দশম অধ্যায় : কাবুলের পথে বাবুর
ফারগানা রাজ্য ত্যাগ ও খুরাসান যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমি মুহররম মাসে গ্রহণ করি। আমি যাত্রা শুরু করলাম এবং হিসারের আলাক-ইয়ালাক নামক পাহাড়ি গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম। কালটা ছিল শীতকাল। আমি পাহাড় অঞ্চলে শিবির ফেললাম।
এই সময়ে আমি ২৩ বছর বয়সে প্রবেশ করেছিলাম। আমি আমার চেহারায় ক্ষুরের ব্যবহার শুরু করেছিলাম।
আমার সঙ্গে ওই সময় ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত বিশ্বস্ত সাথি ছিলেন। তাদের অধিকাংশই স্বাবলম্বী ছিলেন (সাধন সম্পন্ন ছিলেন, আর্থিকভাবে বাবুরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না)। এবং প্রশস্ত বক্ষ ও গ্রীবা বিশিষ্ট বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ ছিলেন। শিবির ফেলার পর আমি আমার সাথিদের সঙ্গে এই বিষয়ে পরামর্শ করতে লাগলাম যে, এখন আমাদের খুরাসান অভিমুখে রওনা হওয়া উচিত হবে কি-না। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল না। এখনও আমার আশা ছিল যে, হিসার রাজ্য থেকে অথবা খুসরো শাহের পক্ষ থেকে আমার যে কোনো প্রকারের সাহায্য মিলে যাবে।
এই আশা নিয়ে কিছুদিন যাবৎ আমি শিবির ফেলে রাখলাম। তবে কোথাও থেকে কোনো সহযোগিতা মিলল না। এই সময়ে পেশগড়ের ‘মুল্লা বাবা’ ওই পথ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি খুসরো শাহের মুরিদ (আস্থাভাজন)-দের অন্যতম ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো। তবে তাঁর দিক থেকেও আমি কিছু পেলাম না। যদিও তিনি যদি চাইতেন তাহলে তাঁর উপর আস্থা জ্ঞাপনকারী গোত্রের লোকেদের আমাকে সহযোগিতা করতে বলে দিতেন। তা ছিল তাঁর ইশারার অপেক্ষা মাত্র। সাথে সাথে তারা এসে যেত।
সেখানে শিবির ফেলে তিন-চার দিন যাবৎ সামরিক সহযোগিতা পাওয়ার কোশেশ করতে থাকলাম। কোনো সাফল্য না পেয়ে অগত্যা সেখান থেকে ডেরা গুটিয়ে নিলাম। অধিক দিনযাবৎ পড়ে থেকে কোনো লাভ ছিল না। সেখান থেকে রওনা হয়ে আমরা হিসারের এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম যেটি ইমাম মুহিব্ব’ নামে সুপরিচিত ছিল। সেখানে পৌঁছাতেই খুসরোর কিছু সশস্ত্র সৈনিক সেখানে এসে পৌঁছাল। খুসরো শাহ আমার প্রতি ভীত-ত্রস্ত লোকেদের অন্যতম ছিলেন। তিনি তাঁর সশস্ত্র সৈনিক আমার সেবায় পাঠিয়ে আমার কৃপা ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সৈনিকদের পাঠানোর সাথে সাথে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে এই সংকেতই ছিল যে, তিনি আমার বর্তমান অবস্থায় তাঁর সৈনিক পাঠিয়ে নিজের মানবিক কর্তব্য পালন করেছেন। তবে, এ কথা তো আমি জানতামই যে, আসল কারণ কী ছিল। অবশ্যই তিনি এই ভেবে ত্রস্ত হচ্ছিলেন যে, না জানি কখন আমি তাঁর দিকেই ঘুরে দাঁড়াই। তবে, ওই সময়ে আমার মানুষেরই প্রয়োজন ছিল, খুসরো শাহ সে প্রয়োজন মিটিয়েছিলেন।
সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে আমি পথিমধ্যেকার নানা গোত্র ও উপজাতিদের মধ্য থেকে সৈনিক রূপে মানুষের ব্যবস্থা করতে চাইলাম কিন্তু সফলতা মিলল না। এখন তাদের মনে এই আশঙ্কা জাগতে লাগল যে, শীঘ্রই যদি ভালো কোনো সাফল্য পাওয়া না যায় তাহলে এমনটি যেন না হয় যে, আমার সঙ্গে চলমান সৈনিকরা আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায়। তবে পরবর্তীতে এ আশঙ্কা ভিত্তিহীন প্রমাণ হয়। তারা সম্পূর্ণরূপে আমার অনুগত ও নিবেদিতপ্রাণ ছিল। তারা তাদের পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে আমার সাথে এসেছিল। আমার উপর তাদের ভরসা ছিল। আসলে ‘সরায়-পুল’-এর পরাজয় এবং রাতারাতি আমার সৈনিকদের আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া এবং সমরখন্দ রক্ষা করতে না পারার কারণে আমার আত্মবিশ্বাস কিছুটা কমে গিয়েছিল; যার কারণে আমি আমার সঙ্গে চলমান লোকেদের নিয়ে শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। পরের দিনগুলোতে এ আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।
