ভূমিকা

পাক ভারত—বাংলা উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত মুসলিমদের রাজনৈতিক অভিযানগুলোকে আমি রাজনৈতিক মিশন বলে অভিহিত করে থাকি। অষ্টম শতাব্দীর শুরুর প্রথম দশকের দ্বিতীয় পাদে অর্থাৎ ৭১২ ঈসায়ী মনে মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানটি ছিল ভারতে মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক মিশন। বিপক্ষে ছিলেন সিন্ধুর হিন্দু রাজা দাহির। তাঁর পরাজয় ও মুহম্মদের বিজয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম আধুনিক ঘটনা। কেননা, সদ্য পৌত্তলিকতামুক্ত আরববাসী পৌত্তলিক ভারতবাসীর জীবনে ইসলামের আলোকবার্তা বয়ে এনেছিলেন। সেই আলোর সংস্পর্শে পৌত্তলিক সিন্ধুবাসী হিন্দুরা আলোকিত হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে উত্তর—পশ্চিম সীমান্ত প্ৰদেশ, পঞ্জাব, বেলুচিস্তান কেউই বাদ যায়নি। তারা সবাই আলোক্কাত ও মুসলিম হয়ে ওঠেন

মুসলিমদের দ্বিতীয় বিজয়াভিযান পরিচালিত হয় সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে। তৃতীয় বিজয়াভিযান পরিচালিত হয় মুহম্মদ ঘুরির নেতৃত্বে এবং তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের দিল্লিতে প্রথম মুসলিম সালতানাত কায়েম হয়। বিপক্ষে ছিলেন অহঙ্কারী দাম্ভিক পৃথ্বিরাজ চৌহান। তাঁর দম্ভ চূর্ণ করে দিয়ে দিল্লিতে মুসলিম সালতানাত কায়েম করে এদেশে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন মুহম্মদ ঘুরি। অবশিষ্ট পৌত্তলিক ভারত ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে। চতুর্থ অভিযান পরিচালিত হয় জহির—উদ—দিন মুহম্মদ বাবুরের নেতৃত্বে। প্রতিপক্ষ ছিলেন ইব্রাহীম লোদি। তারপরের প্রতিপক্ষ ছিলেন রাজা সাঙ্গা। বাবুরকে পরাজিত করে তিনি দিল্লি সালতানাত দখলের দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবুর তা চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দিয়ে দিল্লিতে মোগল সালতানাত কায়েম করেন পরবর্তী প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের জন্য। এই বিজয়ের ধারাবাহিক বর্ণনা এই ভূমিকায় প্রদত্ত হয়েছে। ‘বাবরনামা’ গ্রন্থের পাঠকদের জন্য তা খুবই প্রাসঙ্গিক।

এক

বিশ্বনবি হজরত মুহম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব মানব জাতি ও মানব—সভ্যতার ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর আবির্ভাবের সাথে সাথে নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা একদিকে যেমন শেষ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি মানুষের যুগযুগান্তরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাধনা পূর্ণতালাভ করেছিল। পবিত্র মহানবির (স) উপর মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন অবতরণের সাথে—সাথে যেমন আসমানি কিতাবের ধারা পূর্ণতা লাভ করেছিল, অন্যদিকে তেমনি পবিত্র কুরআনে ‘তোমাদের দ্বীনকে পুরা করলাম’ এবং ‘ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম’—ঘোষণার সাথে সাথেই মহানবি (স) ত্রিকালশ্রেষ্ঠ ও ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষরূপে জগতে চিরপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। এ কোনো অতিশয়োক্তি নয় যে, তিনিই জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, ত্রিকালশ্রেষ্ঠ এবং ইহপরকালের অবিসংবাদিত নেতা। তাই তাঁর উপর অবতীর্ণ পবিত্র মহাগ্রন্থ আল—কুরআন যেমন সকল কালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, মানবজাতির চিরকালের মহাসনদ; তেমনই সেই পবিত্র কুরআনের প্রতিবিম্ব মহানবির জীবন ও বাণী বিশ্বমানবের চিরকালীন ও চিরন্তন আদর্শ। মহানবি (স) বিদায় হজ্বের ভাষণে তাই স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে থাকবে—তাহলে কেউ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।’ মহানবি (স)—এর পবিত্র মুখনিঃসৃত এ বাণী বিশ্বমুসলিমের চিরকালীন—চিরকালের পথপ্রদর্শকের বাণী—স্পষ্টতই, একথা যুগে যুগে কালে কালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, মহানবির এ বাণী অজর—অমর—অব্যয়—অক্ষয়; তার লয় নেই, তার ক্ষয় নেই; মহাপ্রলয়কালাবধি মহাকাল—সাগরে তা আলোকবর্তিকার ন্যায় পথহারা পথিককে আলোর সন্ধান দিয়ে যাবে—ন্যায়হারা, সত্যহারা, পথহারা জাতিকে সঠিক সত্যের দিশা দিয়ে যাবে।

