দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ[১]

রমেন বললে, আমার এক কাকা ছিলেন, তাঁর দু-পাটি দাঁতই বাঁধানো। খুড়ো দামী টুথপেস্ট ঘষতেন, বিশ্বাস ছিল ওতে দাঁতের গোড়া শক্ত হয়। তোমার জলধিরও বুদ্ধি দেখি তেমনি। ও জানে পাহারা জিনিসটা দরকারী, অতএব তোমাকে ঘিরে কষে পাহারা লাগিয়েছে। শুনি ও-ই না কি তোমার আধা-মনিব। তাই মনিবানার দুরমুশ ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে নিতে চায় মণিমালার নৈতিকতার বনেদে কোথাও আলগা মাটি আছে কি না। ওকে খামকা বজবজের গল্প করতে গেলে কেন?

সত্যি কথা বলায় দোষটা হ’লো কি?

হায় রে কপাল! সত্যি বোঝার শক্তি থাকলে বজবজের ব্যাপার শুনে ও হাসতো, বেড়ালের মতো মুখ ফোলাতো না। ভাবি, তোমাকে ভালবাসতে গেছে ও কোন্‌ বুদ্ধিতে? ইডিয়ট!

মণি হেসে ফেললে। বললে, তোমার বুদ্ধিই বা এমন কি ধারালো! তোমার বিদ্যের বিস্তৃতি দেখে অবাক হই, শুনতে শুনতে হুঁশ থাকে না, গঙ্গার ঘাটে বারোটা বেজে যায়,—কিন্তু বুদ্ধির বেলায় সব পুরুষই সমান। তবু, জলধিবাবুর প্রশংসা করি, আমাকে সে আর যা-ই ভাবুক, অন্ততঃ রূপসী ভাবে না। কিন্তু তুমি আরও বেহায়া, আরও বড় ইডিয়ট।

ওগো আমি যে কালী-ভক্ত। বলিনে তুমি রূপসী, বলি তুমি ভীমা, ভয়ঙ্করী,—তোমার মুখের হাঁ কুমীরের মতো, গায়ের রং অমাবস্যা-রাত্রির চেয়ে গাঢ়তর, তুমি আশ্চর্য! দেবতারা বোঝেন না তা নয়, কিন্তু ভক্তের মুখে বাড়িয়ে শুনতে ভালবাসেন। যদি আমি বাঙ্গালী না হয়ে হিন্দুস্থানী হতাম, উপাস্য দেবতা হতেন হনুমানজী, তা হলে তাঁরও পোড়ামুখে তেল-সিঁদুরের ঘন প্রলেপ লাগিয়ে হাতজোড় করে বলতাম, হে জবাকুসুমসঙ্কাশ, তুমি তীক্ষ্ণদ্রংষ্ট্র, বজ্রনখ, তোমার গায়ের রোঁয়ার ইন্দ্রধনুর দ্যুতি, তোমার ল্যাজ গিয়ে ঠেকেছে আকাশে, তোমার মত বীর দ্বিতীয় নেই, তুমি প্রসন্ন হয়ে আমার প্রতি কৃপাদৃষ্টি কর। হনুমানজীর অজ্ঞাত থাকতো না ভক্ত খোশামোদ করচে, কিন্তু বর দিয়েও ফেলতেন। অভীষ্ট লাভ হ’তো।

মণি হেসে বললে, হনুমানজী তোমার গলায় ল্যাজ জড়িয়ে সাত সমুদ্দুর পারে রেখে আসতেন—যেখান থেকে এসেচ সেইখানে।

আহা, সে-ই কি কম লাভ মণি! ফিরে যাবার ভাড়া লাগতো না, এরোপ্লেনের চেয়েও শিগগির গিয়ে পৌঁছতাম। তাতে অন্ততঃ এই লাভ হ’তো, ওই বর্বরটাকে হিংসে করে বেড়ানোর দুর্গতি থেকে রক্ষে পেতাম।

সে দুর্গতি থেকে আমিই তোমাকে বাঁচাবো। এ বাসায় আর ঢুকতে দেবো না।

ঢুকতে দেবে না? কাকে? আমাকে, না তাকে?