অতিরিক্ত সহায়তা পেলেন বাবুর
আমরা কবাদিয়ান পৌঁছাতেই খুসরো শাহের ছোট ভাই বক্ল্ তাঁর বাহিনীর বেশ বড় একটা অংশ নিয়ে আমার কাছে এসে পৌঁছালেন। তিনি শহরে-সফা ও তিরমিজের শাসক ছিলেন। তিনি আমার জন্য তাঁর আনুগত্য পেশ করলেন। আমরা ঔবজাফেরির আমু এলাকা, তারপর তিরমিজের বিপরীত দিকে প্রবহমান নদী পার হলাম। নদী পারের বাসিন্দারা তাদের এলাকায় আমাদের প্রবেশ করার খবর পাওয়ামাত্রই তারা সপরিবারে পানাহার সামগ্রীর উপহার নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমার কাছ থেকে এই বিষয়ে নিশ্চিত হলেন যে, আমি তাদের এলাকা অধিকার কিংবা লুটতরাজ করতে আসিনি। তারা নির্ভয় হয়ে গেলেন। তাঁদের এলাকা অতিক্রম না করা পর্যন্ত তাঁরা আমাদের সাথে সাথে রয়ে গেলেন। তাঁরা আমাদের সকল প্রকারের আদর-সৎকার করলেন।
কাহমর্দ ও বামিয়ান এলাকা অতিক্রম করার সময়ও সেখানকার বাসিন্দারা আমাদের এরকমই আদর-সৎকার করলেন।
তার আগে, খুসরো শাহের বোনের ছেলে আহমদী কাসিম (আহমদ-ই-কাসিম) আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এসে গেলেন। আগে আমার চিন্তা ছিল যে, আমরা আজর কেল্লা এবং কাহমর্দের উপত্যকা দিয়ে, কারো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই পার হয়ে যাব, তখন পরবর্তী পরিকল্পনা যেখানে আমলে নেওয়া যাবে।
যা ভেবেছিলাম তাইই হলো। কাহমর্দ উপত্যকা পার হয়ে আসার পর তখনও আমি অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় আলবক-এ, ইয়ার-আল-বলালকে তার কিছু সাহসী সৈনিকদের নিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে আমার দিকে আসতে দেখা গেল।
আমি একটু সতর্ক হলাম। তবে, ক্ষণিকের জন্যই। কেননা, আগত সশস্ত্র অশ্বারোহীরা আমার শিবির থেকে বেশ কিছু দূরেই ঘোড়ার লাগাম টেনেছিল। তারা এক সাথে নেমে পড়ল। তারা ঘাড় ঝুঁকিয়ে আমাকে সালাম করল।
আমি জবাব দিয়ে স্বাগতভাবে বললাম— ‘খোশ আমদেদ (তোমাদের আগমনকে স্বাগত)।’
ইয়ার-আল-বলাল আমার খুব নিকটজন হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন। আমার সুদিনের সময়কার লড়াইগুলোতে তিনি তাঁর তরবারির ঝলকানি দেখিয়ে আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন। আমার ক্ষমতাহীন হয়ে যাওয়ার পর আমার সম্মতি নিয়ে তিনি খুসরো শাহের কাছে চলে গিয়েছিলেন।
‘কীভাবে আসা হলো বলাল…?’ আমার কাছে ডেকে আমি তাকে সহর্ষে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘এদিকে আপনার আসার খবর পেতেই আমি খুসরো শাহের কাছ থেকে আপনার কাছে আসতে আমার আর তর সইল না। আমার অধীনস্ত সৈন্যরা বলল, ‘যেখানে আমি সেখানে তারাও। তারাও আপনার খিদমতে আমার সঙ্গে এসে গেল…’
‘আমার সৌভাগ্য…।’ আমি বললাম।
‘আমরা একটি ক্ষুদ্র জায়গার মধ্যে বদ্ধ থাকার জন্য পয়দা হইনি…।’ আল-বলাল আমার মনের কথাটা বললেন-আমাদের যুদ্ধে তরবারির ঝলকানি দেখানো আর সম্মুখবর্তীদের ঝলক দেখানোর শখ রয়েছে এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যে আপনার সঙ্গে থাকলেই তা পুরো হতে পারে। খুসরো শাহের মনও এত দুর্বল নয়…।’ আমার খুশির আর সীমা রইল না।
ইতোমধ্যে কম্বর আলী শেখও আমার কাছে ফিরে এলেন। তিনি জিন্দান উপত্যকায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হলেন। কম্বর আলী নিজে একাই একটা ফৌজ ছিলেন। রণক্ষেত্রে তাঁর তরবারির ঝলকানি বিপক্ষীয়দের মনে ভয় ধরিয়ে দিত।
