» » » পঞ্চদশ অধ্যায় : মোগলদের বিদ্রোহ

বর্ণাকার

পঞ্চদশ অধ্যায় : মোগলদের বিদ্রোহ

কুজ বেগদের বিদ্রোহ দমন করে আমি সবে কাবুলে ফিরেছিলাম, তখনই খবর এল যে, করিমদাদ ও বাবা কিফরা, অস্তরাগচে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা জাহাঙ্গীর মির্জার কিছু সাথি সরদারকেও আমার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে।

এটা কোনো ভালো খবর ছিল না। আমি তৎক্ষণাৎ কঠোরভাবে হুকুমনামা জারি করলাম যে, ষড়যন্ত্রকারীদের প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।

তাদের ধরা হলো। ফাঁসি দেওয়ার জন্য তাদের প্রকাশ্য বাজারে নিয়ে যাওয়া হলো।

যখন তাদের ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছিল সে সময় কাশিম বেগের সুপারিশে খলিফা আমার কাছে এলেন। তিনি অসময়ে আগমনের জন্য খেদ প্ৰকাশ করলেন।

তিনি নিজের কথা তুললেন। তাঁকে খুশি করার জন্য আমি দোষীদের ফাঁসি রদ করে দিলাম। কিন্তু তাদের হেফাজতে রাখার আদেশ দিলাম।

খলিফার কথার মর্যাদা রাখা আমার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাঁর শুধু সামাজিকই নয়, ধর্মীয় সম্মানও এত পরিমাণ ছিল যে, এ কথা যদি দেশে ছড়িয়ে পড়ত যে, আমি খলিফার কথা মানিনি তাহলে পুরো দেশের মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিত।

এই সময়ে খুসরো শাহের অধীনস্ত সেবকরা হিসার থেকে কুন্দুজ পর্যন্ত মোগল, চিলমা, সৈয়দ ও সকমা সরদারদের মধ্যে গিয়ে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রচার করা শুরু করে দিল।

দুই তিন হাজারের মতো তুর্কি যুবক খোদা বখ্‌শের নেতৃত্বে শব্দক থেকে শাহনুর পর্যন্ত বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসে গেল। ওই পর্যন্ত পৌঁছানোর মধ্যে তারা মোগল, চিলমা, সৈয়দ ও শকমা সরদারদের কাছ থেকে খুব বড় সাহায্য পাওয়ার আশা করেছিল। তবে, শাহনজর পর্যন্ত এসে যাওয়ার পর যখন তুর্কিদের মনে হলো যে, আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তাদের শক্তি যথেষ্ট নয় তখন তারা খাজা রিয়াজের আশ্রয়ে গিয়ে পৌঁছাল। তারা খাজা সাহেবের কাছ থেকে আমার বিষয়ে রায় জানল।

খাজা সাহের তাদের কী রায় দিলেন, তা আমি জানতে পারলাম না। তবে একথা জানতে পারলাম যে, আবদুর রজ্জাক চালাক উপত্যকায় তাদের কাছে এসে মিলিত হয়েছে। ওই সময়ে আমার প্রতি আবদুর রজ্জাকের মনোভাবও বিগড়ে ছিল। ওই সময়ে খলিফা ও মোল্লা বাবা আমাকে এক-দুবার পরামর্শ দিতে এলেন। তাঁরা আমাকে ইঙ্গিত দিলেন যে, আমার বিরুদ্ধে মোগলদের বিদ্রোহ দিনের-পর দিন তপ্ত হয়ে উঠছে।

এখনও পর্যন্ত আমার সৈনিক জীবন এরই মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছিল। কারা বিদ্রোহ করছে, কোথায় আমার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এ সবের উপর দৃষ্টি রাখা এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াটা আমার কাজ ছিল। এ জন্য তাদের ইঙ্গিতের উপর আমি মনোযোগ দিলাম না।

