» » সপ্তম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

একষট্টি

‘ওই কে এলে আকাশ পরে দিক-ললনার প্রিয়/ চিত্তে আমার লাগল তোমার ছায়ার উত্তরীয়…’

মণিকুন্তলা গান করছেন। গলা খুলে নয়, গুনগুন করে। তিনি ছোট মেয়ের ঘর গোছাতে এসেছেন। বাসি জামা, বিছানার চাদর,  বালিশের ওয়াড় আলাদা করেছেন, এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলে রাখা জামাকাপড় ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে রাখছেন, খোলা বই তাকে গুছিয়ে তুলছেন। কম্পিউটারের ঢাকা দিলেম। জানলার নীচে জল। নিশ্চয় জানলা খোলা ছিল। কাপড় এনে সেই জল মোছবার সময় মণিকুন্তলা মনে মনে মেয়েকে ধমকও দিচ্ছেন। এই মেয়ে বৃষ্টি-বাদলায় জানলা আটকাতে কবে শিখবে? শুধু ছোট মেয়ের ঘরের কাজ নয়, একই সঙ্গে বাড়ির অন্যদিকেও খেয়াল দিতে হচ্ছে মণিকুন্তলাকে। সকালবেলায় সংসারে অনেক কাজ। যতই কাজের লোক থাকুন না কেন, বাড়ির গিন্নিকে নজর রাখতে হয়। এর সঙ্গে গুনগুন করে গান। কাজ করতে করতে যখন মেয়ের ঘরে আসছেন, গানের ভলিউম বাড়ছে। যখন ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা বা পাশের ঘরে যাচ্ছেন গান হয়ে যাচ্ছে আবছা।হেডফোনের সেরা অফার

এখন যেমন মণিকুন্তলা এই ঘরে। তাই গান স্পষ্ট।

‘মেঘের মাঝে মৃদঙ্গ তোমার বাজিয়ে দিলে কি ও

ও তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিয়ো দিয়ো…’

বারিধারা বিছানায় শুয়ে আছে। গলা পর্যন্ত চাদর। পাশবালিশ জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে আছে। খানিক আগে তার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু এখনও সে ঘুম থেকে ওঠেনি। ঘুম ভাঙা আর ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে বিস্তর ফরাক। এমনকী খাট থেকে নেমে ব্রাশ করলেও অনেক সময় ঘুম থেকে ওঠা হয় না। বারিধারা দেখেছে, বহুবার ব্রেকফাস্ট করতে করতেও সে ঘুমের মধ্যে থেকেছে। এখন যেমন ঘুম ভেঙে এবং ঘুম থেকে না উঠে মায়ের গান শুনছে। খুব ভালো লাগছে। লাগবারই কথা। এই মহিলার গানের গলা যতটা না ভালো, গান করবার ধরনটা বেশি ভালো। খুব স্বতঃস্ফূর্ত। এত সহজভাবে গাইতে পারে যে মনে হয় গানটা আর পাঁচটা কাজের মতোই। কোনও আয়োজন লাগে না। কোনও জোরজার লাগে না। প্রাণে গান এলেই গাওয়া যায়। মহিলার ওপর বারিধারার হালকা হিংসেও হল। ইস সে যদি মায়ের গলার খানিকটা পেত। নিমেষে আবার হিংসে চলেও গেল। গান গাইতে পারবার থেকে গান শুনতে পাওয়াও কম আনন্দের নয়।

মণিকুন্তলা গান থামিয়ে, মেয়ের দিকে তাকালেন। কড়া গলায় বললেন, ‘কী রে, কখন উঠবি?’

বারিধারা চাদরটা মাথার ওপর টেনে নিয়ে বলল, ‘উঃ গান থামিও না। তোমার পরীক্ষা হচ্ছে।’

মণিকুন্তলা হাতে মেয়ের জামা নিয়ে থমকে গেলেন।

‘কীসের পরীক্ষা?’