কাহমর্দে নয়া খুশির বার্তা
নতুন খুশির বার্তা এটাই ছিল যে, আল বেগমের সঙ্গে জাহাঙ্গীর মির্জার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আল বেগম, মাহমুদ মির্জা ও খানজাদা বেগমের কন্যা ছিলেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা এটাই ছিল যে, জাহাঙ্গীর মির্জা আমার বিশ্বস্তদের অন্যতম ছিলেন। তিনি তখন পর্যন্তকার জীবনে অন্য মির্জাদের বিপরীত আচরণ করে এসেছিলেন।
মাহমদ মির্জা ও খানজাদা বেগমের কন্যার সঙ্গে জাহাঙ্গীর মির্জার বিবাহ হয়ে যাবার অর্থ এই ছিল যে, মির্জাদের সমস্ত শক্তি জাহাঙ্গীর মির্জার পক্ষে এসে যাওয়া। জাহাঙ্গীর মির্জার পক্ষে সমস্ত মির্জাদের এসে যাওয়ার অর্থ ছিল এখন আমার আর মির্জাদের জোটবদ্ধতার মোকাবিলা করতে হবে না।
ইতোমধ্যে কাহমর্দে, সেখানকার প্রশাসক বাকী বেগ আমার সঙ্গে এসে মিলিত হলেন। তাঁর ভাষা ছিল—
‘দশ দরবেশ (ফকির) একই কম্বলের মধ্যে শুতে পারেন, কিন্তু দুই রাজা এক কামরায় বা একই রাজ্যের সীমার মধ্যে থাকতে পারেন না।
তিনি পরে বললেন—
‘যদি কোনো মানুষের একটি রুটি মিলে যায় তাহলে তিনি তার অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা একটি ফকিরকে দিয়ে দিতে পারেন; কিন্তু কোনো রাজার যদি কোনো জায়গায় রাজত্ব মিলে যায় তাহলে তিনি অন্য রাজার রাজ্যেকেও গ্রাস করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন।’
বাকী মির্জার কথা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। প্রকৃতপক্ষে, তিনি সেখানকার প্রশাসক ছিলেন। এই এলাকাটি মাহমুদ মির্জার পুত্রের অংশে ছিল। মাহমুদ মির্জার পুত্র বাকী মির্জাকে ওই এলাকার প্রশাসক নিযুক্ত করে রেখেছিলেন, যার মধ্যে কাহমদও ছিল।
বাকী মির্জার পক্ষে ওই এলাকায় আমার ঘাঁটি গেড়ে থাকতে নিষেধ করারও সাহসও ছিল না, শক্তিও ছিল না। অতএব, তিনি আমাকে ইশারা-ইঙ্গিতে বলে দিয়েছিলেন যে, একই রাজ্যে দুই রাজা থাকতে পারেন না। অন্য ভাষায় তিনি বলে দিয়েছিলেন যে, আমাকে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।
পরে তিনি আমাকে সবিনয়ে জানালেন— ‘তিনি এখন এসে এ কথা বলার প্রয়োজন এ জন্য অনুভব করেছেন যে, আমি খবর পেয়েছিলাম যে, খুসরো শাহ তাঁর সামরিক শক্তি এবং অন্য সাথিদের নিয়ে সেখানে, আমার কাছে এসে আমাকে (বাবুরকে) বাদশাহ ঘোষণা করতে চাইছেন।’
বাকী বেগ কর্তৃক প্রদানকৃত উপরোক্ত জানকারি আমার জন্য খুব বড় সুসংবাদ ছিল, তবে তাঁর জন্য ছিল চিন্তার বিষয়।
খুসরো শাহের দ্বারা কাহমর্দে এসে আমাকে বাদশাহ ঘোষণার সোজা অর্থ ছিল কাহমদ দুই বাদশাহর এলাকা হয়ে যায় যে-এক মাহমুদ-পুত্রের, দুই আমার।
তার পরের কথা, বাকী বেগের কিছু বলার প্রয়োজন পড়ল না। আমি নিজেই সবকিছু বুঝে নিলাম। আমি এ কথা কেমন করে ভুলতে পারতাম যে, আমার বিরোধিতার মামলা হলে তো মাহমুদ মির্জার সাথে আমার অন্য দুই চাচা আহমদ মির্জা এবং ঔলঙ্গ বেগ, মাহমুদ মির্জার সঙ্গে নিজেরাই সহযোগিতায় নেমে পড়তেন।
এই পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীর মির্জার অবস্থাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ত। তাঁকে আমার বিরুদ্ধে তাঁর শ্বশুর ও চাচি শাশুড়িদের পক্ষ নিতে বাধ্য হয়ে যেতে হতো, কেননা, তাঁর বিবাহের পাগড়ি তখনও অটুট ছিল।
মির্জা ভাইদের একতার বিষয়ে যেমনটি আমি আশা করতাম, ঠিক ওই রূপে সামনে এল। বাকী বেগের বিনয়ের পর হুসাইন মির্জার পক্ষ থেকে আমাকে একটি গুপ্তপত্র পাঠানো হলো। বদিউজ্জামান মির্জা, খুসরো শাহ এবং জুনিন বেগের দ্বারাও আমার কাছে এমন বার্তাই পাঠানো হলো।১
সবার পক্ষ থেকে একই বার্তা ছিল— ‘তিন ভাই-ই, মাহমুদ মির্জা, আহমদ মির্জা ও ঔলঙ্গ মির্জারা একজোট হয়ে গেছেন। তারা আমার প্রতি অগ্রসর হচ্ছেন….।’
