মাসে কোরআন মাজীদের ততটুকু শোনাতেন যতটুকু অবতীর্ণ হয়েছিল। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ঐ বছর জিবরীল (আঃ) কে দু’বার কোরআ’ন শুনিয়েছেন। যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্তরে কোরআন মাজীদ এমনভাবে সংরক্ষিত ছিল যে সামান্য ভূল ত্রুটি বা সামান্য হেরফেরের কোন প্রকার কোন সম্ভবনা ছিল না।

সাহাবা কেরামগণের মাঝে শিক্ষিত অশিক্ষিত সর্বপ্রকার লোকই ছিল, শিক্ষিত লোকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল, তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোরআ’ন সংরক্ষণের জন্য কোরআ’ন মুখস্ত করা এবং লিখিত ভাবে রাখা উভয় পদ্ধতিই তিনি অবলম্বন করেছেন।

উভয় পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নীচে উল্লেখ করা হল:

কোরআ’ন মুখস্ত করা:

কোরআ’ন মাজীদের অবতীর্ণ যেহেতু শাব্দিক ভাবে হয়েছিল অতএব জিবরীল (আ.) শব্দ এবং আয়াতের ধারাবাহিকতার সাথে সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তার বিশুদ্ধ উচ্চারণও শিখাত, আর ঐ শাব্দিক ভাবেই উম্মত পর্যন্ত পৌঁছানো জরুরী ছিল, তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সার্বিক প্রচেষ্টা কোরআ’ন মুখস্ত করার ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন।

মদীনায় হিযরত করার পর তিনি সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেছেন, এরপর মসজিদের এক পাশে সামান্য উঁচু করে “সুফ্‌ফা” তৈরী করে তাকে মাদ্রাসায় রূপ দিয়েছেন, যেখনে উস্তাদগণ তাদের ছাত্রদেরকে কোরআ’ন শিক্ষা দিত। ওবাদা বিন সামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: যখন কোন ব্যক্তি হিজরত করে মদীনায় আসত তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে আমাদের আনসারদের মধ্য থেকে কারো নিকট পাঠিয়ে দিতেন, যেন তাকে কোরআ’ন শিখানো হয়। মসজিদ নববীতে কোরআ’ন মাজীদ তেলাওয়াত করা এবং শিক্ষা দেয়ার আওয়াজ এত বেশি হত যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন যে, হে লোকেরা তোমরা তোমাদের আওয়াজ সংযত রাখ।

কোরআন মুখস্ত করার প্রতি তাড়াহুড়া এবং বেশি গুরুত্ব দেয়ার দ্বিতীয় কারণ এই যে, আরবদের ছিল যথেষ্ট মুখস্ত শক্তি, যারা তাদের বংশধারাতো বটেই এমনকি তারা তাদের ঘোড়ার বংশধারাও পরিষ্কার করে জানত।

কোরআ’ন মুখস্তের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার তৃতীয় কারণ ছিল এই যে, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নামাযে কিছু না কিছু তেলওয়াত করা অপরিহার্য, ফরয নামায ব্যতীত নফল নামায, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযের ফযিলত সাহাবা কেরামগণের মাঝে কোরআ’ন মুখস্তের আগ্রহকে আরো বৃদ্ধি করেছে।

রমযান মোবারকের পূর্ণ মাস কোরআ’ন মাজীদ তেলওয়াত, শ্রবণ, মুখস্ত, শিখা, শিখানোর বিশেষ সময়, এতদ্ব্যতীত কোরআন মাজীদের অসংখ্য ফযিলত এবং কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রেখে কোরআন মুখস্ত করার ব্যাপারে সাহাবা কেরামগণ একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী থাকার জন্য চেষ্টা করত।