তোমাকে। আমার রংটা কালো মানি, মুখের হাঁও একটু বড়, কিন্তু তাই বলে কুমীরের মতো?

না না, অত বড় নয়, একটু ছোট। কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেচ, অতিশয়োক্তি শুনতে যে তোমরা ভালবাস মণি। তাই ত বাড়িয়ে বলি।

আর কাউকে শোনাও গে, আমার দরকার নেই।

কে বললে নেই? সবচেয়ে দরকার তোমারই। যে মেয়ের দেহের রূপ আছে, বাপের টাকা আছে, তাকে বাইরে থেকে যাচাই করে নেবার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু সম্পদ যার অন্তরে লুকানো, তার আমার মতো একজন অকপট ভক্ত নইলে চলেই না। কিন্তু সে কি ওই জলধি? বুঝেছি, ওর তোমাকে ভাল লেগেচে। কেন জানো? ও ভেবেছে, ও যে তোমাকে পছন্দ করে সে ওর নিজেরই মহত্ত্ব। তোমার নিজের গুণে নয়, ওর স্বকীয় ঔদার্যে।

কিন্তু তুমি পছন্দ করেছ কার গুণে শুনি?

রমেন গম্ভীর হয়ে বললে, নেহাত মিথ্যে বলনি মণি। খুব সম্ভব তাই বটে। ওটা আমার নিজেরই বৃহত্ত্ব। নইলে তোমাকে হয়ত চিনতেই পারতাম না। কিংবা কি জানো মণি, নদীর স্রোতে যেখানটায় ঘূর্ণিপাকে ঘোরে, কুটোকাটা না বুঝেও সেই দিকে ছোটে। ঘুরে ঘুরে আবর্তে ডুব মারে, তার পরে কোথায় যায় কে জানে। ছিলাম ইউরোপে, ছেলেবেলায় সেইটুকু পরিচয়, কতকাল পরে কি ভেবে হঠাৎ চিঠি লিখে খোঁজ নিলে, মন অমনি চঞ্চল হয়ে উঠলো। চাকরি ছেড়ে দিলাম, যা কিছু সম্বল ছিল বিক্রি করে ভাড়া যোগাড় করে তোমার কাছে ছুটে এসে উপস্থিত হলাম। এর কি নিগূঢ় অর্থ নেই ভাবো? ঘূর্ণাবর্তের উপমাটা একটু চিন্তা করে দেখো। আর রূপের কথা যদি তোলো, একটু চেয়ে দেখলেই টের পাবে তুমি আমার পায়ের কড়ে আঙুলেও লাগো না। ইউরোপের গল্প নিজের মুখে আর করতে চাইনে, কিন্তু তোমাদের এই খাঁচা-বোঁচা বেঁটে দেশের কত রূপসী মেয়ের মাথা ঘুরে যায় এমন চেহারা কি আমার নয়? সত্যি বলো!

মণি হেসে ফেলে বললে, কি বিনয়! প্রভুপাদ গোস্বামীরাও পর্যন্ত হার মানে। আচ্ছা রমেন, তোমার প্রণয়-নিবেদনের ভাষাটা কি তুমি মুখস্থ করে রেখেছ? রোজই ঠিক একই রকম বলো কি করে? কোথাও একটা কমা সেমিকোলন পর্যন্ত বাদ পড়ে না, হুবহু একই কথা প্রত্যহ বলতে তোমার লজ্জা করে না?

নিশ্চয় করে।

তবে বল কেন?