একদিন রাতে, যখন আমি নামাজ পড়ে চারবাগের দরবারে এসে বসে ছিলাম, ওই সময়ে মুসা খাজা একজনকে সঙ্গে নিয়ে খুবই দ্বিধা-সংকোচের সঙ্গে আমার কাছে এলেন। তিনি আমার কানে কানে বললেন—মোগলদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য সঠিক যে তারা বিদ্রোহী হয়ে গেছে। একথাও জানা গেছে যে, আবদুল রজ্জাককে তারা তাদের পক্ষে টেনে নিয়েছে, তবে এ খবর পুরো ঠিক নয়। আজ রাতে তারা কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে পারে।

আমি সহজ রইলাম। কিছুক্ষণ পর আমি হেরেমের দিকে গেলাম যা ওই সময়ে ওই দুই বাগের মধ্যে অবস্থিত ছিল।

আমি সেখান থেকে এক বাহাদুর গোলামকে সাথে করে নিলাম এবং নীরবে শহরে বের হলাম। আমি নিজেই আমার বিরুদ্ধে উত্থিত বিদ্রোহের সঠিক জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শহরের বাজারগুলোতে সাধারণ দিনের মতেই দিনটা ছিল। কোথাও বিদ্রোহ বা আমার নাম নিয়ে কোনো চর্চা চলছিল না।

আমি নগরের প্রধান দরওয়াজা, যাকে লৌহদ্বার বলা হতো, সেখান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম। খাজা মুহম্মদ এবং অন্য পাহারাদাররাও সাধারণ দিনের মতো পাহারাদারি করছিল। সে আমাকে তার দিকে, বাজারের দিক থেকে চলে আসা সড়কে দেখেছিল। সে আমার পানে আসতে লাগল।

আমি ওই বিদ্রোহীদের সম্পর্কে কথাবার্তা বললাম। তাকে সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিলাম।

আমি রাতারাতি প্রস্তুত করিয়ে নিয়েছিলাম। সকাল হতেই আমি পাঁচশো বিশ্বস্ত, বাহাদুর সৈনিককে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলাম।

অনতিবিলম্বেই আমি সুসংবাদ পেলাম যে, তিন হাজার সশস্ত্র বিদ্রোহীর উপর আমার পাঁচশো সৈনিক এমন আক্রমণ চালাল যে, তাদের জন্য পালাবার পথ পাওয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যেকার অধিকাংশকেই মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমার বিশ্বস্ত সৈনিকেরা বিদ্রোহীদের কাবুলে ঢোকার আগেই ঘিরে ফেলেছিল। বিদ্রোহীদের কোনো রকমের সুযোগ না দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে নিকেশ করতে শুরু করে দিয়েছিল।

এইভাবে অতি দ্রুত গতিতে বিদ্রোহীদের দমনের পর জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা ওখানেই চাপা পড়ে রয়ে গেল। বিদ্রোহীদের দমনের খবর শুনতেই আমি ওই দুই বন্দীকেও মৃত্যুর স্বাদ চাখিয়ে দিলাম। খলিফার সুপারিশে যাদের আমি প্রকাশ্য ময়দানে মৃত্যুদণ্ড রদ করেছিলাম। তারাই ছিল বিদ্রোহের মূল। বিদ্রোহের আগুন তারাই জ্বালিয়েছিল। তাদের জীবন দান আমার জন্য এক ভয়ংকর ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারত।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. প্রকৃতপক্ষে দেশে শাসক বদল হতে থাকে, তবে সময়ের খলিফার তাজ ও তখতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না। খলিফা ধর্মীয় নেতৃত্বে থাকেন এবং ধর্ম-বিষয়ক রীতি-নীতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সেজন্য মানুষের ভক্তিভাব তাঁর উপরে থাকে, তাঁরা তাঁর দেওয়া ধৰ্মীয় নির্দেশ মেনে চলে। বাদশাহ তাতে বাদ সাধতে পারেন না। কারণ বাদশাহও ওই নিয়মের অধীন। —অনুবাদক