বাবুরের রণনীতি : অগ্রবর্তী হওয়ার ক্রম জারি
আমি আমার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে কাহমর্দ ত্যাগ করলাম। আমি আমার বিশ্বস্ত, বাকী বেগের উপর কোনো আঁচ আসতে দিতে চাচ্ছিলাম না।
আমি অগ্রসর হয়ে মুর্গ-এ-আব-এর তটে গিয়ে ডেরা বাঁধলাম। সুরক্ষার দৃষ্টিতে এই তট আমার জন্য সম্পূর্ণরূপে সুবিধাজনক ছিল। সেখানে যদি উজবেকদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ হয়ও তা সত্ত্বেও তাদের দমন করার জন্য পূর্ণ শক্তি আমার কাছে ছিল।
বদিউজ্জামান মির্জাদের প্রতি তাঁর সচেতনতা প্রদর্শনের জন্য বলখ কেল্লা, শিয়াবর্গা ও আন্দিরকুর্দ সুরক্ষার জন্য তাঁর সৈন্যদের লাগিয়ে দিলেন। নিজে গিরজবাঁ ও জেংগ উপত্যকায় পাহারাদারি করতে লাগলেন। এটি ছিল পার্বত্য-ক্ষেত্র।
মির্জাদের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা দেখিয়ে তিনি আমার প্রতি আনুগত্য জারি রাখলেন। তিনি আমাকে গুপ্ত পত্র পাঠালেন—
‘খুসরো শাহের পক্ষ থেকে বার্তা এসেছে যে, তিনি তাঁর ছোট ভাইকে, বাদাখশান ও খুরাসানের পার্বত্য পথ ধরে বহুসংখ্যক সৈন্যসহ রওয়ানা করিয়ে দিয়েছেন। যদি উজবেকদের পক্ষ থেকে আপনার উপর কোনো হামলা হয় তাহলে খুসরো শাহের ভাই কঠোরভাবে তাদের দমন করবেন। উজবেকরা আপনার নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না।
আমি ঐ পত্রকে ব্যর্থ মনে করে একদিকে ফেলে দিলাম। সর্বপ্রথমে আমার সামরিক শক্তি এতটা মজবুত ছিল যে, উজবেকদের ধূলিসাৎ করে দিতে পারতাম। দ্বিতীয়ত, এই মুর্গ-এ-আব-এর এলাকাটি তাইমুরি সালতানাতের একটি অংশ ছিল। সেটিকে মির্জাদের পক্ষ থেকে কাউকেই দেওয়া হয়নি। ওই এলাকায়, ওই সময়কার তাইমুর বংশজ হুসাইন মির্জার শাসন ছিল। হুসাইন মির্জা ওই সময়কার সবচেয়ে বড় এবং প্রতাপশালী শাসক ছিলেন। তিনি মির্জা বংশের যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো স্থানের শাসক বানাতে পারতেন আবার যে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে শাসনাধিকার ছিনিয়েও নিতে পারতেন।
এখন এটা অন্য বিষয় ছিল যে, বছরের পর বছর ধরে হুসাইন মির্জার এ মনোযোগিতা আর ছিল না যে, কে, কোথায় শাসন করছেন, কে কোনটিকে বেদখল করছেন। তিনি সেনা বৃদ্ধি করেননি। কোনো রাজ্য জয়ের উৎসাহও তাঁর ছিল না। তিনি শুধু তাঁর নিজের সালতানাত না হারানোর প্রতিই মনোযোগ রাখতেন। তাঁর সালতানাতের খালি জায়গা দখল করে কেউ যদি বছরের পর বছর ধরে সেখানে পড়ে থাকেন তবুও হুসাইন মির্জা তাকে ফালতু ব্যাপার মনে করে শান্তির বাঁশি বাজিয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করতেন।
আমি মির্জাদের নয়, হুসাইন মির্জার ক্ষেত্রে ছিলাম। অতএব, নিশ্চিন্ত ছিলাম। আমি আমার পূর্বপুরুষদের ভূমিতে ছিলাম। হুসাইন মির্জার সঙ্গে আমারও এতটাই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, যতটা ছিল মাহমুদ মির্জার, আহমদ মির্জা ও ঔলংগ বেগ মির্জার বংশধরদের।
মুর্গ-এ-আব-এর বিষয়ে আমি বলতে পারি যে, সেখানে আমি কিছুটা এরকম নিশ্চিন্ত ছিলাম যেমনটি ছিলাম আমার পিতৃরাজ্য ফারগানায়। এখন এটা ভিন্ন বিষয় ছিল যে, ফারগানা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, মুর্গ-এ-আব-এ আমি ডেরা বেঁধে অবস্থান করছিলাম।
মুর্গ-এ-আবকে অধিকার করে রাখাটা আমার গন্তব্য ছিল না, আমার লক্ষ্য অনেক বড় ছিল। ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমি একদিন আমার সৈনিকদের হুকুম দিলাম—
‘তিরমিজ পার্বত্য এলাকা এবং কিরকি উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বহু সংখ্যক নৌকার ব্যবস্থা করা হোক। সেই সাথে ভারী মাত্রায় সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা হোক।’
