☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
একত্রিশ
‘দ্য ক্যালকাটা’ হোটেলের ঘরে ঢুকে বৈশাখী সান্যাল অবাক হলেন।
এই দুনিয়ায় ঠকবাজ, জালিয়াত, দু’নম্বরী লোকদের দেখতে বেশি ভদ্রলোকের মতো হয়। অরিজিনালের থেকে বেশি। পোশাক-আশাক ফিটফাট। কথাবার্তা, চালচলন, জুতো পালিশের মতো চকচকে। হয় শুদ্ধ বাংলা, নয় চাপা গলায় ইংরেজিতে কথা বলে। মনে হবে শিক্ষা, রুচি, ভদ্রতায় এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। সেই সঙ্গে সততার পূজারি। দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য মন আকুল। গত পনেরো বছরে বহু চিটিং কারবারির সঙ্গে বৈশাখীর দেখা হয়েছে। তাদের মধ্যে কারও কারওকে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। দু’নম্বরী কাজকে এরা ভারী সুন্দর মোড়কে ঢেকে রেখেছে। ভদ্রতার মোড়ক। গোটা বিষয়টাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অফিসে, স্কুলে, কলেজে, পথেঘাটে, ট্রামেবাসে, কলকাতার নন্দন চত্তরে এদের দেখলে মানুষ ভক্তি শ্রদ্ধা দেখায়। ছেলেমেয়েকে ফিসফিস করে বলে, ‘বাবু, বড় হয়ে তোমাকে এনার মতো হতে হবে। যাও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো।’
ঘরে ঢুকে বৈশাখী এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। ঠিক ঘরে এসেছেন তো? নীচের রিসেপশন থেকে তো এই ঘরের কথাই বলল। রিসেপশনের লোকটা ভিখিরি মার্কা স্যুট পরেছে। অনেকদিন কাচা হয়নি। ডানহাতের বগলের কাছটা কুঁচকে আছে। বুকের কাছে একটা বোতাম নেই। তবে দ্যা ক্যাটকাটা হোটেলের সঙ্গে মানানসই। ঢোকবার সময়েই বৈশাখীর মনে হচ্ছিল, এই বাড়িটাও যেন অনেকদিন কাচা হয়নি।
‘আপনিই মিসেস সান্যাল?’
‘হ্যাঁ।’
‘কার কাছে এসেছেন?’
বৈশাখী একটু থমকে থেকে বললেন, ‘এডি’।
রিসেপশনের লোকটা টেবিলের একপাশে রাখা ইন্টারকম কানে দিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। রিসিভারের দিকে তাকাল। ফোনে গোলমাল হলে সবাই রিসিভারের দিকে তাকায়। লোকটা নম্বর টিপে কয়েকবার ঘটঘট করল। দু’বার রিসিভারে চড় মারল। লাভ হল না, ফোন রেখে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘থার্ড ফ্লোরে চলে যান। একশো পাঁচ নম্বর রুম।’
‘সিঁড়ি কোনদিকে?’
‘ওইদিকে লিফট।’
‘লিফটে নয়। সিঁড়িতে যাব।’
লোকটা মুখ তুলে চাপা গলায় বলল, ‘অতটা হেঁটে উঠবেন কেন? লিফটে যান?’
‘বৈশাখী বলল, আমি সিঁড়িতেই যাব। সিঁড়ি কোনদিকে?’