বড়ই সৌভাগ্যবান ঐ আরবজাহান, যে জাহানে, যে মরুর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন পবিত্র মহানবি—যিনি আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহিমের দ্বীনকে আরবদেশের বুকে পুনরুজ্জীবিত করে—কাবাকেন্দ্রিক অধ্যাত্মিক মহাজগৎ সৃষ্টি করে বিশ্বমানবের জন্য অমিয়সুধার মহাভাণ্ডার সুরক্ষিত করে গেলেন। এ এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার; এবং আরো অদ্ভুত এবং আরো সুন্দর একটি ব্যাপার হলো যে, ইসলামের মহানবি আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর একেবারেই মধ্যভাগে—মধ্যস্থলে—একেবারেই মক্কা—মহানগরে; যা জেদ্দা বন্দরের অনতিদূরেই অবস্থিত। আদিমানব আদম ও হাওয়ার পদস্পর্শধন্য জেদ্দা—অনতিদূরেই যুগযুগান্তরের নবি—রসুলদের পদস্পর্শধন্য মক্কানগরী—সে মক্কানগর—যেখানে সুরক্ষিত রয়েছে পবিত্র স্বর্গীয় পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’, সে পবিত্র কাবাগৃহ—যাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল ইব্রাহিমি দ্বীনের আধ্যাত্মিক জগৎ—সে কাবানগরী মক্কায় মহানবির আবির্ভাব বিশ্বমানবের জন্য আরেক তাৎপর্যময় মহাঘটনারূপে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। একেবারে আদিমানব ও আদিনবি আদম থেকে শুরু করে আখেরী নবি মুহম্মদের (স) আবির্ভাব—সেমিটিক ধর্মজগতের এক যুগান্তকারী ঘটনারূপে ত্রি—জগতে অজর অমর—অব্যয়—অক্ষয় হয়ে রইল।

মহানবি মুহম্মদ (স) নিজের জীবন ও সাধনা দিয়ে অশিক্ষিত, অজ্ঞ আরব জনগণকে যে মহামন্ত্র ও মহাসত্যের সন্ধান দিয়েছিলেন, সে মন্ত্র, সে আলোকিত সত্য তাদের যুগযুগান্তরের অন্ধকার ও অজ্ঞতাকে দূরীভূত করে দিয়ে এক আলোকিত ও সম্ভাবনাময় জান্নাতি জাতিরূপে জগতে তাদের চিরমহিয়ান হওয়ার মহামর্যাদায় বিভূষিত করল। সদ্য আলোকিত জাতি, সেদিন সুসভ্য ও মহিমান্বিত জাতিসত্তায় রূপান্তরিত হয়েছিল। তাদের চোখের সামনেকার সকল অন্ধকার বিদূরিত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন তাঁরা অনুভব করেছিলেন, যে মহিমান্বিত মহাসত্যের সন্ধান তারা পেয়েছেন যে মহাসত্য তা শুধু তাদের জন্য নয়; তা এসেছে বিশ্বমানবের জন্য। আলোকিত আরবজাহানের বাইরের অনালোকিত জগতকে সে সত্যের আলোয় আলোকিত করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের দিগদিগন্তে তা ছড়িয়ে দেওয়ার এক স্বর্গীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা কখনো বা দিগ্বজয়ীর বেশে, কখনো বা চিরত্যাগী চির সন্ন্যাসীর বেশে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়লেন। বিশ্বমানবের দরবারে সে মহাসত্যের বাণী পৌঁছে দেওয়ার যে আধ্যাত্মিক মাদকতা তাঁরা সেদিন অনুভব করে জীবন—মরণ—পণ করে বিশ্বের দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তা কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব? এটা কোন মহাশক্তি আর কোন মহামন্ত্রবলে সম্ভব হলো? নিশ্চয়ই তার সামনে জগতের আর সব ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, বৈশ্বিক সমস্ত ধ্যানধারণাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। পবিত্র ইসলামের আলোকিত জীবন—দর্শনের সামনে ইরানের মানিকীবাদ (Manikism) নিশ্চয়ই বড় অসহায় ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। খোদ আরবের পৌত্তলিকতাবাদ, তার প্রতিবেশী আরো দুই ধর্মীয় মতবাদ খ্রিস্টীয় ও ইহুদিবাদ—নিঃসন্দেহে তার সামনে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। নতুবা ইসলামের আলোকিত সৌন্দর্য ও আলোকিত জীবনবাদের সংস্পর্শে আসার ফলে তারা এ নবীন জীবনবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কেন? যে ইজম বা যে বাদটাই ছিল পুরোমাত্রায় ভাববাদ, এবং সে বাদ বা ইজমকে কেন্দ্র করে যে মানবতাবাদ বা মানবজীবনবাদ গড়ে উঠল—আর তার সংস্পর্শে অন্যান্য ইজম বা বাদ ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কোন মহাশক্তি আর কোন মহামন্ত্রবলে? সে কি তরবারির জোরে? প্রাচ্যের ও পাশ্চত্যের ইসলাম—বিরোধী নিন্দুকদের ইসলামের বিরুদ্ধে ও জঘন্য অপবাদ সুস্থ ও সুকুমারবুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি—হবেও না কোনোদিন। এভাবেই ইসলাম তার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির বলে একদা যেদিন পৃথিবীর মধ্যস্থলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মহানবির তিরোধানের মাত্র একশো বছরের মধ্যে তা পশ্চিমে স্পেন ও পূর্বে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

দুই

ইসলামের পবিত্র মহানবির (স) তিরোধানের পর পর্যায়ক্রমে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অতিবাহিত হয়ে হজরত আবু বকর, হজরত উমর, হজরত উসমান ও হজরত আলীর (রা) পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলাম জগতে দুর্যোগের যে ঘনঘটা নেমে আসে, তা ছিল মূলত রাজনৈতিক। ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শ, ইসলামের আর্থসামাজিক ও আধ্যাত্মিক জগৎ তখনও পর্যন্ত একই ঐক্যসূত্রে গ্রোথিত ছিল। এবং তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলোতে ইসলামের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল—ইসলামের অগ্রাভিযান। সে অভিযান একদিকে ছিল যেমন রাজনৈতিক, অন্যদিকে তেমনই ছিল আর্থসামাজিক ও আধ্যাত্মিক। এর পুরো বিষয়টিকে এক কথায় মিশন (Mission) বলে অভিহিত করাটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। যেমন—রাজনৈতিক মিশন, সামাজিক মিশন, আধ্যাত্মিক মিশন, অর্থনৈতিক মিশন ইত্যাদি। আমরা এর সমস্তটিকে একত্রিত করে—বোঝার সুবিধার্থে ‘মুহম্মদী মিশন’ বলে অভিহিত করব। তাতে বিষয়টি বুঝতে আরও সুবিধা হবে।