বারিধারা চাদরের নীচ থেকে বলল, ‘এই গানটা তুমি ভালো গাও না শ্রাবণী সেন ভালো গায়। আবার মুখড়াটা ধরো।’

মণিকুন্তলা কটমট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাদর মুড়ি দেওয়া মেয়ের চুলের ঝুঁটিটা ঠিক কোনদিকে বোঝবার চেষ্টা করলেন। বুঝতে পারলেই ধরে নাড়িয়ে দেবেন। সাতসকাল থেকেই রসিকতা করা বেরিয়ে যাবে।

বারিধারা বলল, ‘মা, ঘাবড়িও না। পরীক্ষার ফার্স্ট রাউন্ডে এগিয়ে আছ।’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘একটা চড় মারব।’

বারিধারা খিলখিল করে হেসে চাদর সরিয়ে উঠে বসল। ডান হাত বাড়িয়ে নাটকীয় ঢঙে বলল, ‘মণিকুন্তলা ম্যাডাম, রাগ করবেন না। সত্যি আপনি একজন সুকণ্ঠের অধিকারিণী। সংসার নামক হারমোনিয়ামের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্যাঁ পো করে মরছেন। অধিকাংশ গুণী মহিলার জীবনে এমনটাই ঘটে। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় প্রতিভা মাথা কুটে মরে। আপনি যদি সঙ্গীতের চর্চা নিয়মিত করতেন তা হলে শ্রাবণী সেন না হোন মণিকুন্তলা সেন হিসেবেই শ্রোতাদের কাছে পরিচিত এবং সমাদৃত হতেন। তবে দুঃখ করবেন না ম্যাডাম, আপনি আপনার এই কন্যার কাছে কোনও বড় গায়িকার থেকে কম নন।’

মণিকুন্তলা বুঝলেন, এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলা ঝকমারি ছাড়া আর কিছুই নয়। সকাল মেয়ের সঙ্গে ঝকমারি করার জন্য নয়, সকাল সংসারের কাজ করবার জন্য। চটি ফটফটিয়ে রাগের শব্দ করে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যাক, মেয়ের ঘুমের মধ্যে ঘরটা তাও খানিকটা সাফসুতরো করা গেছে।

বারিধারা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ মেঘ ভরা। কালো মেঘ নয়, কাজল লেপটানো মেঘ। কাল সারারাত ধরে বৃষ্টি পড়েছে। তবে খুব জোরে নয়। সকালের দিকে খানিকটা ধরেছে। আকাশ বলছে, আবার যে-কোনও সময় ঝমঝমিয়ে নামবে। সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বৃষ্টির দিন।

বারিধারা আড়মোড়া ভাঙল। তার মন ভালো লাগছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মন ভালো লাগা একটা সুলক্ষণ। বৃষ্টির দিনের কতগুলো নিজস্ব নিয়ম আছে। একে বলে ‘বৃষ্টির দিনের নিয়ম’। এই নিয়ম না মানলে, বৃষ্টি রাগ করে। সেই রাগ যদি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন বিপদ ঘটে। বৃষ্টি অভিমান করে এবং বেশ ক’দিন এ মুখো হয় না। বারিধারা মনে মনে নিয়মগুলো ঝালিয়ে নিল। সারারাত বৃষ্টি পড়লে এবং পরদিন সকালেও আকাশ মেঘে ভরা থাকলে সহজে বিছানা ছাড়তে নেই। সেদিনের যাবতীয় রুটিন কাজ বাতিল করতে হয়। গোটা সকালে বারবার গরম চা চাই। সঙ্গে ডিমের পকৌড়া। পিছনে গাঁক গাঁক করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলবে। দুপুরে খিচুড়ি। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনন্দীর ‘মরীরা দুপুর’ বা অরহান কামুকের উপন্যাস ‘দ্য মিউজিয়ম অফ ইনসেন্স’ পড়তে হবে। বিকেলে পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে ফোন বা ফেসবুকে আড্ডা। সন্ধেবেলা খাটে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে সিনেমা দেখতে হবে। কোরিয়ান মুভি ‘আ বিটার সুইট লাইফ’ অথবা বাংলায় ‘সোনার কেল্লা’। এর মাঝখানে প্রেমিক বা প্রেমিকা ফোন করবে। সেই ফোন ধরা চলবে না। তাকে টেনশনে রাখতে হবে। এতে এক ধরনের বিরহও তৈরি হবে। স্বেচ্ছাবিরহ। বৃষ্টিতে মিলনের চেয়ে বিরহ বেশি ইন্টারেস্টিং।