এই কায়দাটা শিখিয়ে গেছে অর্চিনের বাবা।
‘অচেনা বাড়িতে কাজে গেলে চট করে লিফটে ওঠানামা করবে না। করলেও সিঁড়িটা চিনে রাখবে। কোনওরকম গোলমাল হলে পালানোর অপশন জানতে হয়। লিফট সব সময় নিজের হাতে থাকে না। যখন দরকার তখন হয়তো দেখবে দশতলার ওপর উঠে বসে আছে। নামতে নামতেই বিপদে পড়ে যাবে।’
নোংরা কোট পরা রিসেপশনিস্ট সিঁড়ির পথ দেখিয়ে আবার ভাঙা ইন্টারকমে মন দিল। এবার তার ধরে টানাটানি করছে। বৈশাখী মনে মনে বললেন, যেমন হোটেল, তেমন তার রিসেপশনিস্ট, তেমন তার ইন্টারকম। নিশ্চয় লিফটে উঠলে কোনও একটা বিপত্তি ঘটত।
তিনতলায় উঠে ডানদিকের করিডর দিয়ে খানিকটা গেলে একশো পাঁচ নম্বর রুম। বৈশাখী করিডরে যেতে যেতেই হাত দিয়ে চুল ঠিক করলেন। আঁচল দিয়ে মুখ মুছলেন। একশো পাঁচ নম্বর ঘরের দরজা আধখানা খোলা। একসময়ে এইসব জায়গায় একা আসা-যাওয়া করতে ভয় করত। কে কোথায় ফাঁদ পেতে আছে কে জানে! হয়তো পুলিশ বসে আছে ঘাপটি মেরে। তার ওপর মহিলা। চিটিংবাজ, চোর, স্মাগলার, ছ্যাঁচোড় নিয়ে কাজ। খারাপ কিছু করে বসতে পারে। অর্চিনের বাবা ভরসা দিয়েছিল।
‘এই চিন্তা করবে না। চোর-ছ্যাঁচোড়রা প্রফেশনাল হয়। তারা যাকে দিয়ে কাজ করায় তার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করে না। তারা যখন খারাপ কাজ করে সেটাও প্রফেশনালভাবে করে। খুব বেশি হলে তোমাকে প্রস্তাব দিতে পারে। জোরজুলুম করবে না।’
বৈশাখী রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রস্তাব দেবেন মানে! আমার সঙ্গে নোংরামি করবে কিনা তার প্রস্তাব দেবে!’
অর্চিনের বাবা শুয়ে শুয়েই হেসেছিল। বলেছিল, ‘আমরা যেটাকে নোংরামি বলি, সবাই সেটাকে নোংরামি বলে না বৈশাখী। আবার উলটোটাও তাই। কোনটা পরিষ্কার, কোনটা নোংরা কে বলবে?’
অর্চিনের বাবা সাত বছর হল মারা গেছে। এখন আর কায়দা শেখানোর কেউ নেই। বৈশাখী নিজেই সাবধান হতে শিখেছে। খারাপ কাজ যারা করে তারা নিজেদের লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না, এটা ঠিক নয়। তার একাধিক অভিজ্ঞতা আছে। অর্চিনের বাবাকে সবটা বলা হয়নি। ইচ্ছে করেই হয়নি। তখন বয়স কম ছিল। এখন বয়স বেড়েছে। এই শরীর দেখে পুরুষমানুষের বাসনা জাগবে না। তারপরেও বিশ্বাস নেই। সেরকম কিছু হলে যাতে নিজেকে বাঁচানো যায় তার ব্যবস্থা আছে। শুধু তাই নয়, পেশাগত কোনও ঝামেলার হাত থেকে হঠাৎ বাঁচতে হলেও ব্যবস্থা লাগে। বৈশাখী সান্যাল কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগে রিভলভার রাখেন। তাতে ছ’টা বুলেট ভরা আছে। জিনিস কেনবার পর ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চালানো শিখেও এসেছেন। যারা বেচেছে, তারাই শেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। দুটো বুলেট ফ্রি দিয়েছে। তারপরেও আরও তিনটে বুলেট কিনে গুলি ছুড়েছিলেন বৈশাখী। খুব আরাম হয়েছিল।
হাত বাড়িয়ে একশো পাঁচ নম্বর ঘরের দরজায় টোকা দিলেন বৈশাখী।
ভিতর থেকে ফিনফিনে গলায় কেউ কথা বলে উঠল।
‘ভিতরে আসুন মিসেস সান্যাল।’
পার্টি জানল কী করে? রিসেপশনের ফোন ঠিক হয়েছে? নাকি লিফটে করে এসে খবর দিয়ে গেছে?