৪র্থ হিযরীতে বিরে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনায় ৭০ জন সাহাবীর ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে তারা সবাই ভাল কোরআ’ন তেলওয়াতকারী ছিল, তারা দিনের বেলায় কাঠ কেটে আহলে সুফ্‌ফার লোকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করত এবং কোরআন শিখত ও শিখাত, আর রাতে আল্লাহ্‌র নিকট দোয়া করা ও নামায আদায়ে ব্যস্ত থাকত।[৩]

সাহাবা কেরামগণের এ আগ্রহের ফলাফল এই ছিল যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায়ই হাফেযগণের একটি বড় দল গড়ে উঠেছিল, ঐদলের মধ্যে আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু), ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু), ওসমান গনী (রযিয়াল্লাহু আনহু), আলী (রযিয়াল্লাহু আনহু), তালহা (রযিয়াল্লাহু আনহু), সা’দ (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রযিয়াল্লাহু আনহু), হুযাইফা বিন ইয়ামান (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবু হুযাইফা (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর গোলাম সালেম (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবু হুরাইরা (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন ওমার (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রযিয়াল্লাহু আনহু), আমর বিন আস (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন আমর (রযিয়াল্লাহু আনহু), মোয়াবীয়া (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন যুবাইর (রযিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ্ বিন সায়েব (রযিয়াল্লাহু আনহু), আয়শা (রাযিয়াল্লাহু আনহা), হাফসা (রাযিয়াল্লাহু আনহা), উম্মু সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-গণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য।[৪]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর সাথে সাথেই ১১ হিযরীতে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০ হাফেযে কোরআ’নের শাহাদাত বরণ একথা স্পষ্ট করে প্রমাণ করে যে ঐ সময় পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ হাফেয গড়ে উঠেছিল, মুখস্ত করার মাধ্যমে কোরআন মাজীদ সংরক্ষণের এ ধারা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্ধমান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা চালু থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।

কোরআন লিখন:

কোরআন মুখস্ত করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া সত্বেও কোরআন লিখে রাখার গুরুত্বের কথা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোটেও ভুলে যান নি। এ উদ্দেশ্যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষিত সাহাবাগণকে এ দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন যে, ওহী নাযিল হওয়া মাত্রই তারা তা লিখে রাখবে। যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর নিদৃষ্ট ওহীর লিখক ছিল, এছাড়াও সরকারী অন্যান্য বিষয়াবলী লিখে রাখার দায়িত্বও তার ছিল। স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বিদেশী ভাষা শিখার এবং লিখার জন্য দিক নিদের্শনা দিয়ে ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখ যোগ্য ওহী লিখকগণের নাম নিম্ন রূপ:

  1. আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  2. ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  3. ওসমান (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  4. আলী (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  5. ওবাই বিন কা’ব (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  6. যুবাইর বিন আওয়াম (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  7. মোয়াবিয়া বিন সুফিয়ান (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  8. মুগীরা বিন শো’বা (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  9. খালেদ বিন ওলীদ (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  10. সাবেত বিন কায়েস (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  11. আবান বিন সাঈদ (রযিয়াল্লাহু আনহু);
  12. আবদুল্লাহ্ বিন সাঈদ বিন আস (রযিয়াল্লাহু আনহু)।[৫]

জাহেলিয়াতের যুগেও লিখক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নির্দেশ দিয়ে রেখে ছিলেন যে, সে যেন সাহাবা কেরামগণকে লিখা শিখায়, বলা হয়ে থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে ওহী লিখকগণের সংখ্যা ৪০ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে ছিল।[৬]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, যখনই কোরআ’ন কারীমের কোন আয়াত অবতীর্ণ হত তখন তিনি ওহী লিখকদেরকে পরিপূর্ণভাবে নির্দেশ দিতেন যে, এ আয়াতটি ওমুক ওমুক সূরায় ওমুক ওমুক আয়াতের পরে লিখ, তখন ওহী লিখকগণ পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, গাছের পাতা, হাড্ডি বা কোন কিছুর উপর লিখে রাখত, এভাবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে কোরআন কারীমের এমন একটি কপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের তত্ত্বাবধানে লিখিয়েছেন। এছাড়াও অনেক সাহাবী এমন ছিলেন যে, তারা নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহে কোন কোন সূরা বা আয়াত নিজের নিকট লিখে রাখত, যেমন ওমার (রযিয়ল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতি একটি পুস্তিকায় সূরা ত্বা-হা এর কিছু আয়াত লিখে রেখেছিল, তাই বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অগোছানো ভাবে ১৭টির অধিক মোসহাফের (কোরআ’নের কপি) সন্ধান পাওয়া যায়।[৭]