বারিধারা ঠিক করল, সে আজ বৃষ্টি দিনের নিয়ম মেনে চলবে। সে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বার তোড়জোড় শুরু করল।

মণিকুন্তলা আবার ঘরে ঢুকলেন।

‘বৃষ্টি, জরুরি কথা আছে। মুখ ধুয়ে নীচে এসো। চা খেতে খেতে কথা বলব।’

বারিধারা শোবার প্ল্যান ত্যাগ করে বলল, ‘আজ তো জরুরি কথা শোনা যাবে না মা।’

মণিকুন্তলা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কেন? আজ তোমার কী?’

বারিধারা গায়ের চাদর সরিয়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরল। হাসিমুখে বলল, ‘আজ বৃষ্টির দিন। আজ জরুরি কথা বলা বারণ।’

মণিকুন্তলা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন। তার এই মেয়েটা ছেলেমানুষ বয়স থেকেই বৃষ্টি পাগলা। বৃষ্টি পড়লে চোখে চোখে রাখতে হত। ছুতোনাতা পেলেই বারান্দা, উঠোন, ছাদে ভিজতে চলে যেত। মণিকুন্তলা একবার পিটুনি দিলেন। নাতনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে দাদুর কাছে গেল। কমলকান্তি সেন পুত্রবধুকে ডেকে পাঠালেন। মণিকুন্তলা ঝগড়া করবেন বলেই প্রস্তুত হয়ে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে গেলেন।

‘বাবা আপনি আর আশকারা দেবেন না। এই সেদিন জ্বর থেকে উঠল মেয়ে। বারণ শুনছে না।’

কমলকান্তি সেন গম্ভীর ভাব বললেন, ‘তুমি শাসন করে ঠিক করেছ। অবাধ্য ছেলেমেয়েকে দু-ঘা দেওয়াটাই উচিত। আমি তোমাকে এই কারণে ডাকিনি।’

মণিকুন্তলা গজগজ করতে করতে বললেন, ‘তা হলে কী কারণে ডেকেছেন?’

কমলকান্তি অপরাধীর ঢঙে বললেন, ‘নাতনির এই বৃষ্টি ভেজা স্বভাবের জন্য আমিই দায়ী সেকথাটাই বলতে ডেকেছি।’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। তবে ওই মেয়ে যদি আবার বৃষ্টিতে ভিজতে যায়, আবার আমার হাতে মার খাবে।’

কমলকান্তি বললেন, ‘আর ভিজবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘সে আপনার ব্যাপার। আমি ছাড়ব না।’

কমলকান্তি বললেন, ‘তুমি ঠাণ্ডা হও। যার ভালো নাম বারিধারা, ডাকনাম বৃষ্টি সে তো বৃষ্টিতে ভিজবেই। না চাইলেও ভিজতে হবে। তার কোনও অপরাধ নেই। ছোট নাতনির নাম আমি বদলে দিচ্ছি। সেই ব্যাপারে আলোচনার জন্য আমি তোমাকে ডেকেছি। আচ্ছা, মেয়ের নাম যদি রোদ্দুর দিই? কেমন হবে? তবে তাতেও চিন্তা আছে। তখন হয়তো রোদে টইটই করে ঘুরবে। তাই না? সবথেকে ভালো হয়, এইমেয়ের নাম আমি দিই ঘর। তা হলে নিশ্চয়ই চুপটি করে ঘরে বসে থাকবে।’

মণিকুন্তলা আর পারেননি। শ্বশুরমশাইয়ের সামনেই ফিক করে হেসে ফেলেছিলেন। বারিধারার সেই বৃষ্টি পাগলামি যায়নি। এখনও ভেজে। বড় হয়েছে বলে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভেজে। টুক করে ছাদে চলে যায়।

মণিকুন্তলা হাত সরিয়ে নিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘বাজে কথা পরে বলবে। তোমার দিদিকে আনতে গাড়ি গেছে। সে এলে আমরা তোমার দাদুর প্রাোজেক্ট নিয়ে মিটিং করব।’

