বাবুরের জন্ম ও বংশ পরিচয়

জহির-উদ-দিন মুহম্মদ জালাল-উদ-দিন বাবুর, সংক্ষেপে ‘বাবুর’ নামেই পরিচিত। পিতা উমর শেখ মির্জা, ফারগানা, বর্তমান উজবেকিস্তান রাজ্যের শাসক ছিলেন। মাতা কুতলুক নিগার খানম। পিতার দিক দিয়ে বাবুর মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত বিজেতা এবং ভারত জয়ী বীর আমির তাইমুরের চতুর্থতম অধঃস্তন এবং মায়ের দিক দিয়ে মোগল বীল চেঙ্গিস খানের চতুর্দশ অধঃস্তন ছিলেন। তাইমুর বংশীয় এই মহান সন্তান পূর্ব—পুরুষ আমির তাইমুরের সূত্রে ভারতকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে বিবেচনা করতেন। সেই আকাঙ্ক্ষা ও পূর্ব পৌরুষেয় আবেগ তাঁকে ভারত—বিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি কাবুল থেকে সসৈন্যে এসে ভারতের পানিপথের যুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের শেষ প্রদীপ ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন তথা তাঁর পূর্ব—পুরুষ তাইমুরের রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। এইভাবে তিনি তাঁর স্বপ্ন সাকার করেন।

বাবুর জন্মেছিলেন তৎকালীন মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের আন্দিজান শহরে ১৪৮৩ ঈসায়ী সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ফারগানা এখন উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তৎকালীন ফারগানা রাজ্যের শাসক উমর শেখ মির্জার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বাবুর। উমর শেখ মির্জার স্ত্রী, অর্থাৎ বাবুরের মা কুতলুক নিগার খানম ছিলেন চেঙ্গিসি উত্তরাধিকারী ইউনুস খানের কন্যা। পিতা এবং মাতা উভয় দিককার বিবেচনায় মঙ্গোলদের থেকে উদ্ভূত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে ওঠা বাবুরের জাতি—পরিচয়ের মধ্যে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছিল। এই অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে ইসলামি জাতিতে পরিণত হয় এবং খোরাসান ও তুর্কিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। বাবুরের মাতৃভাষা ছিল চুগতাই। ওই ভাষা তাঁর কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। সেজন্য বাবুরের মাতৃভাষাকে চুগতাই তুর্কি ভাষা বলা হয়। ওই ছাড়া ওই যুগে তাইমুরি বিত্তবান ও সংস্কৃতিবানদের প্রধান ভাষা ফার্সিও তাঁর দখলে ছিল। ফলে তিনি চুগতাই তুর্কি ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। আর ওই রকমই একটি সমৃদ্ধ ভাষা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চুগচাই তুর্কিতে তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ আত্মজীবনী ‘তুজুক—ই—বাবরী’ যা ফারসিতে অনূদিত হয়ে ‘বাবরনামা’ নামে জগদ্‌বিখ্যাত হয়ে ওঠে। চুগতাই তুর্কির ভাষা ফার্সির মতোই আরবি লিপিতে লেখা হয় এবং সে ভাষা, তার গঠনশৈলী, যেমন শব্দগঠন, বাক্যগঠন, ব্যাকরণ প্রায় সবটাই ফার্সির অনুসারী।

আন্দিজানিরা সকলেই তুর্কি ছিলেন। শহর, বাজার, জনবসতি, লোকালয়—এক কথায় সকলেই তুর্কি নামে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যের ভাষা মানুষের কথ্য ভাষাকেই গ্রহণ করেছিল। যেমন মির আলী শের নাওয়াইয়ের লেখা, যদিও তিনি ‘হিন’ বা হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন, তা সত্ত্বেও তা এগুলোরই একটি উপভাষা। সুন্দর চেহারার মানুষ সেখানে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। বিখ্যাত সংগীত শিল্পী খাজা ইউসুফ ছিলেন একজন আন্দিজানি।