আমার আদেশ পালন করা হতে লাগল। এই এলাকার উপজাতি এবং পাহাড়ি বস্তিগুলোর বাসিন্দারা আমাকে সর্বপ্রকারে সহযোগিতা করছিল।
এইভাবে ছোট একটা রাজ্য তো বটে; বরং ওই ভূ-ভাগে একজন বাদশাহ রূপে পরবর্তী প্রস্তুতি গ্রহণ করার পূর্ণ অবসর আমি পেয়েছিলাম।
বাবুরের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি
একের-পর-এক, আমার ছেড়ে যাওয়া সাথিরা আমার সঙ্গে আবার মিলিত হয়ে আসছিল। খুসরো শাহের এক মোগল সৈনিক আমার কাছে চলে এল। সে বলল-’আমরা মোগল সরদাররা আপনার প্রতি আমাদের আনুগত্য পেশ করতে চাই।’ পরে সে বলল— ‘খুসরো শাহ তাঁর সমস্ত সৈন্যসহ আপনার খিদমতে চলে আসছেন…।’
ওই বার্তা আমার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। কিছুক্ষণ পরেই আমি শুনতে পেলাম যে, সায়ক খান আন্দিজান অধিকার করে নিয়েছে। এখন সে হিসার ও কুন্দুজ অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে।
এই খবরের পর আবার খবর এল যে, খুসরো শাহ কুন্দুজ ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন সদলবলে কাবুলের পথ ধরেছেন।
এবার যখনই হোক, আমার নিকট পর্যন্ত পৌঁছানোটা নিশ্চিত ছিল।
আমাকে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। তিন-চার হাজার ঘোড়ার মাথা আমার নজরে এল। তাদের পিঠে মোগল অশ্বারোহীরা ছিল। তারা তাদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হতে আসছিল। তারা এল। আমি তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কিন্তু এটা দেখে আমি সংশয়ে পড়ে গেলাম যে, তারা খুসরো শাহের নেতৃত্বে আসেনি। তাদের সামনে পিছনে কোথাও খুসরো শাহের খবর ছিল না। ওই তিন-চার হাজার মোগল ঘোড়সওয়ার নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে, নিজেদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে আমার সেবায় উপস্থিত হয়েছিল।
এবার আমার খুসরোর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হলো।
ইতোমধ্যে আরো একটি খবর এল যে, বাকী বেগ, কম্বর আলীকে পদচ্যুত করে দিয়েছেন, সেই সাথেই এ খবরও এল যে, কম্বর আলীকে তার হঠকারী আচরণের জন্য রুষ্ট হয়ে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর এ ধরনের হঠকারী আচরণের কথা আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। আসলে, সে যতবড় বীরপুরুষ ছিল, তার হঠকারী আচরণও ছিল ঠিক ওই রকমই। তাকে আমার নিজের কাছে রাখার যে অভিজ্ঞতা আমার ছিল সে অনুসারে কখনো-কখনো তার হঠকারিতা দেখে আমার মনে হতো যে, জেনে বুঝে সে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বাজে আচরণ এবং কথাবার্তা বলছে।
খুসরো শাহের অপেক্ষায় বাবুর
খুসরো শাহের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তার বিষয়ে আমার কাছে খবর এল যে, মোগল অশ্বারোহীরা আমার কাছে এসে পৌঁছাবার পর তিনি খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে তাঁর দুর্দিনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি তাঁর জামাইকে তাঁর ভবিষ্যতের কথা ভাবার জন্য আমার কাছে পাঠালেন।
তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি তাঁর সমস্যার কথা বললেন এবং আমার কাছ থেকে আশ্বাস পেলেন। আসলে খুসরো শাহ হাওয়া বুঝে ছাতা ধরা লোক ছিলেন। তিনি যেদিকে ওজন বেশি দেখতেন সেই পাল্লায় বসে পড়তেন। তিনি বীর বাহাদুর নন, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মানুষ ছিলেন এবং নিজের জীবনের নিরাপত্তার উপর বেশি নজর রাখতেন।
তার জামাই আমার পাল্লা ভারী অনুভব করে আমার কাছ থেকে ফিরে চলে গেল।
তাকে পাঠানোর পর আমি আমার বাহিনীকে কিজিলের পার্বত্য ভূমির দিকে রওনা করিয়ে দিলাম, যেখানে অনদর-আব নামক নদী তাকে স্পর্শ করত।
