তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বুকের নীচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে এককড়ি একমনে লিখে যাচ্ছে। এক পাশে গুড়গুড়ির কলকেটা বৃথা পুড়ছে, হাতের কাছে নলটা অনাদরে পড়ে, টেনে নেবার সময় হয়নি, চায়ের বাটিটা ঠাণ্ডা জল হয়ে গেলো, মুখে তোলবার ফুরসত পায়নি, এমনি সময়ে জলধি এসে উপস্থিত। মিনিট পাঁচ-ছয় চুপচাপ বসে থেকে বললে, এককড়িদা, আপনার অভিনিবেশটা একটু বিচলিত করতে চাই। বড় দরকার।

এককড়ি মুখ না তুলেই বললে, বলো।

কি এত লিখছেন?

আমাদের কল্যাণ-সঙ্ঘের আইন-কানুনগুলোর কিছু কিছু পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তারই একটা খসড়া করচি।

করুন। পরিবর্তন আবশ্যক হয়েছে নিশ্চিত। Rather overdue.

হুঁ, বলে এককড়ি লেখায় মন দিলে।

আবার মিনিট পাঁচ-ছয় নীরবে কাটলো। জলধি বললে, অন্য সব-কিছু তাচ্ছিল্য করা যেতেও পারে, কিন্তু মানুষের নৈতিক চরিত্রটা নয়। কারণ, সুনাম যদি ঘোচে, হাজার চেষ্টাতেও সঙ্ঘকে আমরা খাড়া রাখতে পারবো না, কাত হয়ে পড়বেই। এখানে আমাদের শক্ত হতে হবে।

নিশ্চয়।

এই দুটো দিন আমি অনেক ভেবেচি এককড়িদা। কষ্ট খুবই হয়, কারণ এই ওর জীবিকা। শুনেচি কে একজন অন্ধ আত্মীয়কেও মণি প্রতিপালন করে। তবু মণিকে রাখা চলবে না, বিদায় দিতেই হবে। জানি আপনার মন ভারী নরম, কিন্তু এ এতবড় serious matter যে, আপনাকে দুর্বল হতে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না।

এককড়ি কলম রেখে উঠে বসলো। চামড়ার কালো পোর্টফোলিওটা কোলে তুলে নিয়ে খুঁজে খুঁজে একখানা কাগজ বার করে জলধির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, গুড়গুড়ির নলটা মুখে নিয়ে নিঃশব্দে তামাক টানতে লাগলো।

কাগজখানা পড়তে পড়তে জলধির মুখ পাংশু হয়ে গেল। শেষ করে বললে, মণিকে জবাব দেবার পূর্বে একবার আমাকে জানালেন না কেন?

এককড়ি মুখের নলটা সরিয়ে রেখে বললে, এইমাত্র ত তুমি নিজেই বলছ আমাদের শক্ত হতে হবে, মণিকে রাখা চলবে না। তা ছাড়া কোথায় তুমি ছিলে হে? তিনদিন এলে না, এলে কথাটা নিশ্চয়ই শুনতে পেতে। আর যাকে সরাতেই হবে তাকে শীঘ্র সরানোই ভাল। অবিচার করিনি, তিন মাসের মাইনে বেশী দিয়ে দিয়েচি। এই দেখ রসিদ।—এই বলে একটুকরো টিকিট-মারা কাগজ জলধির সামনে এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো, শুনলাম সেও বাড়িআলাকে নোটিশ দিয়েচে। লোকটা ভাল, পনরো দিনের কড়ারেই রাজী হয়েচে, একমাসের নোটিশ দাবী করেনি।

জলধি তিক্তকণ্ঠে বললে, হাঁ, মহাশয় ব্যক্তি। মণি কোথায় যাবে কিছু জানিয়েছে?

না, বলেছে চিঠি লিখে পরে জানাবে।

তাকে জবাব দিলেন আপনি, কিন্তু আমার নাম করতে গেলেন কেন?

বেশ কথা! তুমি সেক্রেটারী, তোমার ঘোরতর আপত্তি তাকে না জানিয়ে চলে?

শুধু আমার আপত্তি, আপনার নয়?

নিশ্চয়!

জানিয়েছেন তাকে?

