কাফের মোশরেকদের কোরআনের সাথে দুশমনী এখন কোন গোপন বিষয় নয়, আর সময় অতিক্রমের সাথে সাথে এ দুশমনী আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। নিকট অতীত এবং বর্তমানের মোশরেক ও ইহুদী-নাসারাদের কোরআনের সাথে দুশমনীর কিছু উদাহরণ নিচে পেশ করা হল:

  1. বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ই গালডিসটোন সংসদে এ বক্তব্য পেশ করেছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোরআন মুসলমানদের হাতে, বা তাদের অন্তরে বা মাথায় থাকবে, ততক্ষণ ইউরোপ মুসলিম দেশসমূহে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, আর যদি প্রতিষ্ঠিত করেও তাহলে তা স্থায়ী করতে সফল হবে না। এমনকি ইউরোপ নিজে টিকে থাকাও নিরাপদ হবে না।[১]
  2. ১৯০৮ খৃষ্টাব্দে বৃটেনের মন্ত্রী নোআবাদিয়াত এ বক্তব্য পেশ করেছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের নিকট কোরআন মাজীদ থাকবে, ততক্ষণ তারা আমাদের পথ আগলে থাকবে, আমাদের উচিত কোরআনকে তাদের জীবন থেকে দূর করে দেয়া।[২]
  3. অবিভক্ত ভারতের ইউপির গভর্ণর স্যার উইলিয়াম মিউর কোরআন মাজীদ সম্পর্কে তার কুমনোভাবকে এভাবে প্রকাশ করেছে যে, দু’টি জিনিস মানবতার দুশমন, মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তলোয়ার এবং মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোরআন।[৩]
  4. আলজিরিয়ার উপর ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসনের শত বছর পূর্তিতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রনায়ক তার এক বক্তব্য বলেছে, মুসলমানদের রাত দিন থেকে কোরআন বের করা এবং আরবী ভাষার সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট করা জরুরী। যাতে করে আমরা সহজে তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারি।[৪]
  5. ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দে ভারতে হিন্দুরা নিয়মিত একটি আন্দোলন শুরু করেছে যে, হয় কোরআন ছাড় না হয় ভারত ছাড়। ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দে কলকাতার একটি আদালতে হিন্দুরা মামলা করেছে যে, কোরআন মাজীদের উপর নিয়মানুবির্তিতা আরোপ করতে হবে।[৫]
  6. নেদারল্যান্ডের এক ফ্লিম নিৰ্মাতা ‘এত্বায়াত’ নামে একটি ফ্লিম তৈরী করে, সেখানে একজন পতিতার পেটে সূরা নূরের এ আয়াতটি লিখে দিয়েছে— ٱلزَّانِيَةُ وَٱلزَّانِي فَٱجۡلِدُواْ كُلَّ وَٰحِدٖ مِّنۡهُمَا مِاْئَةَ جَلۡدَةٖۖ وَلَا تَأۡخُذۡكُم بِهِمَا رَأۡفَةٞ فِي دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۖ وَلۡيَشۡهَدۡ عَذَابَهُمَا طَآئِفَةٞ مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢ — অর্থ: ‘ব্যভিচারী ব্যভিচারিণী তাদের প্রত্যেককে একশ বেত্রাঘাত করবে, আল্লাহ্‌র বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ্ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও, মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সূরা নূর – ২)। এর সাথে একজনের পিঠে বেত্রাঘাতের জখম অবস্থায় দেখানো হয়েছে, এ ফ্লিমের মূল উদ্দেশ্য হল এই যে, ইসলামের এ শাস্তি একটি অবিচার, জুল্‌ম।
  7. বর্তমান সময়েও অ্যামেরিকান এক বুদ্ধিজীবী ওয়াশিংটন টাইমে কোরআন মাজীদ সম্পর্কে তার কুমনোভাব এভাবে প্রকাশ করেছে যে, মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদীতার মূল হল স্বয়ং কোরআন মাজীদের শিক্ষা। একথা বলা ঠিক নয় যে, মুসলমানদের মধ্যে একজন সন্ত্রাসী এবং অল্প সংখ্যক উচ্চাভিলাষী সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদেরকে বন্দী করে রেখেছে। বরং মূল বিষয়টি কোরআনী শিক্ষার ফল। এ সমস্যার সমাধান এটাই যে, মধ্যমপন্থী মুসলমানদেরকে কোরআন মাজীদের শিক্ষা পরিবর্তন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।[৬]
  8. ৭ জুলাই ২০০৫ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনে ঘটে যাওয়া বোমাবাজীর উপর কথা বলতে গিয়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য পেশ করেছে যে, ইসলামী সন্ত্রসীরা ইরাকে ক্ষমতা দখলের জন্য পাশ্চাত্য পরিকল্পনার পরিবর্তে শয়তানী দর্শন এ হামলায় উদ্বুদ্ধ করেছে। (হে আল্লাহ্ তুমি তাদের উপর অভিসম্পাত কর)।[৭]
  9. ইটালীর প্রসিদ্ধ সাংবাদিক খাতুন এবং ইয়ানা ফালাসী এ বক্তব্য রেখেছে যে, মুসলমানদের পবিত্র কিতাব কোরআন, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না; একথা বলা ভুল হবে যে সন্ত্রাসী অল্প কিছু মুসলমান বরং সমস্ত মুসলমানই এ চেতনা রাখে।[৮]