বারিধারা এবার প্রায় লাফিয়ে উঠল।

‘খুব ভালো হবে।  একটু পরে রোদ উঠবে, প্রাোজেক্টের জন্য কাজ করাটা কোনও কাজ নয়। এটা আনন্দ। মিটিংয়ে আর কে কে থাকবে? বাবা?’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘না, আজ আমরা শুধু তিনজনে একটু কথা বলে নেব। সবাইকে নিয়ে কবে বসা হবে, তাই ঠিক করব। তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।’

ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে তিনজনে কথা হল। সাতদিন বাদে মিটিংয়ের একটা দিন ঠিক হল। সবাইকে থাকতে হবে। ওই সময় কোর্টের কাজে অর্চিনের কলকাতায় আসবার কথা। সেও থাকবে। বারিধারার দায়িত্ব পড়ল, সবাইকে খবর দেওয়ার।

প্রথম কাজ হবে, একটা ট্রাস্ট তৈরি করা। ঝাড়গ্রামের জমিটা একদিন সরজমিনে দেখে আসা হবে। পাঁচিল দিয়ে সেই জমি ঘিরে ফেলা দরকার। ভিতরে আপাতত একটা ঘর বানানোর বন্দোবস্ত করলেই চলবে। ওটা হবে সাইট অফিস। আপাতত সেনবাড়িতে বসে কাজ শুরু হবে। বাকি কাজ সেদিন মিটিংয়ে আলোচনা করে ঠিক হবে।

বারিধারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ব্যস, তাহলে আজকের মতো জরুরি কথা শেষ। এবার রেনি ডে উদযাপন হবে।’ মেঘবতী বলল, ‘দাঁড়াও, আমার একটা কথা আছে।’

বারিধারা মুখ ভেটকে বলল, ‘আবার কী কথা দিদি? চল ছাদে গিয়ে ভিজি। দেখ কেমন জোরে বৃষ্টি নেমেছে।’

মেঘবতী বোনের কথায় পাত্তা না দিয়ে থমথমে গলায় বলল, ‘বাবা আমাকে সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে জয়েন করতে বলছে। বলছে, এখন থেকে অফিসে গিয়ে কাজকর্ম শিখতে।’

বারিধারা মায়ের মুখের দিকে তাকাল।

‘কী ব্যাপার মা? দিদি, যা বলছে সত্যি?

মণিকুন্তলা চায়ের কাপ মুখ থেকে নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি। তোদের বাবা আমাকে বলেছে, কোম্পানির দায়িত্ব তো এবার কাউকে বুঝে নিতে হবে। সেটা বাড়ির কাউকেই নিতে হবে। তোর বাবার তো বয়স হচ্ছে। বাড়ির কেউ দায়িত্ব না নিলে কীভাবে চলবে?’

বারিধারা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘এটা তো খুব ভালো কথা। সেন অ্যাসোসিয়েটস তো তুলে দেওয়া যায় না। বাইরের লোক দিয়ে ব্যবসা চলেও না। দিদি যদি দায়িত্ব নেয় তার মতো ভালো আর কিছু হবে না। তোর কি আপত্তি আছে দিদি?’

মেঘবতী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আগে ছিল। বলেছিলাম, এ সবের মধ্যে আমি নেই। এখন বাবা বুঝিয়ে বলবার পর কেমন যেন গুলিয়ে গেছে। বাবা বলল, আমার তো ছেলে নেই। দুই মেয়ে। ছেলে থাকলে সে ব্যবসা চালাত। মেয়ে আছে বলে কি ব্যবসা তুলে দিতে হবে? বাবার কথাটায় ধাক্কা খেলাম। সত্যি তো মেয়েরা ব্যবসা চালাতে পারে না? বড় বড় কোম্পানির মাথায় মেয়েরা রয়েছে। অনেক ব্যবসায় মালিকও মেয়ে। তা হলে আমরা কেন বাবাকে হেল্প করতে পারব না? বাবার বয়স বাড়ছে। বাবার ওপর চাপ পড়ছে। জ্যোতিষ্ককে বলেছিলাম। সে বলল, অবশ্যই তোমার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। জটিল কাজে তোমার মাথা পরিষ্কার। বাবাকে কিছু বলিনি। আগে তোমাদের বললাম। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। তোমরা বলে দাও।’