ইসলামের এ মিশন বা মুহম্মদী মিশন অতীত পৃথিবীর সমস্ত মিশনকে নস্যাৎ করতে—করতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এ ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর ফারুক রাজিআল্লাহুতায়ালা আনহুর অবদান যেন সবচেয়ে বেশি বলে প্রতীত হয়। মহানবি মুহম্মদের (স) সেই জগদ্বিখ্যাত উক্তি—‘আমার পরে নবি হলে উমর হতেন নবি’—এ যে কোনো অতিশয়োক্তি নয় ইসলামের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সে কথার সততা আমাদের চোখের সামনে সূর্যসত্য হয়ে ফুটে ওঠে।

তাঁর উপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর অপার করুণা বর্ষিত হোক। সেই মহান খলিফার হাত দিয়ে তৎকালীন বিশ্বের যে সকল দেশে মুহম্মদী মিশন পরিচালিত হয়েছিল তা আশ্চর্যরকমভাবে সার্থক হয়ে উঠেছিল। ইসলাম জগতের সেই মহান সন্তানের মধ্যে আল্লাহ যেন ‘নবুয়তি বরকত দান করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ মিশনই হয়েছিল সফল ও সার্থক। এবং আরও সুখ ও আনন্দের বিষয় যে, তাঁর আমলে বিজিত প্রায় সমস্ত ভূখণ্ডেই আজও ইসলামের পতাকা সমুন্নত রয়েছে।

তাঁর হাতেই বিজিত হয়েছিল মিশর ও ইরানের মতো দুটি প্রাচীন সভ্য দেশ ও সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশই এসেছিল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। আজকের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান প্রভৃতি ভূখণ্ড ছিল তারই খিলাফতকালের বিজয়ের স্মারক। একথা ভেবে আজ আমাদের শোকের অন্ত নেই যে, সে মহান খলিফা অত্যল্পকালের মধ্যেই ইসলামের ইতিহাসে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়; সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সুদুর্লভ। তবে এর চেয়েও শোকাবহ ঘটনা যে, মহান খলিফার অপঘাতে শাহাদতের ঘটনায় সেদিনকার মুসলিম বিশ্ব যেমন বিমূঢ় ও মুহ্যমান হয়েছিল, আজকের মুসলিম বিশ্ব সমভাবে তার অংশীদার। তাঁর মতো অতি দ্রুত গতিতে ও অতি দ্রুত পদচারণায় বিশ্বের অন্যান্য ভূখণ্ডে তাঁর মতো করে আর ইসলাম প্রচারিত হতে পারল না এবং মর্তপৃথিবী ঐভাবে সুগঠিত হতে পারল না। সত্যি, এ দুঃখ রাখার জায়গা নেই।

তিন

ঐতিহাসিকভবে একথা সত্য যে, হজরত উমরের খিলাফতকালে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে দু—একটি মিশন পরিচালিত হয়েছিল। তবে তা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ না হওয়ার মূলে ছিল হজরত উমরের সীমাহীন দূরদর্শিতা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে যতগুলো অভিযান প্রেরিত হয়েছিল তার সবকটিতেই তাঁর এ দূরদর্শিতা সক্রিয় ছিল। তাঁর দেশবিজয়ের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, বিজিত ভূখণ্ডগুলোতে তিনি নিরঙ্কুশ শাসন কায়েম করতেন। তাঁর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ছিল অসাধারণ। সে বিশাল ব্যক্তিত্বের খিলাফতাধীনে কোনো প্রাদেশিক শাসনকর্তার পক্ষে তাঁর নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না। খলিফা উমরের শুধু দূরদর্শিতা নয়; দূরদৃষ্টিও ছিল অসাধারণ। মদিনা মুনাওয়ারা থেকে বহুদূরস্থিত প্রদেশগুলোর প্রশাসন ব্যবস্থাকে তিনি যেন সেই দূরদৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ করতেন। কোনো প্রশাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাঁর আদেশ অমান্য করা, আর কোনো প্রজার পক্ষে সম্ভব ছিল না প্রশাসনিক নিয়ম ও আইনকানুনকে ভঙ্গ করা। তাঁর খিলাফতাধীনে এভাবেই গড়ে উঠেছিল এক শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসনব্যবস্থা। বলাবাহুল্য, বিজিত এলাকাগুলোতে এভাবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আনয়ন না করা পর্যন্ত তিনি নতুন নতুন এলাকায় মিশন পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। সেজন্য তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে মিশন পাঠানোর ব্যাপারে তাঁর কিছুটা দ্বিধা ছিল। তবুও একথা ঠিক যে, পূর্ণ জীবন লাভ করলে তাঁর নবুয়তি—বরকতময় হাতের কল্যাণে মুহম্মদী মিশন তৎকালীন বিশ্বের আরও কত এলাকা যে বিজিত হয়ে সেখানে চিরস্থায়ী ইসলামি ব্যবস্থা কায়েম হতো তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আল্লাহ সেই পবিত্রাত্মা মহাপুরুষের কল্যাণময় আত্মাকে জান্নাতে চিরশান্তিতে রাখুন।

