» » পঞ্চম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

একচল্লিশ

তমসা আরেক হাত ভাত তুলে দিল অর্চিনের প্লেটে। অন্য কোনও সময় হলে অর্চিন বারণ করত, আজ করল না। তার খিদে পেয়েছে। থানা থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছিল অর্চিন। শেখর আটকাল।

‘আমার বাড়িতে চল। খেয়ে নিবি।’

অর্চিন বলেছিল, ‘থাক শেখরদা।’

শেখর বলল, ‘কেন? থাকবে কেন? খিদে পায়নি?’

অর্চিন শুকনো হেসে বলল, ‘তা পেয়েছে। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেব। তোমার বাড়িতে গিয়ে আবার ঝামেলা পাকাব না।’

শেখর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ঝামেলার কী আছে? আমি খাব, তুইও খাবি। চল। তমসাকে একটা ফোন করে দিচ্ছি। ও আজ বাড়িতে আছে।’

মুখে বললেও স্ত্রীকে ফোন করতে ভুলে গেল শেখর। গোটা পথই সে কথা বলতে বলতে এল।

আগে থেকে না জানালেও তমসা ব্যবস্থা করে ফেলেছে। শেখরও বসেছে। খাওয়া খুবই সাধারণ। ভাত, ডাল, একটা তরকারি। তমসা দুজনকে ডিম ভেজে দিল। অর্চিন বাধা দিয়েছিল।

‘কিছু লাগবে না তমসাদি।’

হিসেবমতো শেখরের স্ত্রীকে অর্চিনের ‘বউদি’ সম্বোধন করা উচিত। ডাকে না। বিয়ের আগে থেকেই পরিচয়। তখন ‘তমসাদি’ ডাকত, এখনও তাই ডাকে। অনেকেই তাই করে। পার্টির সঙ্গে যাদের  যোগাযোগ, তারা আগে যেমনভাবে তমসাকে চিনত, এখনও সেরকমভাবে চেনে। ফলে নতুন করে সম্বোধন বদলের প্রশ্ন ওঠে না।

তমসা সঙ্কুচিত হয়ে বলল, ‘আজ মাছ-টাছ কিছু নেই। থানায় যাবে বলে তোমার দাদা বাজারে গেল না। ইস, তুমি যে কী করে খাবে অর্চিন?’

অর্চিন বলল, ‘কী বলছ তমসাদি, আমি তো বেশিরভাগ দিন দুপুরে ভাতই খাই না। ইউনিভার্সিটিতে এটা-সেটা খেয়ে কাটিয়ে দিই। বাড়িতে মাসি রাগ করে। কী করব? লেট করে ফেলি। খেতে বসবার সময় কই? আজ যে ভাত পেলাম, এটাই অনেক। আর কিছু লাগবে না।’

তমসা কথা শোনেনি। সে ডিম ভেজে এনেছে। মনে মনে রাগও হয়েছে। শেখর কি কোনও দিন অভ্যেস বদলাবে না? চিরকাল আগে কিছু না বলে লোক এনে বলে, ‘তমসা ভাত হবে নাকি? আজ আমার সঙ্গে সোমনাথ খাবে। আমারটাই দাও, ভাগ করে নিই।’

তমসা পরে রাগ করে, ‘কেউ খেতে এলে আগে একটু জানাবে তো। তার সামনে ভাগ করে দাও কথাটা শুনতেও খারাপ লাগে।’

শেখর অবাক হয়ে বলে, ‘ভাগ করে খাব বলবার মধ্যে খারাপ লাগবার কী আছে?’

তমসা থমথমে গলায় বলে, ‘এটা পার্টির কমিউন নয় শেখর। সংসার। এখানে তোমার স্ত্রী, ছেলেও থাকে। সংসারের একটা নিয়ম আছে। বাইরের কাউকে খেতে বললে, তাকে আলাদা যত্ন করতে হয়। পার্টি কমিউনে কেউ বাইরের নয়। আলাদা যত্ন লাগে না।’

শেখর কাঁচুমাচুভাবে বলে, ‘বুঝেছি। কিন্তু কী করব? আমি নিজেও তো জানতাম না সোমনাথ ভাত খায়নি। এইমাত্র জানলাম। বললাম তো, আমারটাই দুজনকে ভাগ করে দাও।’

তমসা আরও রেগে যায়। বলে, ‘আবার এক কথা। একজনের ভাত ভাগ করা যায় নাকি? আর শুধু ভাত? ভাতের সঙ্গে ডাল-তরকারি, মাছ দিতে হবে না? সেটাও কি ভাগ করে হবে?’