বাবুর একজন মোঙ্গলীয় হওয়া সত্ত্বেও মধ্য এশিয়ায় তুর্কি এবং ইরানিদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বাবুর তাঁর সেনা গঠন করেছিলেন বিভিন্ন জাতির মানুষদের সমন্বয়ে। তাঁর সেনাদলে ইরানি, তুর্কি, পাঠান, আরবীয়, নানা উপজাতীয় আফগান সবাই ছিল। সে হিসেবে তাঁর সেনা ছিল সৰ্ববাদীসম্মত জাতীয় বাহিনী। সবাইকে নিয়ে চলার, সবার মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তার করার, সবাইকে একই নেতৃত্বে নিয়ে আসার যে অসাধারণ যোগ্যতা বাবুরের ছিল তাই তাঁকে অবলীলাক্রমে দিগ্বিজয়ী বাদশাহ রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তিনি ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বটে, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তিনি সমগ্র মধ্য এশিয়ার বাদশাহ।

ব্যক্তি—জীবনে তিনি ছিলেন হানাফি মজহাবভুক্ত গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। কিন্তু এটা ছিল তঁর ব্যক্তিগত বোধের জায়গায় সুদৃঢ় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। তা সত্ত্বেও শিয়া এবং সুফিদের তিনি মোটেও উপেক্ষা করেননি। সেটা করলে তিনি ইরানি সুলতান ইসমাঈল সফভির নৈতিক সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হতেন। এক অতি উচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রতিভাও যেমন তাঁর ছিল তেমনি ছিল কূটনৈতিক প্রতিভাও। এর অন্যতম উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায় বেয়াড়া আফগান উপজাতিদের তাঁর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা প্ৰদৰ্শনে।

বাবুর ছিলেন অত্যন্ত সুগঠিত শরীর ও স্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি কেবল ব্যায়ামের জন্য দু’কাঁধে দুজন মানুষকে বসিয়ে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নামতেন। কিংবদন্তি আছে চলার পথে বাবুর তাঁর সামনে পড়া সকল নদী সাঁতরে পার হতেন এবং ভারতের গঙ্গা নদী তিনি দু’বার সাঁতরে পার হয়েছিলেন। সুদৃঢ় মানসিক শক্তি ও স্পৃহার অধিকারী ছিলেন তিনি। প্রথমা স্ত্রী সুলতান বেগমের কাছে বাবুর অত্যন্ত লাজুক ছিলেন এবং পরে তিনি তাঁর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে কিশোর বয়সের কামনা বাবুরী নামে এক বালকের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