পবিত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর ইসলাম জগতে জয়ের ধারা বদলে যায় এবং মুহাম্মদী মিশন প্রেরণের ধারা নতুন নতুন গতি লাভ করে। প্রাথমিক যুগে ইসলাম যেখানে নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে এক মহিমান্বিত জীবনব্যবস্থারূপে তাঁর পরিচয় অব্যাহত রেখে অবলীলাক্রমে অমুসলিম বিশ্বের পানে প্রধাবিত ছিল, পরবর্তী যুগে সেখানে তা সঙ্কুচিত হয়ে নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যকে প্রবলতর করে তুলে আত্মঘাতী ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ প্রণোদনাকে অনিবার্য করে তুলল। এভাবে মুসলিম বিশ্ব নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল, পূর্বের বিজয়ের ধারা শ্লথ হয়ে পড়ল, এবং এক—একটি এলাকায় বংশগত খিলাফতের ধারা প্রযুক্ত হলো। রাজনৈতিক মতপার্থক্য পর্যায়ক্রমে আধ্যাত্মিক মতপার্থক্যের রূপ পরিগ্রহ করল। ইসলামের শত্রুরা নব—নব ছদ্মবেশে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করল এবং ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা—হাঙ্গামায় ইন্ধন যোগাতে লাগল। এভাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুসলিম নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ল, বংশগত খিলাফত কায়েম হয়ে পড়ল এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিশন প্রেরিত হতে লাগল। ভিন্ন ভিন্ন পথে হলেও তা ছিল মুহাম্মদী মিশন। তা ছিল মুহম্মদেরই শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা। এ মিশন শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবেও প্রেরিত হতে লাগল এবং পর্যায়ক্রমে বিজিত অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত মানুষদের হৃদয়—মন—প্রাণ জয় করে নিতে লাগল। এ বিজয়ের ধারায় হিঁদুস্তান বিজয়ের পরিকল্পনা ছিল ইসলামি ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা।

চার

মহানবি মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচারিত জীবনবাদ পৃথিবীর দিগ—দিগন্তে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত মানবজাতির মহান সন্তানেরা সামান্যতম অলসতাকেও প্রশ্রয় দেননি। মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী—এ সৌভাগ্য ও সম্মান তাঁরা ত্যাগ করতে মোটেও রাজি ছিলেন না। তাই জীবনমরণ পণ করে তাঁরা পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। বিশ্বমানবের দরবারে তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন সেই স্বর্গীয় বাণী—স্বর্গীয় জীবনবাদ। এ ছিল স্পষ্টতই মিশনারি কর্মসাধনা। তা ছিল নিজেদের জীবনের বিনিময়ে মহানবির মিশনকে বিশ্বমানবের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার সাধনা। এ মিশন প্রেরণ মূলত তিনটি পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। দিগ্বিজয়ীদের মারফত, ধর্মপ্রচারক—সুফি—সন্তদের মারফত এবং বণিকদের মারফত। সন্দেহ নেই, এ সুসংস্কৃত ও পরিশীলিত ধর্ম ও সংস্কৃতি পথভ্রান্ত, পথহারা ও অন্ধকারের যাত্রীদের প্রকৃতই পথ দেখাতে সমর্থ হয়েছিল। আলোকিত ধর্ম, আলোকিত সংস্কৃতি অনালোকিত ধর্ম ও সংস্কৃতির জগতে অতি দ্রুত স্থান করে নিতে সমর্থ হয়েছিল। দিগ্বিজয়ী, সুফি—সন্ত ও বণিকরা—প্রকৃতপক্ষেই মিশনারির ভূমিকা পালন করে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। তৎকালীন আবিষ্কৃত মহাদেশ ও ভূখণ্ডগুলোতে আরব বণিকদের ছিল অবাধ যাতায়াত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিগ্বিজয়ী মিশনারিদের দিগ্বিজয়ী মিশন পরিচালনার বহুকাল পূর্বেই পৃথিবীর বহু ভূখণ্ডে ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল। যেমন—দক্ষিণ ভারতীয় সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকাসহ শ্রীলঙ্কা, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি ভূখণ্ড—যেগুলো আজ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মালদ্বীপ প্রভৃতি নামে পরিচিত—যে স্থানগুলো সহ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি ভূখণ্ডে তো প্রথমেই বণিকদের মারফত ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল। এ দেশগুলোর অধিকাংশতেই তো মুসলমানদের রাজনৈতিক মিশন পরিচালিতই হয়নি; তা সত্ত্বেও ঐ ভূখণ্ডগুলোতে বণিক ও ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মারফত অতি দ্রুত ইসলাম পৌঁছে গিয়েছে। তৎকালীন বিশ্বের অনেক ভূখণ্ডই ছিল অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সে সব এলাকায় অতি দ্রুত ইসলাম তার জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়।

ঐ সময়ে রাজনৈতিক অভিযান প্রেরণের বহু পূর্বেই তৎকালীন ভারতবর্ষের দক্ষিণ—পশ্চিম সমুদ্রোপকূল সহ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ইত্যাদি ভূখণ্ডগুলোতে আরব বণিকদের অবাধ পদচারণা ছিল। এবং ব্যবসা—বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদের সূত্র ধরেই অবশেষে ভারত ভূখণ্ডে বড় রকমের দিগ্বিজয়ী মিশন পরিচালিত হয়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, খলিফা উমরের শাসনামলে হিঁদুস্তানে রাজনৈতিক মিশন প্রেরণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, সে মিশন তেমন সফলতা অর্জনে সমর্থ হয়নি। ইতোমধ্যেই মহাত্মা খলিফা উমর শাহাদত বরণ করেন। তারপর, বহুকাল যাবত আর তেমন কোনো ফলপ্রসূ রাজনৈতিক মিশন প্রেরণের সংবাদ পাওয়া যায় না।

ইতোমধ্যে মুসলিম জগতে অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন দেখা দেয়। সময় প্রবাহের সাথে সাথে খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তারপরের ইতিহাস তো ইতিহাসের মনোযোগী পাঠকমাত্রের অজানা নয়। এরপরে, ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পদ্ধতিতে পৃথিবীর একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় ইসলামের মিশন।