বলবার হেতু আছে মণি। দেবতাদের প্রসন্ন করার দুটো ধারা আছে। এক স্তব, আর এক মন্ত্র। স্তব মনের আবেগে যথা-ইচ্ছা বানানো যায়, তার একদিনের বাক্য আর একদিনের সঙ্গে মেলার দরকার নেই। শুনে দেবতা খুশী হয়ে বর দিতেও পারেন, না-ও পারেন। তাঁর অনুগ্রহ, ভক্তের জোর নেই। কিন্তু মন্ত্র তা নয়, ইচ্ছামত বানানো যায় না, মুখস্থ করে আবৃত্তি করতে হয়। উচ্চারণ নির্ভুল হলে দেবতার না বলবার জো নেই, চুলের ঝুঁটি ধরে বর আদায় হয়। একেই বলে সিদ্ধমন্ত্র। সাহেবরা বলে ম্যাজিক। বুনোদের মধ্যে এই মন্ত্রে যারা সিদ্ধিলাভ করেচে, সমাজের ভিতর তাদের প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপের অবধি নেই—লোকে থরথর করে কাঁপে।

মণি বললে, বুনোদের মন্ত্র তুমিও জানো না, আমিও না। নিশ্চয় তার গভীর অর্থ আছে, কিন্তু তুমি যা আমার কাছে আবৃত্তি করো তার বারো আনার মানে হয় না।

রমেন বললে, শুনে আহ্লাদে তোমার পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করচে। আশা হচ্চে হাতড়ে হাতড়ে এতদিনে ঠিক জিনিসটিতে হাত লেগেছে। মণি, ও-বস্তু যত অর্থহীন হয় ততই হয় খাঁটি। একদম অবোধ্য হলে তার আর মার নেই—সেই হলো একেবারে সিদ্ধমন্ত্র। তখন দেবতার গলায় গামছা দিয়ে টেনে এনে অভীষ্ট আদায় করা যায়।

মণি গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেললে। বললে, বুনোদের অনেক দেবতা, তাদের মন্ত্রসিদ্ধ ওস্তাদদের ভাবনা নেই—যাকে হোক একটা ধরতে পারলেই হলো, কিন্তু তুমি কোন্‌ দেবতার ঝুঁটি ধরে বর আদায় করবে শুনি?

এখন শুনে কি হবে? শুধু এইটুকু জেনে রাখো, ঝুঁটি খুললে তার চুল পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, সেইটি বাগিয়ে যখন ধরবো, তখন দেবতা আপনিই টের পাবেন। কথাটি কবেন না, সুড়সুড় করে পিছনে পিছনে আসবেন। শুধু বাঙলা মুলুক নয়, হয়ত ইউরোপ পর্যন্ত।

তোমার ভারী আস্পর্ধা রমেন।

আস্পর্ধাই ত। নইলে সব ছেড়ে এত দূরে আসতাম কোন্‌ সাহসে?

তোমার ভুল। তুমি জানো দেশের কাজে আমি নিজেকে সঁপে দিয়েচি।

দিলেই বা গো। মন্ত্রের জোর যে তারও উপরে। দেশ-টেশ কোথায় ভেসে যায়।

মণি রাগ করে বললে, দেখো, মন্ত্র মন্ত্র করে চালাকি করো না। আমার কুমীরের মতো হাঁ, অমাবস্যার মতো রং—আমার আশা তুমি ছাড়ো। সত্যি ভালোবাসলে কেউ অমন বলে না। তা আবার প্রিয়ার মুখের উপর। তার চেয়ে বরঞ্চ তুমি যেখান থেকে এসেছ সেইখানেই ফিরে যাও।

ফেরবার জো নেই মণি, ভাড়ার টাকা পাবো কোথায়?