বৈশাখী সান্যাল ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ঘরের একপাশে চেয়ার-টেবিল। লোকটা টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে আছে। টেবিলে চায়ের কাপ। এ কেমন পোশাক! মলিন শার্ট, প্যান্ট। উস্কোখুস্কো চুল। একমুখ দাড়ি। চিমসে মার্কা চেহারা। চোখে এক ধরনের চোর চোর ভাব। শুধু চোখ কোন, গোটা চেহারাটার মধ্যেই এক ধরনের চোর-ছ্যাঁচোড় ভাব। যে দেখবে তারই সন্দেহ হবে। এই পোশাক, এই চেহারা দিয়ে কখনও চুরি-চামারির কাজ করা যায়? কাজ করতে হয় ভদ্রলোকের পোশাকে।
অর্চিনের বাবা প্রথম যে দু’নম্বরী লোকটার কাছে তাকে নিয়ে গিয়েছিল, তার কথা আজও বৈশাখী ভুলতে পারেননি।
অর্চিনের বাবা বলেছিল, ‘আজ তোমাকে একজন বিরাট মানুষের কাছে নিয়ে যাব।’
‘কার কাছে?’
অর্চিনের বাবা বলল, ‘অবনী সমাজপতি।’
বৈশাখী ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, ‘নামটা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন শুনেছি।’
অর্চিনের বাবা হেসে বলেছিল, ‘স্বাভাবিক। শুধু শোনওনি, দেখেওছ। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে অবনী সমাজপতির ছবি বের হয়।’
বৈশাখী বললেন, ‘তাই হবে। উনি নেতা-মন্ত্রী নাকি?’
অর্চিনের বাবা বলল, ‘না, উনি সমাজসেবী। সমাজের দরিদ্র, দুঃখী মানুষের সেবা করেন।’
বৈশাখী বললেন, ‘বাঃ। ভালোমানুষ তাহলে।’
অর্চিনের বাবা মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। ভালোমানুষ। অমন ভালোমানুষ না থাকলে আমাকে না খেয়ে মরতে হত।’
বৈশাখী অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘না খেয়ে মরতে হত! মানে?’
অর্চিনের বাবা বলল, ‘মানে আর কী, এই যে কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কাজকর্ম নেই, ধেড়ে বয়েসে বেকার, এদিকে বিয়ে করে বসে আছি, এরকম মানুষ না থাকলে সংসার চলত কীভাবে?’
বৈশাখী বলেছিলেন, ‘এসব কী বলছ! বুঝতে পারছি না।’
‘বুঝে কাজ নেই। গেলেই বুঝতে পারবে।’
বৈশাখী চুপ করে গিয়েছিলেন। অর্চিনের বাবার অবস্থা তখন ভয়ঙ্কর। কাজ চলে গেছে। হাতে টাকাপয়সা নেই। এদিকে পেটে তখন অর্চিন এসে গেছে। লোকটা কাজের জন্য পাগলের মতো ঘুরছে। কিন্তু কাজ পাওয়া যাচ্ছে না।
