ষোড়শ অধ্যায় : বাবুরের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য
এ বছরের শুরুতে শাহ ইসমাঈল ও মুহম্মদ শায়বানি খান উজবেকের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার খবরে কাবুল সরগরম হয়ে রইল। শাহ ইসমাইল শায়বানির বিরুদ্ধে সেনাভিযানের আদেশ দিয়েছেন, এ খবর বছরের মধ্যভাগে এসে আমার কাছে এসে পৌঁছাল।
রমজান মাসে (ডিসেম্বর, ১৫০৯ ঈ.) মির্জা খান বেগ এসে একটি চাঞ্চল্যকর খবর দিলেন। তা ছিল ‘শাহ, ইসমাঈল নর্ভ-এর নিকট শায়বানিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছেন।
আগে আমার কাছে একটি অপুষ্ট খবরও এসেছিল যে, শাহ ইসমাঈল শায়বানিকে শুধু পর্যুদস্তই করেননি, তার মাথাও ধড় থেকে নামিয়ে দিয়েছেন।১
খবর নিঃসন্দেহে অপুষ্ট ছিল তবে আমার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণকারী ছিল। আমি নিজে বহুকাল ধরে শায়বানির সঙ্গে সামনা-সামনি মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে আসছিলাম। যদি শাহ ইসমাঈলের হাতে শায়বানির মৃত্যু হয় তাহলে আমার অংশে বদলা নেওয়ার জায়গাটা আর কোথায় অবশিষ্ট থাকত?
মির্জা খান পরে এ খবরও দিলেন—
‘উজবেকদের মধ্যে ছোটছুটি শুরু হয়ে গেছে। তারা সবাই আমু এলাকা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে চলে গেছে। আমু-র, তা সে উজবেক আমির হোক কিংবা সাধরণ মানুষ হোক, তারা আমু-র সাথে সাথে কুন্দুজ ছেড়েও পালিয়ে যাচ্ছে। কুড়ি হাজার মোগল সৈনিক মরগুয়া থেকে নিয়ে কুন্দুজ পর্যন্তকার সমস্ত এলাকা উজবেক-মুক্ত করে তুলোছে ‘
মির্জা খান পরে আরো বললেন—
আমি কুন্দুজ থেকে আসছি। আমি সবকিছু স্বচক্ষে দেখেছি।’
আমি মির্জা খানের কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করলাম। অবিশ্বাসের কোনো কারণ ছিল না।
শাহ ইসমাঈলের পক্ষ থেকে বাবুরকে আমন্ত্রণ
মির্জা খান ওয়াইস কুন্দুজ ফিরে গিয়ে বাবুরকে পত্রবাহক দ্বারা বার্তা পাঠালেন। বার্তায় লেখা ছিল— ‘শাহ ইসমাঈল, তাঁকে (বাবুর) আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বলেছেন তিনি এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। একথাও বলেছেন যে, তিনি তাঁকে সহযোগিতা দিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের এলাকাকে তাঁকে দেওয়ানোর ইচ্ছা রাখেন।’
মির্জার পত্র যখন আমার কাছে পৌঁছাল, তখন পর্যন্ত তুষারপাতের কারণে কুন্দুজ পর্যন্ত উপত্যকা প্রায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছিল।
আমি আব-দারার রাস্তা ধরলাম। রমজানের শুরুয়াতি দিনগুলোতে আমি বারমান হয়ে অগ্রসর হতে থাকলাম।
আমি যখন কুন্দুজে পৌঁছালাম তখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির খবর খুব উৎসাহব্যঞ্জকভাবে মির্জা খানের পক্ষ থেকে আমাকে দেওয়া হলো। তিনি মরওয়ার সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইরানের সুলতান শাহ ইসমাঈল কীভাবে শায়বানিকে পর্যুদস্ত করেছিলেন, এ কথা তিনি খুব আবেগভরে বলতে লাগলেন।