পাঁচ

খলিফা হজরত উমর (রা)—এর স্বপ্ন অনেক কাল পরে সফল হয় এক সপ্তদশবর্ষীয় আরব তরুণের দ্বারা। আর সেই সাথে একথাও অতীব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় যে, আরবদের সিন্ধু বিজয় শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়; সমগ্র বিশ্ব—ইসলামের ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা। খলিফা হজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাইপো ও জামাতা সপ্তদশবর্ষীয় তরুণ মুহম্মদ ইবনে কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয় ভারত ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা। প্রকৃতপক্ষে, এ বিজয়ের দ্বারাই ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই যে সিন্ধু বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল—বিচ্ছিন্নভাবে হলেও সে বিজয় ছিল এক চিরস্থায়ী বিজয়। বাস্তবিকই এ ছিল ইসলামের এক সার্থক রাজনৈতিক মিশনের সাফল্য। সাফল্যের এ পথ বেয়েই একদিন সমস্ত হিঁদুস্তান ইসলামের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল। উপায় ছিল না; কারণ সমগ্র হিঁদুস্তান তখন পৌত্তলিকতার অন্ধকার গহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। পটভূমিটি তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ রাখে। একই অবস্থা ছিল আরবেও। পবিত্র মক্কা নগরীতে হজরত ইব্রাহিম ও তাঁর পুত্র ইসমাইল কাবা—শরীফ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে একেশ্বরবাদী পবিত্র জীবনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তাঁদের তিরোধানের পরে পৌত্তলিকতাবাদীরা পুতুল—প্রতিমা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই পবিত্র মক্কাভূমিকে অপবিত্র করে ফেলেছিল। পবিত্র কাবাগৃহে ছবি ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সে গৃহের পবিত্রতা নষ্ট করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, একেশ্বরবাদী আরবভূমি অপবিত্র পৌত্তলিকতার অন্ধকার গহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তারপর পবিত্র দ্বীনের নবি মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লালামের আজীবন প্রচেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে পাপপঙ্কিল আরবভূমি একেশ্বরবাদী পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। একই অবস্থা ছিল ভারতবর্ষেও। সেখানেও পৌত্তলিকতার অভিশাপদগ্ধ জনজীবন সমাজের একদল সুবিধাবাদী পৌত্তলিক—পুরোহিত—নৃপতিদের জালে আবদ্ধ হয়ে ছটফট করছিল—মানবতার নাভিশ্বাস উঠছিল। সপ্তদশ বর্ষীয় তরুণ মুজাহিদ, প্রথমে গাজী ও পরে শহীদ, মুহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে সিন্ধুভূমিতে ইসলাম কায়েম হওয়ার পর পৌত্তলিকতার অভিশাপ থেকে সেখানকার জনগণ মুক্তির নিশ্বাস নিতে থাকে। এক উন্নত সংস্কৃতি ও পবিত্রতম জীবনব্যবস্থার সংস্পর্শে আসার পর সেখানকার মানবচিত্তের পৌত্তলিকতাদগ্ধ ঘোর অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে এবং একটি অত্যুন্নত ও পরিশীলিত জীবনবাদ ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। এদের মধ্যে বহুসংখ্যক পৌত্তলিক মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে ধন্য হয়। সদ্যাগত আরবদের সাথে ভ্রাত্বত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় একটি সুসংস্কৃত ও সুপরিশীলিত সুন্দর সমাজব্যবস্থা। ইসলাম আরব—হিঁদুস্তানের ভৌগোলিক ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে এক সুসংহত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে।

এভাবে কেটে যায় প্রায় তিনশো বছর। এই সুদীর্ঘ তিনশো বছরে ইসলাম বৃহত্তর সিন্ধু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। এর মূল কারণ ছিল বাগদাদকেন্দ্রিক তৎকালীন খিলাফত ব্যবস্থার মধ্যে ঐক্যের নিদারুণ অভাব। অগণিত রাজনৈতিক মতবাদদীর্ণ ভ্রান্ত ও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষজাত ধ্যান—ধারণার কারণে পরবর্তীকালে অবশিষ্ট হিঁদুস্তান অভিমুখে বড় কোনো রাজনৈতিক মিশন পরিচালিত হতে পারল না। ফলে, আরব মুসলমানরা বৃহত্তর সিন্ধু উপকূলেই দিন অতিবাহিত করতে লাগল।

হিঁদুস্তানের মাটি ও আহাওয়ার নিজস্ব একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সে বৈশিষ্ট্য ও সে প্রভাব থেকে আরব মুসলমানরা নিজদের মুক্ত রাখতে পারল না। সর্বোপরি, স্বল্প পরিশ্রমে পর্যাপ্ত জীবনোপকরণের পরম্পরাগত ধারা তাদের অলস, কুঁড়ে ও অপদার্থ জাতিসত্তায় পরিণত করল। ভোগবিলাসের স্পৃহা ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগত শিথিলতা তাদের আরব—ভূমিজাত বীরত্ব ও দিগ্বিজয়গত স্পৃহাকে ধূলিমলিন করে দিল। ফলে, ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মিশন সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে বৃহত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারল না। এর জন্য আরো তিনশো বছর অপেক্ষা করতে হলো।

ছয়

ভারতে ইসলামের বিজয়াভিযানের ধারায় অবশেষে যুক্ত হলো ইরানের গজনীর শাসকদের উত্থান। ইরানের সামানী বংশীয় পঞ্চম রাজা আবদুল মালিকের প্রভুভক্ত ক্রীতদাস আলপ্তগীন নিজ কর্মগুণের দ্বারা যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে তা গজনবীবংশ রূপে অক্ষয়—অব্যয় হয়ে আছে। ইরানের রাজবংশজাত সবুক্তগীন ভাগ্যদোষে ক্রীতদাসরূপে আলপ্তগীনের নিকটে বিক্রীত হন বটে, কিন্তু ধমনিতে প্রবাহিত রাজরক্ত ও উন্নত ললাটের অধিকারী সৌভাগ্যবান সবুক্তগীন অচিরেই গজনীর সালতানাত লাভ করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সবুক্তগীন ইরান ও আফগানিস্তানের পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করে ভারতের উদ্দেশে রাজনৈতিক অভিযান প্রেরণ করেন। আরবদের প্রায় পৌনে তিনশো বছর পর সবুক্তগীনের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ তুর্কি মুসলিমদের সফল রাজনৈতিক মিশন পরিচালিত হয়। জয়পালের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত পৌত্তলিক বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে।