পরদিন, ১৫০৪ ঈসায়ী সনের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ, তথা পয়লা রবিউল আউয়ালে আমি অনদর-আব নদী পার হয়ে, সামনে অবস্থিত বিশাল ময়দানে সেনা শিবির স্থাপনের আদেশ দিলাম।
ওখানে আমি খুসরো শাহের আগমনের খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছু সময় পর তিনি পূর্ণ উৎসাহে তাঁর পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে আমায় সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি আমার সামনে পড়তেই প্রথা এবং নিয়ম অনুসারে মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে তিনবার সালাম করলেন। হাঁটু গেড়ে বসে আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। উঠে পিছু হটে গিয়েও তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে তিন বার সালাম করার নিয়ম পালন করলেন। তিনি তাঁর সমস্ত মাল ও আসবাব ঘোড়া ও খচ্চরের গিঠে তুলে নিয়ে এসেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাই জাহাঙ্গীর মির্জা ও মির্জা (ওয়াইস) খানও এসেছিলেন। তারাও সম্মান প্রদর্শনের ওই রীতিই পালন করলেন। তাঁরা আমার নামে খুত্বা (যশোগাথা) পড়লেন।
তারপর, আমার সেবায় নিয়ে আসা উপহার সামগ্রী আমাকে পেশ করা হলো। আমি তাদের বসতে বললাম। তবে তাঁরা বসলেন না। দু-এক দণ্ড২ দাঁড়িয়ে থেকে তাঁরা কথাবার্তা বলতে লাগলেন।
খুসরো শাহের বার্তালাপের বিষয় তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। তিনি কোনো সাহসী ব্যক্তি ছিলেন না। যুদ্ধ ও বাহাদুরি দেখানোর মতো কোনো কাজ তিনি কখনো করেননি। অতএব, ওই বিষয়ে তিনি বেশি চর্চাই করতে পরতেন না। তিনি কাপুরুষ ও নেমকহারাম লোকেদের মধ্যে গণ্য হতেন। তবে, যখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার কাছে এসে জুটেছেন তখন এমনিতেই আমার পাল্লা ভারী হয়ে যাচ্ছিল, আমার প্রয়োজন না থাকলে আমি তাকে ভাগিয়ে দিতাম।
খুসরো শাহ ব্যক্তিগতভাবে যা-ই হোন না কেন, তাঁর কাছে শক্তিশালী সৈন্যবল ছিল। তাঁকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতো লোকের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল। তিনি একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন এবং এ সুসংবাদও ছিল যে, এর চেয়ে বিশাল সংখ্যক মানুষ দু-একদিন বাদে আমার সেবায় এসে যাবে।
হিন্দুকুশ পর্বতে বাবুর
আমি শিবির তুলে নেওয়ার আদেশ দিলাম। হিন্দুকুশ পর্বত পার হতে সফর শুরু করলাম। আমরা যতই চড়াই অতিক্রম করছিলাম ততই পাহাড়ি লোকেরা আমার সেবায় চলে আসছিল। তাদের মধ্যে খুব ভালো লোকও ছিল আবার খারাপ লোকও ছিল, কিছু বাহাদুরও ছিল, কিছু বীরবিক্রমে যুদ্ধ করার আবেগে টগবগ করছিল তো কিছু লোক কেবল বোঝা বহনের কাজেই আসতে পারত। বহু লোক সপরিবারে এসে আমার কাছে জুটেছিল।
আমার এক বিশাল কাফেলা সামনে এগিয়ে চলেছিল। আমার সাফল্য কামনা করে যাওয়া গীত লহরী দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
রাস্তায় আরো বিশ-ত্রিশ হাজার সৈন্য আমার সঙ্গে এসে মিলিত হলেন। এই সৈনিকেরা মাহমুদ মির্জার সালতানাত ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন। তাঁরা লৌহ-দরওয়াজার রক্ষক ছিলেন। তাঁরা মাহমুদ মির্জার সেবা ত্যাগ করে আমার সেবায় চলে এসেছিলেন।
আমার সেনাদল হিন্দুকুশ পেরিয়ে আরো এগিয়ে চলেছিল। সে সময় একজন বৃদ্ধ আমাদের দলের সামনে চলে এলেন। তিনি তাঁর নাম বললেন, হাসান বরদিন। নিজেকে চুঙ্গিস্কর আদায়কারী বলে পরিচয় দিলেন। তিনি নিজেকে আইকিক এবং ঔবাজ লোকেদের দ্বারা সেখানে নিযুক্ত বলে জানালেন। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি যখন আমার পিছন ধরে অগ্রসরমান কাফেলার প্রতি যেইমাত্র দৃষ্টিপাত করলেন, অমনি তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল।