লিখনীর মাধ্যমে কোরআন সংরক্ষণের ধারা আজও মুখস্তের মাধ্যমে কোরআ’ন সংরক্ষণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণে শুধু জারিই নেই বরং তা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, মোটামুটি শতাধিক ভাষায় কোরআন মাজীদের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, শুধু মদীনায় প্রতিষ্ঠিত “বাদশাহ ফাহাদ আল কোরআ’ন একাডেমী” থেকে প্রতি বছর ২কোটি ৮০ লক্ষ কোরআন মাজীদের কপি ছেপে বিশ্ব ব্যাপী বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। (তাঁকে আল্লাহ্ ইসলাম এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন)।

উল্লেখ্যঃ প্রেস আবিষ্কারের পরে সর্বপ্রথম ১১১৩ হি. জার্মানীর হামবুর্গ প্রেসে কোরআন মাজীদ ছাপানো হয় যার একটি কপি আজও দারুল কুতুব মিশরিয়াতে বিদ্ধমান আছে।[৮]

আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়ল্লাহু আনহু)-এর যুগে কোরআন মাজীদ একত্রিত করণ:

ইয়ামামার যুদ্ধে যখন হাফেজগণের একটি বড় দল শহিদ হয়ে গেল তখন সর্বপ্রথম ওমার ফারুক (রযিয়ল্লাহু আনহু) কোরআ’ন মাজীদ লিখিত ভাবে একত্রিত করার প্রয়োজন অনুভূত করেন, তাই তিনি আমীরুল মুমেনীন আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট এসে বলল, ইয়ামামার যুদ্ধে হাফেজদের একটি বড়দল শহিদ হয়ে গেছে, যদি যুদ্ধসমূহে এভাবে হাফেযগণ শহিদ হতে থাকে তাহলে আশঙ্কা রয়েছে যে কোরআ’ন মাজীদের একটি বড় অংশ বিনষ্ট হয়ে যাবে, তাই তুমি কোরআ’ন মাজীদ একত্রিত করার প্রতি গুরুত্ব দাও।

আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়ল্লাহু আনহু) বললেন, যেকাজ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জিবদ্দশায় করে নি সেকাজ আমি কি করে করতে পারি?

ওমার (রযিয়াল্লাহু আনহু) উত্তরে বললেন, আল্লাহ্‌র কসম এটা খুবই ভাল কাজ! এরপর আল্লাহ্ তা’লা একাজের জন্য আবুবকর (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অন্তর খুলে দিলেন, তখন তিনি যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডেকে বললেন, তুমি যুবক এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তোমার ব্যাপারে কারো কোন খারাপ ধারণা নেই, তুমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অহীর লিখক ছিলে তাই তুমি কোরআন মাজীদের আয়াতসমূহ খুঁজে তা একত্রিত কর। যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) বলল, যদি তারা (আবুবকর এবং ওমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) আমাকে কোন পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে বলত তাহলে তা আমার জন্য এতটা দুষ্কর হত না যতটা দুষ্কর কোরআ’ন মাজীদ একত্রিতকরণ। আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু) যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু)-কে একাজের জন্য বার বার বলতে থাকলেন, এমন কি এক সময়ে আল্লাহ্ যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অন্তরকে একাজের জন্য খুলে দিলেন ফলে তিনি একাজ করতে শুরু করলেন।[৯]

যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) কত কষ্ট স্বীকার করে একাজে আঞ্জাম দিয়েছেন তা একথা থেকে অনুমান করা যাবে যে, যখন কোন ব্যক্তি কোন আয়াত নিয়ে যায়েদ (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট আসত তখন তিনি নিম্ন উল্লেখিত চারটি পদ্ধতিতে তা যাচাই বাছাই করতেন,

  1. যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) নিজে হাফেজ ছিলেন তাই প্রথমে নিজের মুখস্তের আলোকে তা যাচাই করতেন।
  2. ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু) ও যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে কোরআ’ন একত্রিত করার কাজে জড়িত ছিলেন, তিনিও কোরআ’নের হাফেজ ছিলেন তাই তিনিও নিজের মুখস্তের আলোকে তা যাচাই করতেন।
  3. যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) ততক্ষণ একটি আয়াতকে গ্রহণ করতেন না যতক্ষণ না দু’জন গ্রহণ যোগ্য ব্যক্তি এ সাক্ষ্য না দিত যে, হাঁ এ আয়াতটি সত্যিই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে লিখা হয়েছে।
  4. পরিশেষে পেশকৃত আয়াতটিকে অন্যান্য সাহাবাগণের লিখিত আয়াতের সাথে মেলানো হত, যে আয়াতটি এ চারটি শর্ত অনুযায়ী সঠিক হত তা গ্রহণ করা হত। এত গুরুত্বের সাথে যায়েদ (রযিয়াল্লাহু আনহু) কোরআন একত্রিকরণের এগুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন।

যায়েদ বিন সাবেত (রযিয়াল্লাহু আনহু) একত্র কৃত এ কপিটিকে “উম্ম” বলা হত, এ উম্মের ৩টি বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল —

ক) সমস্ত সূরাসমূহের আয়াতগুলোকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিদের্শিত বিন্যাস অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে।

খ) ঐ কপিতে কেরআতের (তেলওয়াত পদ্ধতির) ৭টি পদ্ধতিই বিদ্ধমান ছিল, যাতে করে যে ব্যক্তি যে পদ্ধতিতে সুবিধামত কোরআন তেলওয়াত করতে পারবে সে ঐভাবে তা করবে।

গ) সূরাসমূহ ধারাবাহিক ভাবে সাজানো হয়নি বরং প্রত্যেকটি সূরা পৃথক পৃথক ভাবে সহিফার (পুস্তিকার) আকৃতিতে বিন্যস্ত করা হয়েছিল।

আবুবকর সিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে ঐ কপিটি আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল, আবুবকর সিদ্দীক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মৃত্যুর পর ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগে এ কপিটি ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট ছিল, ওমার ফারুক (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাহাদাত বরণের পর এক কপিটি উম্মুল মুমেনীন হাফসা বিনতু ওমার (রাযিয়াল্লাহু আনহার) নিকট সংরক্ষিত ছিল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে, পাঠ করুন আপনার পালনকর্তা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।
  2. সফিউর রহমান মোবারকপুরী লিখিত আর রাহিকুল মাখতুম; পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭।
  3. আররাহিকুম মাখতুম পৃ ৪৬০।
  4. মোকাদ্দামা মায়ারেফুল কোরআন। পৃ ৮১।
  5. ফাতহুল বারী, খণ্ড ৯ পৃ ১৮।
  6. ড. সুবহী সালেহ লিখিত উলুমুল কোরআন, বাইরুত।
  7. মাওলানা আবদুর রহমান কিলানী লিখিত আয়েনা পরোয়েযিয়াত,খণ্ড ৫, পৃ ৭১৮।
  8. ড. সুবহী সালেহ লিখিত উলুমুল কোরআ’ন।
  9. বোখারী কিতাব ফাযায়েল কোরআ’ন, বাব জামউল কোরআ’ন।