কোরআনের সাথে দুশমনির এ কথাগুলোতো কাফের নেতাদের মুখ দিয়ে বের হয়েছে কিন্তু যে দুশমনী তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে তা আরো মারাত্বক।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ بِطَانَةٗ مِّن دُونِكُمۡ لَا يَأۡلُونَكُمۡ خَبَالٗا وَدُّواْ مَا عَنِتُّمۡ قَدۡ بَدَتِ ٱلۡبَغۡضَآءُ مِنۡ أَفۡوَٰهِهِمۡ وَمَا تُخۡفِي صُدُورُهُمۡ أَكۡبَرُۚ قَدۡ بَيَّنَّا لَكُمُ ٱلۡأٓيَٰتِۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡقِلُونَ ١١٨

অর্থ, ‘তাদের মুখ থেকেই শত্রুতা প্রকাশিত হয় আর তাদের মনে যা গোপন রাখে তা গুরুতর। (সূরা আল ইমরান-১১৮)।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কোরআন মাজীদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রোপাগাণ্ডার ক্ষেত্রে কাফেরদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এ কোরআন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত নয় বরং মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই তা রচনা করেছে। আজও কাফেরদের মূল লক্ষ্য এ বিষয়েই যে, এ কোরআন মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিজস্ব রচনা বলে প্রমাণ করা, যাতে করে ইসলামের সবকিছু নিজে নিজেই নষ্ট হয়ে যায়।

এ উদ্দেশে কোরআন মাজীদে বার বার পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, প্রথমে আরবী ভাষায় পরিবর্তনকৃত কোরআন প্রকাশ করা হয়েছে, এর পর হিব্রু ভাষায় পরিবর্তন কৃত কোরআন প্রকাশ করা হয়েছে, ইহুদী নাসারাদের এই কামনাকে নস্যাত করার জন্য সাউদী আরব সরকার আজ থেকে ২১ বছর আগে ১৪০৫ হিজরী বাদশাহ ফাহাদ কোরআন একাডেমী নামে একটি বিরাট প্রকল্প স্থাপন করেছে, যা প্রতি বছর তিন কোটি কোরআন মাজীদ ছেপে সমগ্র বিশ্বে ফ্রি বণ্টন করার সুভাগ্য লাভ করেছে।[৯] এই বাদশাহ্ ফাহাদ কোরআন একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইহুদী নাসারাদের উদ্দেশ্য ধূলোলুণ্ঠিত হল।

ইহুদী নাসারারা তাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য এখন একটি নুতন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, আজ থেকে মোটামুটি দশ বছর পূর্বে (৯/১১ ঘটনার পাঁচ ছয় বছর পূর্বে দু’জন ফিলিস্তিনী ইহুদী আল-মাহদী এবং সাফী আরবী ভাষায় কোরআন মাজীদের আদলে একটি কিতাব রচনা করে, তার নামসমূহ কোরআন মাজীদের সূরাসমূহের নামের অনুরূপ করে রাখা হয়েছে, যেমন— সূরা ফাতেহা, সূরা সালাম, সূরা নূর, সূরাতুল ঈমান, সূরাতুত তাওহীদ, সূরাতুল মাসীহ, সূরাতুন নিসা, সূরাতুন নিকাহ, সূরাতু তালাক, সূরাতুস সিয়াম, সূরাতুস্ সালা ইতাদি। এ সূরাসমূহে কোরআন মাজীদের সূরাসমূহের আদলে ছোট ছোট আয়াত লিখা হয়েছে, ৯০% শব্দ এবং বাক্য কোরআন মাজীদ থেকে নেয়া হয়েছে। কিতাবটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ফোরকানুল হক’। প্রথম প্রকাশনায় আরবী এবং ইংরেজী ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, প্রতি পৃষ্ঠার অর্ধেক আরবী আর অর্ধেক ইংরেজী অনুবাদ। ১৫×20 সে. মি. আকারে ৩৬৬ পৃ.। কিতাবটি অ্যামেরিকান ইহুদী কোম্পানী “project omega 2001”, এবং “Wise press” প্রকাশ করেছে, যার বিক্রয় মূল্য ১৯.৯৯ ডলার। প্রকাশকের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, এটা ফোরকানুল হকের প্রথম পারা এরপর আরো ১১ পারা প্রকাশিত হবে, ফোরকানুল হকের এ সংক্ষিপ্ত পরিচিতির পর আমরা তার বিভিন্ন দিক নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই।