তুর্ক মঙ্গোলীয় ও ইরানি সংস্কৃতি

ট্রান্স অক্সিয়ানা ও খোরাসানে তুর্ক মঙ্গোলীয় এবং ইরানি জনগণ পাশাপাশি বসবাস করতেন। এঁরা নৃতাত্ত্বিক জাতিতাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত হলেও কালের ধারাবাহিকতায় অনিবার্যভাবে এদের জীবনে ইসলাম এসে গিয়েছিল। ধর্মতাত্ত্বিক তথা ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাঁরা মুসলিম হয়ে গেলেও যুগ—যুগান্তরের দৈশিক—আঞ্চলিক সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাদ পড়ে যেতে থাকে। যেমন সাগ্নিক—পৌত্তলিক ধারার ধ্যান—ধারণা উপজাত বিশ্বাস—এ সব তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে অপসাংস্কৃতিক অপবাদ বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। ইসলাম তাদের সংস্কৃতিবান করে তুলতে থাকে। একই কথা মঙ্গোলীয়দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমনটি বাবুরের নিকটাত্মীয় মির্জা হায়দার লিখেছেন—‘চুগতাইয়ের আমল (মোঙ্গল বা মোগল সম্প্রদায় চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খান থেকে উদ্ভূত) ছিল নিষ্ঠুর এবং কুরুচিপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের মতো শিক্ষিত ছিল না। বোঝা যায় যে, অসংস্কৃত নামা জাতি—গোষ্ঠী ইসলামের সংস্পর্শে এসে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠে। তুর্ক—মঙ্গোলীয়—ইরানি সকলের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। ইসলাম তাদের সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার শিক্ষা স্বরূপ তাদের মসজিদ দিয়েছে—যেখানে ছোট—বড়—ধনী—দরিদ্রের কোনো ভেদ নেই। সে জন্য অঞ্চলগতভাবে সংস্কৃতির নাম ভিন্ন—ভিন্ন হলেও তারা যখন ইসলামের আদলে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠে তখন হয়ে যায় মুসলিম। অতএব তুর্ক—মঙ্গোলীয়—ইরানিরা ইসলাম গ্রহণের পর রাতারাতি একট সুসংস্কৃত জাতি ও শাসকগোষ্ঠী হয়ে উঠল। এখানে জেনে রাখা দরকার যে, তুর্ক মঙ্গোলীয়রা ছিল প্রধানত সামরিক পেশার মানুষ এবং ইরানিরা ছিল বেসামরিক মানুষ। ইরানিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল ফার্সি ভাষা এবং তুর্ক—মঙ্গোলীয়দের মধ্যে প্রচলিত চুগতাই ভাষা। মধ্য এশিয়ায় তৃণভূমি প্রধান বৃক্ষহীন প্রান্তরে চেঙ্গিস খানের পৃষ্ঠপোষকতার তুর্ক—মঙ্গোলরা একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাষা রূপে বিরাজমান ফার্সি ছিল এদের প্রধান ভাষা, তাজিক ভাষা ছিল এদের মাতৃভাষা এবং সমস্ত শিক্ষিত ও শহুরে মানুষের ভাষা ছিল ফার্সি ভাষা। আমির তাইমুরের সরকারি তথা রাজভাষাও ছিল ফার্সি, এই ভাষায় তাঁর প্রশাসন চলত। তাঁর রাজ্যের ইতিহাস, কাব্য—কবিতা ও সাহিত্য—সংস্কৃতি এই ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু আমির তাইমুরের পরিবার ও গৃহ পরিবেশে চুগতাই তুর্কি ভাষা প্রচলিত ছিল। ওই যুগে আরবি ছিল জ্ঞান—বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব তথা উৎকর্ষমূলক বিষয়াবলি ও উচ্চ ভাবধারা প্রকাশের ভাষা।

বাবর বা বাবুর—নাম ও পদবি

জহির উদ—দিন মুহম্মদ তাঁর নাম, কিন্তু তিনি ডাকনাম বাবর বা বাবুর নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। বাবর নামটি একটি লোমশ জন্তু ইন্দো—ইয়োরোপীয় শব্দ ‘বিভার’—রাশিয়ান ‘ববর’, তুর্কি শব্দ ‘বাবর’—বাবুর, ইরানি—তুর্ক উচ্চারণ ‘বাহ—বর’, অবশেষে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল বাবর বা বাবুর। মির্জা মুহম্মদ হায়দার লিখেছেন—‘চুগতাই এর আমল (মোঙ্গল সম্প্রদায় চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খান থেকে উদ্ভূত) ছিল নিষ্ঠুর এবং কুরুচিপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের মতো শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁরা দেখল এ নামটা উচ্চারণ করা, সুকঠিন। সে জন্য তাঁরা তাঁর নাম দিলেন ‘বাবর’। উল্লেখ্য যে, চুগতাই খানের নামানুযায়ী যেমন ‘মোগল’ ‘মোঙ্গল’ বা ‘মুঘল’ শব্দটি এসেছে, তেমনই তাঁর নামানুসারে তাদের ভাষার নাম হয়েছে চুগতাই তুর্কি। বাবুরের মাতৃভাষা ‘চুগতাই তুর্কি’ নামে পরিচিত। এবং তিনি সেই ভাষাতেই লেখেন তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজুক—ই—বাবরী, যা তাঁর পৌত্র আকবর ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়ে তা সংরক্ষণ করেছিলেন।