কারখানায় কাজ করলে কী হবে, অর্চিনের বাবা না ছিল লেখাপড়া জানা ইঞ্জিনিয়ার, না ছিল মেকানিক। এমনকী লেবারও নয়। মাঝারি ধরনের ম্যানেজারের কাজ করত। মাঝারি ধরনের কর্মীর কাজকর্ম চলে গেলে বিপদ। এদের বিশেষ কোনও যোগ্যতা থাকে না। আবার প্রেস্টিজের কারণে যে-কোনও কাজ চট করে করতেও পারে না। বন্ধ কারখানায় ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাশিয়াররা কেউ কেউ এদিক-ওদিক কাজ পেয়ে গেল। অনেক লেবার এখানে-সেখানে মুটে-মজুরের কাজ শুরু করে দিল। কেউ কেউ ঠেলাও চালাতে শুরু করল। অর্চিনের বাবার জন্য কোনওটাই সম্ভব হল না। বয়স হয়ে গেছে। বেশি খাটাখাটনি সম্ভব ছিল না। একটা চাকরি ছেড়ে দিতে হল। ন’ঘণ্টা, দশ ঘণ্টার কাজ ছিল। বেতনও কম। তার ওপর লোকটার মেজাজ ছিল অদ্ভুত। সহজে রাগত না। কিন্তু রাগলে হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। ঠিক এই কারণে বৈশাখীর বাবা-মায়ের সঙ্গে তুলকালাম করে এসেছিল। বড় মেয়ে বিয়ে করে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর বৈশাখীর মা সতর্ক হয়েছিলেন। মণিকুন্তলা সেনের খুড়তুতো বোন। তিনি মেয়েকে চোখে চোখে রাখতেন। যাতে বড় মেয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। মেয়ে যেন কিছুতেই প্রেম না করে। ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা তো দূরের কথা, কিশোরী বৈশাখীকে ছেলেদের মুখোমুখিও হতে দিতেন না সেই মহিলা। স্কুলে যাতায়াতে পাহারা। ছাদে পাহারা। বিয়েবাড়িতে পাহারা। আত্মীয়দের বাড়িতে থাকা বন্ধ। বন্ধুদের বাড়িতে একা যাওয়া নয়। এমনকী সকাল-বিকেল মেয়ের খাতাপত্র ঘেঁটে দেখা হত। প্রেমপত্র নেই তো? এই নজরদারি মেয়ে বড় হওয়ার পরও চলল। তারপরেও মেয়ে কলেজে ঢুকেই প্রেমে পড়ল। নরমাল প্রেম নয়। পাগলের মতো প্রেম। নিজের ভালোমন্দর জ্ঞান ছিল না। বাড়িতে এত কড়াকড়ির জন্যই প্রেমের তীব্রতা ছিল ভয়ংকর। সেকেন্ড ইয়ারে বিয়ে করে এসে মাকে খুব শান্তভাবে খবর দিয়েছিল।
‘আমি বিয়ে করেছি মা। আজ আমাদের রেজিস্ট্রি হয়েছে।’
‘বিয়ে! রেজিস্ট্রি! কী বলছিস হাবিজাবি কথা?’
‘কথাটা হাবিজাবি নয়, তবে বিয়েটা হাবিজাবি হয়েছে। আমার বর এখনও কোনও চাকরিবাকরি করে না। এটা একটা সমস্যা।’
‘বৈশাখী কী বলছিস এসব কথা! কী বলছিস তুই! আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস?’
‘না মা, ঠাট্টা করছি না। ছেলে ভালো কিনা জানি না। লেখাপড়া বিশেষ করেনি। প্রেমে পড়বার কারণে অতসব বিচার করিনি। করবও না। আমাকে খুব ভালোবাসে শুধু এইটুকু বুঝেছি। তবে সেটাও এখন পর্যন্ত। পরে কী হবে জানি না।’
‘কেন এরকম করলি?’
‘কী বলছ মা! কেন প্রেমে পড়লাম কেউ বলতে পারে?’
‘তুইও দিদির মতো আমাদের মুখে চুনকালি দিলি?’