শেখর মাথা চুলকে বলে, ‘সরি, তোমাকে সমস্যায় ফেললাম।’

তমসা গম্ভীর গলায় বলে, ‘সরি বলছ কেন? দুদিন অন্তরই তো ফেলো। আমি তো কাউকে আনতে বারণ করিনি। একটু আগে জানাতে সমস্যা কোথায়? মোবাইল থেকে একটা টেক্সট করে দিতে তো পারো। ভাতটা অন্তত বসিয়ে দিতে পারি।’

শেখর জিভ কেটে বলে, ‘ইস, একদম মাথায় ছিল না। এরপর কাউকে খেতে ডাকলে তোমাকে আগে জানিয়ে দেব।’

পরের বারও একই কাজ করে শেখর। সে আবার কোনও রবিবার কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে বেলা তিনটের সময়। ঢুকেই বলে, ‘তমসা আমাকে আর সামন্তককে ভাত দাও। তাড়াতাড়ি দাও। খিদেতে পেট জ্বলছে দুজনের।’

তমসা রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলে। এই মানুষটার ওপর রাগ করে কী লাভ। তমসা অবশ্য এক্সট্রা লোক খাওয়ার বিষয়টা ছোটবেলা থেকেই দেখেছে। একাত্তর-বাহাত্তর সাল তখন। সরকারি স্কুলের শিক্ষক বাবা পরিবার নিয়ে বারাসাতে। সরকারি বাধানিষেধ অমান্য করে পুরোদমে রাজনীতি করছে। তবে বেশিটাই করতে হচ্ছে গোপনে। সর্বত্র খুনোখুনি, পাড়াছাড়া, পুলিশের ধড়পাকড় চলছে। সেই সময় পার্টির অনেকেই লুকিয়ে খেতে আসত। কেউ আগে বলে আসত, কেউ আসত বিনা নোটিসে। চুপচাপ খেয়ে চলে যেত। প্রথম দিকে মা সমস্যায় পড়ত। পরে রোজই দু-তিনজনের জন্য বেশি করে ভাত বসানো হত। অনেকটা ডাল আর বড় করে একটা তরকারি। পালিয়ে বেড়ানো, না-খাওয়াদের জন্য ভাত-ডালই তখন বিরাট ব্যাপার।

আজ তমসার স্কুলে হাফছুটি হয়ে গেছে। স্কুল যে এলাকায়, সেখানকার কে একজন মারা গেছে। ছোটখাটো কোনও নেতা। গতকাল সেকেন্ড পিরিয়ডের পর ক’টা ছেলে এসে একরকম জোর করে বড়দির ঘরে ঢুকল। স্কুল ছুটি দিতে হবে। এলাকায় ‘জনদরদি নেতা’ মারা গেছে, পাড়ায় লেখাপড়া চলে কী করে? বড়দি তাদের বোঝাল, মেয়েদের স্কুলে এরকম হুটপাট ছুটি দেওয়া যায় না। অনেক মেয়ের বাড়ি থেকেই গার্জেনরা নিতে আসে। তারা একা বাড়ি ফেরে না। ফলে ছুটির পরও মেয়েদের স্কুলে আটকে রাখতে হয়। টিচারদেরও থাকতে হয়। প্রথম দিকে ছেলেগুলো বুঝতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত বুঝেছে। কাল ছেড়ে দিয়েছে, তবে তার বদলে আজ হাফ ছুটি দিতে হল। এই বিষয়টা নিয়ে কাল টিচাররুমে মালিনী আর অন্তরাদির মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। মালিনীদি রাগ করছিল।

‘কোথা কার কে দু-পয়সার নেতা মারা গেছে বলে স্কুল ছুটি দিতে হবে। এ কেমন কথা? এ তো গুণ্ডামি। বড়দিই বা মেনে নিলেন কেন?’