সামরিক জীবন

১৫৯৪ ঈসায়ী সনে মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবুর তাঁর পিতৃরাজ্য ফারগানার শাসনভার গ্রহণ করেন। মধ্য এশিয়ার রাজ্য ফারগানা এখন উজবেকিস্তান নামে সুপরিচিত। তাঁর সিংহাসন নিষ্কণ্টক হতে দেননি তাঁর নিজের চাচা ও আত্মীয়—স্বজনেরা। এর বাইরেও আরো অনেক শত্রু ছিল তাঁর। এক সময়ে শত্রুদের ষড়যন্ত্র সফল হয়। বাবুর ক্ষমতাচ্যুত হন এবং কিছুকাল ধরে তিনি আশ্রয়হীন হয়ে যাযাবরের মতো জীবন—যাপনে বাধ্য হন। এ সময়ে তাঁর কয়েক বন্ধু এবং এলাকার কৃষকদের সঙ্গেই শুধুমাত্র তাঁর যোগাযোগ ছিল। যাযাবর জীবনের মধ্য থেকেই তিনি শক্তি সঞ্চয় করেন এবং ১৪৯৭ সনে সমরখন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালান এবং সাত মাস পরে তিনি শহর দখলে সমর্থন হন। ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে ফারগানায় কিছু অভিজাতের বিদ্রোহের কারণে স্থানটি তাঁকে হারাতে হয়। এদিকে ফারগানা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে রাতের অন্ধকারে তাঁর বাহিনীর লোকেরা তাঁকে ফেলে চলে যায়, ফলে তাঁকে সমরখন্দ ও ফারগানা দুটিই হারাতে হয়। বাবুর এ প্রসঙ্গে ‘বাবরনামা’য় সখেদে লিখেছেন—‘আমার হাত থেকে সমরখন্দও চলে গেল, ফারগানাও। এখন আমার আর জানা ছিল না যে, আমি কোথায় যাচ্ছি, আর আমার মনজিল কোথায়।’

১৫০১ ঈসায়ী সনে আবার সমরখন্দ পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নেন। তবে পূর্বের মতোই তাঁর শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মুহম্মদ শায়বানি খানের কাছে আবারও পরাজিত হতে হয়। ফলে তিনি তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এরপর বাবুর একটি শক্তিশালী সেনা গঠনে তৎপর হন এবং তাতে তাজিক ও বাদাখশানিদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তুষারাবৃত অঞ্চল হিন্দুকুশ অতিক্রম করেন এবং কাবুল অধিকার করেন। কাবুল অধিকার তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। একদিকে তিনি যেমন আত্মীয়—কণ্টক—মুক্ত ধনী রাজ্য লাভ করেন তেমনই কিছুটা শান্তি—স্বস্তি লাভ করেন এবং বৃহত্তর সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করতে থাকেন। এই সময়ে তিনি ‘পাদশাহ’ (বাদশাহ) উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৬ ঈসায়ী সনে হুসাইন বাইকারার অকালমৃত্যু তাঁর পরবর্তী অভিযানকে বিলম্বিত করে। ওই সময়ে বাবুর তাঁর মিত্রপক্ষের শহর হেরাতে দু’মাসের জন্য অবস্থান করেন এবং সম্পদের অভাবে তিনি এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেও তিনি এই রাজ্যকে প্রাচর্যমণ্ডিত করেছেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্যে তিনি চমৎকৃত হন। তিনি অহিগুরের কবি মির আলী শির নাওয়াইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। নওয়াইয়ের সাহিত্যের ভাষা ছিল চুগতাই তুর্কি। তিনি বাবুরের প্রতিভার বহুমুখিনতায় মুগ্ধ হন এবং তাঁকে তাঁর মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কিতে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহিত করেন।

এদিকে কাবুলে বিদ্রোহ ঘনায়িত হচ্ছিল। সংবাদ পওয়ামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ কাবুলে ফিরে এসে অত্যন্ত কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন। এর দু—বছর পর আরো একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং কিছু শীর্ষ স্থানীয় নেতা তাঁকে কাবুল থেকে বিতাড়িত করেন। কিছু সঙ্গীসহ বাবুর কাবুল থেকে চলে গেলেও তিনি পুনরাক্রমণ করে কাবুল দখল করেন এবং বিদ্রোহীদের নিজের অধীনে নিয়ে আসেন।