তাঁর এবারের বিবরণে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, যুদ্ধে শয়বানি বীরের মতো লড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি একথাও বলেন যে, শাহ ইসমাঈল তাঁর জন্য সমরখন্দের শাসন প্রকাশ্যে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ওদিকে অগ্রসর হয়ে সহজে সমরখন্দ অধিকার করতে পারেন। অন্যান্য উৎসাহব্যঞ্জক তথ্যাবলির মধ্যে মির্জা খানের পক্ষ থেকে যা পাওয়া গেল, তা ছিল এরকম—
‘আমার চাচা মাহমুদ মির্জা ও আহমদ মির্জার ফৌজ অকশায় শয়াবানির দ্বারা মর্মান্তিকভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁরা এ সময়ে খুরাসানে গিয়ে মুগলিস্তানে পলায়িত আছেন। অনেক বড় সংখ্যক মোগল ফৌজ কাশগড়ে আমার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। তাঁরা হলেন সেই ফৌজ, শায়বানি যাদের পরাজিত করে বন্দী করে রেখেছিলেন। শায়বানির মৃত্যুর পর তাঁরা মুক্ত। কিছু মোগল সৈনিক পশ্চিম দিক থেকে এসে আমার প্রতীক্ষায় আছেন।
এরকম মোগল সৈনিকের সংখ্যা ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। ওই সৈনিকদের এক শক্তিশালী নেতৃত্বের খুব প্রয়োজন ছিল। তারা হতাশ ছিল, নেতাবিহীন ছিল। আমি কুন্দুজ অভিমুখে রওনা হয়ে গেছি। ওখানে আমি দ্রুত পৌঁছাব, মির্জা খান ওয়াইস এই বার্তা পাঠিয়ে তাদের উৎসাহিত করে রেখেছিলেন।
মির্জা খান ওয়াইসের সফল রাজনীতি ওই সময় তুঙ্গে উঠেছিল। তিনি তাদের আশ্বস্ত করে রেখেছিলেন এবং বিশ্বাস দিয়ে রেখেছিলেন যে, আমার নেতা পেলেই তাদের হৃত মর্যাদা শুধু পুনরুদ্ধারই হবে না; বরং তারা এই ভেবে গর্বিত হবেন যে, তাঁরা কাবুল ও মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় যোদ্ধা বাবুরের বাহিনীর সৈনিক।
আমি যে ফৌজ নিয়ে মির্জা খানের কাছে পৌঁছেছিলাম, তার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। তারাও মোগল সৈনিক ছিল। পাঁচ হাজার মোগল সৈনিকের সঙ্গে কুড়ি হাজার মোগল সৈনিক বেড়ে যাওয়া গর্বের কথা ছিল।
আমি তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে খাকান থেকে নিয়ে আন্দিজান অবধি জয় করতে করতে মোগলদের নিষ্কণ্টক মোগলিস্তান দিলাম। ওই এলাকাগুলোতে শাসনকারী উজবেক প্রশাসকদের খেদিয়ে সেগুলো মোগল প্রশাসকদের হাতে তুলে দিলাম। মোগলদের ‘খান’ উপাধি প্রদান করলাম।
অল্পকিছু সময় কুন্দুজে অতিবাহিত করে আমি হিসার অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম। ওখানে উজবেক সুলতান মেহেদি ও হামজা শাসন করছিলেন।
আমার হিসার আগমনের খবর পেয়ে পথিমধ্যে দু’জনেই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিনা যুদ্ধে তাঁরা আমার বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
বাবুরের প্রতি শাহ ইসমাঈলের অনুকম্পা
আমি তখনও কুন্দুজেই ছিলাম, তখন আমার বোন খানজাদাকে শাহ ইসমাঈল কর্তৃক তাঁর সামরিক সুরক্ষায় পাঠানো হলো। এটি শাহ ইসমাঈলের অনুকম্পা ছিল। আমার বোন খানজাদাকে শায়বানি জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল। মরওয়ায় শায়বানি ও তার সিপাহসালার সৈয়দ হায়দারের পরাজয়ের পর তার সৈন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর, শাহ ইসমাঈল পরাজিত উজবেকদের শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। কিছু শিবির জেনানখানা (মহিলা আবাস) রূপে ছিল। সেগুলোতে নারী ও শিশুরা ছিল।
শাহ ইসমাঈল প্রত্যেকের সঙ্গে রাজকীয় আচরণ করেছিলেন। তিনি তাঁর শাহী বাহিনীয় সুরক্ষায় নারী ও শিশুদের ওই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যেগুলোকে তারা নিরাপদ বলে মেনে নিতে চাচ্ছিল।
খানজাদার পরিচয় পাওয়ার পর শাহ ইসমাঈল তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
শাহ ইসমাঈলের এই মানবিক ব্যবহারের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমি সুদীর্ঘ কৃতজ্ঞতাসূচক পত্র শাহ ইসমাঈলকে লিখলাম এবং মির্জা খানকে তাঁর সেবায় পাঠালাম। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন পত্রের সঙ্গে আমি মূল্যবান উপহার ও কিছু মৌখিক বার্তা পাঠালাম, যা মির্জা খান শাহ ইসমাঈলের সামনে উত্তম ভাবে বয়ান করতে পারেন।
আমি শাহ ইসমাঈলের বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য নিবেদন করেছিলাম, তাঁর আন্ত রিকতা প্রার্থনা করেছিলাম।
আমি হিসার অভিমুখে পুনরায় রওনা হয়ে গেলাম। সেখানকার শাসন ব্যবস্থা শক্ত-পোক্ত করে তোলা এবং তাকে শত্রুদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করাটা ছিল আমার জজবাতি মামলা। সেখানে আমার পূর্ব পুরুষ তাইমুরের সালতানাত ছিল। উজবেকরা অনেক কাল ধরে তা অধিকার করে রেখেছিল। যদিও আমি হিসারকে, উজবেকদের কবল থেকে মুক্ত করিয়ে নিয়েছিলাম, তবুও এ সম্ভাবনা আমি অস্বীকার করতে পারতাম না যে আমার শক্তি বিকেন্দ্রিত করতেই তারা হিসারকে পুনরাধিকার করার চেষ্টা করতে পারে।
হিসার পৌঁছাতেই এ সম্ভাবনা সত্য রূপে সামনে আসতে দেখলাম। পুল-এ-সঙ্গ (পাথরের সেতু)-এ উজবেকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার খবর এল। তারা আক্রমণমুখী ছিল।
একদিন মির্জা খান, শাহ ইসমাঈলের কাছ থেকে ফিরে হিসারে আমার কাছে এসে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি খবর দিলেন যে, শাহ ইসমাঈল তার ইরানি বাহিনীর কিছু অংশ উপহার স্বরূপ পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইরানি সেনা দ্রুত এসে আমার বাহিনীতে যোগ দেবেন।
মাসের শেষের দিকে উজবেক বাহিনী একদিন সকালে দ্রুত এসে সুখ-আব সেতুর নিচে পৌঁছে গেল।
খবর পেতেই আমি দ্রুতগতিতে পাহাড়ি রাস্তা ধরে আব-দারা পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম। সেখানে পৌঁছেই যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
উজবেকদের উপর, পাহাড়ি রাস্তা ধরে এসে আমার সৈন্যরা যে হামলা চালাবে এ আশঙ্কা ছিল তাদের কল্পনাতীত। তারা তো সেতুর রাস্তা ধরে সে আগমনেরই আশা করছিল। মধ্যভাগ থেকে তাদের উপর হামলা হওয়াতে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ওই হামলায় উজবেকরা দলে দলে মারা পড়ল। পিছনে ফেরার কোনো সুযোগই তাদের দেওয়া হয়নি। জান বাঁচানোর জন্য তারা সামনে দরবন্দ-এ-আহন (ইরান দওয়াজা) র দিকে ছুটল। তারা এক রকম নিজেরাই দলে দলে মৃত্যুর মুখের দিকে ছুটছিল। পরে, হিসার সীমান্তে অবস্থিত কুসল থেকে কছম খান এক বড় বাহিনী নিয়ে নেমে পড়ল।
কছম খান ছিল সয়ারানির উত্তরাধিকারী। সে উজবেক সরদারদের পক্ষ থেকে ‘উজবেক খাকান’ উপাধি লাভ করেছিল।