অন্তরাদি বলল, ‘এমন করে বলছ যেন আজই এমন প্রথম ঘটল। আগেও হয়েছে। আমি অন্তত দশটা ইনস্টান্স দেখাতে পারি। পলিটিক্যাল প্রেসার দিয়ে ছুটি।’

মালিনী বলল, ‘তারা কেউ এরকম ফুটো নেতা ছিল না।’

অন্তরাদি বলল, ‘ফুটো নেতা না আস্ত নেতা, তা বলতে পারব না, তবে সেটাও এক ধরনের গুণ্ডামি ছিল।’

মালিনী তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘গুণ্ডামি! তখন গুণ্ডামি ছিল! কী বাজে বকছ? একটা উদাহরণ দেখাও অন্তরাদি, কবে গুণ্ডামি করে স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। এইভাবে মস্তানরা এসে হেডমিস্ট্রেসের ঘরে ঢুকতে পারত?’

অন্তরাদি বলল, ‘মালিনী, বিষয়টা ছোটবড় নয়, পলিটিক্যাল পার্টির নেতা মারা গেলে স্কুল-কলেজ, দোকান-বাজার বন্ধ করে দেওয়াটা আমাদের এখানকার একটা কালচার হয়ে গেছে। পাড়ার নেতা আর এমপি, এমএলএ-তে তোমার কাছে পার্থক্য থাকতে পারে লেখাপড়ার কাছে কী পার্থক্য? তা ছাড়া একটা সময় জোর করে বড়দির ঘরে ঢুকতে হত না। ফোন চলে আসত। তাতেই কাজ হত। সেটাও এক ধরনের গুণ্ডামি ছিল।’

তমসা ইচ্ছে করেই চুপ করে ছিল। এই ঝগড়ায় ঢুকলেই সবাই ভাবত, রাজনীতি করছে। স্কুলের সকলেই তার পলিটিক্যাল আইডেন্টিটির কথা জানে। আবার এটাও জানে, এই পরিচিতি নিয়ে সে কখনও কোনও সুবিধে নেয়নি। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না, পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও স্কুলের প্রশাসনিক বিষয়ে কখনও নাক গলায়নি। তখন বড়দি মাঝে মাঝে ডাকতেন। রুটিন, পরীক্ষা, রেজাল্ট এসব নিয়ে মিটিং করতে চাইতেন। তমসা কোনওদিন একা যায়নি। আর পাঁচজন সিনিয়র টিচারকে নিয়ে ঘরে ঢুকত। বড়দি অসন্তুষ্ট হতেন। সে জানত, বড়দির এই একা ডাকার পিছনে ‘ক্ষমতা’-কে খুশি করবার চেষ্টা থাকত।

‘তোমার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই তমসা। সবাইকে জুটিয়ে আসবে না।’

তমসা বলত, ‘এটা হয় না। সিনিয়র কলিগদের বাদ দিয়ে আমি এইসব বিষয়ে একটা কথাও বলতে পারি না। বলবও না।’

বড়দি একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘রুটিন তৈরির সময় তো তোমার সঙ্গে আলাদা বসাই উচিত। তোমার অবস্থা তো আর পাঁচজনের মতো নয়। স্কুলের বাইরেও তোমাকে আর পাঁচটা কাজ করতে হবে। তোমার পলিটিক্যাল রেসপন্সিবিলিটি আছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তোমাকে স্কুলে আটকে থাকলে চলবে কেন?’

তমসা হেসে বলত, ‘স্কুলে ঠিকমতো কাজ করাটাও আমার কাছে এক ধরনের পলিটিক্যাল রেসপন্সিবিলিটির মধ্যে পড়ে বড়দি। মেয়েদের পড়ানোটা মিটিং, মিছিলের মতো আমি কম গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সবার মতোই রুটিন মেনে চলব।’

তারপর থেকে আর বড়দি এই বিষয়ে তমসাকে ঘাঁটাতেন না। বিষয়টা স্কুলের অন্য টিচাররা জানতেন। তমসার প্রতি তাদের মনোভাব অন্যরকম ছিল। কেউ কেউ বলত, ‘তমসা তোমাদের দলে যদি তোমার মতো মানুষ আরও বেশি থাকত, তা হলে ভালো হত।’ তমসা উত্তর দিত না। হাসত। মনে মনে দুঃখ পেত। পার্টি সম্পর্কে মানুষের মনে খারাপ ধারণা!