ফোরকানুল হকের বিভিন্ন দিক

 ফোরকানুল হকের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার আগে এ বিষয়টি বর্ণনা করা জরুরী যে, ফোরকানুল হককে আল্লাহ্ পক্ষ থেকে ওহীকৃত কিতাবের আদলে পেশ করা হয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ, এক স্থানে লিখা হয়েছে— ‘আমি এই ফোরকানুল হকেকে ওহী হিসেবে অবতীর্ণ করেছি। (সূরাতুত তানযিল-৪)।

অপর এক স্থানে লিখা হয়েছে— ‘ফোরকানুল হককে আমি অবতীর্ণ করেছে যাতে করে পথভ্রষ্টদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর পথে নিয়ে আসি।’ (সূরা মাসীহ্-৬)।

উল্লেখিত আয়াত সমূহের আলোকে ফোরকানুল হকের লেখকদের নিম্নোক্ত দাবীসমূহ প্রমাণিত হচ্ছে, চাই তারা তা বাস্তবে করে থাকুক আর নাই করুক—

  1. বক্তা আল্লাহ্ নবী।
  2. জীবরীল ওহী নিয়ে তার নিকট আসে।
  3. ফোরকানুল হকে যা কিছু লিখা হয়েছে তা সবই আল্লাহ্ পক্ষ থেকে।

কোরআন মাজীদের আলোকে এ তিনটি দাবীর বিধান এ রকম—

وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا أَوۡ قَالَ أُوحِيَ إِلَيَّ وَلَمۡ يُوحَ إِلَيۡهِ شَيۡءٞ وَمَن قَالَ سَأُنزِلُ مِثۡلَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُۗ وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِي غَمَرَٰتِ ٱلۡمَوۡتِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ بَاسِطُوٓاْ أَيۡدِيهِمۡ أَخۡرِجُوٓاْ أَنفُسَكُمُۖ ٱلۡيَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ ٱلۡهُونِ بِمَا كُنتُمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ غَيۡرَ ٱلۡحَقِّ وَكُنتُمۡ عَنۡ ءَايَٰتِهِۦ تَسۡتَكۡبِرُونَ ٩٣

অর্থ, ‘আর ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম কে হতে পারে যে আল্লাহ্‌র প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে? অথবা এরূপ বলে, আমার উপর ওহী নাযিল করা হয়েছে অথচ প্রকৃত পক্ষে তার উপর কোন ওহী নাযিল করা হয় নি। (সূরা আন‘আম-৯৩)।

অতএব,ফোরকানুল হকে যা কিছু লিখা হয়েছে তা পরিষ্কার মিথ্যা, অপবাদ এবং বাতেল। এ সমস্ত ইবলিসী কথাবার্তা এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল এই যে, হয়তবা এর মাধ্যমে ইহুদী নাসারাদেরকে নিজেদের বন্ধু এবং সমমনের বলে বিশ্বাসকারীদের চোখ খুলে যাবে এবং তাদের অনুভূতি হবে যে, যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের দুশমন তারা কখনো মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না?

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. আনোয়ার বিন আখতার লিখিত উম্মত মুসলিমা কে দিলখোরাস হালাত পৃ. ২০৪।
  2. মরিয়ম জামিলা লিখিত ইসলাম এক নাযরিয়া, এক তাহরিক পৃ. ২২০।
  3. শাইখ মোহাম্মদ আকরাম লিখিত হাওজে কাউসার পৃ.১৬৩।
  4. মাহেনামা মোহকামাত, জুন ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দ পৃ. ৩১।
  5. হাফতা রোজা তাকভীর, করাচী, ১ম ডিসেম্বর ২০০৪ খৃষ্টাব্দ।
  6. মাহে নামাহ মোহাদ্দেস, লাহোর, মার্চ, ২০০৫, পৃ. ২২।
  7. হাফতা রোজা তাকভীর, করাচী, ২১ জুলাই ২০০৫।
  8. মাহে নামা তায়েবাত, লাহোর, আগষ্ট ২০০৫।
  9. উল্লেখ্য বাদশাহ ফাহাদ কোরআন একাডেমী আরবী ছাড়াও উর্দু, বাংলা, ইংরেজী, ফ্রান্সী, আলবেনী, কোরী, থাই, জার্মান, রাসিয়া, চায়না, তুর্কী, পোর্তোগালী, ইন্দোনেসী ভাষায় কোরআন মাজীদের অনুবাদও প্রকাশ করছে। বর্তমানে বাদশাহ্ ফাহাদ একাডেমী অন্ধ লোকদের জন্য কোরআন তেলওয়াতের জন্য কোরআন মাজীদ প্রস্তুত করছে। (আল্লাহ্ তাদেরকে সর্বোত্তম প্রতিদান দিন)।