কছম খান জান বাজি রেখে আমার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যে তুমুল যুদ্ধ চালিয়ে গেল, সে কথা আমি হায়দার নামক ব্যক্তির কাছ থেকে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হায়দায় যুদ্ধের পুরো দৃশ্যটি স্বচক্ষে দেখেছিল।
আমি স্বয়ং যেহেতু সুখ-আব-এর মোর্চা থেকে উজবেকদের যুদ্ধের মজা চাখাচ্ছিলাম, সে জন্য কুরসলের উত্তরে উজবেক বাহিনীর যুদ্ধ দেখতে পারি নি। তাদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল হিসার দরওয়াজায় প্রধান রক্ষকের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
হায়দারের বয়ান অনুসারে-’কছম খান বাঘের মতো লম্বা-লম্বা লাফ দিয়ে মোগল সেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। সে যেখানেই পৌঁছাচ্ছিল, সেখানেই মোগল সৈনিকদের পংক্তি ফাঁকা করে দিচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্য তার সামনে দাঁড়ালে তার মুণ্ডু গড়াগড়ি যেত। সে অত্যন্ত ভয়ংকর ভাবে জান বাজি রেখে যুদ্ধ করছিল।’
বাবরনামা অনুসারে-সমরখন্দ পুনঃপ্রাপ্তির জন্য যখন আমি (বাবুর) অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন এইরকমই একটি ‘পুল’-এর উপর উজবেকদের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধে আমাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। আমি সমরখন্দে পৌঁছাতে পারিনি।
ওই দিনও যদি ‘পুল’-এর যুদ্ধে হেরে যেতাম তাহলে হিসার আমার হাত থেকে বেরিয়ে যেত, তবে, বিপুল সংখ্যক মোগল সেনার সামনে, সন্ধ্যা পর্যন্ত টেনে আনা যুদ্ধে উজবেক সেনা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তার কিছু শীর্ষ সরদারই মাত্র বেঁচে ছিল, আমার সৈন্যরা যাদের জীবিতাবস্থায় ধরে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
অস্ত্র সমর্পণকারী প্রধান লোকেদের মধ্যে য়াহুদি, হামজা ও তার পুত্র মামক ছিল প্রধান। আমার সামনে তাদের নিয়ে আসা হলো।
আমার মন-মস্তিষ্কে তখন হায়দার দ্বারা বর্ণিত উজবেকদের সাহসিক যুদ্ধের দৃশ্য ভাসছিল। আমার মস্তিষ্কে এটাই ভাসছিল যে, ওরা আমার বাহাদুর সঙ্গীদের রক্ত বইয়ে দিয়েছে, এ কথা মনে আসতেই আমি হুকুম দিলাম—
‘খুন কা বদলা খুন! ইনকে কাপড়ে ভী খুন সে রংগ দো।’
‘রক্তের বদলে রক্ত! এদের বস্ত্রও রক্তে রাঙিয়ে দাও।’
ইরানি সেনা উপহার
যুদ্ধ সমাপ্তির পর আমি হিসারের নাগরিক বসতির দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। রাস্তায় স্থানীয় উপজাতির বহুসংখ্যক লোক আমাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল।
ওখানেই আমি এক বিশাল ইরানি সেনাকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ওই সেনা শাহ ইসমাঈলের পক্ষ থেকে আহমদ বেগের নেতৃত্বে আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল।