আমি যোগাড় করে দেবো।

তা হলে সে-ই ভালো। দু-জনের ভাড়া যোগাড় করো।

দু-জনের নয় একজনের। কিংবা আর একটা কাজ করো না রমেন? নানা দেশের নানা ইউনিভারসিটি থেকে পাস করার যে লম্বা ফর্দ তোমার নামের পিছনে আছে তাতে বিদেশ ফিরে যাবার দরকার কি? চেষ্টা করলে এখানেই যে একটা বড় চাকরি পাবে। অনেক সুন্দরী ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার আলাপ আছে, কেউ তাদের সম্বন্ধে এতটুকু কলঙ্কের আভাস পর্যন্ত দিতে পারে না, তারা এমনি মেয়ে। চিরদিন সাধ্বী পতিব্রতা হয়ে তোমার ঘর আলো করবে আমি লিখে দেবো। এমন কি, জামিন পর্যন্ত হবো। কথা দিচ্ছি তুমি সত্যিই সুখী হবে রমেন। শুধু একটি প্রার্থনা, যখন তখন এসে এক কথা নিয়ে আমাকে আর জ্বালাতন ক’রো না।—বলতে বলতে তার চোখ মুখের ভাব গম্ভীর হয়ে এলো, বললে, তা ছাড়া নিজেকেও ত চিনি। আমার মতো একটা দজ্জাল দুর্দান্ত কুশ্রী মেয়ে নিয়ে তোমার হবে কি? আমি কি কোন অংশেই তোমার যোগ্য?

রমেন উত্তর দিলে, কোনদিন কি বলেচি তুমি আমার যোগ্য? নিজেকে কি আমিই চিনিনে? তোমার ঐ ভাল-ভাল সতীলক্ষ্মী বান্ধবীদের যথাকালে যথাযোগ্য পাত্রে অর্পণ করো, আমি তিলার্ধ আপত্তি করবো না।

কিন্তু জাত-সাপুড়ের কল্যাণ-কামনায় যদি উপদেশ করো তাকে গোখরো-কেউটে ছেড়ে হেলে আর ঢোঁড়া সাপ নিয়ে খেলাতে, তবে বরঞ্চ পেশা ছেড়ে দেব, কিন্তু আত্মমর্যাদা নষ্ট করবো না। মরণ আছে জেনেও।

আমি বুঝি গোখরো কেউটে, আর তুমি জাত-সাপুড়ে?

আমি নয় ত কি ঐ জলধিটা? যে কেবল তোমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করছে আর নানা ছলে পাহারা দিয়ে ফিরচে—সে?

তাই সে ফিরুক, কিন্তু তুমি আর আমাকে জ্বালাতন করতে পাবে না তোমাকে বলে দিলাম।

ওগো মণি, কাঁদবে তুমি কাঁদবে। এখন মস্ত বাহাদুরি হচ্ছে, কিন্তু একদিন বুঝবে জ্বালাতন করবার যার কেউ নেই তার চেয়ে দুর্ভাগা মেয়েও আর জগতে নেই।

তোমার চিন্তা নেই রমেন, সম্প্রতি জলধিবাবু আছেন, তিনি একাই যথেষ্ট। যখন তিনিও থাকবেন না তখন তোমাকে চিঠি লিখে জানাবো।

তাই জানিয়ো। কিন্তু আমার যে বিশ্বাস হতে চায় না, তুমি সত্যই আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও।

এতক্ষণে তার পরিহাসের হালকা কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো দেখে মণির মুখের ’পরেও একটা ব্যথার ছায়া পড়লো। হয়ত ভাবলে কি জবাব দেবে, কিন্তু দেবার পূর্বেই নীচে সদর রাস্তায় একটা মোটর এসে দাঁড়ালো এবং পরক্ষণেই এককড়ির গলা শোনা গেল—মণি মণি, তুমি কোন্‌ ঘরটায় থাকো?