‘আমাদের প্রেম যদি তোমাদের মুখে চুনকালি হয়, সেটা তোমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। দিদির সঙ্গে তোমরা যে ব্যবহার করছ, সেটা অন্যায়। দিদির বিয়ে তোমরা মানওনি। পরবর্তী জীবনে আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছ, সেটা অত্যাচার। ক্লাস নাইনে লেটার বক্সে ছেলেদের চিঠি পেয়ে বাবা আমাকে রাতে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল। অথচ সেই চিঠির বিন্দুবিসর্গ আমি জানতাম না। সেদিন রাতে গায়ে বেল্টের জ্বালা নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যদি কোনওদিন সুযোগ হয়, ওই চিঠি যে লিখেছে, তার সঙ্গে প্রেম করব। তাকে বিয়ে করব। সে যে-ই হোক। তুমি শুনলে খুশি হবে মা, আমি সেই ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি। তাকে আমি বিয়েও করেছি। আনন্দের কারণে যাচাই করে দেখতে পারিনি, ছেলে আমাদের পরিবারের যোগ্য কিনা।’
‘আমি এ বিয়ে মানি না।’
‘কিছু এসে যায় না। আমি দিদির মতো চলে যাব।’
বৈশাখীর বাবা পরদিন অফিস গেলেন না। সারাদিন বাড়িতে থম মেরে বসে রইলেন। বিকেলে মেয়েকে বললেন, ‘ছেলেটিকে বাড়িতে একবার ডাকতে পারবে? নাকি তার এ বাড়িতে আসবার সাহস নেই?’
বৈশাখী ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, ‘পারব।’
‘তাহলে ডাকো।’
বৈশাখী নীচু গলায় বলল, ‘তুমি কি চিন্ময়কে বকাবকি করবে? অপরাধ যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা কিন্তু তার একার নয়। বিয়ের জন্য আমিই তাকে চাপ দিয়েছিলাম।’
বৈশাখীর বাবা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘তুমি ছেলেটিকে খবর দাও। তার সঙ্গে আজ বিকেলে আমি চা খাব।’
বৈশাখীর বর চিন্ময় এল সন্ধেবেলা। তখন চেহারা ছিল রোগা-পাতলা। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। হাবভাবে এক ধরনের ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গি। চোখমুখ বলছে, রণক্ষেত্রে প্রবেশের আগে মনে মনে তৈরি হয়েই এসেছে।
বৈশাখীর বাবাকে নীচু হয়ে প্রণাম করতে গেলে তিনি বাধা দিলেন। ‘থাক, ওসব লাগবে না। বসো।’
ভিতর থেকে চা এল। শুধু চা-ই এল। বৈশাখীর যতদূর মনে পড়ে, বাবা সেরকমটা আদেশ করেছিলেন।
‘শুধু চা দেবে। আর কিছু নয়।’
সেই চা আসবার পর বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘নাও, চা খাও।’
চিন্ময় বলে, ‘থাক, ও সব লাগবে না। কেন ডেকেছেন বলুন।’
বৈশাখীর বাবা এই উত্তরে খানিকটা থমকে যান। সম্ভবত বুঝতে পারেন, এই ছেলে কঠিন। লড়াই করবার জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার মেয়েকে ডিভোর্স দিতে হবে।’
চিন্ময় বলল, ‘কেন?’
বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘আমি আমার বড় মেয়েকে হারিয়েছি। ছোট মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেব না।’
চিন্ময় চেয়ারে হেলান দিয়ে, মৃদু হেসে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করায় আপনার মেয়ের জীবন নষ্ট হবে ভাবছেন কেন?’
বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘যদি নষ্ট না হয়, সে যদি রাজরানি হয়, তাতেও কিছু আসে যায় না আমার। মেয়েকে আমি আমার পছন্দমতো বিয়ে দেব। তাতে তার ক্ষতি হলে হবে। আমি তার জন্ম দিয়েছি, আমি তার জীবন তৈরি করব। যাই হোক, কথা বাড়াতে চাই না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি ডিভোর্স দেবে। কালই আমি উকিল ডেকে কাগজপত্র তৈরি করে ফেলব। তুমি এসে সই করে দেবে। এই সময় আসবে।’ একটু থামলেন, তারপর অবহেলায় বললেন, ‘আর হ্যাঁ। আমি তোমায় কিছু টাকা দেব। এইসব করতে তোমার নিশ্চয় খরচাপাতি হয়েছে। কত লাগবে বলো? বিশ হাজার?’