তিনি কিছু বললেন না, কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমি তাঁকে ওই লোকেদের শক্তির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যারা তাকে সেখানে চুঙ্গি আদায়ের জন্য নিযুক্ত করেছিল। তিনি তাদের সংখা দুই থেকে তিনশো বলে জানালেন। তাঁর যা অবস্থা হচ্ছিল, তা দেখে হাসি ছাড়া আর কিছুই আসতে পারত না। তিনি আমার বিশাল কাফেলার কোন অংশে হারিয়ে নিয়েছিলেন, পরে তাঁর আর কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া গেল না।
ওই দিন সন্ধায় কাফেলার শিবির ফেলার পর, যখন খুসরো শাহ তাঁর ডেরায় চলে গিয়েছিলেন, তখন মির্জা খান আমার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পাওয়ার পর আমার সামনে উপস্থিত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সবিনয়ে নিবেদন করলেন-
‘আমি, আমার ভাইয়ের (খুসরো শাহ) জন্য আমার প্রাণ দিতে চাই…।’
তাঁর এই কথা শুনে আমি ও আমার দরবারিরা চমকে উঠলাম। আমি তাঁকে তাঁর কথা স্পষ্ট করতে বললাম, তখন আসল কথা প্রকাশ্যে এসে পড়ল। মামলা এটাই ছিল যে, খুসরো সামনেকার কষ্টদায়ক পথ অতিক্রমে অসমর্থ ছিলেন। তিনি খচ্চর বা উটের পিঠে চড়েও চলতে পারছিলেন না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তিনি তাঁর পরিবার-পরিজনদের কথা মনে করে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। নিজের এই দুরবস্থার কথাটা আমার সামনে উপস্থিত হয়ে বলতে তার সাহসে কুলাচ্ছিল না। সে জন্য তিনি তাঁর ছোট ভাই মির্জা খানকে পাঠিয়েছিলেন।
এই কারণেই মির্জা খান বলেছিলেন, তিনি তাঁর ভাইয়ের বদলে নিজের জীবন দিতে চান।
অন্য কথায় খুসরো শাহ আমার কাছ থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছিলেন। খুসরো শাহের এই চরিত্রের কথা আমার অজানা ছিল না। আমি আগে থেকেই জানতাম যে, তিনি কাপুরুষ এবং কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি তাঁর ছিল না।
আমি খুসরো শাহকে সানন্দে মুক্তি দিলাম। সেই সাথেই বলে দিলাম যে, তিনি তাঁর মাল-আসবাবসহ সঙ্গে তিন-চারটি খচ্চর কিংবা উটও নিয়ে যেতে পারেন।
এই অনুমতির পর খুসরো শাহের খুশির আর সীমা-পরিসীমা রইল না। তিনি তাঁর সব হীরে-জহরত, সোনা-রুপা এবং অন্য সকল বস্তু যে সব তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন তার সব গুছিয়ে নিলেন। দুটি খচ্চরের পিঠে তা চাপিয়ে দিলেন। সওয়ারির জন্য উট নিয়ে নিলেন।
তিনি আমার কাছে বিদায় নিতে এলেন। তিনি আমার সঙ্গে ওয়াদা করলেন যে, তিনি খুরাসান, ঘুলে ও দজানার রাস্তা ধরে খুরাসানের উদ্দেশে রওনা হবেন। তারপর তিনি কাহমর্দ থেকে নিজের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে কাবুলে আমার কাছে আবার ফিরে আসবেন।
আমার কাছে তাঁর ওয়াদার কোনো গুরুত্ব ছিল না।
খাজা জায়েদে পরবর্তী শিবির
কাবুল অভিমুখে রওনা হয়ে খাজা জায়েদ নামক স্থানে পরবর্তী শিবির ফেলা হলো। পরদিন সকালে হামজা বেগ দুশল নামক স্থানে উজবেক ঘোড় সওয়ারদের দেখতে পেয়েছেন। এ খবর শোনামাত্রই আমি সৈয়দ কাসিম ও আহমদ কাসিম কোহবরের নেতৃত্বে সাহসী সৈনিকদের একটি দল দেখতে পাওয়া উজবেকদের বিরুদ্ধে রওনা করিয়ে দিলাম।
পাঠিয়ে দেওয়া সৈনিকেরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। তাদের আচ্ছামতো দিয়ে দিল, তাদের কারো একজন ছিন্ন মস্তক নিয়ে আমার কাছে ফিরে এল।