এরপরে, গজনী বংশের মহান সন্তান গাজী বীর সলতান মাহমুদের উত্থান। এ মহান সন্তানের নেতৃত্বে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে পর পর আঠারোটি শান্তি মিশন পরিচালিত হয়। এ মিশনগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের মাটিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। মহাবীর গাজী সুলতান মাহমুদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো যে, তিনি কখনো কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। বিশ্বের সমরেতিহাসে এ এক আশ্চর্যজনক দৃষ্টান্ত।

১০০০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদের প্রথম সামরিক মিশন পরিচালিত হয় এবং ১০২৬ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাট ও সোমনাথে সর্বশেষ অষ্টাদশতম মিশন সার্থকভাবে পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর হিঁদুস্তান অভিযান সমাপ্ত হয়। এভাবে গাজী বীর সুলতান মাহমুদ পুনঃপুনঃ সমর মিশন পরিচালনার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার কায়েমের পথ সুপ্রশস্ত করেন।

১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদের ইন্তিকালের পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীরা তাঁর মিশনের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হন।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, যখন কোনো প্রবল ব্যক্তিত্বের উত্তরাধিকারীরা পূর্বের প্রবলত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন তার অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের পরাজিত করে সে স্থান দখল করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নিজেদের নতুন করে সংযোজন করে তার ধারা রক্ষা করে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আলোকিত ও প্রবল প্রতাপান্বিত গজনী বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ঘুরি বংশ সে স্থান দখল করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অগ্রণী হলো।

গজনী বংশের যেমন সুলতান মাহমুদ, ঘুরি বংশের তেমনই মুহম্মদ বিন সাম। ‘মুঈনউদ্দীন’ ও ‘শিহাবুদ্দীন’ তাঁর উপাধি। ইনিই ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি নামে সুপরিচিত। সুলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত—মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বোধ করি শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরির আবির্ভাব হয়েছিল।

সবকিছু দেখেশুনে মনে হয় সুলতান মাহমুদের অসমাপ্ত মিশনকে সমাপ্ত করার জন্য বিধাতা তাঁকে হিঁদুস্তানে প্রেরণ করেছিলেন।

পৌত্তলিক নৃপতিদের বিরুদ্ধে সুলতান মাহমুদের যে ভূমিকা ছিল, মুহম্মদ ঘুরিও হিঁদুস্তানে সে ভূমিকাই পালন করে গিয়েছেন। পঞ্জাব, মুলতান, গুজরাট, কনৌজ, দিল্লি, আজমীর, বুন্দেলখণ্ড, বাংলা, বিহার সর্বত্রই তিনি শান্তি মিশন পরিচালনা করেছিলেন। এসব মিশন পরিচালনা ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি বলে স্বীকৃতিলাভ করেছে। বিশেষ করে, আজমীর বিজয় তাঁর জীবনের এক অক্ষয় কীর্তি বলে পরিগণিত হবে। আর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দীন আইবকের আরেক বিশ্বস্ত অনুচর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বিহার ও বঙ্গবিজয়—ভারত—ভূখণ্ডে ইসলামের অবিস্মরণীয় বিজয় বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে একথাও সত্য যে, সুলতান মাহমুদ ও ঘুরির দেশ—বিজয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। সুলতান মাহমুদ ছিলেন অপরাজিত বীর——মুজাহিদ ও গাজী; কিন্তু ঘুরি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করেছিলেন কিন্তু সে পরাজয় ছিল তাঁর জয়ের পূর্ব—লক্ষণ। পিছিয়ে এসে দীর্ঘ লাফ দেয়ার সাথেই তার তুলনা করা যায়। মুহম্মদ ঘুরি তাই—ই করেছিলেন।

ঘুরির ভারত অভিযানের—বলাবাহুল্য, শান্তি মিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে সমরাভিযান। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে রাজপুত বাহিনীর বিরুদ্ধে পরাজয় ছিল প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর বিজয়েরই আলামত। বাস্তবিকই তাই হয়েছিল—তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন। তারপর মীরাট, কোল, দিল্লি, কনৌজ, কালিঞ্জর ইত্যাদি বিজয়—প্রকৃতপক্ষে, ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হবার কথা ছিল না—হবারও নয়। কারণ, এ যুগের কবির কথায়—‘আল্লাতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান।’ বলাবাহুল্য, তাঁরা ছিলেন পূর্ণ ইমানের অধিকারী সাচ্চা মুসলমান। বাতিলপন্থীদের যত সামরিক ক্ষমতাই থাকুক না কেন, ইসলামের শান্তি মিশনের সাথে সংঘর্ষে পর্যুদস্ত হওয়াটাই ছিল প্রাকৃতিক বিধিবিধানের অংশ।

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় একটু সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা একান্ত আবশ্যক। এ পর্যন্ত ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কায়েমের ক্ষেত্রেও তিন বীর মুজাহিদের অবদান কারও চেয়ে খাটো করতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে, এ ছিল বিজয়ের ধারাবাহিকতায় তিনটি মনজিল। প্রথম মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী মুহম্মদ বিন কাসিম, দ্বিতীয় মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী সুলতান মাহমুদ আর তৃতীয় মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি। প্রথম জন ছিলেন আরব, পরবর্তী দু’জন তুর্কি—বলাবাহুল্য তরুণ তুর্কি। এ মহাত্মাদের বিপুল বিজয়াভিযান সিঁদুস্তান ভূখণ্ডে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার যেমন কায়েম করে, তেমনই পৌত্তলিক ভারতে ইসলামের বিজয় পতাকাতলে ইসলামের সুশীতল শান্তিবাতাস প্রবাহের পথ প্রশস্ত করে, মুসলমানদের বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। এভাবে এ ভূখণ্ডে ইসলামের এক দীর্ঘস্থায়ী বিজয় সূচিত হয়। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ বিন কাসিম ও সুলতান মাহমুদ ভারতে ধারাবাহিক ও স্থায়ী মুসলিম শাসনব্যবস্থা ঠিক পুরোপুরি কায়েম করে যেতে পারেননি; সে কাজটি সম্পন্ন করেন মুহম্মদ ঘুরি। বাস্তবিকই ভারতে স্থায়ী মুসলিম রাজ কায়েমের মধ্য দিয়ে ভারত—ইতিহাসে তিনি তিনি চিরস্থায়ী সম্মানের অধিকারী হয়ে গেলেন।