নিশ্চয় জানিয়েছি।

জলধির মুখে আর কথা যোগালো না, শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।

এককড়ি খসড়ার কাগজগুলো একে একে গুছিয়ে নিয়ে জলধির পানে এগিয়ে দিলে, বললে, পড়ে দেখ।

লেখা শেষ হোক না দাদা, ঢের সময় আছে।

তার ঔদাসীন্যে এককড়ি বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললে, কোথায় ঢের সময়! ছাপতে হবে, যেখানে যত মেম্বার আছে সার্‌কুলেট করতে হবে,—গড়িমসির ত কাজ নয়। এই দিকটায় আমার চোখ খুলে দিয়ে তুমি মস্ত কাজ করেছ, জলধি। সত্যই ত। চরিত্রই যদি না রইলো ত রইলো কি? সঙ্ঘ দাঁড়াবে কিসের ’পরে? এখন থেকে এই সুনামই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় asset—সত্যিকার মূলধন। সঙ্ঘ-সংক্রান্ত যে যেখানে আছে—পেড্‌ বা আনপেড্‌—সকলেই বুঝবে এদিকে সেক্রেটারীর লেশমাত্র গাফিলতি নেই। সে মণির মতো কাজের লোককেও বিদায় দিতে একমুহূর্ত বিলম্ব করেনি। আমি তোমাকে congratulate করি জলধি।

জলধি অন্তরে জ্বলে গিয়ে বললে, আপনার ইচ্ছেটা কি মণির ব্যাপার আমরা ঢাক পিটে সর্বত্র প্রচার করি?

তা না হোক, কিন্তু দলের লোকে ত জানবেই, চাপা দেবে কি করে, আর দিয়েই বা লাভ হবে কি?

অর্থাৎ, কল্যাণ-সঙ্ঘের পক্ষ থেকে মণিমালার এই হবে বিদায় অভিনন্দন! না দাদা, মাপ করুন, রাজী হতে পারলাম না। আর কিছু না মনে করি, সঙ্ঘের কল্যাণে এই তিনটে বছর তার অবিশ্রান্ত খাটুনি ভুলতে পারবো না।

ভোলার কথা নয় হে জলধি, কিন্তু উপায় কি? আমাদের কাগজপত্রে মণির বদলে অজয়ের দস্তখত দেখলে দলের লোকে কারণটা জানতে চাইবেই, তখন ঢাকবে কি করে?

জলধি কথাটা ভাল বুঝতে পারলে না,—অজয় আবার কে এলো দাদা?

এককড়ি বললে, সেই ত মণির জায়গায় কাজ করবে। Economics-এ এম. এ., একটুর জন্যে first class-টা গেছে, নইলে যে-কোন কলেজে দেড়-শ’ টাকা তার ঘোচায় কে? মাইনে বাড়াতে হয়নি,—পঞ্চাশ টাকাতেই রাজী হলো। কুড়িয়ে পাওয়া বললেই হয়।

জলধির রাগের সীমা রইলো না, কিন্তু যথাসাধ্য চেপে রেখে প্রশ্ন করলে—রত্নটি কুড়িয়ে পেলেন কখন?

আজ সকালেই। অজয়ের বাপের সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল, বছর-খানেক ধরে সে ছেলের জন্যে একটা সুপারিশ-চিঠি চাইছিল মামার ওপরে। নানা কারণে দিতে পারিনি, তাই—

তাই মামার দায় আমার কাঁধে চাপালেন?

না হে না। সে কাল থেকে যখন অফিসের ভার নেবে, তার কাজ দেখে তুমি খুশী হবে। মণির চেয়ে অযোগ্য হবে না বলে দিলাম।

জলধি আর তর্ক করলে না। ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললে, আসলে আপনার প্রকৃতিটা বড় নির্মম, এককড়িদা। আমি নিজে যদি কখনো বিদায় নিই, কেবল এই জন্যেই নেবো। ইতিমধ্যে আপনার গণেশের কলম চলতে থাক্‌, আমি উঠলাম। এই বলে সে ক্ষুদ্র একটা নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এককড়ি ডেকে বললে, কোথায় যাচ্ছ জলধি?

যাবার মুখ নেই, তবু যেতে হবে। পুরুষত্ব বলুন, মনুষ্যত্ব বলুন, দেশের পায়ে আজো একেবারে জলাঞ্জলি দিতে পারিনি। মায়া-মমতা আজও যেন বুকের মধ্যে কোথায় বেঁধে, এককড়িদা।

অর্থাৎ মণির বাসায় গিয়ে তাকে একটু সান্ত্বনা দিতে চাও?