আজ তমসার ছুটি না থাকলে মুশকিল হত। অর্চিনের খাবার নিয়ে মুশকিল।

শেখর গুপ্ত চাপা গলায় বলল, ‘ক’টা দিন আণ্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করো অর্চিন।’

অর্চিন চুপ করে রইল। এই কথা থানা থেকে বেরিয়েও বলেছে শেখরদা। এখন আরও ঠাণ্ডা মাথায় বলছে।

‘নিজের পড়াশোনাটা শেষ করো। তার মধ্যে টুকটাক যেটুকু কাজ করবার করবি। সিচুয়েশন যখন বদলাবে, তখন দেখা যাবে।’

অর্চিন মুখ তুলে বলল, ‘পুলিশের হুমকিতে রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলছ শেখরদা?’

শেখর বলল, ‘তা বলিনি, বলেছি কৌশল করে চলতে। পলিটিক্সে কৌশলও মানতে হয়। এখন তোমার চুপচাপ থাকবার সময়। পুলিশ তোমার ওপর নজর রাখছে অর্চিন। এটা বোঝবার চেষ্টা করো। কোনও একটা কেস দিয়ে পুলিশ তোমায় ধরে রাখলে সেটা সুবিধের হবে?’

তমসা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। বলল, ‘ঠিকই, অর্চিন এখন ক’টা দিন পলিটিক্সের মধ্যে তোমার না থাকাই ভালো।’

অর্চিন বলল, ‘তোমরা তো আছো তমসাদি। তোমরা কি ভয় পেয়ে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছ?’

শেখর বলল, ‘আমাদের অবস্থানের সঙ্গে তোর অবস্থানের তুলনা চলে না। আমরা কীভাবে পার্টি করি, সবাই জানে। আমাদের দৌড় কতদূর তাও জানে। তোরা ফ্রেশ, আনপ্রেডিক্টেবল। ভয়ঙ্কর গোলমালে কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারিস। নিজেদের নিয়ে চিন্তাভাবনা তোদের কম। পলিটিক্যাল মুভমেন্টে যুক্তির থেকে আবেগকে তোরা বেশি পছন্দ করিস। স্বাভাবিকভাবেই তোদের নিয়ে মাথাব্যথা। সব যুগেই আগে ইয়ংদের ওপর নজর পড়েছে অর্চিন। এটা নতুন কিছু নয়। ছাত্রছাত্রী, যুবকদের নিয়ে রাষ্ট্র সবসময়ই উৎকণ্ঠিত থাকে।’

তমসা বলল, ‘ক’টা দিন চুপচাপ থাকাই ভালো।’

পুলিশ সেরকমই বলেছে। বলেছে, এখনকার মতো কিছু করা হচ্ছে না, কিন্তু নজর রাখা হবে। দ্বিতীয়বার সন্দেহ হলে অ্যারেস্ট করা হবে। ক’দিন আগে পুলিশ যখন সেনবাড়িতে গিয়ে অর্চিনের খোঁজখবর নিয়েছিল, সেদিনই অর্চিন সোজা চলে আসে শেখর গুপ্তর কাছে।

শেখর বলে, ‘দাঁড়া, থানায় আমার একজন চেনা অফিসার আছে। একসময় আমি ওর ঝামেলার বদলি সামলেছিলাম। ভদ্রলোক আমাকে মনে রেখেছেন। তাকে একবার ফোন করি। তোকে কেন খুঁজছে, আগে সেটা বুঝে নিই।’

শেখর গুপ্তকে সেই পরিচিত অফিসার বললেন, সুপর্ণ ভট্টাচার্যর কাছ থেকে খবর নিয়ে জানাবেন। উনিই অর্চিনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অফিসার শেখরকে ফোন করেন। অর্চিনের বিরুদ্ধে আর্মস পাচারের অভিযোগ এসেছে। মাসখানেক আগে কৃষ্ণনগরে একটা রেইডে কয়েকটা রিভলভার, কিছু গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তারা অর্চিনের পার্টির অ্যাক্টিভিস্ট। মারদাঙ্গায় থাকে। পার্টি সরকারি ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও তারা পার্টি থেকে সরেনি। এদেরই একজন জেরায় জানিয়েছে, কলকাতা থেকে আর্মস পাঠানো হয়। এই সূত্রে বেশ কয়েকজনের নাম তারা বলেছে। তার মধ্যে একজন অর্চিন। সুপর্ণ ভট্টাচার্য কেসটার একটা পার্ট তদন্ত করছে।