চার-পাঁচদিনের সফরের পর আমরা ঘুর-বুন্দ নামক স্থানে পৌঁছালাম। এই পার্বত্য এলাকাটি উত্তসুর শহর নামে পরিচিত। সেখানে পৌঁছে জানা গেল যে, সেখানকার প্রধান হাকিম হলেন শেরাক নামক একজন ব্যক্তি। সে সময়ে তিনি বারান নামক স্থানে অবসর যাপন করছিলেন। তিনি এলাকার সুরক্ষার জন্য কিছু সিপাই রেখে গিয়েছিলেন।
তবে আমাদের অগ্রসর হওয়ার সময় কোনো সিপাই সামনে আসেনি। অবশ্যই তারা লুকিয়ে পড়াটাকেই নিজেদের জন্য মঙ্গল বলে মনে করেছিল। পরবর্তীকার ইলাকেদার (এলাকার প্রশাসক) ছিলেন আবদুর রজ্জাক মির্জা। তিনিও আমাদের বাহিনীর অগ্রবর্তী হওয়ার খবর পেয়ে পানজিরের রাস্তা ধরে কাবুলের উদ্দেশ পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সামনে লমঘান তুরখানি আফগানদের এলাকা ছিল। আমরা সফর জারি রাখলাম। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সফর জারি রইল। পথ রোধ করার জন্য কেউ এল না।
ওইদিন রাতে আসমানে আমি একটি উজ্জ্বল তারকা দেখি। ওই তারকাটিকে এর আগে আমি আর কখনো দেখিনি। ওই উজ্জ্বল তারকাটির নাম ছিল ‘শুকতারা’। তা সাধারণত, দক্ষিণ দিকে উদিত হয়, তাকেই কখনো-কখনো মাত্র দেখা যায়। সে যখন উদিত হয় তখন তার উজ্জ্বলতার কাছে আর সব তারকা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।
ওই তারকাটির সম্পর্কে আমার বহু কিছু শোনা ছিল। ওটা দেখামাত্রই আমি আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমি খুশির চোটে ফেটে পড়তে চাইলাম-
‘তুমি কত দূর থেকে চমক দিচ্ছ… ও শুকতারা! আমি শুনেছি তুমি সৌভাগ্যের প্রতীক। ওই মানুষের তুমি ভাগ্য বদলে দাও, যার উপর তোমার আলোক বৰ্ষিত হয়।’
সূর্য এক বাঁশ পরিমাণ উপরে উঠে গিয়েছিল। আমাদের কাফেলা সনজিদের পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করে গিয়েছিল। ঐ সময়ে আমাদের সাহসী অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুত গতিতে এসে আমাদের কাছে খবর পৌঁছে দিল যে, আলকারিয়ারের কুরাবাগে শেরাক গোত্রের কিছু লোক ওঁৎ পেতে রয়েছে আমাদের উপর হামলা করবার জন্য।
আমি একটি ক্ষুদ্র অশ্বারোহী দলকে এই বলে পাঠিয়ে দিলাম যে, যে কোনো ভাবেই হোক তাদের কাবু করে আমার সামনে নিয়ে আসা হোক।
শেরাকদের সঙ্গে আমার দলের সৈন্যদের একটি হালকা যুদ্ধ হলো। তারা তাদের কাবু করতে সমর্থ হলো।
আমার সৈনিকেরা তাদের বন্দী করে আমার সামনে নিয়ে এল। তাদের ঘোড়া থেকে নামানো হলো। সংখ্যায় তারা ৭০-৮০ জন ছিল। তারা শক্তপোক্ত বাহাদুর লোক ছিল। তারা ছিল জন্মাগতভাবে যুদ্ধবাজ প্রজাতির লোক। তারা চলমান কাফেলার উপর অকস্মাৎ হামলা চালানোয় খুব দক্ষ। বৃহৎ হতেও বৃহত্তর কাফেলার উপর হামলা চালিয়ে লুটতরাজ করা তাদের পেশা। বন্দী করে নিয়ে আসা এই শেরাকদের সবাইকে আমি জীবনভিক্ষা দিলাম। তাদের আমার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- উপরোক্ত সকল নাম এবং অন্য লোক যাঁরা ঐ সময়ে বাবুরকে গোপনে সাহায্য করছিলেন, তাঁরা তাঁর বাদশাহ হওয়ার সময় তাঁর বিশ্বস্ত সাথি ও কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা তাঁর বিচক্ষণতা ও শক্তি-সামর্থ্যের সঙ্গে ভালো মতো পরিচিত ছিলেন। বাবুরের সাম্রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার পর তাঁরা যেখানে যেখানে সুবেদার ও প্রশাসক ছিলেন, সেখানে-সেখানে নয়া শাসকের অধীনে রয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাঁদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য তখনও বাবুরের প্রতি রয়ে গিয়েছিল। তাঁরা শুধু আশাই নয়; বরং পূর্ণরূপে বিশ্বাসও রাখতেন যে, বাবুর একদিন বড় সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে যাবেন, তখনও তাঁর কৃপা দৃষ্টি তাদের উপর রয়ে যাবে। —অনুবাদক
- বাবুরনামার ইংরেজি অনুবাদকেরা ‘দণ্ড’র ব্যাখ্যা আধুনিক কালের ২৪ মিনিট সময় রূপে দিয়েছেন। —অনুবাদক