চিন্ময় চুপ করে রইল। বৈশাখীর বাবা বললেন, ‘কী হল, চুপ করে গেলে কেন? বিশে হবে না? পঁচিশ?’
চিন্ময় নীচু গলায় বলল, ‘আমি যদি রাজি না হই?’
বৈশাখীর বাবা কড়া চোখে তাকালেন। দাঁত ঘষে বললেন, ‘রাজি না হলে বিপদ হবে।’
‘কার?’
বৈশাখীর বাবা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ?’
চিন্ময় এবার হেসে বলল, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে রসিকতা করতে পারেন, আমি পারব না কেন? বিয়ের পরদিন যদি কাউকে ডেকে ডিভোর্স করতে বলা হয়, সেটা রসিকতা ছাড়া কী?’
বৈশাখীর বাবা এবার চিৎকার করে উঠলেন।
‘শট আপ। সান অফ আ বিচ। পুলিশ ডেকে লকআপে ঢুকিয়ে দেব। মেরে হাড় ভেঙে দেব শুয়োরের বাচ্চা।’
চিন্ময় উঠে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে যা বললেন, তার জন্য আপনার আমার কাছে একটা চড় প্রাপ্য। কিন্তু আমি আপনাকে মারলাম না। সম্পর্কে আপনি আমার শ্বশুরমশাই হন। শ্বশুরমশাইয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়। ভেবেছিলাম, ক’দিন পরে, একটা কাজকর্ম জোগাড় করে বৈশাখীকে নিয়ে যাব। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত বদল করলাম। আজই আপনার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাব। অবশ্য যদি সে যেতে চায়।’
বাবার চিৎকার শুনে আড়াল থেকে বৈশাখী এবং তার মা ছুটে এসেছিলেন। বৈশাখীর দিকে তাকিয়ে ছেলে বলল, ‘তুমি কি আজ আমার সঙ্গে যাবে বৈশাখী?’
বৈশাখী একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘চলো, আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।’
মেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবা বলেছিলেন, ‘আর কোনওদিন এ বাড়িতে ঢুকবে না।’
বৈশাখী মলিন হেসে বলেছিলেন, ‘আমি জানি বাবা। আমাকে আর এ বাড়িতে আসতে হবে না।’
না, বৈশাখী জানতেন না। তাকে এ বাড়িতে আবার আসতে হল। তখন বড় দুঃসময়।
অর্চিনের বয়স তখন আট মাস। চিন্ময় জেলে। সোনার দোকানে হাতসাফাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পুলিশ বেদম মারধর করেছে। বৈশাখীর নামও পেয়েছে। সোনার দোকানে অপারেশনের সময় চিন্ময়ের সঙ্গে বৈশাখীও ছিল। দুজনে মিলে গয়না কেনবার ভান করছিল। এটা-সেটা নেড়েচেড়ে দেখছিল। এক ফাঁকে বৈশাখী গলায় পরা নকল চেইন খুলে দোকানের আসল চেইনের সঙ্গে বদলে দেন। হাতের আংটিও বদল করে। তখনকার দিনে এত সি সি টিভির নজরদারি ছিল না। তার পরেও দুদিনের মধ্যে চিন্ময়কে পুলিশ ধরে ফেলে। তারা বৈশাখীর খবরও পায়। পুলিশ তাকে যে-কোনও সময় ধরবে ধরবে অবস্থায় বৈশাখী আট মাসের অর্চিনকে কোলে নিয়ে বাড়িতে পালিয়ে আসেন। বাবা-মা দুজনেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোর মেয়েকে তারা বাড়িতে কিছুতেই আশ্রয় দেবেন না। ইতিমধ্যে তারা কানাঘুষোয় খবর পেয়েছিলেন, চিন্ময় কাজকর্ম হারিয়ে চুরিচামারি, চিটিংবাজি, স্মাগলিং-এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের মেয়েও হাত মিলিয়েছে। দুজনেই মনকে বুঝিয়েছিলেন, তাদের কোনও সন্তান নেই। এই মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর পুলিশের তাড়া খেয়ে এসেছে। ছিঃ। ছিঃ।
বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমাকে রাখতে হবে না। আমার ছেলেটাকে তোমরা রেখে দাও। আমাকে পুলিশ ধরলে, ছেলেটা ভেসে যাবে।’
কঠোর বাবা-মা প্রথমে তাতেও রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত নাতির মুখ দেখে মায়া হয়। মেয়েকে বলেন, নাতিকে তিনি রাখতে পারেন। কিন্তু শর্ত মানতে হবে। ভবিষ্যতে কোনওদিন ফিরে এসে ছেলের দাবি করা যাবে না। সে জানবে, শিশু বয়েসেই তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু মুখে বললে হবে না। লিখে দিয়ে যেতে হবে। যতদিন ছেলে নাবালক থাকবে, তার ওপর কোনও দাবি করা যাবে না। বৈশাখী আগুপিছু ভাবেননি। ছেলেকে বাঁচাতে বাবার শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। হাতে সময় নেই। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারলে, পরে আবার দেখা যাবে। বাবা-মা তো। কতটাই বা কঠিন হতে পারবে। নিজের চোর-চিটিংবাজ বাবা-মায়ের থেকে দাদু-দিদার কাছে থাকলে সে মানুষ হবে।
সেদিন রাতেই বাড়িতে পুলিশ এল। বৈশাখীর সুটকেসে চুরি করা সোনার চেইন পাওয়া গেল। বৈশাখীকে ধরে নিয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সাজা হয়। জেল থেকে বেরিয়ে দুজনেই ঠিক করে, ছেলের থেকে তারা দূরে থাকবে। জেলখাটা বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক না থাকাই ঠিক।
অর্চিন দাদু-দিদার কাছে থেকে বড় হয়। লেখাপড়ায় মন বসে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে থাকে। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। বৈশাখী বাবাকে লুকিয়ে মাকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন। মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতেন। ‘কেন তুই ফোন করেছিস?’
‘অর্চির খবরটুকু শুধু দাও মা।’
‘কী করবি খবর নিয়ে? ছেলেকে নিয়ে যাবি?’
‘না না, শুধু খবরটুকু জানব। সে ভালো আছে?’
‘ওকে বিরক্ত করিস না। ওইটুকু ছেলে সারাদিন বই পড়ে। ক্লাসে এবারও ফার্স্ট হয়েছে।’
বৈশাখী ফোনের ওপাশে কেঁদে ফেলে।
‘বাঃ, তোমরা ওকে মানুষ করেছ।’
‘তুই ওকে বিরক্ত করিস না। ওর সামনে আসিস না। জেলখাটা বাবা-মার কথা জানলে ছেলেটার সর্বনাশ হয়ে যাবে। মা হয়ে তুই এই সর্বনাশ করিস না।’
‘কখনও করব না। কোনও দিনও করব না। অর্চি কি আমার কথা জিগ্যেস করে?’
‘না করে না। আমরা তাকে বুঝিয়েছি। কতজনেরই তো বাবা-মা থাকে না। অন্য লোকে দত্তক নেয়। তাদের কাছে মানুষ হয়। আমরা তো ওর নিজের দাদু-দিদা। তুই ওকে নিয়ে যাস না বৈশাখী। নিজের যে সর্বনাশ করেছিস, ওর করিস না।’
‘করব না মা।’
বৈশাখী মনকে শক্ত করে নিয়েছিলেন। চিন্ময়ও বুঝিয়েছিল।
‘ছেলেটাকে মানুষ হতে দাও বৈশাখী।’
বৈশাখী বলেছিলেন, ‘আমরা কি এইসব অপরাধের কাজ ছেড়ে দিতে পারি না?’
চিন্ময় বলেছিল, ‘পারব না কেন? পারি বই কী। এই কাজ ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষে করে থাকতে পারি। না খেয়ে মরতে পারি।’
‘যারা চুরি-চামারি করে না, তারা কি সবাই না খেয়ে মরে? আমরা না হয় কম খেয়ে থাকব।’
চিন্ময় বলল, ‘কোথায় থাকব? বস্তিতে?’
বৈশাখী বললেন, ‘দরকার হলে তাই থাকব।’
‘পারবে?’
বৈশাখী হেসে বলেছিলেন, ‘জেলে থাকতে পেরেছি, আর বস্তিতে থাকতে পারব না?’
চিন্ময় হেসে বলল, ‘তাতে গা থেকে জেলের গন্ধ যাবে?’
বৈশাখী বললেন, ‘না যাক। আমরা চেষ্টা করি।’
চিন্ময় মৃদু হাসল। বলল, ‘পুরোনো কথা ভুলে গেলে বৈশাখী? তখনও তো চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়েছিল কোনও?’ কথাটা ঠিক। কারখানার কাজ চলে যাওয়ার পর চিন্ময় নতুন করে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পাকাপাকি কাজ জোটেনি কোনও। ঠুকরে চলছিল। এখানে একমাস, সেখানে দশদিন। এইভাবে চলতে চলতে কাঞ্চন রক্ষিতের সঙ্গে যোগাযোগ। কাঞ্চন ছিল নামকরা চিটিংবাজ। অপরাধ জগতে তার নাম ছিল চিটকাঞ্চন। বাড়ি-জমি নিয়ে কারবার করত। একই সম্পত্তি তিন জায়গায় বেচত। জাল দলিল থেকে জাল রেজিস্ট্রেশন—সবের ব্যবস্থা ছিল। চিটকাঞ্চন একদিন চিন্ময়কে ডেকে পাঠাল।
‘আমার সঙ্গে কাজ করবে?’
চিন্ময় লোকটার নাম শুনেছিল। সাবধানে বলল, ‘কী কাজ?’
‘কী কাজ সে পরে বলব। আগে বলো করবে কিনা।’
চিন্ময় অবাক হয়ে বলল, ‘কী কাজ না জেনে হ্যাঁ-না বলব কী করে?’
চিটিকাঞ্চন বলল, ‘এই লাইনে এটাই নিয়ম। আগে হ্যাঁ-না, তারপর কাজের কথা।’
চিন্ময় চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনার কাজ মানে তো ঝামেলা।’
চিটিকাঞ্চন সহজভাবে বলল, ‘ঝামেলা তো বটেই। চিটিংয়ের কারবার করি, ঝামেলা থাকবে না? ঝামেলা বেশি বলে টাকাও বেশি। দোকানে ম্যানেজারি করে কত টাকা পাও? আমার কাছে তার তিনগুণ পাবে। রাজি কিনা বলো?’
চিন্ময় বলল, ‘হঠাৎ করে আমাকে ধরলেন কেন? আপনার কি মনে হয় আমি দু’নম্বরি কাজ ভালো পারব?’
চিটিংকাঞ্চন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মনে হচ্ছে। তোমার চেহারার মধ্যে একধরনের শিক্ষিত, সৎ-সৎ ভাব আছে। আমি এই ধরনের চেহারা খুঁজছিলাম। তুমি যে দোকানে কাজ করো, সেখানকার লোক আমাকে খবর দিয়েছে।’
চিন্ময় হেসে ফেলল। নিজের চেহারা নিয়ে এরকম কথা সে কখনও শোনেনি।
‘কী করতে হবে?’
চিটিংকাঞ্চন বলল, ‘তাহলে রাজি তো?’
‘পুলিশ ধরবে না তো?’
চিটিংকাঞ্চন সহজভাবে বলল, ‘ধরতে পারে। চান্স আছে। তবে ধরলেও বেশিদিন ভিতরে রাখতে পারবে না। আমাদের ব্যবস্থা আছে। কেস লাইট করে দেওয়া হয়।’
চিন্ময় এই অকপট ভঙ্গিতে মজা পেল। বলল, ‘কাজটা বলুন।’