শেখর সুপর্ণ ভট্টাচার্যকে বললেন, ‘অর্চিনকে নিয়ে আমি থানায় যাচ্ছি।’

অফিসার বলে, ‘আজ আসতে হবে না। আমি সুপর্ণর সঙ্গে কথা বলেছি। আপনি কাল সকালে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেবেন শেখরবাবু। আমি কথা বলে রাখব।’

শেখর উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘না, আমিও যাব।’

কমলকান্তি সেনের মৃত্যুর কারণে পরের দুদিন থানায় যাওয়া হয়নি। আজ গিয়েছিল।

সুপর্ণ ভট্টাচার্যই সেনবাড়িতে অর্চিনের খোঁজে গিয়েছিলেন। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। সম্ভবত কলিগের পরিচিত হওয়ার কারণে বেশি ঠাণ্ডা ভাব দেখালেন। তবে ঠাণ্ডা ভাবেই কড়া কথা বলতে ছাড়লেন না।

শেখর গুপ্ত বললেন, ‘আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। অর্চিন রাজনীতি করে ঠিকই, তবে সে একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সে ফার্স্ট হয়। সে আর্মস পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলেন, ‘সেটাই তো আমাদের কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার। এত ভালো ছেলে এরকম একটা কাজে কীভাবে ইনভলভড হল?’

কেসটা সিআইডি-র। আমাদের ক্রশচেক করবার জন্য পাঠিয়েছে। সেই খোঁজে আমি সরাসরি ওর বাড়িতে চলে যাই।’

অর্চিন বলল, ‘আমি এ সবের কিছুই জানি না।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বললেন, ‘তুমি জানো না, কিন্তু যাদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো পাওয়া গেছে, তারা তোমাকে চেনে।’

অর্চিন বলল, ‘রাজনীতি করতে গেলে তো অনেককেই চিনতে হয়। আমি কখনও কৃষ্ণনগরে যাইনি।’

সুপর্ণ ভট্টাচার্য বললেন, ‘ওরা কলকাতা থেকে গেছে। যাওয়ার সময় আর্মস নিয়ে গেছে।’

এইভাবে আরও খানিকক্ষণ জেরা চলে। শেখর গুপ্ত দু-একবার কথার মাঝখানে ঢোকবার চেষ্টা করলে অফিসার তাকে চুপ করিয়ে দেন। একটা সময় অর্চিনকে বলেন, ‘রাজনীতি-টাজনীতি বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দাও। তোমার সামনে ব্রাইট কেরিয়ার। আর্মস কেসে যদি একবার আটকে দিই, গোটা জীবনটাই তো বরবাদ হয়ে যাবে। অত বড় ঘরের ছেলে তুমি। নিজের ভালো-মন্দটা বোঝার চেষ্টা করো। এবারের মতো তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু তোমার ওপর আমাদের নজর রইল। দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না। অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ করতে করতে তোমার অনেকটা ক্ষতি হয়ে যাবে।’ তারপর শেখর গুপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি বোঝান। আমি খবর নিয়ে দেখেছি, আপনার এই শিষ্যটি কিন্তু ক্রমশ উগ্র রাজনীতির দিকে যাচ্ছে। আটকান। হাতে খুব প্রমাণ না থাকলেও আর্মস কেসে আটকে রাখা যায়। শুধু সন্দেহের বশেই আটকে রাখা যায়। আপনার মুখ চেয়ে আর ছেলেটির কেরিয়ারের জন্য করলাম না। আপনারা ভেটেরান পার্টিকর্মী। পার্টি পলিটিক্স নিয়েই থাকবেন। আপনাদের পলিটিক্স ছাড়বার কথা বলে লাভ নেই। এদের বারণ করুন।’

শেখরদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্চিন বুঝতে পারল, তার মুখ তেতো। সে একটা সিগারেট ধরাল। ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। হতাশ লাগছে। অস্থির লাগছে। ঋষার সঙ্গে দেখা করবে? তাতে কি মন খানিকটা শান্ত হবে? বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে অর্চিন ঠিক করল সে সল্টলেক যাবে। ঋষা ওখানে পেয়িং গেস্ট থাকে।