সান্ত্বনা দেবার দরকার হবে না, এটুকু অন্ততঃ তারে জানি। সে যাই হোক, আমি হলে কিন্তু এমন সরাসরি জবাব দিতাম না,—এবারের মত শুধু একটা warning দিয়েই পালা শেষ করতাম।

শুনে এককড়ি প্রথমটা গম্ভীর হলো, তার পরে হঠাৎ হেসে ফেলে বললে, দূর গাধা! তোর পালা আরম্ভ করার বুদ্ধিটাও যেমন অসাধারণ, পালা শেষ করার ফন্দিটাও তেমনি চমৎকার। এই warning দেবার মতলব কে যোগালেন? এই বুঝি তারে চিনেচিস্‌ এতদিনে একসঙ্গে কাজ করে?

জলধি এ তিরস্কারের উত্তর খুঁজে না পেয়ে হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইলো।

এককড়ি বলতে লাগলো, তার আচরণ আমরা অনুমোদন করিনে, এই ধরনের স্বেচ্ছাচার আমাদের ভাল লাগে না। অতএব বিদায় দেওয়া হলো এ কথাটা মণি অনায়াসে বুঝবে, কিন্তু তোর চোখ রাঙিয়ে ধমক দেওয়া বুঝবে না। বরঞ্চ, এইজন্যে সে কৃতজ্ঞ থাকবে যে, আমরা তার সংস্রব ত্যাগ করেচি, কিন্তু অসম্মান করিনি। বলিনি, প্রভুর রুচির সঙ্গে ভৃত্যের রুচি মেলেনি বলে এবার শুধু তার কান মলে দেওয়া হলো, ভবিষ্যতে নাক কেটে দেওয়া হবে।

জলধি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলে, তা হলে জবাবটা একেবারে settled? এর নড়চড় হতে পারবে না?

না। কল্যাণ-সঙ্ঘের নামটা তার জন্যে পালটাতে পারবো না।

জবাব শুনে জলধি বহুক্ষণ পর্যন্ত নীরবে নতমুখে বসে রইলে; তার পরে মুখ তুলে অনুতপ্ত স্বরে ধীরে ধীরে বললে—এবারের মতো আমার অভিযোগটা আমি প্রত্যাহার করচি এককড়িদা। এবার তাকে আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত।

এককড়ি ঘাড় নেড়ে বললে, আমি প্রস্তুত নয় জলধি।

কিন্তু সত্যই সে কোন অপরাধ করেছে কি না তাও বিচার করবেন না?

সত্যিকার অপরাধ তুই কারে বলিস জলধি? যা ইঙ্গিত করেছিস তা-ই?—না সে দোষ সে কখনো করেনি, কখনো করবে না।

তবু বিদায় করে দেবেন?

হাঁ তবুও। আমাদের মধ্যে ওকে রাখতে পারবো না।

কতখানি বিপদের মধ্যে তাকে ঠেলে দিচ্ছেন একবার তাও চিন্তা করবেন না?

সে চিন্তায় লাভ? বিপদকে সে ভয় করে নাকি? তোর হলে চিন্তা করতাম। এই বলে এককড়ি একটু হেসে গুড়গুড়ির নলটা তুলে নিয়ে মুখে দিলে।

জলধি গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চললাম।

এককড়ি তামাকের ধুঁয়ার সঙ্গে আবার একটু হেসে বললে, কাল একবার আসিস। বুঝেচি, তোর আসল মতলব ছিল মণিকে ধমকানো,—জবাব দেওয়া নয়। যখন সেখানে যাচ্ছিস, তখন কথা উঠলে বলিস, জবাব তাকে আমিই দিয়েছি—তুই নয়, তুই বরঞ্চ তাকে রাখতেই চেয়েছিলি।

জলধি ভেবে পেলে না কথাটা তামাশা, না আর কিছু। অন্তরে মর্মান্তিক জ্বলে গেল, কিন্তু প্রকাশ না করে শুধু বললে, অত্যন্ত বাহুল্য কথা এককড়িদা। জবাব দেবার সত্যিকার মালিক যে তুমি, আমি নয়, এ কথা সে জানে। এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ দোরের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে বললে, তবু সেই বাহুল্য কথাটাই বলার জন্যে একবার তার বাসায় যেতে হবে। আমার সম্বন্ধে মণি আর যাই মনে করুক, এ না মনে করে এক অভাগা আর এক অভাগার অন্ন মেরে দিলে। এই বলেই দ্রুতবেগে চলে গেল।