বারিধারা মেঘবতীকে জড়িয়ে ধরে ফটাস করে গালে একটা চুমু খেল। মেঘবতী বোনকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিল। বারিধারা একগাল হেসে বলল, ‘ভেরি গুড। এই না হলে তুই বারিধারা সেনের দিদি? অবশ্যই রাজি হবি। তোর কড়া হাতে বাপ-ঠাকুরদার কোম্পানির আরও ভালো হবে। তুই যদি রাজি না হতিস তোকে ত্যাজ্য দিদি করতাম।’

মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি কি পারব? অত বড় অফিস। অত কাজ। আমি তো কখনও এরকম কঠিন কাজ করিনি।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘তুই অফিসে জয়েন করেই একটা ছিঁচকাঁদুনে রুম বানাবি। যখন দেখবি কাজ সামলাতে পারছিস না, নাকানি-চোবানি খাচ্ছিস, তখন ওই ছিঁচকাঁদুনে রুমে গিয়ে খানিকক্ষণ কেঁদে নিবি। বাইরে বোর্ড ঝোলানো থাকবে বস ইস নাউ ক্রাইং, ডোন্ট ডিসটার্ব।’

মেঘবতী হাত বাড়িয়ে বোনের কান ধরবার চেষ্টা করল। মণিকুন্তলা মেয়েদের ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোরা থামবি? এরকম একটা সিরিয়াস সময়ে বাচ্চাদের মতো মারামারি করছিস?’

তারপর বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুই পারবি মেঘ। তোর বাবা জেনেশুনেই তোর কথা ভেবেছে। বলেছে, সহজ কাজে কেঁদে ফেললেও, কঠিন কাজে আমার বড় মেয়ের খুবই ঠাণ্ডা মাথা।’

মেঘবতী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আর একটু পরে রোদ উঠলে প্রাোজেক্টের কী হবে?’

মণিকুন্তলা হেসে বললেন, ‘তার জন্য তো আমরা সবাই আছি। তুইও থাকবি।’

মেঘবতী কান্নার ভাব ঝেরে ফেলে বলল, ‘আমি থাকব তো?’

মণিকুন্তলা বললেন, ‘এ মা! কেন থাকবি না? অফিসের কাজের পর যতটা পারবি সময় দিবি।’

বারিধারা হুকুমের ঢঙে বলল, ‘শনি, রবি আর অন্যান্য ছুটির দিন আপনি প্রাোজেক্টে যাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন সেখানে আপনি বস নন, সেখানে বস আমি। আমি যা অর্ডার করব সেই মতো কাজ করবেন।’

মেঘবতী এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে বোনকে তাড়া করল। বারিধারা হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটল। মেঘবতী হাসতে হাসতে গেল পিছনে। দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন মণিকুন্তলা। খুশিতে তাঁর বুক ভরে গেল। কিন্তু এই খুশি একটু পরেই মণিকুন্তলার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। খানিকক্ষণ মেয়েদের সাড়াশব্দ না পেয়ে খানিকটা চিন্তিত হয়েই মণিকুন্তলা ছাদ পর্যন্ত চলে যান এবং সেখানে যা দেখলেন তাতে রাগে মাথায় আগুন ধরবারই কথা। ধেড়ে মেয়েরা এ কী কাণ্ড করছে! বৃষ্টিতে হাত ধরাধরি করে পাগলের মতো ভিজছে যে! ছি-ছি, এদের কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই?

বারিধারা আর মেঘবতী ভিজতে ভিজতে তাদের মাকে দেখতে পায় এবং হাত ধরে জোর করে টেনে ছাদে নামায়।

‘ওরে আমায় ছাড়, ওরে আমায় ছাড়’ বলতে বলতে মণিকন্তলাও ভিজতে থাকেন। মাথায় রাগের আগুন নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার এমন আনন্দ তিনি আগে কখনও পাননি।

মা-মেয়ের এই আনন্দস্নানে সব থেকে খুশি হল খোদ বৃষ্টি। সে আরও ঝেঁপে নামল।