এদিকে ১৫১০ ঈসায়ী সনে উজবেক নেতা শায়বানি খান পারস্য, বর্তমান ইরানের শাসনকর্তা ইসমাঈল সফভির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। ইনি ছিলেন বাবুরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু। বাবুর তাঁর সঙ্গে সরাসরি ময়দানে হাতাহাতি যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। ইসমাঈলের হাতে মৃত্যুর খবরে বাবুর এই ভেবে হতাশ হন যে, তাঁর সঙ্গে তাঁর সরাসরি হাতাহাতির সুযোগ আর হলো না, তবে, বাবুর এই সুযোগে তাঁর পূর্বপুরুষের তাইমুরি রাজ্য পুনরুদ্ধারের কাজে নেমে পড়েন। কয়েক বছর যাবত বাবুর ইরানি শাসক ইসমাঈলের সঙ্গে যোগসাজশে মধ্য এশিয়া অধিকারের জন্য মিলিত হন। বাবুর সফভিকে তাঁর রাজ্যের সার্বভৌম রাজা বলার অনুমতি দেন। শায়বানি খাঁ নিহত হলে তাঁর অন্তঃপুর থেকে বাবুরের বোন খানজাদা বেগমকে উদ্ধার করে ইসমাঈল বাবুরের কাছে ফিরিয়ে দেন। উল্লেখ্য যে, শায়বানি বাবুরের আত্মীয়—পরিজনদের নিজের পক্ষে টানার জন্য খানজাদাকে জোর করে বিয়ে করেন। ইসমাঈল বাবুরকে সামরিক সাহায্যসহ অনেক ধনসম্পদ সরবরাহ করেছিলেন, বাবুর প্রতিদানে তাঁকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যি সুবিধা দিয়েছিলেন।

শাহ—এর পারস্য ওই সময়ে শিয়াদের দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। তিনি নিজেকে সপ্তম শিয়া ইমাম মূসা আল—কাজিমের বংশধর বলে দাবি করতেন। সে সময়ে তাঁর নামে মুদ্রা চালু করা হয় এবং তাঁর নামে মসজিদে খুৎবা দেওয়া হতো। এদিকে কাবুলেও বাবুরের নামে মুদ্রা ও খুৎবা প্রচলিত ছিল। পরে বাবুর বুখারার দিকে রওনা হন এবং সেখানে তাঁর বাহিনীকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তাইমুর বংশীয় বলে এ ক্ষেত্রে তাঁর খুব সমর্থন ছিল। শহর ও গ্রামের লোকেরা তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে সর্বস্ব উজাড় করে দিতেও পিছপা হতো না। বাবুর এ ক্ষেত্রে পারস্যের শাহের সহযোগিতা ফিরিয়ে দেন শুধু এই হিসেবে যে, এখন আর তাঁর সাহায্যের আর ততটা প্রয়োজন নেই। ১৫১১ ঈসায়ী সনের অক্টোবরে বাবুর সমরখন্দে পুনঃপ্রবেশে সমর্থ হন। সমরখন্দ এতদিনে একটি সুসমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়ে উঠেছিল এবং সেখানকার জনগণ তাকে তাদের মুক্তিদাতা রূপে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। বাবুর শিয়া পোশাকে সুন্নিদের সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। বাবুরের আত্মীয় মির্জা হায়দায় লিখেছেন—“বাবুর একটু ভীত ছিলেন পারস্যের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে। পারস্যের শাহকে খুশি করার জন্য যেমন সুন্নি সম্প্রদায়কে লাঞ্ছিত করেননি; তেমনই শাহের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক হাতটিও সরিয়ে দেননি। এর ফলে, আট মাস পরে তিনি উজবেকদের উপর পুনরায় জয়লাভে সমর্থ হন।’

উত্তর ভারত জয়

বাবুর তাঁর আত্মকথার একস্থানে সমরখন্দ পুনরুদ্ধার সম্পর্কে লিখেছেন—‘সমরখন্দ পুনরুদ্ধার ছিল আল্লাহর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।’ এরপর বাবুরের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ফারগানা পুনরাধিকার করা। এদিকে পশ্চিম দিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয় ছিল। তা ছাড়া বাবুরের আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল ভারত জয় করা। তিনি তাইমুরি ধারাবাহিকতায় ভারতকে উত্তরাধিকার বিবেচনা করতেন।