সাত

মুহম্মদ শিহাবউদ্দীন ঘুরির ভারত বিজয়ের সাথে, ভারতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মুহম্মদ ঘুরির ভারতাভিযানের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমান আধ্যাত্মিক মিশনারিরা ইসলাম প্রচারে বাতিলপন্থীদের দ্বারা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন। অতীতে যেমন হয়েছিলেন—ইসলামের নবি—রসুলেরা! পৌত্তলিকতার অন্যতম ও শক্তিশালী ঘাঁটি ভারতে নায়েবে রসুলেরা ইসলাম প্রচারে প্রাণঘাতী বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর এ বাধ্য অপসারণ করে ইসলামের শান্তির ধারাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য ভারতে বারবার সমর—মিশন পরিচালনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তখনও পর্যন্ত এ সমর—মিশন পরিচালনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন ইসলামের উপর্যুক্ত তিন বীর মুজাহিদ।

শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরির সাথে ভারতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরির বিজয় প্রকৃতপক্ষে এ ভূখণ্ডে ইসলামের আধ্যাত্মিক বিজয়ের পথকেও সুগম করেছিল। এ বিজয়ের মধ্য দিয়েই রাজস্থান প্রদেশের আজমীরে ইসলামি আধ্যাত্মিক মিশনের শান্তির বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন সুলতানুল হিন্দু খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি সঞ্জরী রহমাতুল্লাহ আলাইহে। বলাবাহুল্য, তৎকালীন আজমীর এলাকার শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহান তাঁর আধ্যাত্মিক মিশনকে বারবার বাধাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ যাঁর ললাটে হিঁদুস্তানের আধ্যাত্মিক সম্রাট হওয়ার সৌভাগ্যচিহ্ন অঙ্কন করে দিয়েছিলেন, সেখানে হিঁদুস্তানের একজন প্রাদেশিক শাসকের ঔদ্ধত্য কীভাবে টিকে থাকতে পারে? পর্যুদস্ত ও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলেন পৃথ্বিরাজ চৌহান। সেই আজমীর আজ পৃথ্বিরাজ চৌহানের জন্য নয়, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির কারণেই পুণ্যতীর্থক্ষেত্রে পরিণত বিগত হাজার বছর ধরে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সে পুণ্যতীর্থক্ষেত্রে এসে সেই মহাসাধকের স্পর্শপদ—ধন্য—ধূলিকণা মাথায় করে নিয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে হিঁদুস্তানে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ধারায় চার মহাপুরুষের নাম অতীব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। এঁরা হলেন খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকি, খাজা ফরীদউদীন মাসউদ গঞ্জশকর ও হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহ আলাইহে।

হিঁদুস্তানে মুসলমানদের রাজনৈতিক মিশনের সাথে—সাথেই আধ্যাত্মিক মিশনের ধারা এ মহাপুরুষেরা সুযোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ওই রাজনৈতিক পটভূমিকায় এ মহাপুরুষদের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনা করা হবে। এর ফলে, তৎকালীন হিঁদুস্তানের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পটভূমি, পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝতে সহজ হবে।

চিশতিয়া তরিকার পীর, মহান বুজুর্গ ও ইসলামের নৈতিক—আধ্যাত্মিক দর্শনের মহান প্রচারক খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি ১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে সাজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন প্রসিদ্ধ সাধক খাজা গিয়াসউদ্দীন হাসান চিশতি। তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে মহানবির (স) দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসেনের (রা) বংশধর। মহাত্মা খাজা বিদ্যাশিক্ষা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তবে প্রথমে গিয়েছিলেন সমরখন্দে। সেখানে তিনি পবিত্র কুরআন মজীদের ত্রিশ পারা সম্পূর্ণ মুখস্ত করে নেন এবং ইসলামি জ্ঞানার্জনের সাধনায় নিয়োজিত হন। তারপর তিনি প্রসিদ্ধ সাধক হজরত খাজা উসমান হারুনীর (র) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখান থেকে নিজ পীরের সাথে তিনি দামিশক সফর করেন। সেখানে ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধকদের বড় একটি জামাতের সাথে তাঁর দেখা হয়ে যায়। তাঁরা সকলেই আল্লাহর ধ্যানে এমনভাবে মশগুল ছিলেন যে, তা দেখে তাঁর হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, তা থেকে তিনি আল্লাহ প্রেমের এক গভীর মাদকতা অনুভব করেন এবং উপযুক্ত সুফল লাভে সমর্থ হন। সেখান থেকে তিনি মক্কা মুআজ্জমা ও মদিনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে রওনা হন। সে সময়েও তাঁর পীর খাজা উসমান (র) তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। তাঁর পীর খাজা উসমান আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভে পাকা—পোক্ত করে দিয়ে তাঁকে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার জন্য পাঠিয়ে দেন। মঈনউদ্দীন পীরের আদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রথমে মাতৃভূমি সাজিস্তান এবং সেখান থেকে একটি আধ্যাত্মিক দল নিয়ে হিরাট, বলখ ও গজনী হয়ে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং অচিরেই দিল্লি এসে পৌঁছান।