কে একজন বলে দিলে তেতলায় উঠে বাঁ-দিকের ফ্ল্যাটটা।

মণি ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে সাড়া দিলে—আসুন এককড়িদা, এই আমার ঘর।

মিনিট-খানেক পরে এককড়ি এসে ঢুকলো, যে চাকরটা চিনিয়ে দিতে তাঁর সঙ্গে এসেছিল, সে বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে রইলো।

এককড়ি আসন গ্রহণ করে চারিদিকটা একবার চেয়ে নিয়ে বললে, বাঃ—দিব্যি সাজানো-গোছানো ঘরটি ত!

মণি শুধু একটু হাসলে। কিন্তু পিছনের থেকে রমেন এ কথার জবাব দিয়ে বললে, তার কারণ আছে এককড়িদা। এ হলো লক্ষ্মীর বাসস্থল, গাছতলা হলেও এর পারিপাট্যটুকু আপনার চোখে পড়তই। আপনার বাড়ি কখনো দেখিনি, কিন্তু জোর করে বলতে পারি সে-ও এত সুন্দর নয়। আপনি ভাবচেন, না দেখেই লোকটা বলে কি করে? বলি এইজন্যে যে, জানি বৌ-ঠাকরুন স্বর্গীয় হয়েচেন, বেঁচে থাকলে এমন কথা মুখে আনতেও পারতাম না।

কথাগুলো এককড়ির ভালই লাগলো, তথাপি এই অপরিচিত যুবকের গায়েপড়া আলাপ ও আত্মীয় সম্বোধনে সে বিরক্ত-মুখে ফিরে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কে আপনি?

আমি রমেন, দাদা। মণির ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। কেবল বয়সে নয়, সকল দিকেই আপনার ঢের ছোট। আমাকে ‘তুমি’ বলতে হবে।

যাকে চিনিনে, কোনদিন আলাপ-পরিচয় নেই, তাকে কি হঠাৎ ‘তুমি’ বলা সাজে?

সাজে দাদা, সাজে। কিন্তু হঠাৎ ত নয়। আপনি চেনেন না বটে, কিন্তু মণির মুখ থেকে আপনাকে যে আমি খুব চিনি। সন্দেহ হচ্ছে, জলধিবাবু আমার প্রতি মন আপনার বিষিয়ে না দিলে ‘তুমি’ বলতে আপনি একটুও দ্বিধা করতেন না। তিনি ঠিক কি কি বলেছেন জানিনে, কিন্তু মণিকে আড়ালে জিজ্ঞাসা করলে টের পাবেন, আমি দুর্জন দুর্বৃত্ত মোটেই নয়। নিরীহ মানুষ, বিদেশে ছেলে পড়িয়ে খেতাম, বহুদিন পরে অকস্মাৎ মণির একটা পত্র পেয়ে মন কেমন করে উঠলো, কোনমতে ভাড়াটা যোগাড় করে চলে এলাম। মোটামুটি এই আমার পরিচয়, এর মধ্যে মিথ্যে একটুও নেই।

কথাগুলি বলার এমন একটি সরল আবেদন যে, যে ক্রোধ মনের মধ্যে নিয়ে এককড়ি এখানে এসেছিল তার অনেকখানিই শান্ত হয়ে গেল। ইচ্ছে হলো এই প্রসঙ্গে সদয়-কণ্ঠে একটু আলাপ করে, কিন্তু তাও পারলে না, জলধির অভিযোগ বাধা দিলে। তাই বলি-বলি করেও শেষে চুপ করেই বসে রইলো।

মণি প্রশ্ন করলে, আজকের অধিবেশনের কি হলো এককড়িদা?

অধিবেশন হয়নি। স্থগিত রইলো।

কেন? আমি না যাবার জন্যে নয় ত?

কতকটা তাই বটে। আজ কি তুমি খুব অসুস্থ?

না, ঠাণ্ডা লেগে সামান্য একটু জ্বরের মতো হয়েচে, অনায়াসে যেতে পারতাম জলধিবাবু বারণ না করলে। বললেন, আটকাবে না, আজকের দিনটা তিনি বেশ চালিয়ে নিতে পারবেন। তাই যাইনি এককড়িদা।

শুনে এককড়ি ভারী বিস্মিত হলো : জিজ্ঞাসা করলে, জলধি কি তোমাকে যেতে বারণ করেছিলো?