বাবুর মনে করতেন, দিল্লি সালতানাতে পুনরায় তাইমুর বংশীয়দের শাসন কায়েম হওয়া উচিত। তিনি নিজে তাইমুরবংশীয় হওয়ার কারণে দিল্লি সালতান অধিকার করতে চাইতেন। তাইমুরের দিল্লি অধিকার প্রসঙ্গে দু—একটি কথা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। দিল্লি সালতানাতে খিলজি রাজবংশের পতনের পর একটা অরাজক অবস্থা চলে আসছিল। তাইমুর লঙ্গ—এর দিল্লি আক্রমণের পর সৈয়দেরা অবস্থার সুযোগ নিয়ে দিল্লির ক্ষমতা অধিকার করেন। তাইমুর লঙ্গের দ্বারা পঞ্জাবের শাসক নিযুক্তির পর খিজির খান এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পরে, লোদি রাজবংশের আফগানরা সৈয়দদের হারিয়ে দিল্লি সালতানাত অধিকার করেন।

এদিকে এ যুগে বাবুর নিজেকে সৈয়দ বংশের সত্যিকারের শাসনকর্তা হিসেবে দাবি করেন। লোদিদের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া সৈয়দ বংশের প্রকৃত শাসনকর্তা হিসেবে দিল্লি সালতানাতের দাবিদার বাবুর ইব্রাহীম লোদিকে একটি বার্তা পাঠান, তাতে তিনি যে দেশগুলো প্রাচীনকাল থেকে তুর্কিদের উপর নির্ভরশীল, সেগুলোর উপর নিজের অধিকার দাবি করেন। ইব্রাহীম লোদির জবাব না আসায় তিনি ছোট ছোট রাজ্যগুলোর উপর আক্রমণ শুরু করে দেন। সর্বপ্রথম তিনি কান্দাহার অধিকার করে নেন। তিনি কাবুলের পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণের রণকৌশল ঠিক করেন। কান্দাহার বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তাঁর ভারত আক্রমণ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে সংঘটিত হয়। বাবুরের কান্দাহার দুর্গ দখল ও আরো ছোটখাটো কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সব যুদ্ধ তাঁর পরবর্তীতে ভারত আক্রমণে সফল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ইতোমধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটে। এই সময়ের কথা বাবরনামায় নেই। এটি হয় তিনি লেখেননি, নতুবা লিখেছিলেন তবে নষ্ট হয়ে যায়। এই সময় ইরানের শাহ ইসমাঈল সফভি একটি চরম দুঃসময় কাটান। তাঁর বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অটোমান রাজা প্রথম সেলিম এর বিরুদ্ধে চালদিরাম যুদ্ধে। ওই যুদ্ধে অটোমান তুর্কিরা সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করে। ইসমাঈলের সহযোদ্ধা সঙ্গী বাবুর দু’জনেই সামরিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং বাবুর তাঁর বাহিনীকে কামান যন্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে একজন অটোমান তুর্কি উস্তাদ আলী কুলী খাঁকে আমন্ত্রণ জানান। উস্তাদ তখন ‘কামান—মানব’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাবুরের একথা মনে ছিল যে, তাঁর বিরোধীরা এ ধরনের অস্ত্র তাঁর না থাকার জন্য তাঁকে বিদ্রুপ করত। এই যন্ত্রগুলো থেকে বিকট আওয়াজ বেরুত এবং তা থেকে কোনো বর্ষা বা তীর নিক্ষিপ্ত হতো না। এই অস্ত্রগুলো স্বল্পসংখ্যক সৈন্যদের হাতে দেওয়া হয় শত্রুদের উপর কর্তৃত্ব করার জন্য। ভারত জয়ের পথে অগ্রসর হওয়ার সময় বাবুর সঙ্গে কামান নেন এবং চলার পথে এগুলোর ব্যবহার হয় প্রধানত ক্ষুদ্র—ক্ষুদ্র শত্রুদলের শক্তি, অবস্থান ও কৌশল জানার জন্য। কাবুল ও কান্দাহার ছিল বাবুরের দুটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। বাবুর ওই দুটি এলাকার মানুষদের সঙ্গে বড়ই আন্তরিক ব্যবহার করতেন এবং তাদের স্থানীয় সংস্কৃতি প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে বিধবা ও এতিমদের সাহায্য করে তাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন।