চতুর্থ পরিচ্ছেদ[১]

ওদিকে মণিমালার ঘর থেকে এইমাত্র গুটি-চারেক মেয়ে নেবে গেল। তারা মণির বন্ধু। এসেছিল নারী-সমিতির পক্ষ থেকে। আগামী সপ্তাহে বসবে অধিবেশন, ডেলিগেট আসচেন নানা জেলা থেকে প্রায় শতাধিক, প্রস্তাব এই যে, উক্ত সভায় মণিমালাকে মুভ করতে হবে একটা omnibus resolution—তাতে বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে চাকরিতে নর-নারীর সমান মাইনে পর্যন্ত নানা দাবীই বেশ কড়া করে থাকবে। মণি কিন্তু রাজী হলো না, হেসে বললে, যে চেহারা ভাই আমার—কেউ বিয়ে করলেই বেঁচে যাই, তা আবার বিবাহ-বিচ্ছেদ। এনা হেনা দুই বোন, তাদের ঝাঁজই সবচেয়ে প্রখর, রেগে বললে, বিয়ে কি আমাদেরই হয়েছে নাকি? আমরা নিজেদের কথা ত ভাবছি না, ভাবছি সমস্ত নারীজাতির হয়ে। তুমি বলতে পারো চমৎকার, ডিবেট করতে তোমার জোড়া নেই, তাই সুকল্যাণী মিটারের ইচ্ছে এ resolution তোমাকে দিয়েই প্রস্তাবিত করা। আমরা ফিরে আসছি তাঁর চিঠি নিয়ে, দেখি কি করে তখন অস্বীকার করো।

মণি বললে, আমাকে মাপ করো ভাই।

এনা বললে, জানো এতে তাঁকে অপমান করা হবে।

অপমান ত করচি নে ভাই, আমি হাতজোড় করছি।

আচ্ছা সে দেখা যাবে। আসছি চিঠি নিয়ে। হয়ত বা তিনি নিজেই এসে হাজির হবেন। এই বলে মেয়েরা চলে গেল। তাদের কাপড়ের এসেন্সের গন্ধে তখনও ঘরের বাতাস ভারী, উত্তেজিত কণ্ঠের ঝাঁজালো তর্ক তখনও চারটে দেওয়ালের গায়ে মাথা ঠুকে বেড়াচ্ছে। মণি ডাকলে, রমেন কি ঘুমুচ্ছো?

ঘরের অপর প্রান্তে একটি কেম্বিসের ইজিচেয়ারে রমেন চোখ বুজে শুয়েছিল, সাড়া দিয়ে বললে, না, আমার ট্রেনের-শব্দেই ঘুম হয় না, এ ত চার-চারটে এরোপ্লেনের সার্কাস চলছিল।

তুমি ভারী অসভ্য, রমেন। মেয়েদের সম্বন্ধে কখনও কি শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা কইতে পারো না?

রমেন চুপ করে রইলো। মণি বলতে লাগলো, আমি আশা করেছিলাম আমাদের আলোচনায় তুমি যোগ দেবে, কিন্তু একটি কথা কইলে না, ওধারে গিয়ে শুয়ে রইলে। তোমার সম্বন্ধে ওঁরা কি ভেবে গেলেন কল্পনা করতে পারো?

না।

ভেবে গেলেন একটি আস্ত জানোয়ার। ভেবে গেলেন এ পশুটাকে মণি যখন-তখন তার ঘরের মধ্যে সহ্য করে কি করে!

উঃ—

কিসের উঃ—?

ধরো, এই মেয়ে চারটির যদি কোনদিন বিয়ে হয়! উঃ—

মণি রেগে বললে, বিয়ে ত হবেই একদিন। ওঁরা কি চিরকাল আইবুড়ো থাকবেন নাকি?

রমেন গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলে, সে মতলব এঁদের নেই তা হলে? ঠিক জানো?

মণি হেসে বললে, না নেই। ঠিক জানি।

উঃ—

তোমার বুকে কি শেল বিঁধছে নাকি?

হাঁ বিঁধছে। মানস-চক্ষে আমি সেই দুর্ভাগাগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসলো। বললে, জানো মণিমালা, পরম জ্ঞানী Aristotle সম্বন্ধে একটা প্রবাদ আছে। কোথায় যেতে পথের ধারে একটা গাছের ডালে দেখতে পান, একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলচে। মুগ্ধ-চোখে চেয়ে থেকে বলেছিলেন, আহা, এমনি ফল যদি পৃথিবীর সমস্ত গাছের ডালে ফলতো, জগৎ স্বর্গ হয়ে যেত। ত্রিবিধ দুঃখ-নাশের মীমাংসা বুদ্ধদেব দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু দুনিয়াকে স্বর্গ করবার থিওরি একমাত্র তিনিই আবিষ্কার করে গেছেন। হাঁ, জ্ঞানী বটে!

রমেন ভেবেছিল, মণি খুব একচোট হাসবে, কিন্তু হল উলটো। দেখতে দেখতে তার মুখের চেহারা কঠোর হয়ে এলো, শান্ত গম্ভীর-স্বরে বললে, রমেন, তোমার এই কথাটা আমি চিরদিন মনে রাখবো।

রমেন অপ্রতিভ হয়ে বললে, কথা ত আমার নয় মণি, এরিস্টটলের। তা-ও সত্যি কি বানানো তা-ই বা কে জানে।

না, সত্যি। তাও শুধু তাঁরই নয়, সমস্ত পুরুষের মুখেরই এই এক কথা। সেই বুড়ো Aristotle আজও আড়াই হাজার বছর পরে তোমার মধ্যে বেঁচে আছে। সে আছে জলধির মধ্যে, সে আছে এককড়িদা’র ভিতরে। তাই ত গেল আমার চাকরি। তিন বছরের রাত্রিদিনের সেবা একমুহূর্তের ভর সইলো না। তুমি নিজে মনিব হলেও আমার চাকরি ঠিক এমনি করেই যেতো, রমেন।

রমেন ক্ষুব্ধ হয়ে বললে, আমি মনিব যখন নয়, তখন সে প্রমাণ দিতে পারলাম না। কিন্তু তুমি মিথ্যে তিলকে তাল করছো, মণি। বুড়োর তামাশাটা সত্যি হলে কি মানুষ আজও বেঁচে থাকতো! কোন কালে নিঃশেষ হয়ে যেতো।

নিঃশেষ না হবার অন্য হেতু আছে, রমেন। কারণ, মানুষকে রাখার ভার পুরুষের ’পরে নেই, সে আছে আর একজনের ’পরে। তাই ত দেখি নরনারী এতকাল একসঙ্গে থেকেও আজও সন্ধির একটা ফরমূলা খুঁজে পেল না, কোন্‌ পথে দুঃখের নিরসন, সে দিকটাই তাদের চোখে পড়লো না, চিরদিন কানা হয়ে রইলো।

রমেন আস্তে আস্তে বললে, মণি, কেন জানিনে, কিন্তু মনে হচ্ছে আজ তোমার মনটা অত্যন্ত উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে আছে।

উদ্‌ভ্রান্ত? হতে পারে। কিন্তু একটা প্রশ্নের হঠাৎ জবাব পেয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম ওদের অনুরোধ শুনবো না, বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রস্তাব আমার মুখ দিয়ে বার হবে না, কিন্তু এখন স্থির করলাম, এ প্রস্তাব আমি নিজেই আনবো।

রমেন একটু হেসে বললে, সে না হয় করলে, কিন্তু জিনিসটা ভাল কি মন্দ, মানুষের অভিজ্ঞতায় এর দাম কি নির্দিষ্ট হয়েছে, তার কি জ্ঞান তোমার আছে মণি?

মণি বললে, কোন জ্ঞানই নেই,—ইতিহাস ত জানিনে,—আর যেটুকু আছে সে-ও তুমি ইচ্ছে করলে খণ্ড খণ্ড করে দিতে পারো, কিন্তু তোমার কথা আমি শুনবো না। বরঞ্চ এই কথাই জোর করে বলবো, আমার অন্তরের সত্য অনুভূতি আমাকে সত্য পথ দেখিয়ে দেবে। দেবেই দেবে।

সত্য অনুভূতি পেলে কখন?

এইমাত্র। তুমি পরিহাসের ছলে যা বললে তার মধ্যে।

সে কি কখনো হয়?

হয় রমেন, হয়। গল্প শোনোনি, আমাদের লালাবাবু মেছুনির মুখের একটা উড়ো কথা শুনে সংসারত্যাগ করে গিয়েছিলেন। অথচ কত লোক ত দিন-রাত শোনে, তারা কি ঘরদোর ফেলে সন্ন্যাসী হয়ে যায়? কিন্তু যে শুনতে পায় সে-ই শুনতে পায়।

মণি, তুমি যে এতবড় পাগল আমার ধারণা ছিল না।

মণি হেসে বললে, পাগলই ত। নইলে কি দেশের জন্যে জেল খাটতে যেতে পারতাম ? প্রাণ দিতেও রাজী ছিলাম। তুমি পারো?

সে পরীক্ষা ত আমাকে দিতে হয়নি, মণি!

পরীক্ষা দেবার দিন যদি আসে পারবে দিতে?

রমেন হঠাৎ এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলে না। এমনি সময়ে দোরের বাইরে থেকে ডাক এল, মণি, আসতে পারি কি?

মণি খুশী হয়ে সাড়া দিলে, আসুন আসুন, জলধিবাবু!

অসম্পূর্ণ

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বিচিত্রা, বৈশাখ ১৩৪৩