হাঁ, বারণই ত করলেন। একটু থেমে মণি বললে, অথচ এমন দিন গেছে যখন সত্যিই বড় অসুস্থ হয়ে ছুটি চেয়েও পাইনি।

আমাকে জানাও নি কেন?

মণি চুপ করে রইলো, কিন্তু তার হয়ে জবাব দিলে রমেন। বললে, একটা কারণ বোধ করি এই যে, উপরিওয়ালার বিরুদ্ধে নালিশ করা ওঁর স্বভাব নয়।

ওঁর স্বভাবের খবর আপনি জানলেন কি করে?

আবার ‘আপনি’ দাদা? বরঞ্চ আর কোথাও উঠে যাবো, তবু বসে বসে আপনার মুখ থেকে ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ শুনতে পারবো না।

এককড়ি হেসে বললে, বেশ ‘তুমি’ই সই। বল তো রমেন, ওর স্বভাবের পরিচয় তুমি পেলে কি করে? শুনছি থাকতে ইউরোপে, বহুদিন কেউ কারও খবর রাখোনি—এই ত সেদিন মাত্র দেশে ফিরেছ।

সবই সত্যি দাদা। তবু আশ্চর্য হয়ে ভাবি, সহসা কেন যে মণি আমার সংবাদ নিতে গেল, আর আমিই বা কেন তেমনি হঠাৎ সব-কিছু পিছনে ফেলে চলে এলাম। কিন্তু সে কথা থাক, আপনার প্রশ্নের জবাব দিই। ছেলেবেলায় ওর আমি মাস্টার ছিলাম। ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ি, মণি পড়ে আমার দু-ক্লাস নীচে। যে ভদ্রলোকটি আমার ইস্কুলের মাইনে, বইয়ের দাম যোগাতেন, হঠাৎ একদিন তিনি মারা গেলেন। মণির বাপ আমাকে ডেকে বললেন, সেজন্য ভাবনা নেই রমেন, তুমি আমার মেয়েটিকে ঘণ্টা-খানেক করে পড়িয়ে যেয়ো।

দুশ্চিন্তা ঘুচলো, কিন্তু দিন দুই-তিন পড়ানোর পরেই বুঝলাম ওকে আমি পড়াবো বটে, কিন্তু আমাকেও ও পড়াতে পারে। কামাই করতে শুরু করলাম, যদি বা যাই গল্প করে কাটাই, তবু দেখা গেল পরীক্ষায় মণি প্রথম হয়েছে। মণির বাপের ছিল দেশোদ্ধারের ব্যাধি, বাড়ির কোন খবরই রাখতেন না, অত্যন্ত খুশী হয়ে আমাকে ডেকে পিঠ ঠুকে দিলেন, বললেন, আমার মতো কর্তব্যপরায়ণ লোক আর নেই এবং আমার কলেজের অর্ধেক খরচ তিনিই দেবেন। আমার কর্তব্যপরায়ণতার বিবরণ বাপের কাছে মণি কোনদিন বলেনি। এমন কি, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও যখন জলপানি পেলে, তারও অর্ধেক কৃতিত্ব আমার ভাগ্যেই জুটলো। জানিনে, কি কারণে বাপের বিশ্বাস ছিল মেয়ের লেখাপড়ার বনেদ আমিই পাকা করে দিয়ে গেছি।

তার পরে?

কার পরে দাদা?

ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পাবার পরে মণি কি করলে?

মণি একটা আঙুল তুলে নিঃশব্দে তর্জন করে শেষে মাথা নেড়ে বললে, ও হবে না রমেন। নিজের সম্বন্ধে বলতে চাও বলো, কিন্তু আমার সম্বন্ধে না।

কিন্তু উনি যে মনিব। জানতে চাইলে কি না বলা সাজে?