দিল্লি থেকে ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ জন সাথি নিয়ে তিনি আজমীরের নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছান। রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের রাজকর্মচারীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই কিছুকাল অবস্থান করেন। কিন্তু এ আধ্যাত্মিক দলের সন্তোষজনক আচরণে খুশি ও নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁদের ছেড়ে দিলে তাঁরা আজমীরে এসে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁরা একটি আশ্রয়—শিবির গড়তে চাইলে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে থাকেন।

এসব বাধাই অবশেষে পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাজস্থানের আজমীরের মাটিতে হিঁদুস্তানের যে সুলতান তাঁর আধ্যাত্মিক শান্তির ছত্র ধরতে চেয়েছিলেন, তাই বাস্তবায়িত হলো কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথ্বিরাজের ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার। একইভাবে, সেখানে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক অধিকার যেমন কাযেম হলো, তেমনি কায়েম হলো মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার।

খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির (র) আধ্যাত্মিক উত্তাধিকারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য ও অনুচর খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) উপর। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনার পূর্বে আবারও আমরা হিঁদুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করব।

মুঈজউদ্দীন বিন সাম বা মুহম্মদ ঘুরি ভারতে পাকাপোক্তভাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার কায়েম করার পর তার উত্তর—দায়িত্বের ভার তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ও দাস সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবকের হস্তে অর্পণ করে আপন রাজ্যে ফিরে যান—সেই সাথে তাঁকে দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তির সনদ দিয়ে যান। সুযোগ্য সেনাপতি ও বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দীন আইবক অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সে সাম্রাজ্যের হাল ধরেন এবং অনিতিবিলম্বেই দিল্লিতে মুসলিম রাজত্বের গোড়াপত্তন করে তাকে রাজধানীর মর্যাদায় উন্নীত করেন। এক মহিমান্বিত সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রূপেও দিল্লিতে মুসলিম—রাজ্যের রাজধানী কায়েম তাঁর জীবনের একটি অতীব উজ্জ্বল ও মহৎ কীর্তি। মুহম্মদ ঘুরি যাঁকে দাসত্বমুক্তির সনদ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দুর্ভাগ্যক্রমে ইতিহাসে দাসবংশ রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু নির্ভুল ও নির্মোহ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে সে বংশকে দাসবংশ বলে মেনে নেওয়া যায় না। কুতুবউদ্দীন আইবক ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইতিহাসে তা দাসবংশরূপে সুপরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল একজন স্বাধীন নৃপতি কর্তৃক এক স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা। সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের অমর কীর্তি হলো নূর কুতুবুল আলম খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে নামাঙ্কিত কুতুবমিনার প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে, এ কুতুব মিনার হলো মুসলমানদের দিল্লি বিজয়ের স্মারক। মহাত্মা কুতুবউদ্দীনের নামে তা উৎসর্গিত ও নামাঙ্কিত করা হয়।

এখন মহান সাধক খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক। কারণ খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতির (র) খলিফা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর বৃত্তান্ত এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক মিশনের সাথে সাথেই হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন সমভাবে কার্যকর ছিল।

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র) মাওরাউন নহর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দেড় বছর বয়সে পিতৃহীন হলে তাঁর মা তাঁকে শিক্ষিত করে তোলেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মওলানা আবু হাফস ওশীর অধীনে তিনি শিক্ষা সমাপন করে বাগদাদে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন তারপর তাঁর পীর—মুর্শিদের নির্দেশে হিঁদুস্তানে গমন করে দিল্লিতে এসে আধ্যাত্মিক শিবির স্থাপন করেন। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন; তা সত্ত্বেও রাজদরবার ও রাজনীতির সাথে তিনি কোনো রকমের সম্পর্ক রেখে চলেননি। দিল্লি মহানগরের কিলোঘরী নাম স্থানে মালিক ইজজুদ্দীনের নামে নামাঙ্কিত মসজিদের নিকটে তিনি ত্যাগী ফকিরের ন্যায় জীবন অতিবাহিত করেন কিন্তু কোনো দিন কোনো অবস্থাতেই সুলতানের দরবারের হাজিরির খেয়াল তার মনে কখনো আসেনি; কিন্তু সুলতান আলতামাশ তাঁর খানকাহ দরবারে নিয়মিত হাজিরা দিতেন।

মহত্মা খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর দিল্লি আগমনের কয়েক দিন পরেই দিল্লির প্রসিদ্ধ সাধক শায়খ—উল—ইসলাম মওলানা জামালউদ্দীন বুস্তামির (র) ইন্তিকাল হয়ে যায়। মওলানা বুস্তামির ইন্তিকালের পর সুলতান আলতামাশ ‘শায়খ—উল—ইসলাম’ খেতাব খাজা বখতিয়ার কাকীকে (র) দিতে চাইলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে দিল্লির আরেক মহান সাধক শেখ নজমউদ্দীন সুগরাকে (র) ঐ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

খাজা বখতিয়ার কাকী দিল্লিতে অবস্থান করেই তাঁর আধ্যাত্মিক মিশন জারি রাখেন। একদা মহাত্মা খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার শান্তিবৃক্ষ আজমীরে রোপণ করেন তাঁর উপযুক্ত শিষ্যসামন্তদের দ্বারা তা হিন্দুস্ত ানের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছায়াদার শান্তিবৃক্ষের ন্যায় ছায়া প্ৰদান করতে থাকল।

মহাত্মা খাজা বখতিয়ার কাকীর নাম হিঁদুস্তানের ইসলামি আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর সেই মহান সাধকের নামে নামাঙ্কিত মুসলমানদের হিঁদুস্তান বিজয়ের স্মারক রূপে কুতুবমিনার নাম ধারণ করে জগতে অক্ষয় হয়ে অবস্থান করবে।