শাহ ইসমাঈল সিল করা লিফাফাও পাঠিয়েছিলেন, যেটি খান্দ আমির নিয়ে এসেছিলেন। আমি লিফাফা খুললাম। পত্র পড়লাম। শাহ ইসমাঈল ট্রান্স অক্সিনিয়া বিজয়ের জন্য আমাকে পূর্ণ সহায়তা দানের আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আমি পত্রবাহক খান্দ আমিরের সামনে শাহ ইসমাঈলের নামে খুৎবা পড়লাম। মুদ্রায় আমি স্বেচ্ছায় ওই বারো ইমামের নামের মোহর লাগানোর কথা বললাম, শাহ ইসমাঈল যাদের মান্য করতেন। আমি উজবেকদের শক্তি সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার কথাও বললাম।
এ সব কথা আমি শাহ ইসমাঈলকে বেশির চেয়েও বেশি করে প্রসন্ন করার জন্য বলেছিলাম। ওই সময়ে ইরানের শাহের ন্যায় বড় কোনো বাদশাহ মধ্য এশিয়ায় ছিলেন না। তিনি নিজে একজন শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর বিশাল সেনা ছিল। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে মান্যকারী অথবা সম্প্রদায়ের সঙ্গে নৈকট্য রক্ষাকারীদের প্রতি সম্পূর্ণ উদার ছিলেন।
তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি যে লোক বা জাতি বিরুদ্ধাচরণ করতেন, তিনি তাদের কট্টর শত্রু ছিলেন। মোগল ও মির্জা ঘরানার লোক শাহ ইসমাঈলের সম্প্রদায়ের উদার রুখের সমর্থক ছিলেন, যেখানে উজবেকবিরোধী বিরোধী ছিলেন। উজবেকরা যখন শক্তি বাড়িয়ে মির্জা ও মোগলদের ক্ষেত্র অধিকার করতে নেমে পড়েছিল, তখন শাহ ইসমাঈল খোদায়ী ফৌজদার হয়ে উজবেকদের নাশ করতে ইরান থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
তিনি তখনও মধ্যে এশিয়ার উজবেকদের বিতাড়িত করে, বিজিত এলাকায় সেনা ছাউনি ফেলে রেখেছিলেন।
তিনি মির্জাদের নির্ভয় করে দিয়েছিলেন। মোগলদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। তিনি এটাই ওজন করেছিলেন যে, মধ্য এশিয়ায় উজবেকদের মাথা তোলার আগেই কে তাদের দমন করতে পারে। আমার নামই তিনি নিয়েছিলেন। তিনি না চাইতেই সেনা সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং আগেও দিতে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আমি তাঁর মেজাজ বুঝে নিয়ে আমার পক্ষ থেকে কিছু মুখ্য বিষয়কে পত্রে লিখলাম। আমি জানতাম যে, ওই কথায় শাহ ইসমাঈল খুশি হয়ে যাবেন।
আমি তৎক্ষণাৎ লড়াইয়ে উজবেকদের পতন, মেহেদি ও হামজার উপর বিজয়ের কথাও লিখে দিয়েছিলাম
শাহ ইসমাঈলের দূতকে পত্র লিখে রওনা করিয়ে দেওয়ার পর আমার সেনানায়কদের সঙ্গে সলা-পরামর্শে বসে গেলাম। পরামর্শে একথা সর্বসম্মতিক্রমে সামনে এল যে, আমাকে সমরখন্দ ও বুখারা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।
এক সেনানায়ক বললেন— ‘বুখারা এখন সেনামুক্ত এবং মুর্খদের দ্বারা ভয়ে আছে।’
বুখারার শাসক উবাইদ খাঁ এ সময়ে পালিয়ে গিয়ে কুর্শলের মধ্যে নিজেকে সীমিত করে নিয়েছিলেন।
আমার সেনা বুখারা অভিমুখে রওনা হয়ে গেল। সেনার অনুসন্ধানী দলকে আমি কুর্শলের দিকে রওয়ানা করিয়ে দিলাম। উবাইদ খাঁ কুর্শল থেকে বেরিয়ে বুখারার দিকে পালিয়ে গেলেন। আমার সেনা তাকে ধাওয়া করল। তিনি উপত্যকা ও পাহাড়ি পথে সমতল এলাকায় নেমে তুর্কিস্তানে পৌঁছালেন। তুর্কিস্তান থেকে আরো কিছু রাস্তা যেত। তিনি কোন রাস্তা ধরে কোথায় যে পালিয়ে গেলেন তার আর হদিস পাওয়া গেল না।
উবাইদ খাঁ-র দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর, আমার সেনার জন্য বুখারা খালি পড়ে ছিল। তখন কোনো বাধা ছাড়াই বুখারা আমার অধিকারে এসে গেল।