মনিব আমার, তোমার নয়। আমার কাছে যখন জানতে চাইবেন আমি তার উত্তর দেবো।

এককড়ি প্রশ্ন করলে, বেশ তুমিই বলো। তোমার কাছেই জানতে চাইচি কি করলে তার পরে? কলেজে গিয়ে ভর্তি হলে?

এ কৌতূহলে লাভ কি এককড়িদা? আপনার কাজ ত চালিয়ে দিচ্ছি।

সে অস্বীকার করিনে মণি, বরঞ্চ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, আমাদের সঙ্ঘের কাজ অনেক বড় করেই এতদিন চালিয়ে এসেচ। কিন্তু আমাদের সেই সঙ্ঘের প্রয়োজন যদি তোমাতে শেষ হয়ে থাকে আর কোন একটা উপায় করে ত দিতে পারি। কিছু একটা তোমার ত করা চাই।

জীবিকার জন্য বলছেন?

ধরো তাই।

কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলো। শেষে মণি জিজ্ঞাসা করলে, আমাকে কি আপনি আর চান না?

জলধি চায় না। সে বলে তুমি থাকলে কল্যাণ-সঙ্ঘের নাম পালটে দিতে হবে।

বুঝেচি। কিন্তু আপনি নিজে কি বলেন?
এখনও বলিনি কিছুই। জানি, জলধির অনেক দোষ, তবুও জানি স্বদেশসেবার জমা-খরচের খাতায় তার খরচ বাদেও বাকী যেটা আছে সেও অনেক। তার মতো স্বার্থত্যাগ করেছে ক’জন? কত লোকে তার মতো দুঃখ ভোগ করেছে? তাকে বাদ দিলে সঙ্ঘ আমার টিকবে না।

তাঁকে বাদ না দিয়েও সঙ্ঘ আপনার টিকবে না এককড়িদা।

এককড়ি মুখ ফিরিয়ে রমেনের প্রতি খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললে, তুমি কি করে জানলে রমেন?

জানিনে, শুধু আমার অনুমান। জলধিবাবু যাই হোন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্তা আপনি। কিন্তু, একটা কথা বলি এককড়িদা, পারা-আঁচড়ানো আরশিতে মুখ দেখে যে মুখের বিচার করে, সে সুবিচার করে না। ভাবে, মুখের ঐ ক্ষতচিহ্নগুলোই সত্যি। আপনারও হয়েচে সেই দশা। সঙ্ঘের অশুভ কামনা করিনে, কিন্তু উদ্দেশ্য যত মহৎ হোক, মনে হচ্ছে এ টিকবে না। কিন্তু মণি, তুমি বিষণ্ণ হয়ে উঠলে কেন, এ ত তোমাকে মানাচ্চে না!

মণি একটুখানি ম্লান হেসে বললে, আমার প্ল্যানটা যে ফেঁসে গেল।

এককড়ি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কিসের প্ল্যান মণি?

মণি একবার দ্বিধা করলে, হয়ত ভাবলে বলা উচিত কি না, কিন্তু এককড়ি তেমনি আগ্রহে চেয়ে আছে দেখে আস্তে আস্তে বললে, একটু পূর্বেই ভাবছিলাম আপনার কাছে হাজার-খানেক টাকা ধার চেয়ে নেবো।

এককড়ি ক্ষণমাত্রও দ্বিধা না করে বললে, বেশ ত, তাই নিয়ো।

রমেন জিজ্ঞাসা করলে, চাকরি ত গেল, শোধ দেবে কি করে?

এককড়ি বললে, সে ও-ই জানে। আমি জানি ও যেখানেই থাক, বেঁচে থাকলে শোধ দেবেই। আর মরে যদি যায় সে এতবড় ক্ষতি যে, হাজার টাকার শোক আমার মনেও পড়বে না। টাকাটা তোমাকে আমি কালই পাঠিয়ে দেবো।

রমেন বললে, কিসের প্রয়োজন তা-ও জিজ্ঞাসা করবেন না?

না। আমি জানি ও অপব্যয় করে না। কিন্তু এখন উঠি। সঙ্ঘের তরফ থেকে তোমাকে সাধুবাদ দেওয়া চলে না, কিন্তু আমার পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ রইলো। যদি কখনও তোমার উপকারে আসতে পারি আন্তরিক খুশী হবো—এই বলে এককড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললে, রমেন, তোমার সঙ্গে পরিচয় শুধু ঘণ্টা-খানেকের, আর কখনও আলাপ করবার সুযোগ হবে কি না জানিনে, কিন্তু এটুকু জেনে গেলাম যে, আমার সম্বন্ধে ধারণা তোমার খুব খারাপ হয়েই রইলো।

রমেন হেসে বললে, তাতে আপনার ক্ষতি হবে না দাদা। কিন্তু এ কথাটা বলাই ভাল যে, রুগী যখন মরে তখন আড়ালে ডাক্তারের বাপান্ত করা ছাড়া গৃহস্থের আর কোন সান্ত্বনাই থাকে না।

এককড়িও হাসলে এবং উভয়কেই নমস্কার করে বেরিয়ে গেল। মণিমালাকে আজ সে প্রথম নমস্কার করলে। আর কোনদিন করেনি।

মিনিট পাঁচ-ছয় ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে রইলো।

মণি বললে, কি রমেন, এবার বাপান্ত শুরু করবে নাকি?

রমেন বললেন, সে নেপথ্যে। তবে প্রত্যক্ষে বলার আজ এইটে পেলাম যে, এতকাল রমেন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল তাঁর চেয়ে মহাশয় ব্যক্তি ভূ-ভারতে নেই। এতদিনে সেই অহঙ্কারটা চূর্ণ হ’লো।

হ’লো ত?

হ্যাঁ। আর একটা কথা বলবো। ভয়ে, না নির্ভয়ে?

নির্ভয়ে বলো।

দাদার একটু বয়স হয়েছে, বেশ মানাবে, না—কিন্তু সংসারে মণিমালার বর যদি কেউ থাকে ত এই ব্যক্তি।

মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো, আহা রমেন, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক।

পড়তেও পারে গো বন্ধু, পড়তেও পারে। কিন্তু আর না, উঠি। রাস্তায় একলা ঘুরে ফিরে মাথাটা ঠাণ্ডা করে নিই গে। নইলে সারারাত ঘুম হবে না। এই বলে সে ধীরে ধীরে উঠে পড়লো। দোর পর্যন্ত এগিয়ে ফিরে চেয়ে বললে, তোমার সতীলক্ষ্মী বিদুষী বান্ধবীদের একবার দেখাতে পারো না মণি?

পারি, কিন্তু কি হবে?

একটু বাজিয়ে দেখবো।

সর্বনাশ! তুমি কি তাদের বিদ্যের পরীক্ষা নেবে নাকি?

ওগো না না। তোমাদের ও-দিকটা আমার জানা আছে, তুমি নিঃশঙ্ক হও। দীর্ঘদিন দেশছাড়া, ইতিমধ্যে দেশের মেয়েদের বহু পরিবর্তন, অর্থাৎ বহু উন্নতি ঘটেছে, এমনি একটি জনশ্রুতি বিদেশ থেকেই কানে পৌঁছেছে। শানে আছড়ালে তাঁরা কিরকম আওয়াজ দেন, অর্থাৎ খাদটা কি পরিমাণে মিশেছে দেখতে একটু সাধ হয় মণি।

তাঁরা তোমাকেও ত আছড়াতে পারেন?

তা-ও পারেন, বিচিত্র নয়।—এই বলে রমেন হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘বিচিত্রা,’ চৈত্র, ১৩৪২।